সংস্থান নেই , প্রতিশ্রুতির ঝুড়িঝুড়ি : প্রসূন ভট্টাচার্য

সামনে ভোট, তাই বাজেটে ফুলঝুড়ির মতো প্রতিশ্রুতি বিলোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুদানের পরিমান বৃদ্ধি থেকে কাজের সুযোগ বৃদ্ধির অনেক ঘোষণাই করলেন, কিন্তু রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এই বাজেটেও আয়ের বন্দোবস্ত রাখতে পারলেন না। শেষপর্যন্ত বাজেট পরিসংখ্যান বলছে, দেউলিয়া পরিণতির দিকে এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কারণ, সরকার চালাতে এবার রেকর্ড পরিমান, প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চলেছে তৃণমূল সরকার। এরমধ্যে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হবে বাজার থেকে চড়া শর্তে।


বৃহস্পতিবার বিধানসভায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন সেটা অনুসারে সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীর ঘাড়ে ঋণের মোট বোঝা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১১ সালে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন হওয়ার সময়ে এর পরিমান ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা।
ঘোষণার নিরিখে বাজেটকে প্রায় নির্বাচনী ইশতেহারে পরিণত করেছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু বাজেটে প্রতিটি ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে আর্থিক সংস্থান রাখতে হয় এবং রাজস্ব আদায়ে তার সংস্থান রাখতে হয়, সেরকম কোনো ভারসাম্যই তিনি রাখেননি। এমনকি বেশ কিছু ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করতে কত অর্থ বরাদ্দ করা হবে তার উল্লেখই করেননি। ফলে এই বাজেটের ফুলঝুড়ির মতো প্রতিশ্রুতিগুলিকে অর্থনৈতিক ভিত্তিহীন বলেও মনে করছেন অনেকে। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর রাজ্যের ঋণভার বাড়িয়ে চলেছে তৃণমূল সরকার, এমনকি বাজেটে পূর্ব ঘোষণার থেকে থেকেও বছর শেষে বেশি ঋণ সংগ্রহ করে চলেছে তারা। এবার তারা বাজেটেই ঘোষণা করে দিয়েছে, প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকার ঋণ সংগ্রহ করবে।
রাজ্য সরকার মোট ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছে। এরমধ্যে ১লক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকা আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে করের ভাগ এবং অনুদান বাবদ। রাজ্য সরকারের নিজস্ব কর সংগ্রহ ধরা হয়েছে ১লক্ষ ২ হাজার কোটি টাকার (এরমধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা মদের ওপরে রাজস্ব বাবদ)। আর ঋণ খাতে আসবে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। এই হলো বাজেটের ভারসাম্যের চিত্র।


খরচ কীভাবে হবে? বাজেটের ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট, রাজ্যে শিল্পোন্নয়ন এবং কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির কোনো সুযোগ এবারও তৈরি করা হচ্ছে না। তার জন্য লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে সরকার উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যায়ও করছে না। যেমন, সেচ সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যয়ের কথা নেই, কর্মসংস্থান ঘটায় এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য এবং বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয়ের কথা নেই। কেবল অকাল বর্ষণে বিপর্যস্ত আলুচাষীদের প্রবল ক্ষোভ থেকে বাঁচতে মাত্র একশো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে শস্যবীমা যোজনায় আলুচাষকে অন্তর্ভূক্ত করার ঘোষণা করে। তাঁতী ও কারিগরদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে এবং যন্ত্রপাতি কেনায় এককালীন সাহায্য দিতে সামান্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প কোনো ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘোষণা নেই। রাজ্যে পিপিপি মডেলে নতুন চারটে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা করে মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এমন বরাদ্দে কত বছর পরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, কবে তার ভিত্তিতে শিল্পোৎপাদন বাড়বে সেটা কেউ বলতে পারে না। ফলে রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না এই বাজেট। এমনিতেই বেসরকারী ক্ষেত্রগুলিতে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুযোগ পাচ্ছেন না কেউ, তার সমাধান না করে সেই স্বাস্থ্যসাথীতেই পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্তর্ভূক্ত করে মাত্র ১৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু নির্দিষ্ট আর্থিক বরাদ্দ দেখানো ছাড়াই কর্মসংস্থানের আজগুবী ঘোষণায় মমতা ব্যানার্জি যে অকৃপন তার প্রমাণ মিলেছে চাকরির ঘোষণায়। চাকরি চুরি যাওয়ায় চাকরি প্রার্থীরা যখন বিক্ষোভে রাস্তায় তখন সরকার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতেই ৫ লক্ষ চাকরির ঘোষণা করা হয়েছে এই বাজেটে। কিন্তু সেগুলো দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষার পদ্ধতি মেনে স্থায়ী নিয়োগ হবে নাকি সিভিক পুলিশের মতো নিয়োগ হবে তা বলা হয়নি।


টেকসই স্থায়ী উন্নয়নের বদলে নগদে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে ভোটের আগে মন জয় করার চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মমতা ব্যানার্জি। লক্ষ্মীর ভান্ডারে টাকার পরিমান ১ হাজার টাকা করা, দক্ষিণবঙ্গের তিন জেলার মৎস্যজীবীদের বছরে দুই মাস ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া, যুবদের ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড দেওয়া, রাজ্যের ২১ লক্ষ জব কার্ড হোল্ডারের একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরী মিটিয়ে দেওয়া, দ্বাদশ শ্রেণীর বদলে একাদশ শ্রেণীতে ট্যাবের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে বাজেটে। বিস্ময়কর ঘোষণা রয়েছে বাজেটে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প নিয়ে। এমএনরেগার বিকল্প ঘোষণার মতো বছরে অন্তত ৫০ দিনের কাজ দেওয়ার ঘোষণা করে কর্মশ্রী প্রকল্পের ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এর জন্য কত খরচ হবে? নির্বাচনের আগে কেবল ঘোষণাই যথেষ্ট মনে করে, বাজেট বিবৃতিতে বরাদ্দের কোনো উল্লেখই করেননি অর্থমন্ত্রী।

দক্ষিণবঙ্গের গঙ্গাসাগরে যাওয়ার জন্য মুড়িগঙ্গার ওপরে একটি এবং বর্ধমান থেকে আরামবাগ যাওয়ার পথে দামোদর নদের ওপরে একটি সেতু এবং নিউটাউনে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের ঘোষণাও করা হয়েছে বাজেটে। এরজন্য বরাদ্দ কিন্তু সবমিলিয়ে মাত্র ৪৫০ কোটি টাকা। ফলে কয়েক হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পগুলিও কবে বাস্তবায়িত হবে, কবে রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে তা নিয়ে সংশয় থেকে গেছে। তবে এরমধ্যেও এবারের নির্বাচনে ‘তীর্থস্থান’এর রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বাজেটে সবচেয়ে বেশি অর্থ (২৫০ কোটি টাকা) বরাদ্দ হয়েছে গঙ্গাসাগরের সেতুর জন্য।
রাজ্যবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে কোনো সুরাহা না দেখাতে পারলেও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির জমি আকাঙ্খা পূরণে সরকারের তৎপরতা ফুটে উঠেছে বাজেটে। গ্রাম শহরে সমস্ত লিজ হোল্ড জমিকে ফ্রি হোল্ড করে দেওয়ার ঘোষণার পাশাপাশি বাজেটে বলে দেওয়া হয়েছে, গ্রাম এবং শহরে জমির উর্ধসীমা আইন পুনর্বিবেচনা করা হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন