সর্বগ্রাসী ক্ষমতার লালসায় সিক্কার এপিঠ ওপিঠ - জয়দীপ মুখার্জী

২ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

প্রথম পর্ব



সোফিয়া ম্যাগডেলানা স্কল, ‘সোফি স্কল’কে মনে পড়ে? ইতিহাস তাঁকে এই নামেই চেনে। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্যামফ্লেট বিলি করা ঝকঝকে সেই তরুণী’কে? বছর একুশের ছাত্রী। না, সোফি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন শ্বেত-গোলাপ (হোয়াইট রোজ) আন্দোলনের একজন কর্মী। অহিংস পথে নাৎসি জার্মানির সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রনায়ক (ফ্যুয়েরার) হিটলারের যুদ্ধবাজ নীতি বিরোধী আন্দোলনের শরিক। বিলি করা প্যামফ্লেটে নাৎসি সরকারের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধ প্রচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত করার চেষ্টা করছিলেন। ফ্যাসিস্ত সরকার রেয়াত করেনি তাঁকে। ১৯৪৩ -এর ১৮ ফেব্রুয়ারির শীত বিকেলে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী গ্রেপ্তার করে তাঁকে। ঝড়ের বেগে মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে শেষ হয় বিচার। ‘বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রোহিতা’র অপরাধে ভূষিত করা হয়। একই ‘অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত করা হয় সোফির দাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের ছাত্র হ্যানস স্কল এবং তাঁদের সঙ্গী ক্রিস্টোফ প্রস্ট’কে। ২২ তারিখ বিকেলে স্ট্যাডেলহ্যাম কারাগারে গিলোটিনে সোফি সহ তিনজনকে শিরচ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকারি করা হয়।

সোফিয়া ম্যাগডেলানা স্কল
বিলি করা প্যামফ্লেটে
সেদিন তাঁদের মৃত্যুদন্ডে স্বাক্ষরকারী সেই বিচারক ফ্যাসিস্ত বেতনভূক রোল্যাঁ ফ্রেজার’কে ইতিহাস মনে রাখেনি। ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ২১ ফেব্রুয়ারি বিচারপর্বে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সোফির অকুতোভয় শিকারোক্তি, “কাউকে না কাউকে তো শুরু করতেই হতো। প্যামফ্লেটে আমরা যা লিখেছি এবং ছাত্র-ছাত্রীদের যা জানিয়েছি, আরও অনেকেই সেকথা বিশ্বাস করে। তফাৎ হলো, আমাদের মতো সাহস করে তারা সেটা বলতে পারেনি”। পরেরদিন মৃত্যুর ঠিক আগে গিলোটিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোফির শেষ কথা, “এরকম একটা ঝলমলে সুন্দর দিনে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে ... আমার মৃত্যুতে কী বা এসে যায়, যদি না আমাদের এই চলে যাওয়াতে হাজার হাজার মানুষ সজাগ না হন, আলোড়িত না হন”। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অযুত-বিক্রম লড়াইয়ে সোফি স্কল চিরস্মরণীয় নাম। তাঁর বিচার এবং শাস্তির নিদানেই ফ্যাসিবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি সম্পৃক্ত। প্যামফ্লেটে সোফিরা ঠিক কী বলতে চেয়েছিল, সেটার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল ফ্যুয়েরারের বিরোধিতা, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অহিংস পথে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনমত তৈরি করার চেষ্টা। অর্থাৎ, হিটলারের চূড়ান্ত স্বৈরাচারি নীতির বিরোধিতা। ফ্যাসিস্ত প্রশাসন সেটা বরদাস্ত করেনি। কারণ ফ্যাসিস্ত শক্তি কোনোরকম বিরুদ্ধ মত’কে সহ্য করতে পারেনা, তাদের শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই।



সভ্যতার ইতিহাসে সাতদশকের বেশি সময় পেরিয়ে এসে আরএসএস-বিজেপি’র তথাকথিত “নতুন ভারত” অহরহ এরকমই বেশ কিছু সংকেত দিয়ে চলেছে। দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের চলমান আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভে শামিল হওয়ার জন্য ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে বছর পঁচিশের নওদিপ কৌর’কে। মোদী সরকারের কৃষক আইনের বিরোধিতার মূল্য চোকাতে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। উত্তর প্রদেশের যোগী সরকারের পুলিশের হেফাজতে রক্তাক্ত হতে হয়েছে তাঁকে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ভ্যানে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটানো হয়েছে তাঁর গোপনাঙ্গে। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে কর্ণাটকের পরিবেশকর্মী দিশা রবি কে। একুশে পা রাখা দিশাও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী নন। তাঁর অপরাধ কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন। তিনি নাকি সামাজিক মাধ্যমে টুলকিট বানিয়ে জনমত গঠন করছিলেন। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে মাসের পর মাস রাস্তায় পড়ে থাকা কৃষকদের জন্য সামাজিক ন্যায় দাবি করেছিলেন দিশা। সোফিদের সেই প্যামফ্লেটই ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গত শতাব্দীর টুলকিট। নাৎসি শাসক তাঁর সেই টুলকিটকে ভয় পেয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আমাদের দেশের শাসক আরএসএস-বিজেপিও দিশা রবি’র টুলকিট’কে বেজায় ভয় পেয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মহা পরাক্রমে দিল্লির পুলিশ পাঠিয়ে ব্যাঙ্গালুরু থেকে ‘রাষ্ট্র বিরোধী সন্ত্রাসবাহী ষড়যন্ত্রমূলক’ কার্যকলাপের দায় চাপিয়ে গ্রেপ্তার করে এনেছেন তাঁকে।

কর্ণাটকের পরিবেশকর্মী দিশা রবি
রবি দিশার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ত্রিশ হাজার ছাত্র-যুব নবান্ন অভিমুখে মিছিল করেছিল কাজের দাবিতে। সামান্য আর্জি, মিছিলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একবার দেখা করুন। এরাজ্যের ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রতিনিধিরা তাঁকে একবার সরাসরি বলতে চান তাঁদের দুর্দশার কথা। মুখ্যমন্ত্রী শুনতে চাননি। কাজ চাইতে যাওয়া মিছিলকে দমন করেছেন অবর্ণনীয় স্বৈরাচারি কায়দায়। আগেরদিন রাতে রাস্তা খুঁড়ে ভারি ইস্পাত এবং বাশের ব্যারিকেড বসিয়ে খাঁচার মতো বন্দী করেছেন মিছিলের পথ। চক্রব্যুহের এক প্রান্ত খোলা রেখে জল কামান, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়ে কাজের দাবিতে রাজপথে নামা ছাত্র যুবদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছেন। তাতেও যখন যৌবনের উদ্যমকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন লাঠি ঢাল হাতে বাছাই পুলিশদের দিয়ে বেধড়ক লাঠিপেটা করেছেন নিরস্ত্র মিছিলকারীদের। নৃশংস আক্রমণে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন ডিওয়াইএফআই কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যা। একত্রিশ বছরের তরতাজা মইদুল অটো চালাতেন। ঘরে বৃদ্ধা মা, বাবা, স্ত্রী, ফুলের কুঁড়ির মতো তিনটে মেয়ে, ছোট ভাই, মইদুল একা রোজগেরে। কাজের দাবিতে পথে নেমেছিলেন বাড়িতে না জানিয়ে। লাঠিধারী পুলিশ ওকে ঘিরে ধরে রাস্তায় ফেলে এলোপাথাড়ি পিটিয়েছিল। তবু হাতের ঝান্ডা আলগা হয়নি। চারদিন পর হাসপাতাল থেকে লাশকাটা ঘর হয়ে ওর সঙ্গীদের কাঁধে মইদুলের নিথর দেহ বাঁকুড়ার কোতুলপুরে বাড়ি পৌঁছেছে। সেদিনের পুলিশী আক্রমণে প্রায় চার শতাধিক যুবক যুবতী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।


নবান্ন অভিযানে প্রথম শহীদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা

আসলে টুকরো ঘটনাগুলি চরম দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারি শাসনের দমনপীড়নের চারিত্রিক বহিঃপ্রকাশ। কখনও স্বৈরাচার একেবারে সর্বগ্রাসী রূপে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদের চেহারায়, কখনও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে ফ্যাসিবাদের পথে, আবার কখনও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয়ে ফ্যাসিবাদী কৌশল প্রয়োগ। কোনো ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ মতের জায়গা নেই। সরকারের বিরোধী মানেই তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, শারীরিক নির্যাতন, কারাগারে নিক্ষেপ কিংবা, গুপ্তহত্যা।

দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের চলমান আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভে শামিল হওয়ার জন্য ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে বছর পঁচিশের নওদিপ কৌর’কে

ফ্যাসিবাদের অন্তর্নিহিত দর্শনই হলো, বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ, ইতিবাচক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিরোধিতা। এর বিপ্রতীপে অযৌক্তিকতা, আধ্যাত্মবাদ, ভাবাবেগ সর্বস্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভিত্তিক চূড়ান্ত স্বৈরাচারি একদলীয় সর্বগ্রাসী সামরিক শক্তিধর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই একমাত্র লক্ষ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী শক্তির অভ্যুত্থান এবং পতনের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। সেই অন্ধকার সময়ের অশনি সঙ্কেত কী আবার দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ঘটনার অনুষঙ্গেই জড়িয়ে শাসকদলের ব্যাপক দুর্নীতি, কারচুপি, গুপ্ত অপরাধ, নয়তো, স্বৈরাচারি পীড়ন কৌশল। আমাদের দেশ ও রাজ্যের দুই শাসক দল বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের এটাই মূল বৈশিষ্ট্য। আদ্যপান্ত ফ্যাসিবাদের পুজারি আরএসএস, বিজেপি’র মূল চালিকা শক্তি। বিজেপি’র প্রতিটি কর্মকান্ডের মস্তিষ্কই হলো আরএসএস। এরাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস জন্মলগ্ন থেকে বেশ কয়েকবার রাজনৈতিকসঙ্গী হওয়ার পর সম্প্রতি বিজেপি’র বিরোধী। তবে দলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি’র স্পষ্ট বার্তা আরএসএস -এর সঙ্গে তাঁদের কোনো বিরোধিতা নেই। একইসঙ্গে আরএসএস -এর পরামর্শ নিয়েই যে বিজেপি’র কর্মসূচী নির্ধারিত হয় সেটাও তাঁর অজানা নয়, নিজেই জানিয়েছেন সেকথা। তা সত্ত্বেও, বিজেপি সম্পর্কে রাজনৈতিক বিরোধিতার আস্ফালন, অথচ আরএসএস -এর প্রতি আনুগত্য! না, তাঁর রাজনৈতিক বোধ-শক্তি নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বরং, রাজনৈতিক সমীকরনে এখনও এর তাৎপর্য গূঢ়। অপরপক্ষে মমতা সম্পর্কে আরএসএস -এর মূল্যয়ন, ‘তিনি’ সাক্ষাত দুর্গামাতা।



এবং দুটি দলেরই ঘোষিত অভিন্ন শত্রু, কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা।

ধারাবাহিক প্রবন্ধ , ক্রমশ.....


শেয়ার করুন

উত্তর দিন