সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ - বর্তমান কৃষক আন্দোলন এই শিক্ষাই দেয় (পর্ব ১)

ভারতে সাধারণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে

২৬শে ২৬শে জানুয়ারি,২০২১ দেশের সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনে সারা ভারত এবং গোটা পৃথিবী সাক্ষী রইল এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে সারা দেশের কৃষকেরা ষাট দিনেরও বেশী সময় ধরে দিল্লীর সীমান্তে আন্দোলন করে চলেছেন। সারা ভারত সংযুক্ত কিষান মোর্চার নামে সারা দেশের কৃষক সংগঠনগুলি একজোট হয়েছে – তাদের পূর্বঘোষণা ছিল এইবছর ২৬শে জানুয়ারি তারা দিল্লিতে ট্র্যাক্টর র‍্যালি করবেন। সেই আন্দোলন দেশের মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক গড়েছে। এই বিষয়েই সিপিআই(এম) ডিজিটালের পক্ষ থেকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কমরেড মহম্মদ সেলিম, সাংসদ কমরেড বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য-কে একসাথে নিয়ে একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করে ২৬শে জানুয়ারি সন্ধ্যায়। আলোচনার উপস্থাপনা এবং সঞ্চালনা করেন কমরেড শমীক লাহিড়ী।

আলোচনার সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ কয়েকটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত হবে

প্রথম পর্ব

আলোচনার শুরুতেই এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

১) এবারের সাধারণতন্ত্র দিবস যথেষ্টই ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে পড়েনা শেষ কবে সারা দেশের মানুষ এইমাত্রায় সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছেন। ভারতের জনসাধারনের মেজাজই আজ সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনে দেশের রাজধানীতে প্রতিফলিত হয়েছে। এক দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মেজাজ আজকের দিনে যে চেহারা নিল তার আসল কারন কি ?

গত দুইমাসেরও বেশী সময় ধরে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে লাখো লাখো কৃষকরা দিল্লী সীমান্তে আটকে থেকে নিজেদের আন্দোলন চালিয়েছেন। তাদের দাবী একশো ভাগ ন্যায্য। দেশের সংসদে কৃষি বিষয়ক অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) পেশ হবার সময় থেকেই সিপিআই(এম) দল এবং দলের সাংসদেরা নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতা করে এসেছেন। আমরা প্রথম থেকেই বলেছি নয়া কৃষি আইনের দ্বারা ভারতের কৃষিক্ষেত্র, উৎপাদিত ফসল এবং গোটা কৃষিজাত পণ্যের বাজারকেই সরাসরি আন্তর্জাতিক কৃষি বিপণন সংস্থা এবং দেশীয় বড় কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কৃষকদের জীবন - জীবিকা ধ্বংস হবে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে