‘নয়া ভারতের’ আম আদমির হাল হকিকত

সরিৎ মজুমদার

‘নয়া ভারতের’ নয়া ধাঁচের সম্রাট সদ্য আরব সাগরে ডুব দিয়ে দ্বারকা দর্শন করে অভিভূত হয়ে পরেছেন। ‘ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা’ বলে উল্লেখ করেছেন মোদী। বলেছেন, ‘আধ্যাত্মিক মহিমার একটি প্রাচীন যুগের সঙ্গে সংযোগ’ অনুভব করেছেন। সে তিনি যেকোন সংযোগ অনুভব করতেই পারেন,কিন্তু তার স্পর্শে এই দেশের আম জনতার নাভিশ্বাস উঠছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একের পর এক পরিসংখ্যান যে নতুন ভারতের ছবি তুলে ধরছে তা অতীতের যে কোন সময়ের ভারতের থেকেই খারাপ।

বেকারত্বের হাল দিয়েই শুরু করা যাক।  অতীতে ৪-৫% বেকারীকেই ভয়াবহ বেকারী মনে করা হলেও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড পরবর্তী সময়ে বলছে ৯-১০% বেকারী হলা ‘নিউ নর্মাল’। আমাদের দেশে কতজন মানুষ কাজ করছেন আর কতজন কাজের সন্ধান করছেন তার আনুপাতিক হার থেকেই বেকারত্বের পরিমাপ করা হয়। একে বলা হয় labour force participation rate। আমাদের দেশে বর্তমানে এই labour force participation rate হল ৪০-৪৫% । অর্থাৎ ৫০% -এর বেশি মানুষ কাজ খুঁজছেন না। কাজের বাজারের পরিস্থিতি এতটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে যে তারা আর কাজ খুঁজতেও উৎসাহী নন বা সেই বাজারের বাইরে চলে গেছেন। বাকি যে ৪০-৪৫% মানুষ কাজের বাজারে টিঁকে আছেন তাদের মধ্যেই কর্মহীনতার হার ৯-১০%।

সরকারি পরিসংখ্যান গণনার পদ্ধতি অনুসারে কোন ব্যক্তি বিগত সপ্তাহে যদি ১ ঘন্টাও কাজ করে থাকে তাহলে সে বেকার নয়! অর্থাৎ বাস্তবে বেকারত্বের হার ৯-১০%-এর থেকে বহুগুণ বেশী। গ্রামীন বেকারত্বের হার আরো বেশি। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক,ক্ষেতমজুর, কৃষক সংগঠনগুলোর দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল, গ্রামীন বেকারত্বের মোকাবিলা করে যে মনরেগা - আইন সংসদে তৈরি হয়েছিল মোদি  সরকার তার ক্ষেত্রকেও ক্রমশ সঙ্কুচিত করছে। শুধুমাত্র ২০২২-২৩ অর্থবর্ষেই ৭.৬ কোটি নথীভুক্ত গ্রামীন মানুষকে মনরেগার আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় আধার সংযুক্তীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে আরো প্রায় ৯কোটি মানুষ এই মনরেগা প্রকল্পের আওতা থেকে বঞ্চিত হবেন। গত ১ বছরে মনরেগার কাজের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১.৫% যা আসলে বেকারত্বের ভয়াবহ হারকেই প্রতিফলিত করে। বেকারত্বের সমস্যা সমাধান না করে সরকার উল্টে মনরেগার মত কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্পকেই সঙ্কুচিত করছে।

এখনো এতো কিছুর পরেও যারা কাজের বাজারে টিঁকে আছেন তাদের মধ্যেও ৫৭% স্বনিযুক্ত। এদের একটা বড় অংশই ব্যাঙ্ক বা অন্য কোথাও থেকে ঋণ নিয়ে নিজেদের উপার্জনের ব্যবস্থা করেছেন। এদের গড় আয় মাত্র ১০,০০০ টাকার আসেপাশে।

হিসাব বলছে ১৫-৫৯ বছর বয়সী ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে যারা কোথাও কোন কাজে নিযুক্ত আছেন তাদের ক্ষেত্রে একাধিক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে , সপ্তাহে অন্তত ৬১ ঘন্টা তাদের কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়। মানে সপ্তাহে ৬দিন কাজ করলেও গড়ে দৈনিক ১০ ঘন্টার ওপর তাদের কাজ করতে হচ্ছে। যেখানে ব্রিটেনে সপ্তাহে এই গড় ৩৬ ঘন্টা, জার্মানি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭ ঘন্টা সেখানে ভারতে তা বহুগুণ বেশি।

যেহেতু এখানে কাজের ঘন্টা,কাজের চাপ অনেক বেশি তাই প্রত্যাশিত যে প্রকৃত বেতনও এখানে বেশি হবে। কিন্তু সমস্ত জি-২০ দেশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধির হার কমছে। বা বলা যায় যে প্রতিটি দেশেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনায় বেতন কমেছে। নয়া উদারবাদের গত ৩ দশকে আমাদের দেশে শ্রমিকদের বেতনের ভাগ মোট উৎপাদনের ৩০% থেকে কমে ১০% তে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্টোদিকে মালিক পক্ষের মুনাফার ভাগ ১৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪%। তিন দশকে মালিকের মুনাফা বেড়েছে ৩গুণ , উল্টোদিকে শ্রমিকের বেতন কমে হয়েছে এক তৃতীয়াংশ।  এই ৩ দশকে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে প্রতি বছর ৬% হারে সেখানে বেতন বৃদ্ধি হয়েছে ২% হারে।

কর্মক্ষেত্রে ছুটির পরিসংখ্যানও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অসুস্থতা সহ নানা কারণে ছুটির অবস্থাও ভয়াবহ। নিয়মিত কাজে যারা যুক্ত তাদের মধ্যে স্থায়ী, চুক্তিবদ্ধ বা ক্যাজুয়াল কোন ধরণের কাজের সাথেই নিয়মিত যুক্ত শ্রমিকদের ৪৭%ই কোন সবেতন ছুটি পান না। এরফলে শ্রমিকদের গড় আয়ু কমে আসছে। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে আয়ের দিক থেকে সমাজের নীচুতলার ২০% মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৬৫ বছর সেখানে ওপরের দিকের ২০%-এর গড় আয়ু ৭২ বছর। ধনী আর গরীবদের গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও ৭ বছরের একটা ফারাক স্পষ্ট। পুঁজিবাদী আগ্রাসন গরীব মানুষের জীবিকা জীবন সবটাই শেষ করে দিচ্ছে।

আমাদের দেশে ৫০% এর বেশি মানুষের গড় মাসিক আয় ৯০০০টাকার চেয়ে কম ! মানে ৫ জনের পরিবার হলে একজন মানুষ সেই পরিবারে দিনে ৬০ টাকার বেশি খরচ করতে পারেন না। চিকিৎসা ছেড়ে দিন, ন্যূনতম বেঁচে থাকাটাও দুষ্কর। United Nations Development Programme এর যে মাপকাঠি তাতেই আমাদের দেশে ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থান করে। সেই মাপকাঠি কী বলে ? গ্রামে মাসিক আয় ১০৯০ টাকা হলে আর শহরে ১২৭০টাকা হলে সে নাকি গরীব নয় ! এরপরেও UNDP-এর হিসাবেই দেশে ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র। ১৫-৪৯ বছর বয়সের মধ্যে ৫০% মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগেন। শিশুদের অপুষ্টির অবস্থাও ভয়াবহ। দেশের ৩২% শিশুর ওজন কম, ৩৫% শিশুর ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম। এইটাই মোদির ‘নয়া ভারত’।

আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫.৫% -এর বেশি। যা আন্তর্জাতিক হিসাবেও অনেকটাই বেশি। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ৮-১০% তে এসে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই অর্থনৈতিক সঙহকট মোকাবিলার পন্থা একটাই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ধার দেওয়ার পরিমাণ বাড়াবে আর সাথে সুদের হারও বাড়াবে। সুদের হার বাড়ার ফলে পুঁজিপতিরা ঋণ নেওয়া কমাবে, বিনিয়োগ কমবে, কাজের সুযোগ কমবে , মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে , জিনিসের দাম কমবে, ফলে উৎপাদনও কমবে। এ একটা মারণ ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদ এইভাবেই সঙ্কট থেকে বেড়োতে চায, মোদির নয়া ভারতে সেই মারণ ব্যবস্থাই আরো জোরদার করা হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে সমস্যাটা দাঁড়ায় আসলে শুধুমাত্র শ্রমিকদের জন্য না, গোটা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার নিজস্ব অস্তিত্ব সঙ্কটের জায়গায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শ্রমিকস্বার্থের আইনগুলো বাতিল করে ৩টি শ্রম কোড দিয়ে শোষণের মাত্রা বাড়ানো। কিন্তু তাতেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সঙ্কটমুক্ত হতে পারবে না। মোদি যত চেষ্টাই করুন না কেন, পুঁজির নিজস্ব সঙ্কট থেকে মুক্তি এই শোষণের যাঁতাকলে কোনমতেই সম্ভব না।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া


শেয়ার করুন

উত্তর দিন