নয়া কৃষি আইন এবং কৃষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে

কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সিপিআই(এম)- এর নোট

সম্পূর্ণ নোটটি তিনটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে।

পর্ব - ১

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কঠিন নিপীড়ন সহ্য করেও নয়া তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সারাদেশের কৃষকেরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ঐতিহাসিক আন্দোলন সংগঠিত করছেন। সেই লড়াইতে ইতিমধ্যেই ৬০ জনেরও বেশি কৃষকের মৃত্যু হওয়ার পরেও তাদের সংগ্রামের উদ্দীপনা এতটুকু কমেনি। এই আন্দোলনের প্রতি সিপিআই(এম) সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে। উদার অর্থনীতির নামে দেশের কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর কোনো দ্বিধা নেই। ১৯৯৫ থেকে ২০২০ সাল অবধি উদার অর্থনীতির প্রয়োগে আমাদের দেশে চার লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তিনটি নয়া কৃষি আইনের সাহায্যে মোদী সরকার দেশের কৃষিক্ষেত্রে সেই নীতিরই তীব্রতা বাড়িয়ে বৃহৎ কৃষি বিপণন সংস্থাগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে চাইছে।

গত বছরের জুন মাসে যখন সংসদে কৃষি সংক্রান্ত অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) আনা হয় তখন থেকে সিপিআই(এম)-ই প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে তার বিরোধিতা করেছে এবং বিক্ষোভ সংগঠিত করেছে। কৃষকদের আন্দোলন শুধু কৃষকদের স্বার্থেই সংগঠিত হয়েছে তাই নয়, দেশের খাদ্য সুরক্ষা, খাদ্য ভান্ডারে আত্মনির্ভরতা এবং দেশের জনগণের স্বার্থেও এই লড়াই - সংগ্রাম চলছে। অসাংবিধানিক কায়দায় কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ করে চলেছে। কৃষি রাজ্যের আওতাধীন বিষয় হিসাবে তালিকাভুক্ত হত্তয়া সত্বেও তার উপরে একতরফা নিয়ন্ত্রণ জারী করতে নয়া তিনটি আইন প্রণয়ন করেছে - কৃষকদের এই আন্দোলন এসবের বিরুদ্ধেও। কোনো নতুন আইনের প্রভাব সমাজের যে নির্দিষ্ট সামাজিক অংশের উপরে পড়ে তাদের সাথে আইন প্রনয়নের পূর্বে আলোচনার যে সাংবিধানিক পদ্ধতি রয়েছে তাকেও কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করেছে। যে কায়দায় এই কৃষি আইন গুলিকে পাশ করানো হয়েছে তাকে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে আঘাত হিসাবেই বিচার করতে হবে।

কর্তৃত্ব বাদী সরকার, একনায়কসুলভ আচরণ

সারা দেশে যখন কৃষকরা আন্দোলন করছেন সেইসময় অর্থনৈতিক সংস্কার প্রসঙ্গে নীতি আয়োগের কর্তাব্যক্তি অমিতাভ কান্ত বিলাপের সুরে বলেন "ভারতে বড়ো বেশি গনতন্ত্র রয়েছে"। এই বিলাপে স্পষ্ট, কান্ত মহাশয় যাদের দ্বারা নিযুক্ত ব্যক্তি, তিনি সেই সরকারেরই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

কৃষকদের আন্দোলনের মাঝেই বহু বিরোধী রাজনৈতিক দল এমনকি সংসদে বিজেপি সরকারকে সমর্থন জানানো দলের পক্ষ থেকেও কৃষি আইন সম্পর্কে নিজেদের আপত্তি প্রকাশ করেছে। এধরনের আপত্তির জবাবে বিজেপি কি অবস্থান নিয়েছে? তারা সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বাতিল করে দিয়েছে। কেন? কারণ সংসদে আলোচনার সুযোগ থাকলে সব পক্ষ থেকেই কৃষি আইন বাতিলের ঐক্যবদ্ধ দাবি উঠবে একথা তারা বুঝেছে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদিন করোনা সংক্রমনের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় একলাখে, তখন সংসদ খোলা রেখে কৃষি বিলগুলিকে আইনে পরিণত করতে সরকারের কোনো সমস্যা হয় নি। অথচ ডিসেম্বর মাসে দিনপ্রতি সংক্রমনের পরিমাণ যখন অনেকটাই কমে তিরিশ হাজারে দাঁড়িয়েছে, তখন সংসদের আলোচনা বাতিল করতে সংক্রমনের অজুহাত দেওয়া হল। এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় সংসদকে এড়িয়ে চলতে বিজেপি কতটা ব্যগ্র। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপেই সেই ব্যগ্রতা ফুটে ওঠে।