পড়বে। এই ধরনের দুর্যোগের সম্ভাবনাকে রদ করতে আমাদের দেশে কয়েক দশক আগেই সরকারী বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। খাদ্য সুরক্ষা আইন, গনবন্টন ব্যাবস্থা, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা, বেআইনি মজুত (হোর্ডিং) বিরোধী আইন এইসবকিছুই সেই উদ্দেশ্যে। এখন মোদী সরকার আর্থিক এবং কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে সেই সমস্ত দুর্যোগের সম্ভাবনাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছে। আর এমন করা হচ্ছে দেশকে লুটে নেবার রাস্তা খুলে দিয়ে বেসরকারি, ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন মুনাফার উদ্দেশ্যে। কৃষকেরা কি দাবী জানিয়েছিলেন নয়া কৃষি আইন বাতিল করা হোক, কৃষক সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পর্কে যথাযথ আলোচনা করা হোক। যদি নতুন কোন আইনের সত্যিই প্রয়োজন থাকে তবে সংসদে সেই আইনএর বিষয়ে সকলে আলোচনা করুন এবং দেশের সংসদই যথাবিধিক্রমে আইন প্রণয়ন করুক। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী যে কোন সাংসদ প্রস্তাবিত আইনের উপরে বিতর্কের দাবী জানাতে পারেন – নয়া কৃষি আইনের প্রস্তাব পেশ করার সময় সিপিআই(এম)-এর সাংসদেরা আলোচনার দাবী জানিয়েছিলেন। তাদের সেই দাবী অগ্রাহ্য করা হল এবং সংসদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল। কৃষকেরা দেশের সংসদে এধরনের দানবীয় এবং অগণতান্ত্রিক কায়দায় পাশ করিয়ে নেওয়া আইন মানতে নারাজ। তারা সংসদে কৃষি আইন বিষয়ক যথাযথ আলোচনার দাবী জানিয়েছেন যা কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিতে চাইছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের এধরনের অযৌক্তিক মনোভাবের বিরুদ্ধেই কৃষকেরা আন্দোলন করছেন – এবং এখনকার পরিস্থিতিতে স্পষ্টই বলা যায় আইন বাতিল ব্যাতিরেকে অন্য কোন সমাধানসুত্র নেই। সংসদে পাশ হওয়া আইনকে সংসদকেই বাতিল করতে হয়। আইন বাতিলের পরে যথার্থ আইন প্রণয়নে সংসদের আগামী অধিবেশনে আলোচনা হোক। আজ সাধারণতন্ত্র দিবসে যা অভূতপূর্ব তা হল কৃষকদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব। দেশের কৃষিক্ষেত্র, জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সংবিধানকে রক্ষা করতে কৃষকদের এই মনোভাবই আমার বিচারে দেশপ্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ, বহু দশক পরে আমরা সবাই যার সাক্ষী থাকলাম। এই আন্দোলন শুধু দিল্লীর প্রান্তে সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন সারা দেশের কৃষকরা। এটাই ভারতের জাতীয়তাবোধ। যারা গোটা দেশের খাদ্যের যোগান দেন তারাই সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যদ্ধারে সঠিক অর্থে দেশপ্রেমের নিদর্শন রাখলেন আজ।

