মূল প্রবন্ধটি পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার অক্টোবর ৩, ২০২১ সংখ্যায় Peasants and the Revolution শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল।
এটা আর দেওয়া-নেওয়ার লড়াই নয়
প্রভাত পট্টনায়েক
পুঁজিবাদের মতো পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে মার্কসীয় তত্ত্বও বিকশিত হয়। সৃজনশীল দর্শন হিসাবে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। বিপ্লবের কাজে কৃষিজীবীদের ভূমিকা শেষ অবধি পুঁজিবাদকেই ক্রমোত্তরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে – একসময়কার মার্কসীয় তাত্ত্বিকরা এমনই মনে করতেন। আজকের পৃথিবীতে মার্কসবাদ সেই ব্যাখ্যা থেকে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেছে। আমরা এই প্রবন্ধে সেই প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছি।
পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে বিপ্লবী সংগ্রামে কৃষক ও কৃষি-মজুরদের সাথে সর্বহারা শ্রেণীকে একটি কার্যকরী জোট গড়ে তুলতেই হয়; এই সত্যটি পিজ্যান্টস ওয়ার ইন জার্মানি (জার্মানিতে কৃষকদের যুদ্ধ) শীর্ষক প্রবন্ধে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস অনেক আগেই তুলে ধরেছিলেন। তাহলেও সমাজ বিপ্লবে কৃষকের ভূমিকা সম্পর্কে এহেন গুরুত্বপূর্ণ মার্কসবাদী তত্ত্বটি সম্পর্কে অনেকদিন ধরেই কিছুটা অস্পষ্টতা ছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের যুগে এডুয়ার্ড বার্নস্টাইনের “সংশোধনবাদের” বিরুদ্ধে বিপ্লবী মার্কসবাদের প্রধান তাত্ত্বিক কার্ল কাউটস্কি অবধি বিশ্বাস করতেন “জমির মালিকদের সাথে কৃষকদের লড়াইতে সমর্থনের প্রশ্নে শহুরে বিপ্লবী আন্দোলনের নিরপেক্ষ থাকা উচিত” একথা আমরা জানতে পারি নাদেঝদা ক্রুপস্কায়ার লেখা থেকে। ক্রুপস্কায়া লিখেছেন: “কাউটস্কির এই বক্তব্যে ইলিচ বিরক্ত হন, দুঃখিতও হন – পরে তিনি তাকে ক্ষমা করার চেষ্টা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে এমন কথা পশ্চিম ইউরোপীয় শ্রেণী সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্য হলেও হতে পারে, কিন্তু রাশিয়ার বিপ্লব কেবলমাত্র কৃষকদের সহায়তাতেই বিজয়ী হতে পারে” (লেনিন স্মৃতিকথা, প্যান্থার হিস্ট্রি পেপারব্যাক, ১৯৭০, পৃষ্ঠা১১০-১১১)।
আগামী শতাব্দীর জন্য বিপ্লব সংগঠিত করার প্রশ্নে মার্কসবাদীদের মৌলিক অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেনিন এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বক্তব্যসমুহ থেকে বিভিন্ন যুক্তিগুলিকে পুনরুদ্ধার করেন। তার যুক্তি ছিল – যেসব দেশে পুঁজিবাদ গড়ে উঠতে দেরি হয়েছে সেখানে বুর্জোয়া শ্রেণী, যারা ইতিমধ্যেই নানাভাবে সর্বহারা শ্রেণী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে, সামন্ত সম্পত্তির উপর বর্তমানে যেকোনো আক্রমণ যে ভবিষ্যতে বুর্জোয়া সম্পত্তির উপরেও আক্রমণে পরিণত হতে পারে এই আশংকাতেই তারা সামন্ত জমিদারদের স্বার্থের জোট তৈরি করেছে। এইসব দেশে সামন্ত সম্পত্তি এবং সামন্ত সামাজিক কর্তৃত্বকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে গরীব চাষিদের মধ্যে জমি বিলি করে দেবার কাজে ১৭৮৯ সালের ফ্রান্সে যে সংহার মূর্তি তারা ধারন করেছিল তার পরিবর্তে এখন সেই কাজকেই তারা ইচ্ছাকৃত ঝুলিয়ে রাখছে, এরই ফলে এই সকল দেশে কৃষক সমাজের গণতান্ত্রিক আশা-আকাংখা অপূর্ণ রয়ে গেছে। আজকের পৃথিবীতে সেই অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করে কৃষকদের আশা পূর্ণ করতে পারে কেবলমাত্র প্রলেতারিয়েতই, আর তাই সেই কাজে প্রলেতারিয়েত শ্রেণী হিসাবেই কৃষকদের সাথে জোটবদ্ধ হবে।