সেপ্টেম্বরে বিলের আকারে গ্রহণ করতে কৃষি বিষয়ক অর্ডিন্যান্স গুলিকে পেশ করা হয়। সিপিআই(এম)- এর প্রতিনিধি সহ লোকসভার বিরোধী এমপি রা এই বিলকে স্ক্রুটিনি র জন্য সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সাধারণ পদ্ধতিই হল স্ট্যান্ডিং কমিটি সংশ্লিষ্ট বিলের শুনানির দিন ধার্য করে, খসড়া বিলের উপরে সবাইকে নিজেদের মতামত জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের তরফে কৃষকদের কিংবা তাদের সংগঠন কাউকেই এই ব্যাপারে একটি কথা বলারও সুযোগ দেয় নি। নিজেদের সংখ্যাধিক্যকে সরকার গায়ের জোরে বিল পাশ করতে কাজে লাগিয়েছে।

রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাধিক্য নেই, সেখানে বেশিরভাগ সাংসদ বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এই নিয়ে সাংসদ দের ভোটদানের অধিকার কেড়ে নিয়ে ভোটের আবেদন খারিজ করে দেয়। ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) - এর সাংসদেরা সোচ্চার হলে তাদের দুজনকে বরখাস্ত করা হয়, এভাবেই সরকার কৃষি বিল পাশ করিয়ে নেয়। সংসদে এই তিনটি বিল সম্পর্কে বিতর্কে সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলগুলির ভূমিকা এখন সরকার চেপে রাখতে চায়। সেদিন সংসদে যে যে বিষয়ে বিতর্কের দাবি তোলা হয় আজ কৃষকরা সেই একই দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন করছেন।

এই সমস্ত তথ্য বর্তমানে ভীষন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে কৃষকদের সাথে আলোচনা না করে অন্যদিকে সাংসদদের আলোচনার সুযোগ না দিয়ে সরকার এখন নিজেদের কিছু পেটোয়া কৃষক সংগঠনগুলির মাধ্যমে কৃষকদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাইছে, তাদের দিয়ে কৃষিবিলের সমর্থনে জনমত তৈরি করতে চাইছে। এই সংগঠনগুলি সুপ্রিম কোর্টে সারা দেশের কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিনিধি সাজতে চেষ্টা করেছে। একই সময়ে বিজেপি নেতৃত্বের তরফে নিন্দাসুচক শব্দপ্রয়োগে কৃষকদের এবং বিরোধী দলগুলোকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চলছে, কৃষকদের আন্দোলন সম্পর্কেও তারা যতটা সম্ভব মিথ্যাপ্রচার করে চলেছেন। এতেই কেন্দ্রীয় সরকারের একনায়কতন্ত্রী মনোভাবের স্পষ্ট হয়ে যায়।

এই লড়াই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে বিজেপি আরেকটি নির্লজ্জ্ব কায়দায় আক্রমণ করছে। লঙ্গরখানা পরিচালনা এবং আগত প্রতিনিধিদের সুবিধার্থে যাবতীয় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আচরন সারা দেশে উদাহরণ তৈরি করেছে। কৃষকদের এই একতাকে নষ্ট করে দিতে, ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করতে বিজেপির পক্ষ থেকে আন্দোলনে খালিস্তানিরা রয়েছে বলে কুৎসার প্রচার চালানো হয়েছে। সেই প্রচারে কাজ না দেওয়ায় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এস ওয়াই এল ক্যানালের জল বন্টনকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করা হলো।  এই সব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করতে কৃষকরা আরো বেশি সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলেন। যদিও এসবের মাঝে নিজেদের ঘৃণ্য এবং দেশবিরোধী কার্যক্রম সম্পর্কে বিজেপির কোনো মন্তব্য নেই।