২) এই প্রসঙ্গেই আরও একটি বিষয় আলোচনা উঠে আসছে। নয়া কৃষি আইনের প্রভাবে শুধু কৃষকদের দুর্দশাগ্রস্থ হতে হবে তাই নয়, সারা দেশের জনসাধারনকেই এই আইনের ফলে সমস্যায় পড়তে হবে। এমন কেন?

সঠিক আলোচনাই উঠে আসছে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি নয়া কৃষি আইন সরাসরি প্রভাবিত করবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে, ফলে সারা দেশের মানুষই সেই আওতায় চলে আসবেন। যদি কোন রাষ্ট্র জনগণের খাদ্য নিরাপত্তাকেই সুরক্ষা দিতে না পারে তবে সেই দেশে সরকারের কি কাজ? খাদ্য নিরাপত্তার অভাব আমরা অন্যান্য অনেক দেশে প্রত্যক্ষ করেছি। যে দেশেই ক্ষমতাসীন শক্তি খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমঝোতা করেছে সেখানেই খাদ্যের ভয়াবহ অভাব দেখা দিয়েছে – আসলে বেসরকারি মজুতদারেরা খাদ্যের অভাব তৈরি করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ বেসরকারি মজুতদারেরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বাজারে খাদ্যের যোগান কমাতে পারবে, খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হবে ফলে প্রয়োজনের সময়ে অনেক মানুষেরই খাদ্য কেনবার সামর্থ্য থাকবে না। পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কুখ্যাত মন্বন্তরের সময়ে এভাবেই বাজারে খাদ্যের ঘাটতি তৈরি করা হয়েছিল। এধরনের খাদ্য সংকট নির্মিত হতে দেওয়ায় সরকারী মদত থাকার অর্থ হবে ভারতের সাধারণতান্ত্রিক কাঠামোর ধ্বংসসাধন। সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনে কৃষকদের আন্দোলন – সংগ্রাম এই জন্যেই আরও বেশী গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কৃষকেরা শুধু এদেশের অন্নদাতাই নন, আগামী দিনের সম্ভাব্য দুর্যোগের মোকাবিলা করতে দেশের জনগণকে রক্ষা করার সংগ্রামেও তারাই রয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষকরাই দেশকে সুরক্ষিত রাখার লড়াই করছেন। কৃষকদের এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের দাবী সমূহ দেশের জনগণের সব অংশের জন্য এই কারনেই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সারা দেশের সব অংশ থেকেই সমর্থন ও সংহতি পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন সেই সমর্থনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। গোটা দেশ কৃষকদের দাবির প্রতি নিজেদের সমর্থন জানাচ্ছেন। আর এতেই প্রমানিত হয় প্রধানমন্ত্রী মোদীর “আত্মনির্ভর ভারত” স্লোগানের চেয়ে বেশী ফাঁকা আওয়াজ আজকের ভারতে আর কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীর কথামতো ভারত আদৌ আত্মনির্ভর হতে পারছে না, বরং সরকারের কৃতকর্মের ফলে ভারত আত্মসমর্পণে উদ্যত হচ্ছে। ভারত অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতা পায় নি, বরং আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বৃহৎ পূঁজির মুনাফার স্বার্থে প্রতিদিন আমাদের দেশ আরও বেশী অর্থনৈতিক সংকটের গভীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে।

৩) ভারতের কর্পোরেট শক্তিগুলির হাতে ইতিমধ্যেই এদেশে খাদ্যের গুদামগুলি তুলে দেওয়া শুরু হয়েছে। তারা নিজেরাও কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় অনেক আগেই এই সংস্থাগুলি কৃষি আইনে সংস্কার হবার খবর পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আপনার ব্যাখ্যা কি?

একেবারেই তাই, এরা অনেক আগে থেকেই নিজেদের মুনাফার স্বার্থে প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আমরা বারে বারে এই কথাগুলিই বলে এসেছি। আজ যা চলছে সেইসব অবশ্যম্ভাবী ছিল বলা চলে। আমাদের দেশের ক্ষমতায় বসে রয়েছে কর্পোরেট – সাম্প্রদায়িক জোট সরকার। সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভারতের কর্পোরেট এবং বৃহৎ পুঁজির মালিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত এই জোট আজ আর কেবল এক সমঝোতা কিংবা আঁতাতের স্তরে সীমাবদ্ধ নেই, এই সম্মিলন এক রাজনৈতিক জোটের চেহারা নিয়েছে। সেই কারনেই আমাদের দেশের কর্পোরেটরা আগেই জানতে পেরেছিল কৃষি আইনে সংস্কারের নামে গোটা কৃষিক্ষেত্রই তাদের হাতে তুলে দিতে চলেছে মোদী সরকার। অন্যান্য যে কোন আইনের লখেত্রেও তাদের একই রকমের প্রস্তুতি থাকে। ২০১৭ সাল নাগাদ, আমি নিজে তখন সাংসদ, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে সারা দেশে কৃষকেরা যাতে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারে সেই আইন প্রণয়নের আবেদন জানিয়েছিলাম। আজ প্রধানমন্ত্রী দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সময় তার সরকারই প্রথম স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক ন্যূনতম সহায়ক মুল্যে ফসল বিক্রির বন্দোবস্ত করেছে বলে অসত্যভাষণ করছেন। এই দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মুল্যের ভিত্তিটাই সম্পুর্ন আলাদা। সুপারিশ ছিল ন্যুনতম সহায়ক মুল্য নির্ধারিত হবে C2 + 50% হারে। C2 খরচ বলতে বোঝায় উৎপাদনের মোট খরচ যার মধ্যে পরিশোধন প্রক্রিয়া বাবদ ব্যয়, পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয়িত শ্রমের হিসাব, মূলধনী সম্পদের উপরে ধার্যকৃত সুদের পরিমাণ এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির নির্দিষ্ট হারে খাজনার পরিমাণ একত্রে ধরা হবে। স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল ফসল কেনার ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের পরিমাণ হতে হবে এই C2 খরচের উপরে আরো পঞ্চাশ শতাংশ  বেশি। এমন হারে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হলে তার পরিমাণ হবে এখনকার তুলনায় প্রতি কুইন্টাল ফসলে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা বেশি। বর্তমানে নিজেদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির সময়ে কৃষকরা কুইন্টাল প্রতি এই পরিমাণ অর্থ কম পাচ্ছেন। কৃষকদের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হচ্ছে A2 + 50% হারে। A2 খরচ হলো কেবলমাত্র পরিশোধনের খরচ। A2 এবং FL খরচ একযোগে ধরা হলে তার মানে হয় পরিশোধনের খরচের সাথে কৃষকের পরিবার উৎপাদনের কাজে যে শ্রমব্যয় করেছে তার সম্মিলিত হিসাব। এমনকি সরকারী দাবি অনুযায়ী A2 + 50% হারে নির্ধারিত মুল্য অবধি কৃষকেরা পাচ্ছেন না। এতেই বোঝা যায় সরকার আদৌ স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানছে না। কৃষকরা এখন কি দাবি করছেন? সারা দেশে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রির অধিকার চাই, কোনো সংস্থা ন্যুনতম সহায়ক মুল্যের চেয়ে কম দামে ফসল কিনলে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে। তাদের দ্বিতীয় দাবী সব রকম ফসলের ক্ষেত্রেই ন্যুনতম সহায়ক মুল্য প্রযোজ্য হতে হবে। তাদের তৃতীয় দাবী সকল কৃষককেই ন্যুনতম সহায়ক মুল্য ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে সারা দেশের কৃষকদের মাত্র ছয় শতাংশ ন্যুনতম সহায়ক মুল্যের সুযোগ পান, এক ডজন ফসলের বিক্রিতেই ন্যূনতম সহায়ক মুল্য প্রযোজ্য হতো। দেশের অন্নদাতাদের ন্যুনতম সুরক্ষা নেই। আজকের ভারতে রাজনীতি এই প্রশ্নেই কেন্দ্রীভূত। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সত্তর বছরে ধারাবাহিক পরিকল্পনামাফিক আমাদের দেশ বিক্রি করা চলছে, দেশের সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে। এখানেই কৃষক আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা। ন্যূনতম সহায়ক মুল্য, একটুকরো জমির মালিকানা এইসবের পরিধি ছাড়িয়ে কৃষকদের আন্দোলনের গুরুত্ব দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বনির্ভরতা রক্ষায়, এখানেই এই সংগ্রামের ঐতিহাসিক মূল্য।   

