শমীক লাহিড়ী
লোকসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে বিজেপি ততোই মরিয়া হয়ে উঠছে জাত ধর্ম ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার জন্য। এছাড়া ওদের সামনে আর কোনও রাস্তা নেই। কারণ মোদীর শাসনকালে অর্থনীতির অবস্থা বেহাল। বেকারত্ব বাড়ছে। সরকারী দপ্তর, ব্যাঙ্ক, রেল, বীমা সহ অসংখ্য শূণ্যপদ পড়ে আছে, কার্যত নতুন নিয়োগ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১/৪ ভাগ মজুরীতে চুক্তি ভিক্তিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ করা হচ্ছে। বেসরকারী ক্ষেত্রগুলির শ্রমিকদের ১২ ঘন্টা কাজ করানো, ইচ্ছেমত ছাঁটাই, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের বাইরে শ্রমিকদের রাখার অধিকার দিয়েছে মোদী সরকার। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নেই অথচ বাজারে জিনিষের দাম আকাশ ছোঁয়া। কার্যত ফোড়ে-দালাল-লুটেরাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে দেশের অর্থনীতি। এই লুটেরা পুঁজির মালিকদের হাতেই রেল, বিমান ও জাহাজ বন্দর সহ সব সরকারী সম্পদ জলের দরে তুলে দিচ্ছে মোদী সরকার। ব্যাপক বেসরকারীকরণের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে মানুষের ক্ষোভ বেড়ে চলেছে এই লুটেরাদের দালাল মোদী সরকারের বিরুদ্ধে।
ভাগের রাজনীতির কারণ
তাই বিক্ষুব্ধ মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এবং ঐক্য বিনষ্ট করতে বিজেপি এখন ধর্ম-জাত-ভাষার নামে বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র করতে চাইছে। এই কাজে যেমন ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে, তেমনই মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে সংবাদ মাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময় মণিপুরে মেইতেই ও কুকি জনজাতির মানুষের মধ্যে তীব্র ঘৃণার বীজ বপন করে জাতি দাঙ্গা বাধানো হয়েছে, আরএসএস-র পরিকল্পনাতেই। এই দাঙ্গা লাগানোর মূল কারণ আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত কুকিদের জমি দখল করা এবং তার মধ্য দিয়ে মাটির নীচে ও ওপরে থাকা বনজ ও খনিজ সম্পদ লুটেরা পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া।
একইভাবে হরিয়ানা ও দিল্লীর উপকন্ঠে অবস্থিত নূহ'তে পরিকল্পনা করে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের ওপর আক্রমণ সংগঠিতভাবে চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা। হরিয়ানা সরকার বুলডোজার নামিয়ে এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ঘর-বাড়ী- দোকান সব ভেঙে দিচ্ছে। অবশেষে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের স্বতপ্রণোদিত হস্তক্ষেপে সাময়িক সময়ের জন্য মুসলমান নিধন যজ্ঞ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে হরিয়ানার বিজেপি সরকার। এখানেও মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের উৎখাত করার মূল উদ্দেশ্য, গুরগাঁও সংলগ্ন ও নূহ'র মূল্যবান জমি দখল করে জমি হাঙড়দের হাতে তুলে দিতে চায় বিজেপির সরকার। দেশের জল-জঙ্গল- জমি, রেল, ব্যাঙ্ক, বীমা, বিমান-জাহাজ বন্দর, রাস্তা, ব্রীজ সহ দেশের সব সম্পত্তি হাতেগোনা কয়েকটি লুটেরা পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মরীয়া মোদী সরকার।
হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ
এই সব কিছুই হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের নাম করে। হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদ এক নয়। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। সময়ের সাথে সাথে নানান পরিবর্তন, বিবর্তন, সংযোজন, সংবর্ধন ঘটেছে এই ধর্মে। আর হিন্দুত্ববাদ হলো একটি রাজনৈতিক ধারণা বা মতবাদ, যা প্রথম নিয়ে আসেন ১৯২৩ সালে দামোদর বিনায়ক সাভারকার নামে এক মারাঠি। ১৯২৮ সালে সাভারকার “হিন্দুত্ব : কে হিন্দু ?” শীর্ষক একটি প্রচার পত্র লিখিতভাবে প্রকাশ করেন। অর্থাৎ 'হিন্দুত্ববাদ' নামক রাজনৈতিক মতবাদ বা ধারণার ইতিহাস ১০০ বছর মাত্র।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, জ্ঞান-অজ্ঞানতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্ম ইতিহাসের লম্বা পথ পরিক্রমা করেছে। যদি বৈদিক যুগকেই হিন্দুত্বের সৃষ্টিকাল বলে ধরে নিই আমরা, তাহলেও অনেক লৌকিক কাহিনী সহ অসংখ্য বই-পুস্তকে বিবৃত আছে হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত নানান কথা। হিন্দু ধর্ম পালনের অন্যতম ভিত্তি হলো - কর্ম, ধর্ম ও জ্ঞান। অর্থাৎ মূলতঃ এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনচর্চা বা আচার আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি হলো বেদ, পুরাণ, শাস্ত্র ও নানাবিধ শ্লোক। ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ - এই ৪টি বেদকেই হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি ধরা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবন চর্চার জন্য মনুস্মৃতি/মনুসংহিতা রচিত হয়। এছাড়াও অনেক কাব্য, মহাকাব্য, পুরাণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে পরিগণিত হয়। কাল ও সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে হিন্দু ধর্মের নানান শাখা উপশাখাও সৃষ্টি হয়েছে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বা নানাবিধ ধর্মীয় উপাচার পালনের ক্ষেত্রে স্থান বর্ণ লিঙ্গ ইত্যাদি ভেদে নানারকম প্রথা প্রচলিত আছে।
অপরদিকে আরএসএস-এর 'হিন্দুত্ববাদ' মাত্র ১০০ বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল একটি ছোট্ট প্রচার পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে। এটি আপাদ-মস্তক একটি রাজনৈতিক প্রকল্প বা ধারণা। হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে আসলে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেই তৈরী হয়েছিল এই রাজনৈতিক মতবাদ, যার সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কার্যত কোনও সম্পর্কই নেই। হিন্দুত্ববাদ এই শব্দটিকে অত্যন্ত সুচতুরভাবে সাভারকার ব্যবহার করেছিলেন ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য। এই রাজনৈতিক প্রকল্পের লক্ষ্য হলো এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরী করা যা ‘হিন্দু ধর্মের মূল্যবোধ ও ভারতীয় সংস্কৃতি'কে রক্ষা করবে। এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হবেন, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষরা থাকতে পারেন, তবে হয় তাঁদের হিন্দু ধর্ম আচার পালন করতে হবে, অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে থাকতে হবে। এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে মনুস্মৃতি।
সব হিন্দু’র সমান অধিকার?
