শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
আর মাত্র কয়েকটি দিন।
আমাদের রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন।
সাধারণভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে গ্রামাঞ্চলের সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে মনে হলেও আমাদের রাজ্যে এমনকি দেশের রাজনীতিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। আজকের পরিস্থিতিতে সেই গুরুত্ব আরও বেশি। বামপন্থীরা নির্বাচনকে শুধুই ভোটে জেতা বা হারার মত করে বিবেচনা করতে পারে না। এধরনের নির্বাচনের সাথেই যুক্ত থাকে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার সংগ্রাম এবং আমাদের দেশের বহুত্ত্ববাদী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টকে শক্তিশালী করার কাজটিও। গ্রামীণ জনসাধারণের স্থানীয় সরকার হিসাবে কাজ করে পঞ্চায়েত- সেই ক্ষমতায়ণকে সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতটিও আরও প্রসারিত হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে এই সকল প্রশ্নগুলিকে বাদ দিয়ে বিচার-বিবেচনা করা চলে না।
আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা মধ্যবয়স্ক ও তদুর্ধ বয়সীদের রয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠন, গ্রামের সমস্যাকে সমাধানের জন্য গ্রামীণ জনগনের নিজেদের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহন ও রুপায়ন। গ্রামন্নোয়নকে একেবারে প্রান্তিক মানুষের অধিকারের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছিল। উন্নয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্ন এমনকি সরকারী অর্থবরাদ্দের ব্যয় অবধি পঞ্চায়েতেরই কাজ ছিল।
পঞ্চায়েত মানে প্রসারিত গনতন্ত্র
প্রকৃত অর্থেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণকে সাথে নিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজে গরীব, মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষা বামফ্রন্টের শাসনকালে সম্ভব হয়েছিল। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন সংগঠিত হয়েছিল বলেই সেই সুযোগ তৈরি হয়। এই পরিচালনায় যারা নির্বাচিত হলেন তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ছিলেন গ্রামীণ সর্বহারা অথবা আধা সর্বহারা মানুষ। এরা যুগের পর উন্নয়নের আওতার বাইরেই ছিলেন- বামফ্রন্ট শাসনই তাদের অধিকার সুরক্ষিত করে, ক্ষমতায় তাদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করে। গ্রামীণ মেহনতি মানুষ, প্রান্তিক জনগণ গ্রামের উন্নয়নে সাফল্যের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পঞ্চায়েতের কাজ বলতে রাস্তাঘাট, পুকুর ইত্যাদি সহ এলাকার উন্নয়ন, ত্রান বিতরণ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ভেবে নেওয়া হয়। সেই পরিসর ছাপিয়েও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কৃষিকাজের উন্নতিসাধনে কার্যকরী সিদ্ধান্তসমূহ, ফসলের বৈচিত্রায়ন এমনকি কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রেও উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সরকারী জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে (ওয়েলফেয়ার স্কিমস) উপযুক্ত প্রাপকদের মধ্যে যথাযথরূপে বণ্টন, শিক্ষার প্রসার ও উন্নতিসাধনের কাজে উপযুক্ত নজরদারি (স্কুল পরিচালন কমিটি ইত্যাদি), সরকারী নিয়ম বিধি অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিচালনা এমনকি সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা অবধি পঞ্চায়েতের ‘কাজ’ বলেই বিবেচিত হত। গ্রামীণ এলাকায় যুক্তিবাদী চিন্তাচেতনার প্রসারেও পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল।
সংকীর্ণ দলবাজির মাধ্যমে বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতের কাজ পরিচালনা করেনি। তাই বিরোধীরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণের যথাযথ সুযোগ পেতেন, অনেক জায়গায় একাধিকবার নির্বাচিতও হতেন। গ্রামীণ এলাকায় গরীব-মেহনতি জনসাধারণের বৈষয়িক ও আর্থিক উন্নয়ন এবং বিকাশের কাজকে পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত করা হত। গ্রামাঞ্চলে সরকারী প্রকল্পের কাজে নিয়োগের সুযোগ, কাজ শেষে ন্যায্য মজুরি পাওয়ার গ্যারেন্টি ছিল সেই পঞ্চায়েত। উন্নয়ন কোনও সাময়িক বিষয় না, একটা ধারাবাহিক কর্মসূচী। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হত।
২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় দখলদারি কায়েমের সুত্রপাত। যে ব্যবস্থা ছিল গনতন্ত্র ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের এক উজ্জ্বল নিদর্শন, তাকে সোজাসুজি ধ্বংস করে দেওয়া হল। উন্নয়নের কাজে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ঐতিহ্য, তৃণমূল শাসনে সেই সুযোগটাই কেড়ে নেওয়া হল। আজকের পঞ্চায়েতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের জায়গাটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার সবটাই আক্রান্ত।
২০১৩ ও ২০১৮ দুটি নির্বাচনই প্রহসনে পরিণত হয়। নির্বাচনে মনোনয়ন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার সবটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এমনকি ঐ পরিস্থিতিতেও যারা বিরোধী হিসাবে নির্বাচিত হলেন তাদের উপরে ব্যপক সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়, নতিস্বীকারে বাধ্য করা হয়। উৎকোচের লোভ দেখানো, সন্ত্রস্থ করে এলাকাছাড়া হতে বাধ্য করার মত গনতন্ত্র বিরোধী যাবতীয় কার্যকলাপ চলে। রাজ্যের তথা দেশের জন্য যে ব্যবস্থা একসময় গর্বের বিষয় ছিল তাকে বরবাদ করে দেওয়া হয়। তৃণমূলের ভরসায় কার্যত দুর্নীতির এক সার্বিক চক্র গড়ে ওঠে। একদিকে গ্রামীন নব্য ধনীরা, আরেকদিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, একজোট হয়ে জনগণের বিকাশে কার্যকরী বন্দোবস্তটাকেই কবজা করতে চাইছে। জোর করে দলত্যাগ করানো, বিরোধীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করার মত ঘটনা রোজকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনকে অবধি সেই কাজে অপব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ হয়েছে অথচ মজুরি পান নি, জব কার্ড অন্যায়ভাবে অন্যের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষকে সাথে নিয়ে বামপন্থীরাই লড়াই করেছেন, করছেন।
এবারের লড়াই গুরুত্বপূর্ণ কেন?
এবারে নির্বাচনের কাজ শুধু ভোটের লড়াই না। এই নির্বাচন রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষারও সংগ্রাম।
পঞ্চায়েত মানুষের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। জনগণের উন্নয়নের কাজে জনসাধারনের সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে। অধিকার ওরা এমনিতে দেবে না, তাকে লড়াই করেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই ব্যবস্থা কায়েম করাই এবারের নির্বাচনে আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই লড়াই যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমনই প্রাসঙ্গিক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্থ করা। সেই বিভাজনের রাজনীতি ঘুরপথে দুর্নীতিকেই লুটে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়- এদের একইসাথে পরাস্থ করতে হবে।
কেন দুই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম?
এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন যেমন জনস্বার্থ বিরোধী তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আবার একইসাথে কর্পোরেট স্বার্থবাহী কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী মতান্ধ, কুপমন্ডুক ও বিভাজনের বিষময় রাজনীতির বিরুদ্ধেও লড়াই।
জনগণের স্বার্থবাহী পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে প্রধান প্রতিবন্ধক এই দুই শক্তি। এদের জন্য পঞ্চায়েত হল ক্ষমতা ভোগ ও সরকারী অর্থ লুটের জায়গা। এদের হাতে জনসাধারণের কোনও অধিকারই সুরক্ষিত হয়। তাই তো আমরা দেখি গরু-পাচার, গায়ের জোরে জমি দখল নেওয়া, জমির চরিত্র বদলে দেওয়া চলেছে। আরেকদিকে ধর্মান্ধতার প্রচার চালানো হচ্ছে, বিভাজনের রাজনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠতে চাইছে। এই দুই রাজনীতিই একে অন্যের ভরসায় এগোয়, উভয়েই মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। পঞ্চায়েতগুলিকে যেনতেন ভাবে দখল করতে এদের মনোভাবের কারন সেটাই। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে না, তাই নির্বাচনের লড়াই মানুষের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম- দুর্নীতিবাজ, বিভেদকামী শাসকের দখলদারি কায়েমের লক্ষ্য। সেই দখলদারি মুক্ত করার সংগ্রাম জনসাধারণকে সাথে নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে – সেটাই বামপন্থীদের কর্মসূচী। তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে সেই কর্মসূচীর সফল রূপায়নে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কোন কোন জায়গায় আরএসএস-বিজেপি’র পক্ষ থেকে জনসাধারণকে বিব্রত করার প্রয়াস যে নেই তা না। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং আরেকদিকে আরএসএস-বিজেপি,প্রতিক্রিয়ার দুই শক্তির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই।
লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত
নানা টালবাহানার পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘন্ট প্রকাশ করে। স্বল্প সময়ের বাধা পেরিয়েই সিপিআই(এম) ও অন্যান্য বামপন্থী দলের কর্মীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বামপন্থীদের এহেন সক্রিয়তার ভিত দুটি – এক, সাহস ; দুই,আত্মবিশ্বাস । পুলিশ-প্রশাসনের চরম অসহযোগীতা, শাসক দলের তরফে নামিয়ে আনা নিরন্তর আক্রমণ সত্ত্বেও এই নির্বাচনে আমরা ২০১৮-এর তুলনায় অনেকটা বেশি পরিমাণে মনোনয়ন জমা করতে সক্ষম হয়েছি, বামপন্থীরা লড়াইয়ের ময়দানেই আছে। গত কয়েকদিন ধরে সারা রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বামপন্থীরা নিবিড় প্রচার চালাচ্ছেন। নানাবিধ অপপ্রচারের মোকাবিলা ও সন্ত্রাস প্রতিহত করেই সেই কাজ এগিয়ে চলেছে। বড় আকারের জমায়েত, ছোট-বড় অসংখ্য মিছিল জনসাধারণের মনে আস্থা,সাহস গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। জনসাধারণের এহেন উৎসাহ বামপন্থী কর্মীদের আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন ।
স্মরণে রাখতে হবে নির্বাচনী লড়াই শেষ অবধি বুথেই হবে। তাই বুথ সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভোটের দিন সমস্ত বাধা পেরিয়ে, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব যেমন নির্বাচনী আধিকারিকদের, তার চেয়ে আমাদের বুথকর্মীদের ভূমিকা বেশী বই কম নয়। সেই কাজে কোনরকম ঢিলেমি বা অবহেলার সুযোগ নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন বুথ সুরক্ষিত রাখার কাজও আমাদের করতে হবে। তৃণমূল,বিজেপি-এর তরফে যেকোন অপচেষ্টা প্রতিহত করার পাশাপাশি সেইসব ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরে নিয়ে আসার কাজও আমাদেরকেই করতে হবে।
শেষকটা দিন এলাকায় এলাকায় ছোট-বড় স্কোয়াড পরিচালনার পাশাপাশি জনগণকে সাহস ও ভরসা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
ভোটের মতই গণনার কাজও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের বুথ থেকে স্ট্রংরুম এবং স্ট্রংরুম থেকে গণনাকেন্দ্র অবধি, এই গোটা পর্বে পার্টি ও বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে, যেকোন অপচেষ্টা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হলে চলবে না। লুট,সন্ত্রাস প্রতিহত করা গেলে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটবেই। এই নির্বাচনে গরীব-মেহনতি জনতা, আামাদের রাজ্যের সংখ্যালঘু,আদিবাসী,তফশীলি ও অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে তবেই এই নির্বাচনী সংগ্রামে আমাদের ভূমিকা পূর্ণতা পাবে। পশ্চিমবঙ্গ তথা আমাদের দেশের রাজনীতিতে এই নির্বাচনের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। জনগণের লড়াইয়ের ইতিহাসে সেই ভূমিকা এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন হিসেবে আগামীদিনে চিহ্নিত হতে চলেছে।