রাজ্য সরকারগুলোর অধিকারের উপরে আক্রমণের প্রসঙ্গে

সংবিধানের সপ্তম তপশীল অনুযায়ী কৃষি হলো রাজ্য সরকারের তালিকাভুক্ত বিষয়। কেন্দ্র রাজ্য যৌথ তালিকার একটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে যাতে কৃষির ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলোর অধিকার খর্ব করা যায়। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ্য সরকারগুলোকে মডেল আক্ট মেনে চলার নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষি আইন সমুহ মেনে নিতে জোর করা হচ্ছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে কেন্দ্র এমন দুটি মডেল অ্যাক্ট গঠন করেছিল। ১৭ সালের কৃষিজ উৎপাদন এবং লাইভস্টক মার্কেটিং আইন এবং ১৮ সালের কৃষিজ উপাদান ও লাইভ স্টক কনট্র্যাক্ট মার্কেটিং সংক্রান্ত আইনে যা যা প্রস্তাব করা হয় সেগুলিই আজকের তিনটি  কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের ধারায় উল্লেখ রয়েছে। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার লক্ষ্য করে একমাত্র অরুণাচল প্রদেশ সম্পূর্ণরূপে মডেল আইন লাগু করেছে, অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব এবং ছত্তিশগড় এই মডেল আইনের মধ্যে থেকে নিজেদের ইচ্ছানুসারে কিছু অংশের প্রয়োগ শুরু করেছে। গত বছরের জুন মাস নাগাদ কেন্দ্রীয় কৃষি দপ্তরের সচিব চিঠি লিখে রাজ্য গুলিকে মডেল এক্ট সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স গ্রহণের নির্দেশ দেন। এই মডেল অ্যাক্ট - এর ভিত্তিতে গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশ রাজ্য দুটি নিজেদের আইনে সংশ্লিষ্ট সংশোধনী এনেছে।

কর্ণাটক হল একমাত্র রাজ্য যারা ২০১৯ সালে কনট্র্যাক্ট ফার্মিং বা চুক্তি চাষ সংক্রান্ত মডেল আইন প্রয়োগ করেছে।

রাজ্য সরকারগুলো যদি চায় তবে তারা নিজেদের সংশ্লিষ্ট বিধানসভায় নির্দিষ্ট আইনের সংশোধন নিয়ে আসতে পারে। যদিও রাজ্যগুলির উপরে এধরনের সংশোধনীর ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের মাধ্যমে কাজের নিরিখে অর্থ মঞ্জুরীর কথা ঘোষণা করেছে, এতে কেবল তখনই অর্থ মঞ্জুরির সুযোগ পাওয়া যাবে যদি রাজ্যগুলি কনট্র্যাক্ট অর্থাৎ চুক্তি ভিত্তিক চাষ এবং জমি লিজ আইন প্রনয়ন করে। এর পরে আরো একধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে  কর্পোরেটদের সুবিধার্থে এক সাধারণ জাতীয় মডেল আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই মডেল আইনগুলির তুলনায় এখনকার নয়া কৃষি আইন সমুহ অনেক বেশি কর্পোরেট স্বার্থ বাহী। 

আন্তর্জাতিক - বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থ রক্ষা

এই একই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে হবে। আমেরিকার নেতৃত্বে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি অনেকদিন ধরেই উন্নয়ন শীল দেশ যেমন ভারতের অভ্যন্তরীণ কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন এবং বাজারে ঢুকতে চেয়েছে। কৃষি সংক্রান্ত চুক্তি সমূহের ভিত্তিতে তাদের নিশানায় থেকেছে আমাদের দেশের সরকারি ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা, গণবন্টন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা। কৃষি আইনসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপের মুখে পড়ে আসলে মোদী সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে কৃষিজ পণ্যের বিপণনকারী বহুজাতিক সংস্থাগুলির মুনাফার স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। একবার এধরনের আইন প্রয়োগে সফল হলে আম্বানি আদানিদের মতো কার্গিল- এর মত সংস্থারও আমাদের দেশের কৃষিজ পণ্যের উপরে একই মাত্রার দখল কায়েম হবে।

ভ্রান্ত তথ্যের প্রচার

বিল পেশ থেকে আইন পাশ করানো অবধি দেশের সংসদীয় এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর ন্যুনতম পদ্ধতি, প্রকরণ সমূহকে অগ্রাহ্য করে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ে মিলে প্রচার করছে যে তারা কৃষি আইন বাতিল ব্যতিরেকে যেকোনো দাবিতে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এই আলোচনার প্রেক্ষিতেই সরকারের তরফে লিখিত বক্তব্যে তারা উল্লেখ করেছে সংশ্লিষ্ট আইন বিষয়ক চুক্তি বজায় থাকবেই, আলোচনাক্রমে বলা যেতে পারে কৃষকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেই চুক্তির রং সাদা হবে নাকি কালো।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে নোটের অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন