আমাদের জাতীয় সংগীত, আমাদের শাসকদলের ভাবনা :পবিত্র সরকার...

২৫ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

প্রথম


ভারতের এখনকার শাসকদের যে দল চালায়, এবং তাদের পিছনে যে হিন্দুত্বস্বপ্নসুখীরা আছে--তাদের প্রায়ই আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে উশখুশ করতে দেখা যায়। যেন কোথাও একটা অস্বস্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ বলে ফেলেও দিতে পারে না, তার উপর বাংলাদেশেও তাঁরই গান চলছে জাতীয় সংগীত হিসেবে, জানা গেছে যে শ্রীলংকার জাতীয় সংগীতের পিছনেও তাঁর কথা আর সুরের অনুপ্রেরণা ছিল—তাই জনগণমন ওই মহলের কাছে কিছুটা যেন গলার কাঁটা হয়ে আছে—না পারে ফেলতে, না পারে ওগরাতে।
তবে এ গান বদলে ফ্যালো--এমন বলার মতো উন্মাদ যে নেই তা নয়, গান্ধিহত্যাকারীর মন্দিরে খাড়া করে পুজো করার মতো লোক যেমন আছে। আছে, কিন্তু তাদের চেয়েও অনেক বেশি করে আছে যারা এর বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ আনে। প্রথমটা কিছুটা মৃদু, তা এ গানের আংশিক বক্তব্য নিয়ে, বা সংবাদ নিয়ে। অভিযোগ উল্লেখ আর অনুল্লেখের—ইংরেজিতে যাকে বলে commission আর omission-এর। এ দেশে এখন ‘সিন্ধু’ বলে কোনও অঞ্চল নেই, সেখানে ‘সিন্ধু’ কথাটা কেন থাকবে ? আর এ গানে আসামের নাম নেই তাই বা কেন ? দ্বিতীয় অভিযোগটা আরও মারাত্মক, সেটা এগান রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নাকি ১৯১২তে দিল্লির দরবার উপলক্ষ্যে ভারতে আগত সম্রাট পঞ্চম জর্জের বন্দনার জন্য এ গান রচনা করেছিলেন, রাজভক্তি দেখানোর উদ্দেশ্যে, তাই এ গানকে ছুড়ে ফেলে দাও। এর পিছনে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আরও কোনও ক্ষোভ থাকতেও পারে। তিনি হিন্দুধর্ম নিয়ে তত উচ্ছ্বসিত ছিলেন না, হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমান ছেলের বিয়ে দিয়েছেন সেই বুড়ো বয়সে (‘মুসলমানীর গল্প’), আবার হিন্দু ছেলের সঙ্গে মুসলমান মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন যৌবনে (‘কুয়াশা’)—ফলে আজকাল যাকে ওরা ‘লাভ-জেহাদ বলে তার এক পান্ডা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এগুলি ওরা সবাই জানে কি না জানি না। তবে ‘জনগণমন’ গানে ভারতের জনগোষ্ঠী যে ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানি’—এই সকলের কথা আছে ভারতের জাতীয় সত্তার অংশ হিসেবে, আছে বহুত্বের কথা—সেটাও বোধ হয় ওদের বুকে জ্বালা ধরায়। ফলে এ গানটিকে ওদের অনেকে শত্রুপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। আর এই সময়ে ‘গীতাঞ্জলি’তেও তো তিনি বলেন, ‘মার অভিষেকে’ ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান’ ইত্যাদি, সে কথাও এরা কেউ কেউ জানে হয়তো, তাই খোদ রবীন্দ্রনাথকেও শত্রু বা ‘দেশদ্রোহী’ বলেই বিবেচনা করে বোধ হয়।

দ্বিতীয়


‘সিন্ধু’ আর ‘আসাম’—কেন আছে কেন নেই নিয়ে প্রশ্ন বোকাদের প্রশ্ন। ‘বোকা’ শব্দটার বদলে আমি জীববিশেষের নাম করতে পারতাম। এক নম্বর, কবিতা ভূগোলবিবরণ নয়, তাতে ম্যাপ দেখে তালিকা করলে তা কবিতা হয় না, আর রবীন্দ্রনাথ যখন গানটি লিখেছিলেন তখন সিন্ধু দিব্যি ছিল ভারতে।
ভারতের জাতীয় সত্তা কী দিয়ে তৈরি সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারণা কী ছিল সে সম্বন্ধে এদের মূর্খতা সীমাহীন। বহুত্ব এদের খুবই অপছন্দ তা তো বোঝাই যাচ্ছে, পুরো দেশটা এরা একমাত্র গেরুয়া রঙে রাঙিয়ে দিতে চায়। অর্থাৎ হিন্দু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না ভারতে। বিশেষ করে মুসলমান না, খ্রিস্টান না। মুসলমানদের মারছে, খ্রিস্টানদের পোড়াচ্ছে। আরও এক ধরনের লোকদেরও মারছে—আসলে ‘না-ধর্মে’র লোক—যাদের বলি যুক্তিবাদী বা মানববাদী। গৌরী লঙ্কেশ, গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর প্রভৃতি তাঁদের দলে। কিন্তু শিখ, বৌদ্ধ, জৈনদের সম্বন্ধে কিছু বলছে না, বোধ হয় তা নিয়ে একটু ভয় আছে। কারণ এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাই দলিতদের উপরেও এরা ভীষণ খাপ্পা। এরা হিন্দু বলতে শুধু উঁচু জাত বোঝে, মনুর পোষ্য সন্তানেরা, দলিতরা নয়। তাই দলিতদের গোঁফ রাখতে দেখলে এরা পেটায়, তাদের কেউ যদি লুকিয়ে উঁচু জাতের মেয়েদের গরবা নাচ দ্যাখে তো মেরেই ফ্যালে। ওদের কাছে জাতীয়তা মানে শত্রু খোঁজা, ভিতরে, বাইরে। ভিতরে হিন্দু ছাড়া অন্যরা, বিশেষত মুসলমান আর খ্রিস্টানেরা, আর হিন্দুদের মধ্যে তলার মানুষেরা, ওদের পূর্বপুরুষদের মার্কা মেরে দেওযা তথাকথিত ‘নীচু’ জাতিরা। আর বাইরে কত আছে—পাকিস্তান, চিন তো বটেই।
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয়তাকে তিনটি দিক থেকে দেখেছিলেন। এক, আমরা যারা প্রতিবেশী—দেশের নানা প্রদেশ, সেই সঙ্গে ধর্মে, ভাষায় সংস্কৃতিতে ভিন্ন মানুষেরা, ইতিহাস তাদের অনেককে এই দেশে এনে ফেলেছে, সব এখন এক সঙ্গে মিশে গেছে। এ হল অনুভূমিক বোধ, horizontal দেখা। আলাদা ধর্ম, নৃ-জাতি, উৎস—কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই দেশের বাসিন্দা, এ দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও বিচিত্র করেছে। তারা এ দেশের ভূমিপুত্র হয়ে গেছে, তাদের বহিষ্করণের বা দমিয়ে রাখার কোনও ব্যাপারই নেই। আর-একটা হল সমাজের উপরে-নীচে যাদের রাজারা আর তাদের পরামর্শদাতা বামুনরা সাজিয়েছে—উঁচু জাত, নীচু জাত, বা ধনী, গরিবের দল। সে হল উল্লম্ব vertical বিন্যাস। তারা সবাই এক—‘চণ্ডালিকা’তে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আনন্দ যেমন বলে চণ্ডালিনী প্রকৃতিকে ‘যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা।’ নানা জায়গায় কথাগুলি লেখেন রবীন্দ্রনাথ, কবিতায়, গল্পে, নাটকে, এমনকি প্রবন্ধে। ওরা রবীন্দ্রনাথের ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ (১৩১২) প্রবন্ধে এই কথাগুলি পড়েছে কি না জানি না। যখন দেশ ‘ভারতমাতা’, ‘ভারতলক্ষ্মী’ –এই সব প্রতীক আর প্রতিমূর্তি নিয়ে লাফালাফি করছে তখন রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ সুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র—কিন্তু ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিযাজীর্ণ প্লীহারোগেকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্য ভাণ্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা। যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে সমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিণী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরানিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অর্ধাশনে পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো আমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সার যায় না।”

যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা


এই কথাগুলি ওদের আরও বোঝার যোগ্য যে, এখানে ভারতের বঞ্চিতদের প্রতিনিধি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিধবা নারীর দৃষ্টান্ত এনেছেন। হিন্দুত্ববিলাসীদের কাছে নারীও তো অবদমিত থাকে, তাদের কাছে পুরুষই বেশি সমাদৃত। এ সব লিখছেন সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে, উনিশ শতকের শেষে, প্রাচীন ভারতের মহিমায় কিছুটা মুগ্ধ ছিলেন। ‘কিছুটা’ই বলছি, কারণ তখনও পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদের গতিবিধি তাঁর চোখ এড়ায়নি, বা দেশে আচারসর্বস্বতার চোরাবালির রাজত্ব। আর তার আগে থেকেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ তাঁর গরিবস্য গরিব হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের জীবনপরিবর্তনের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন, তার বিবরণ চেষ্টা করলেই পাওয়া যেতে পারে। আর তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জাতীয়তার দীক্ষাও অনেক প্রাচীন, সেই ১৮৬৬-র ‘হিন্দুমেলা’ও আগে থেকে। এখানে রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমাত্মক কবিতা পড়েছেন, সেই সঙ্গে একুশ বছর বয়সে ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখে সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন, বঙ্গভঙ্গ থেকে, জালিয়ানওয়ালাবাগ, বহু কবিতা (‘আফ্রিকা’ মনে পড়বে) এবং ১৯৪১এর ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত তাঁর দেশপ্রেমের কোনও সাফাইয়ের প্রয়োজন নেই। তবে তাঁর দেশপ্রেম প্রচলিত দেশপ্রেম থেকে আলাদা, কারণ তাঁর কাছে দেশ কথাটার অর্থ হল দেশের দরিদ্র আর বঞ্চিত মানুষ, আর তাঁর জাতীয়তা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে বিরোধে নয়, নিজের দেশকে ভালোবাসায়, যে দেশে তিনি বিশ্বময়ী আর ‘বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’ দ্যাখেন।

তৃতীয়

সেই রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ সম্বন্ধেই প্রশ্ন তোলা হয়, আগেও যেমন তাঁকে যারা অপছন্দ করত, তাঁর প্রতিভা, প্রতিষ্ঠা আর মর্যাদাকে ঈর্ষা করত তারা তুলেছিল, ‘জনগণমন’ পঞ্চম জর্জের বন্দনায় লেখা কি না। এ ঘটনা সত্ত্বেও যে, এ গানটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ( ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১) উদ্বোধন-সংগীর হিসেবে গাওয়া হয়েছিল, মহাত্মা গান্দির উপস্থিতিতে, ১৯১১তেই। এবং ঘটনা হল যে, পঞ্চম জর্জের সভায় এ গান গাওয়াও হয়নি। তাতে দক্ষিণাচরণ সেনের রচিত একটি গান গাওয়া হয়েছিল। পঞ্চম জর্জের প্রশস্তির জন্যে রচিত হলে এ গান দরবারে গাওয়া হল না কেন, এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের নিন্দুকেরা তোলেননি, কারণ এতে তাঁদেরই বোকা বনতে হত। এই অভিযোগ এমনই নীচু মানের আর নির্বোধ যে, তার উত্তর দেওয়াও অসম্মানজনক বলে মনে হয়। গানটির শরীরেই যা আছে, সেই অন্তর্গত প্রমাণই এই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট। পুরো গানটি যারা পড়েছেন, তাঁদের এর স্তবকগুলি মনে আছে। কিছু আগে লেখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ প্রবন্ধের প্রায় কাব্য বা সংগীতরূপ এই গান, তা হলে এই অভিযোগও তোলা যায় যে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ও পঞ্চম জর্জের বন্দনার উদ্দেশ্যে রচিত।
অভিযোগের তালের মধ্যে তিলটুকু হল, প্রশান্তকুমার পালের মতে, মহারাজা প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর সম্রাটকে বন্দনা করে রবীন্দ্রনাথকে একটি গান লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার পরিবর্তে ভারতের যে সভ্যতা বহু জাতিগোষ্ঠীর অবদানে যুগে যুগে ভারতের জাতীয়তার যে ক্রমবিকাশ ঘটেছে তাই নিয়ে গান লিখলেন। তাই ‘চিরসারথি’ ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ একশো পঞ্চান্ন বছরের শাসক ইংরেজ, আর তখন মাত্র সতেরো-আঠারো বছর আগে সিংহাসনে-বসা সম্রাট পঞ্চম জর্জ হবেন, এমন কথা যে বলে তার মাথায় হয় প্রচণ্ড গণ্ডগোল, না হয়, জঘন্য দুষ্টবুদ্ধি আছে বলে ধরে নিতে হবে। তবে জাতীয় কংগ্রেসের ওই অধিবেশনেই পঞ্চম জর্জের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি হিন্দি গান গাওয়া হয়, তাতে রবীন্দ্রনাথের কিছু করার ছিল কি ? অথচ এই গানটাকেই রবীন্দ্রনাথের গান বলে তখনকার কর্তাভজা কাগজ ‘দি ইংলিশম্যান’ আর ‘দ স্টেট্সম্যান’ ছাপে, আর সেটা বিলেতে-আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের বন্ধুদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।


এ বিষয়ে প্রশ্ন নিয়ে পুলিনবিহারী সেনের চিঠির উত্তরে লেখা রবীন্দ্রনাথের ২০ নভেম্বর, ১৯৩৭ সালে লেখা চিঠির কথাগুলিই গানের মূল পরেপ্রেক্ষিতকে ধরিয়ে দেয়। আহাম্মকদের যত প্ররোচনাই থাকুক, এর বাইরে ‘জনগণমন’ গানটির আর কোনও ইতিহাস সন্ধানের দরকার নেই—
“সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপের সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ায়র ধাক্কায় আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থার যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যপরিচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।“

চতুর্থ

এ কথাতে যাদের সংশয় ঘুচবে না, সেই আহাম্মকিতে নিষ্ঠাবান বেচারি বন্ধুদের জন্য নম্বর লাগিয়ে যুক্তিগুলিকে আবার সাজিয়ে দিই—
(ক ) গানটি পঞ্চম জর্জের বন্দনায় রচিত হয়নি, রচয়িতার সাক্ষ্য। না হলে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

(খ) এটি ১৯১২র দিল্লি দরবারে গাওয়াও হয়নি। বরং এটি ১৯১১-র শেষে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রসের অধিবেশনে দ্বিতীয় দিনের উদ্বোধন সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়েছি। ইংরেজি কাগজে ভুল খবর বেরোয়, অন্যে গানের সঙ্গে এটিকে গুলিয়ে দিয়ে। ওই ক্রীতদাস কাগজগুলির কথা যদি সত্য হত, তা হলে গানটি দিল্লির দরবারেও গাওয়া হত।

(গ) গানের কথাগুলিতে কোনও বিচ্ছিন্ন কালবদ্ধ সাম্রাজ্য বা সম্রাটের কথা নেই। বরং অনন্ত কাল ধরে ভারতের আত্মবিকাশের কথা আছে, আছে তার নিয়ন্তার কথা। আমাদের মতে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনদেবদার মতো, দেশ আর জাতিরও একটি জীবনদেবতা তিনি কল্পনা করেছিলেন।

(ঘ) ঠাকুরবাড়ি আর রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার সঙ্গে কোনও রাজবন্দনার গান সংগতিপূর্ণ নয়।

(ঙ) রবীন্দ্রনাথের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’র অভিব্যক্তিবাদের ইতিহাস-দর্শনকেই বহন করছে এই গান। তার সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বা পঞ্চম জর্জের সম্পর্ক উন্মাদেও কল্পনা করতে পারে না।
তাই এখনও যারা ‘জনগণমন’ নিয়ে নাছোড়বান্দা প্রশ্ন তুলবেন, বিজেপি = হিন্দুত্ববাদী = গৈরিক বাহিনী বা অন্য যে কেউ (বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও হতে পারে) তাঁদের মাথায় বুদ্ধিমত্তার বদলে দুরভিসন্ধির অবস্থান সম্বন্ধে আমাদের কোনও সন্দেহ থাকবে না। তাদের আসল রাগ বোধ হয় ‘হিন্দুবৌদ্ধশিখ জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানি’ কথাগুলির উপর। কিন্তু কিছু তো করার নেই। ভারত বহু ধর্মের বহু সংস্কৃতির দেশই থাকবে।

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উত্‍‌কল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে---
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥


শেয়ার করুন

উত্তর দিন