হিন্দুত্ববাদীদের রাজত্বে সব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কি সমান অধিকার থাকবে? না থাকবে না। কারণ মনুস্মৃতি অনুযায়ী এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হলে সেখানে উচ্চবর্ণের মানুষের অধিকার থাকবে অনেক বেশি। ভারতবর্ষের সংবিধান ১৯৪৯ সালে ২৬শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয়। এর ৩দিন পরে ৩০শে নভেম্বর আরএসএস- এর মুখপত্র অর্গানাইজার পত্রিকায় নতুন সংবিধান সম্পর্কে বলা হয় - “ভারতবর্ষের সংবিধানের সবচাইতে খারাপ বিষয় হ’লো এতে ভারতীয় কিছুই নেই .... মনুস্মৃতি হলো সেই ধর্মগ্রন্থ যা আমাদের হিন্দু জাতির জন্য সবচাইতে উপযুক্ত উপাসনাযোগ্য এবং যেটি প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সংস্কৃতি, প্রথা ও চিন্তাধারার ভিত্তি হয়ে উঠেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনুশীলন করা এই বইটি আমাদের জাতির আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক অগ্রগতিকে সংহত করেছে। আজও কোটি কোটি হিন্দু তাদের জীবন ও অনুশীলনে যে নিয়মগুলি অনুসরণ করে, তা মনুস্মৃতির ওপর ভিত্তি করেই। আজ মনুস্মৃতিই হিন্দু আইন।” - সাভারকার
কি আছে মনুস্মৃতিতে? প্রথমত সব উচ্চবর্ণের মানুষেরই কি সমান অধিকার দেওয়া আছে মনুস্মৃতিতে? মনুসংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ১৫৫নং শ্লোকে বলা আছে -
“নাস্তি স্ত্রীণাং পৃথগ্ যজ্ঞো ন ব্রতং নাপ্যুপোষণম।
পতিং শুশ্রূষতে যেন তেন স্বর্গে মহীয়তে।।”
এর অর্থ - (পতি/স্বামী ছাড়া) স্বতন্ত্রভাবে স্ত্রীলোকের যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস নেই। তিনি যে পতিসেবা করেন, তাতেই স্বর্গে পুজিতা হন।
নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মনুস্মৃতির নবম অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকে বলা আছে -
“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।”
এর অর্থ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়।
অর্থাৎ উচ্চবর্ণের নারীদের অধিকার পুরুষের চাইতে অনেক কম। নারীর কাজ কেবলমাত্র পিতা-পতি ও পুত্রের সেবা করা।
এই কারণেই মহিলা রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্রাত্য ছিলেন।
দ্বিতীয়ত সব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কি সমান অধিকার থাকবে হিন্দুরাষ্ট্রে? না থাকবে না। মনুসংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ৯২নং শ্লোকে লেখা আছে -
“দক্ষিণেন মৃতং শূদ্রং পুরদ্বারেণ নির্হরেৎ।
পশ্চিমোত্তরপূর্বৈস্তু যথাযোগং দ্বিজন্মন:।।”
এর অর্থ শূদ্রের মৃতদেহ দক্ষিণপুরদ্বার দিয়ে এবং দ্বিজগণের মৃতদেহ যথক্রমে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদ্বার দিয়ে বহন করা হবে। মানে ব্রাহ্মণের রাস্তা দিয়ে শূদ্রের যাবার অধিকার নেই, এমনকি মৃত্যুর পরেও।
৮ম অধ্যায়ে ২৮১নং শ্লোকে বলা আছে -
“সহাসনমভিপ্রেপ্সুরুকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজ:।
কট্যাং কৃটাঙ্কো মির্বাস্য: স্ফিচং বাসাবকর্তয়েৎ।।”
এর অর্থ শূদ্র ব্রাহ্মণের সাথে এক আসনে বসতে চাইলে তার কোমরে গরম লোহা দিয়ে ছাপ মেরে তাকে নির্বাসনে পাঠানো উচিত অথবা পশ্চাতদেশ কাটা দরকার (তবে তার মৃত্যু যেন না হয়।)
পূর্বতন রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার জন্যই ব্রাত্য ছিলেন, নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে।
মনুসংহিতাকে দেশের সংবিধান মেনে যে হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার সেখানে হিন্দু নারী ও নিম্ন বর্ণের মানুষ দ্বিগুণ নিষ্পেষিত ও শোষিত হবে। বিজেপি দেশকে আড়াই হাজার বছর আগের পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চাইছে, আজ বিজ্ঞানের প্রবল অগ্রগতিকে অস্বীকার করে।
সঙ্ঘ পরিবার ও ফ্যাসিবাদ
আরএসএস তৈরী হয়েছিল ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি-হিটলারের আদর্শকে ভিত্তি করেই। আরএসএস -এর অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতা বালাকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে ১৯শে মার্চ ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক বেনিটো মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করে অভিভূত হ'য়ে পড়েন। দেশে ফিরে ইতালি'র ফ্যাসিস্টদের মতোই নিজস্ব মিলিটারি বাহিনী তৈরি করেন তিনি। এই কারণেই তাদের কাজকর্মের ধরণ সম্পূর্ণভাবেই ফ্যাসিবাদী কায়দাকেই অনুসরণ করে। হিটলার যেমন জার্মানির সাধারণ মানুষের মধ্যে ইহুদিদের সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ এবং ঘৃণা গড়ে তুলেছিলেন, তেমনই আমাদের দেশে আরএসএস-বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার মুসলমান-খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের বীজ বপন করতে চাইছে। একই সাথে তারা কমিউনিস্টদেরও প্রবল ঘৃণা এবং বিদ্বেষের চোখেই দেখে, যেহেতু কমিউনিস্টরা জাতি-ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে সব খেটে খাওয়া মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। নিজেদের তত্ত্ব এবং কাজের ত্রুটি - দুর্বলতাকে ঢাকার জন্যই তারা কল্পিত শত্রু হিসাবে মানুষের সামনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন ভাষাভাষী বা ভিন্ন উপজাতি মানুষদের তুলে ধরতে চায়, অপর অংশের মধ্যে। সব সমস্যার জন্য মুসলমান – খ্রীষ্টান - কমিউনিস্টরাই দায়ী, এই প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা ও দেশ লুটের ঘটনাবলীকে ধামাচাপা দিতে চায় বিজেপি। সাধারণ মানুষ জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গায় লিপ্ত হয়ে পড়লে, বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, দেশের সম্পদ লুট, মজুরী কমে যাওয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালাতে পারবে না। তাই বিভেদ ও দাঙ্গা বাধানোর রাস্তাকেই নিজেদের ক্ষমতা দখল রাখার রাস্তা হিসাবে বেছে নিয়েছে বিজেপি।
কয়েকটি অসত্য প্রচার
এই কাজের জন্য হিটলার- মুসোলিনির মতোই প্রবল মিথ্যাচারকেই অবলম্বন করেছে ফ্যাসিবাদী দল বিজেপি। যেমন মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তারা প্রচার করে দ্রুত 'হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, কারণ ২০৫০ সালের মধ্যে নাকি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাইতে বেশি হয়ে যাবে। অথচ প্রকৃত ঘটনা ও তথ্য এর বিপরীত। ১৯৫১-২০১১ সালে মুসলমান জনসংখ্যা ৯.৮% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৪.২%। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা ৮৪.১% থেকে ৪.৪% কমে হয়েছে ৭৯.৮%। ২০০১-১১ এই সময়ে হিন্দুদের সংখ্যা বেড়েছে ১৩.৮কোটি, মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে ৩.৪ কোটি। দেশে সব মিলিয়ে এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ২০কোটি। ( সূত্র: সেন্সাস রিপোর্ট)
১৯৫১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ২০কোটি বেশি ছিল মুসলমানদের তুলনায়। ২০১১ সালে এই পার্থক্য বেড়ে হয়েছে ৮০কোটি। ফলে কোনও হিসাবেই হিন্দুদের সংখ্যা মুসলমানদের চাইতে কমবেনা। ২০৫০ সালে তো দূরের কথা, ২৫০০ সালেও সেটা হওয়া সম্ভব নয়, কোনও গাণিতিক নিয়মেই।
আর একটা অসত্য প্রচার করা হয়, মুসলমানদের ৪/৫ টা করে বিয়ে হয়, তাই ওদের বাচ্চা-কাচ্চা অনেক বেশি জন্মায় হিন্দুদের তুলনায়। প্রকৃত ঘটনা তা নয়।
দেশে মহিলাদের গড় সন্তান উৎপাদন হার (TFR) ক্রমহ্রাসমান বিগত ২/৩ দশক ধরেই। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, নাস্তিক সবারই সন্তান উৎপাদন হার কমছে। জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা রিপোর্ট, যা মোদী সরকারের আমলেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে এই হার বেশি কমেছে। বিহার, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান রাজ্যে হিন্দু সন্তান জন্মহার, মুসলমান সন্তান জন্মহারের তুলনায় অনেকটা বেশি।
জাতীয় নমুনা স্বাস্থ্য সমীক্ষার চতুর্থ ও পঞ্চম রিপোর্ট দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, মুসলমান মহিলাদের সন্তান উৎপাদন হার প্রায় ১০% কমেছে। ১৯৯২ সালে হিন্দু ও মুসলমান মহিলাদের সন্তান উৎপাদন হারের তফাৎ ছিল ১.১%। এটা ২০২১ সালে কমে দাঁড়িয়েছে.০.৫% এ। ১৯৯২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে হিন্দু মহিলাদের সন্তান উৎপাদন হার কমেছে ১.২%, আর মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা কমেছে ১.৮%। এসব তথ্য থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের চূড়ান্ত অসত্য প্রচারের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে যায়।
মনে রাখা দরকার, যে এই দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮২% মানুষই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী হলেও, বিগত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থন করেছে ৩৭% মানুষ। তাও যারা ভোট দিয়েছে বিজেপিকে, তাদের সবাই ধর্মীয় কারণে ভোট দেয়নি এদের। বিগত নির্বাচনে শহীদ জওয়ানদের লাশ দেখিয়ে, উগ্র দেশপ্রেমের মিথ্যা প্রচার করে অনেক মানুষের সমর্থন আদায় করেছিল বিজেপি।
তাই হিন্দু ধর্ম মানে হিন্দুত্ববাদ নয়।
হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান
ভারতবর্ষের মত বহু ভাষা বহু ধর্ম বহু জাতির দেশে এক ধর্ম এক ভাষার নীতি প্রয়োগ করাই হ'লো আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবারের মূল লক্ষ্য।
আমাদের দেশের সংবিধানের অষ্টম তপশীলে ২২ টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত আছে। People's Linguistic Survey of India র সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে ৭৮০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশের প্রায় ৫৭% মানুষই হিন্দি ভাষায় কথা বলেনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৭% মানুষের ওপরে যদি জবরদস্তি ৪৩% সংখ্যালঘু অংশের ভাষা হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হয়, এই দেশ তাহলে এক থাকবে?
আসলে বিজেপি হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তান শ্লোগানের মোড়কে দেশবাসীকে মুড়ে ফেলতে চায় ২টি কারণে। প্রথমত আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার ইস্রায়েলের জায়নবাদী বা বর্ণবিদ্বেষী সরকারের অনুকরণে এখানেও মনোলিথিক বা একমূখী একমাত্রিক একদেশদর্শী দেশ বানাতে চায়। যেখানে সঙ্ঘীদের পছন্দের ধর্ম ভাষা সংস্কৃতি খাদ্যাভাসের বাইরে কেউ অন্য কিছু করতে পারবেনা। দ্বিতীয়ত জাত ভাষা ধর্মের ভিত্তিতে বিষাক্ত প্রচারে মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকুক, আর ওরা সমগ্র দেশের সম্পদ ও দেশবাসীকে লুট করে নিলেও সেইদিকে কারোর দৃষ্টি যাবেনা। ব্রিটিশদের পদলেহনকারী আর এস এস, ব্রিটিশ শাসকদের মতোই Divide & Rule এই নীতির ভিত্তিতে দেশ চালাতে চাইছে।
তাই সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক মানুষের অন্যতম প্রধান কাজ - দেশের ঐক্য সম্প্রীতি গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হওয়া।
ফ্যাসিবাদ যখন দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, তখন তার বিরোধিতা না করাই অপরাধ। ফ্যাসিবাদ যখন আপনার-আমার ঘরে ঢুকে পড়তে চায়, তখন তাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করাই কর্তব্য।
দেশহিতৈষী পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