শ্রমিক-কৃষক জোটের এহেন ব্যাখ্যায় লেনিন আজকের পৃথিবীতে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার রূপরেখা নির্মাণ করলেন। বিপ্লবের এই স্তর পেরোনোর পরে শ্রমিকশ্রেণী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাবে এবং তখন বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায় অনুসারেই কৃষকসমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে নতুন নতুন জোট গড়ে তোলা হবে। একই প্রসঙ্গে মেনশেভিকের মুখপাত্ররা যুক্তি দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করতে উদার বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিক শ্রেণীর জোট করা উচিত। লেনিন ব্যাখ্যা করলেন যেহেতু উদার বুর্জোয়ারা কখনোই সামন্তদের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করবে না, তাই তাদের সাথে প্রলেতারিয়েতের জোট কৃষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেই। তাই উদার বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে জোটের পাঁকে পা আটকে না থেকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কৃষকদের সাথেই জোট গঠন করা উচিত।
অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব কেবলমাত্র কৃষকদের সাথে সর্বহারা শ্রেণীর জোট দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে, সর্বহারা শ্রেণী এবং উদার বুর্জোয়াদের মধ্যেকার যেকোনো জোট কার্যত হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে বিশ্বাসঘাতকতা। এই জন্যেই বিপ্লবের পূর্বে বলশেভিকদের কর্মসূচি ছিল “শ্রমিক ও কৃষকদের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব” যা ভবিষ্যতে “সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে” উত্তীর্ণ হবে।
এই সময়োপযোগী তাত্ত্বিক অবস্থান ও সেই অনুযায়ী কর্মসূচীই আজকের পৃথিবীতে মার্কসবাদকে বিকাশের এক অসাধারণ স্তরে উন্নীত করেছে। আগামী শতাব্দীর জন্য তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে এই বোঝাপড়া। লেনিনের যুগ থেকে পুঁজিবাদের সমসাময়িক যুগ অবধি যত বিকাশ ঘটেছে ততই লেনিনের বিশ্লেষণের গুরুত্ব বেড়েছে। আজকের পরিস্থিতি শ্রমিক-কৃষক জোটের প্রয়োজনীয়তাকেই আরও বেশি করে তুলে ধরছে। মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদের বিকশিত চেহারা সম্পর্কে লেনিনের মূল ব্যাখ্যা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যুক্তিসমূহই আজকের পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের মূল ভাবনা যুগিয়েছে।
আজকের পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় মূলত দুটি প্রাসঙ্গিক ভিত্তি রয়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির উত্থান এবং তারই আধিপত্যের অধীনস্থ নয়া-উদার নীতি প্রণয়নে দেশীয় একচেটিয়া পুঁজি এবং আন্তর্জাতিক বড় ব্যাবসায়ী সংস্থা দ্বারা প্রচলিত কৃষিক্ষেত্র দখলের পথটি পরিষ্কার হয়েছে। আজ কৃষকরা জমিদার শ্রেণীর নিপীড়নসহ একচেটিয়া পুঁজির অত্যাচারের দ্বৈত আক্রমনের শিকার।
একচেটিয়া পুঁজি অতি-মুনাফা (Super-Profit)-র কায়দায় লুট চালায়। প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফার যে সাধারণ হার বজায় থাকে তার উপরে, কেবল শ্রমিক শোষণ করেই (উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে) নয়, বরং ছোট পুঁজিপতিসহ ক্ষুদ্র উৎপাদক হিসাবে কৃষকদেরকেও এই ব্যবস্থা শোষণ করে। একচেটিয়া পুঁজি স্বাভাবিক কৃষিব্যবস্থার বিরুদ্ধে “ব্যবসার শ্রেণী শর্তাবলী” চাপিয়ে দেয়। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকেও এই ব্যবস্থা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে হাজির করে। এর উদাহরন হিসাবে মনে রাখতে হয় কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দিকে রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তার অভিমুখ কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজির সহায়তায় ভর্তুকি এবং কর-ছাড় ঠিক সেই অনুপাতেই বৃদ্ধি পায় যে অনুপাতে কৃষকদের জন্য ন্যুনতম সহায়ক মূল্য এবং অন্যান্য খরচে সরকারী ব্যাবরাদ্দ কমিয়ে রাষ্ট্র নিজেকে দায়মুক্ত করে। কৃষকদের দুর্দশার বিনিময়ে একচেটিয়া পুঁজিকে মুনাফা লুটের বন্দোবস্ত করা চলে।
কিন্তু কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থায় একচেটিয়া পুঁজির এহেন দখল কেবল একটি নিরবিচ্ছিন্ন লগ্নীর চেহারাতেই থেমে থাকে না, অর্থাৎ, আয়ের পুনর্বণ্টন কেবল এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তরের চেহারাই নেয় না, বরং এই হস্তান্তর চলে স্টক আদান-প্রদানের কায়দাতেও। পরের থেকে লুট করা সম্পদের পুনর্বণ্টনে এই দুই কায়দা কার্যত একে অন্যের সাথে মিলেমিশে যায়। যার ফলে কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়, দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকরা চাকরির সন্ধানে শহরের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারির দ্বিতীয় যে কারণটি উঠে আসে তা হল প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের এক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের প্রবর্তন। নয়া-উদারবাদের নিজস্ব কায়দা হিসাবে তুলনামূলক অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যই এহেন প্রবর্তনের বৈশিষ্ট্য। এর ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার সাধারণভাবে হ্রাস পেতে থাকে। নয়া-উদারবাদী জমানায় জিডিপি বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হলেও ঐ একই সময়ে শ্রমের উৎপাদনশীলতার হার মন্থর রয়ে যায় ফলে কর্মসংস্থান আটকে থাকে; যখন জিডিপি’র বৃদ্ধি হয় না, তখন কর্মসংস্থানের চেহারা হয় আরও করুণ।
এইসবের ফলে যা হয়, শহরে কাজের খোঁজে কৃষকদের অভিবাসন যেমন একদিকে বাড়তে থাকে তারই সাথে শহরে বেকার শ্রমিকদের মজুত বাহিনীটি ফুলে-ফেঁপে ওঠে, যা মোট শ্রমিকদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প হলেও সংগঠিত শ্রমিকদের মালিকগোষ্ঠীর সাথে দরকষাকষির ক্ষমতা কমতে থাকে। কর্মহীন শ্রমিকদের মজুত বাহিনী জনগণের মধ্যে কোন নতুন গোষ্ঠী নয় তারা শ্রমিকই, ফলে মোট বেকারত্বে তারাও যুক্ত হলে কাজে যুক্ত হবার সুযোগ আগের চাইতে আরও অনেক বেশি সংখ্যকদের মধ্যে ভাগ হয়। এর প্রভাবে কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থার উপরে আরও বেশি চাপ পড়ে যা গোটা দেশে কর্মক্ষম জনগণের জীবনযাত্রার মানে চরম অবনতি ঘটায়।
একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজকের সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষক জোটটি এই জন্যই আরও বেশি প্রয়োজনীয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মানে অতীত দিনের প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়া নয়, এই সংগ্রাম হল সমাজ বিকাশের ধারায় পুঁজিবাদকে উৎখাত করার লড়াই।
বর্তমানে ভারতে কৃষকদের যে সংগ্রাম চলছে তাকে সমাজ বিপ্লবের এই গুরুত্বপূর্ণ বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে। যে তিন নয়া কৃষিআইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা সংগ্রাম করছেন সেগুলির লক্ষ্য কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থাকে একচেটিয়া পুঁজির দখলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এই তিন আইনের আগে মোদী সরকার শ্রমিক বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে যা শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব কমিয়ে দেবার সাথেই শ্রমিকদের উপরে শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। আজকের দুনিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক জোটের লড়াই শুধুই কৃষকদের অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক আশা-আকাংখা পূরণে জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই না; এই সংগ্রাম শ্রমিকশ্রেণী এবং কৃষক উভয়েরই শোষণমুক্তির লড়াই। তারা উভয়েই একইসাথে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির আক্রমণের শিকার, দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে শোষণ সেই মুল প্রক্রিয়ারই অংশ।
ভারতে কৃষকদের সংগ্রাম তাই কোন সাধারণ লড়াই নয় বা নিছক অর্থনৈতিক দাবির জন্য সংগ্রাম নয় যা “দেওয়া-নেওয়ার” মাধ্যমে সমাধান হবে। বর্তমান পরিস্থিতির নিগড়ে যে মূল দ্বন্দ্বটি রয়েছে কৃষকদের লড়াই সেই অনুসঙ্গেই জড়িত। এই লড়াই “করো অথবা মরো” পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে; আজ দেশের সরকারকে স্পষ্ট করে ঘোষণা করতে হবে যে তারা নিজের জনগণের সাথে রয়েছে নাকি আন্তর্জাতিক বড় ব্যবসায়ীদের পাশে – কৃষকদের সংগ্রাম সরকারকে নিজের অবস্থান প্রকাশে বাধ্য করেছে। এতদিন দেশের সরকার নিশ্চুপ থেকেই নিজেদের রাজনীতি চালিয়ে গেছে, যদি এখন তারা সোজাসুজি আন্তর্জাতিক বড় ব্যবসায়ীদেরই স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় তবে তা হবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে একে বিরাট আঘাত।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