৪) আজ শুধু দেশের অর্থনীতি আক্রান্ত তাই নয়, আমাদের দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে বলা যায় গোটা দেশের গনতান্ত্রিক কাঠামোর উপরেই আক্রমন করা হচ্ছে। আক্রমনের চরিত্র তাত্বিক গন্ডি পেরিয়ে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজকের ভারতে সাধারণতন্ত্র দিবস পালনের প্রকৃত অর্থ হওয়া উচিত দেশের জনগণকে যথার্থ মর্যাদা দেওয়া। রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষকে প্রকৃত সম্মান দেওয়া হয় সংবিধানের দ্বারা। সেই সংবিধানের উপরে আক্রমনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ভারত একটি সাধারণতান্ত্রিক দেশ। এই সাধারণতন্ত্রের অর্থ কি? সাধারণতন্ত্র দিবসের তাৎপর্য কোথায়? এর অর্থ শাসক এবং প্রজা ভিত্তিক দেশের কাঠামোকে আমাদের দেশের জনগণ বদলে দিয়েছেন, পুরানো কাঠামো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তারা গঠন করেছেন এমন এক দেশ যেখানে একদিকে রয়েছে রাষ্ট্র আরেকদিকে নাগরিকবৃন্দ যাদের প্রত্যেকের মৌলিক, বুনিয়াদী অধিকার সমান। সেই অধিকারকেই ধ্বংস করে দেওয়া চলছে। দেশের সংবিধান আসলে কি? এটা শুধুমাত্র কিছু অধিকার এবং কর্তব্য ঘোষণার সনদ নয়, এই সংবিধানের বলেই নির্মিত গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম কর্তব্য হল এই সংবিধানকে রক্ষা করা। সেই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই একদিকে একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র, আরেকদিকে একে অন্যের পরিপূরক। যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে এই সরকারের আমলে অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে – সংসদ, বিচারব্যবস্থা, সি বি আই, ই ডি সবার ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। আমাদের বুঝতে হবে এর কারন। এক দীর্ঘ গণআন্দোলনের পরে ভারতে স্বাধীনতার সময়কার পৃথিবীতে আমাদের দেশের সংবিধান মানবাধিকার সহ গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে উদাহরন গড়ে তুলেছিল তাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে আজকের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে এবং জনগনের একাংশের সেই কাজে সমর্থনও রয়েছে। একই প্রসঙ্গে জর্জ লুকাচের কথা চলে আসে, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন একসময় সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল দর্শনের জন্ম হয়েছিল যে দেশে সেই জার্মানিতে কীভাবে হিটলারের হাত ধরে ফ্যাসিজম ক্ষমতায় উঠে এসেছিল। কেন এমন হয়? তার সেই রচনার শিরোনাম – যুক্তিবোধের উপরে আক্রমণ (The Assault On Reason) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশেও এখন এমনই ঘটছে। নয়া শিক্ষানীতির নামে যেভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং তামাম বিদ্যায়তনকেই আক্রমনের নিশানা করা হচ্ছে, এটাই আমাদের দেশে যুক্তিবোধের উপরে আক্রমনের চেহারা। যুক্তিকে নস্যাৎ করে অযুক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে কারন ভারতের গনতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা পাল্টে দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের নামে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ব ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যেই জনমানসে বিজ্ঞানচেতনা, যুক্তিবোধের বদলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে মতান্ধতা, গোঁড়ামি, অযুক্তি। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন গোমূত্রের উপকারিতা বোঝাতে বক্তৃতা দেন, গনেশের প্রসঙ্গে প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা কর্ণের জন্মবৃত্তান্তকে স্টেম কোষ গবেষণা বলেন তার পিছনের আসল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল সার্বিক অযুক্তির দ্বারা নির্মিত জনমানসকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল। এই লক্ষ্যেই সংবিধানকে ধ্বংস করা হয়, সাংবিধানিক কাঠামো, দেশের গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে আক্রমন চলে, যাতে দেশকে, দেশের সম্পদকে লুট করে বেসরকারি, ব্যক্তিগত মালিকানার বিপুল মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সারাংশ হল এটাই। সেই কারনেই আজকের দিনে কৃষকদের আন্দোলন আসলে ভারতের সাংবিধানিক, সাধারণতান্ত্রিক বৈশিষ্টকে পুনরুদ্ধার করার লড়াই। আমরা, ভারতের জনসাধারন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের দেশের কাঠামো হবে সাধারণতান্ত্রিক, যা শাসকের ইচ্ছা নিরপেক্ষ হবে। দেশের ভবিতব্য ঠিক করবেন দেশের জনসাধারণ, কোন আধিপত্যবাদী কর্তৃত্ব নয়। কোন নির্বাচনের ফলাফল ঠিক করতে পারে না এই দেশ কোন ক্ষমতার অনুসারি হয়ে চলবে, ক্ষমতাসীন দলের এই ধারণা ভুল যে তারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বলে এই দশ তাদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। একেবারেই নয়, তাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন ভারতের জনসাধারন। সেই কাজে যে তারা ব্যর্থ একথাই আজ ভারতের জনসাধারন এই ট্র্যাক্টর প্যারেডের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে বাংলা অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন