ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
ভারতের জাতীয় প্রতীক বদলে দিচ্ছে মোদী সরকার। বদলে দেওয়া হচ্ছে ‘সত্যমেব জয়তে’ খচিত ‘ন্যাশনাল এম্বলেম’। বদলে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাস।
সঠিক ইতিহাস রচনা সম্পর্কে কিছু ভিন্নমত পন্ডিতমহলে রয়েছে। মেধাবৃত্তির সেই অনন্য উত্তরাধিকার সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের ওয়াকিবহাল করতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ্যসূচীতে নির্দিষ্ট করে ‘হিস্টিরিওগ্রাফি’ পড়তেও হয়। এমন চর্চা সত্যান্বেষণের নতুন নতুন দরজা খুলে দেয়। সেই কারনেই মনন, মেধা এবং প্রগতির পথে মতপার্থক্যের বিশেষ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
ইতিহাস চর্চার এমন অভ্যাসে বিপদ কার? কাদের?
ক্ষমতায় আসীন হওয়া থেকে শুরু করে ক্ষমতা ধরে রাখা অবধি যে রাজনীতির একমাত্র ভরসা নির্জলা মিথ্যাচার– তারাই চায় ইতিহাস বদলে যাক। নির্মাণের অজুহাতে তারা আসলে ধ্বংস করে। আর তাই মানুষের স্মৃতিহত্যা করা অবৈধ পথে সিংহাসনে বসা শাসকের চিরায়ত সংস্কৃতি। ভারতেও তাই হচ্ছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Ashokas-Emblem-2.jpg)
ভারতবর্ষের (দেশভাগের আগে অবধি আমরা দেশকে ভারতবর্ষ বলি) অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অশোক স্তম্ভের প্রচলন করেছিলেন। অশোকের আমলে শাসনের চিহ্ন হিসাবেই যারা অশোক স্তম্ভকে বিবেচনা করেন তারা হয় অর্ধেকটুকু জানেন, নয়তো ইচ্ছাকৃত বাকি সত্যটুকু চেপে রাখেন। অশোক স্তম্ভ বৌদ্ধধর্মেরও প্রতীক। চারদিকে চারটি এশিয় সিংহের মূর্তির ঠিক তলায় চক্রাকারে বিন্যস্ত থাকে আরও চারটি আকৃতি– সিংহ, ঘোড়া, বৃষ এবং হস্তী। চারটি আকৃতির প্রতিটি জোড়ার মাঝে রয়েছে একটি চক্র। পুরো কাঠামোটি দাঁড়িয়ে রয়েছে উল্টানো শতদলের উপরে। এই পদ্মফুলটি ভারতীয় জনতা পার্টির নয়, আসলে বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন চিহ্ন।
স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রয়োজন ছিল ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত এমন এক জাতীয় প্রতীকের যাতে জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে স্বাধীনতার সংগ্রামে অনুশীলিত ঐক্যের আদর্শকে তুলে ধরা যায়। স্বাধীন ভারতের সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশ) সারনাথে অবস্থিত সম্রাট অশোকের রাজকীয় প্রতীকটিই হবে ভারতের ‘জাতীয় প্রতীক’।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Ashokas-Emblem-1024x444.jpg)
স্বাধীন ভারতের সরকার ‘প্রতীক’ নির্মাণের কর্তব্য সমর্পণ করেছিল বিশ্বভারতীর তৎকালীন অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুকে। বসু পাঁচজন শিল্পীকে সেই উদ্দেশ্যে বাছাই করেন। তাদেরই একজন ছিলেন বিশ্বভারতীর ফাইন আর্টসের ছাত্র, দীননাথ ভার্গব। ২১ বছর বয়সী ভার্গব প্রতিদিন ট্রেনে চেপে কলকাতার আলিপুরে যাতায়াত শুরু করেন। খাঁচায় বন্দি সিংহ’কে নিজের চোখে দেখে শুরু হয় স্টাডি’র। স্টাডি অর্থাৎ শিক্ষা– নির্মাণের পূর্বশর্ত, রচনার আগমনী পর্ব। মনগড়া, একপেশে, বিকৃত গল্পকথা নয়– দুই মাস ধরে নিবিড় অধ্যাবসায় শেষে শিল্পীর হাতের আঁচড়ে নির্মিত হয় ভারতের ‘জাতীয় প্রতীক’।
এই হল আমাদের ইতিহাস।
আজকের ভারত সরকার কেন সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইছে সে কথা বোঝা খুব দুরহ নয়। অশোক স্তম্ভের সিংহের মুখে আগ্রাসী পরিবর্তনটিও আসলে একটি প্রতীক– ঐ আগ্রাসন আসলে ক্ষমতার দম্ভের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ঘৃণার রাজনীতিকেই তুলে ধরছে। আজকের ভারতে সংকীর্ণতাবাদী, বিভাজনকামী বিদ্বেষের উত্তরাধিকার বহন করে চলা রাজনীতির কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ভারত নির্মাতা হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন। তাদের অন্ধ অনুচরেরা এসব না জানলেও প্র্যাগম্যাটিজম যে আসলে ফ্যাসিবাদেরই দর্শন একথা মোদী ভালই বোঝেন। নতুন যা হোক কিছু একটা করে লোকজনকে মাতিয়ে রাখার যে কৌশল বিজেপি’র ঐতিহ্য তার জোরে খুব বেশি হলে চণ্ডাশোকেরই পুনর্জন্ম হচ্ছে, হবে। শাসক হয়ত ভুলে যাচ্ছেন ইতিহাসের শিক্ষা এই যে জনগনের স্মৃতিহত্যায় ক্ষমতাধরের ব্যর্থতাও চিরায়ত।
মোদী একান্তে নিজেকে অশোকের সমান উচ্চতায় ভাবতেই পারেন– ভুলে গেলে চলবে না চণ্ডাশোক পর্বে সম্রাট অশোকের কর্মসূচি আসলে লজ্জার ইতিহাস। আজকের ভারত যে অশোক স্তম্ভে গর্বিত, তা অশোকের ধর্মাশোক পর্যায়ের কীর্তি। সেই অশোক চন্ডভাব পেরিয়ে মানবিক উত্তরণের পথে এগিয়েছিলেন। এখানেই মোদীর শাসনে অশোক স্তম্ভের বিকৃতির মূল নিহিত। মূল প্রাকারে খচিত সিংহমূর্তিটি মহিমাময়। শান্ত, ছিপছিপে, কমনীয়। রাজকীয়ভাবে আত্মবিশ্বাসী। কারন তা মানুষের উত্তরণের গর্বে বিজয়ীর মনোভাবে নির্মিত। মোদীর নতুন কাঠামোয় সিংহের চেহারা অপ্রয়োজনে আগ্রাসী। পেশিবহুল, ক্রুদ্ধ, আক্রমনের ভঙ্গীতে উদ্যত। যা আসলে নতুন ভারতের নামে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখ। যা ভারত নির্মাণের ইতিহাসকেই কামড়ে-আঁচড়ে তছনছ করে দিতে চায়।
ভাববাদী ইতিহাসচর্চা যাকে নিয়তাবাদী পরিণতি বলে আমরা, কমিউনিস্টরা সেই ঘটনাকে ইতিহাসের পুনরাবির্ভাব বলি– এহেন দ্বিতীয় পর্বকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন প্রহসন।
কর্তৃত্ববাদ কখনো সেই প্রহসনের সীমা অতিক্রম করতে পারে না। হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাংকো কেউই পারেন নি। স্বাধীনতার আগে ইতালিতে পৌঁছে মুসোলিনির থেকে হাতে কলমে কাজ শিখে আসা এ বি এস মুঞ্জেও আরএসএস-বিজেপি’কে প্রহসন ব্যাতিত আর কিছুই শেখাতে পারেন নি।
![Musolini-and-Munje](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Musolini-and-Munje.jpg)
সেই মুঞ্জের কথাও বিজেপি ভুলিয়ে দিতে চায়, কেউ কেউ ভুলেও যান– সবাই নয়।
মানুষ ও তার অধিকারকে পায়ের তলে পিষে মারতে ফ্যাসিবাদের তাই প্রয়োজন হয় মেকি চমক (স্পেক্ট্যাকল) নির্মাণের। সেই চমক যে আসলে এক তমসাচ্ছন্ন পথ, উগ্র জার্মান অস্মিতা আসলে কি করেছিল, করতে চেয়েছিল সেই ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে যায় শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমায় এস এস সেনাবাহিনীর অফিসার অ্যামন গোয়েথের সংলাপে –
‘আজকের দিনটিই ইতিহাস। ভবিষ্যৎ মনে রাখবে আজকের দিনটিকে। আগামী দিনে কমবয়সীরা বারে বারে জানতে চাইবে আজকের দিনে এমন কী হয়েছিল। আজ এক ইতিহাস নির্মিত হল। এবং আপনারা প্রত্যেকে সেই ইতিহাসের সাক্ষী রইলেন। সারা পৃথিবীতে যারা কালা জ্বর, ক্যাশিমির দ্য গ্রেটের কারণে ঘৃণিত ছিল সেই ইহুদিদেরই আজ থেকে ছ’শ বছর আগে ক্রাকোও’তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা ক্রাকোও’তে চলে আসে। এই শহরের সবজায়গায় তারা নিজেদের পুঁটলিভর্তি জিনিসপত্র ভরে দিয়ে জাঁকিয়ে বসে। এই শহরটি তাদের কব্জায় চলে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং শিল্প সর্বক্ষেত্রেই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। তারা এসেছিল খালি হাতে, তাদের উন্নতির ইতিহাসও ততটাই ফাঁপা। ছ’শ বছর ধরে এই শহর ইহুদীদের ক্রাকোও’ বলে পরিচিত। আজ থেকে সেই সবকিছুকেই গুজব বলে জানবেন। সেইসব কিছুই আসলে হয়নি। এই কারণেই আজকের দিনটি ইতিহাস’।
মোদী সরকার এখনও অবধি এর চাইতে বেশি কিছু নির্মাণ করতে পারেনি।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