Nandalal Bose Cover

শিল্পে সমাজ ও তন্ত্র: নন্দলাল বসু, ইতিহাস ও একটি অনুসন্ধানের চেষ্টা

প্রাককথন

আমাদের দেশে এমনও একটা সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রের খেলার মাঠ অবধি শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বাৎসরিক কিংবা আকস্মিক কোনও আয়োজনে কৃতি হিসাবে সুখ্যাতি, পাণ্ডিত্যের বুৎপত্তি এসবই ছিল বক্তা নির্ধারণের মাপকাঠি। তৎকালীন কলকাতা এমন ধারার চর্চায় সারা দেশে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতের একটি নির্দিষ্ট অংশের এমন এগিয়ে থাকার কারণ হিসাবে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বিকাশের বাধ্যবাধকতা যেমন ছিল তেমনই ছিল কাণ্ডজ্ঞান প্রসঙ্গে আগেকার প্রশাসকদের অবস্থান। প্রচারের কাঁসি দেখলেই তাকে বাজানোর বিশেষ আগ্রহ প্রকাশে আজকের দেশ কিংবা রাজ্যের প্রমুখদের মতো তারা হন্যে হতেন না, উপযুক্ত ঔচিত্যবোধের প্রভাবে রাজনীতির পরিসর সম্পর্কে অবহিত থাকতেন।

আজকাল সে ঐতিহ্য ঘুচেছে। তাই বিজ্ঞান হোক বা শিল্প সর্বত্র আমরা হয় ‘মার্গদর্শন’ খুঁজে মরি না হলে ‘অনুপ্রেরণা’ ঢুঁড়ে বের করে আনতে চাই। তবু নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু দায় স্বীকার করতেই হয়, আমাদের তো বটেই। তমসাচ্ছন্ন রাত গভীর বলেই মনে রাখতে হয় উজ্জ্বল দিবালোকও একই মাত্রায় সম্ভাবনাময়। ইতিহাসের শিক্ষা তেমনই।

জ্ঞান যদি প্রদীপ হয় তবে তার আলোক সমাহার যার আশ্রয়ে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে ফুটিয়ে তোলে তিনিই শিল্পী, আর্টিস্ট। সেই আর্ট কখনো কথার ছলে কবিতা, সংলাপের ধারে বক্তৃতা, কখনো আবার তুলি ধরা হাতে আঁকা ছবি কিংবা বিমূর্ত সামগ্রী হতে ধীরে ধীরে নির্মিত হতে থাকা ভাস্কর্য। আদত শিল্পী কে বা কারা কিংবা সার্থক শিল্পকর্ম বললেই আজকাল যা সব দাবী করা হচ্ছে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ঠিক পরেই এমন জরাজীর্ণ অবস্থা দেখা যায়নি। হয়ত নন্দলাল বসু’রা তখনও জীবিত ছিলেন বলেই।

১৮৮২ সালে মুঙ্গের প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত খড়গপুরে জন্ম হয় তাঁর। বাড়িতে মায়ের হাত ধরে কারুশিল্পের (ক্রাফট) প্রাথমিক পাঠ নেন। ১৮৯৮-তে কলেজে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়ই অতুল মিত্রের সান্নিধ্যে প্রথাসম্মত শিল্পচর্চা বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ জন্মায়। মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে (পরিবারের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েই) ভর্তি হন ক্যালকাটা আর্ট স্কুলে। ততদিনে তার চেতনায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর আঁকা রীতিমত প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। কমার্স পড়া ছেড়ে এসে আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া সেই ছাত্রই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন অবনীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ছাত্র।

ঠিক এই অবধি এসে ছাত্র’কে গুরুর আলোকে বিচার-বিবেচনা করাই হল দুস্তুর। কিন্তু আমরা অমন ভাবাচ্ছন্ন হয়ে ইতিহাসচর্চা করতে পারি না। আমাদের মনে রাখতে হয় নন্দলাল অবনীন্দ্রনাথের থেকে শিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সারাজীবন ঐ আলোর তলায় বসে থেকে নিজেকে উজ্জ্বল দেখাতে চেষ্টা করেননি, উপযুক্ত শিক্ষার্থীর মতোই অনন্য শিল্পীরূপে নিজস্ব এক পরিচিতি ও শিল্পচর্চার স্বতন্ত্র এক ধারাও নির্মাণ করেছিলেন। সেই অনুভব, সেই উপলব্ধিই এই প্রতিবেদনের অন্যতম প্রসঙ্গ।

নন্দলাল বসু’র আঁকার মধ্যে নিছক ভারতীয় অনুভব মাত্র (ইন্ডিয়াননেস) ছিল না। অমন বর্গীকরণ (ক্লাসিফিকেশন) আসলে সংকীর্ণতা। একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক পরিবেশে সবকিছুকেই জাতীয় পরিচিতির আড়ালে ঢেকে দিতে চাওয়া হয়। সবই যেন আমাদের দেশে ছিল এমন একটা শুন্যগর্ভ অহমিকার আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পের দুই অনন্য বৈশিষ্টের অন্যতম একটিকে। শিল্প অবশ্যই শিল্পীর চেতনাজাত- ব্যক্তির চেতনা ও কল্পনার দ্বৈতে, দ্বন্দ্বে ও সংঘাতেই তার সৃষ্টি। আবার শিল্প শেষ অবধি বস্তুনিষ্ঠও। ঐ যে শিল্পীর নির্মাণের অনুভব তাকে সৃষ্টি করেছে সেইসকল মানবিক অনুভব, উপলব্ধি ঐতিহাসিক পারিপার্শ্বিকতা, সমকালীনতার দ্বারা বাঁধা পড়েই। এসবের মধ্যেই কিছু সৃষ্টির নিগড়ে এমন আবেদন রয়ে যায় যা তাকে সময়ের বাধা পেরিয়ে চিরায়ত করে তোলে। সেটাই শিল্পের অসীম হয়ে ওঠার প্রাকশর্ত। অমন অসীম হয়ে উঠতে বস্তুনিষ্ঠ না হলে চলে না, একথা স্বীকার করতেই হয় না করলে যেটা হয় তাকেই রবীন্দ্রনাথ সত্যনিষ্ঠ না হওয়া বলে চিনতে শিখিয়েছেন, ‘শৌখিন মজদুরি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

নন্দলাল বসু, তাঁর জীবন ও কাজ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য রাজ্য ওয়েবডেস্কের প্রাথমিক ভাবনা ছিল শিল্পীর নিজের কোনও একটি বক্তৃতা বা রচনাকেই সরাসরি ডিজিটাল মাধ্যমে তুলে ধরা। তবু কিছুটা বাড়তি কথা চলে এল। কেন? কারণ শিল্প ব্যাপারটা একক কোনও ব্যক্তি বিশেষের মনের কোনে আটকে থাকা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ মাত্রই নয়, বরং ঠিক উল্টোটাই সত্যি। শিল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি আজও ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ বলে যতই ঢাক পেটাক না কেন, সৃষ্টির ঊষালগ্নে নিজেকে সম্পূর্ণ একা করে না দেওয়া অবধি যেমন শিল্পীর মুক্তি নেই তেমনই একজনের চেতনা হতে নির্গত হওয়ার পর থেকে যতক্ষণ না অন্যের চেতনায় কোনও না কোনও একটা ছাপ ফেলা যায় সৃষ্টরূপ আর যাই হোক সার্থক শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। তাই শিল্পী কি ভেবে সৃষ্টি করলেন সেই প্রশ্নটি পরে গৌণ হয়ে দাঁড়ায়, শিল্পকর্মটি মানুষের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে সেটাই মূল বিষয় হিসাবে সামনে চলে আসে- অন্তত লেনিন তাই ভাবতেন।

তাই নন্দলাল বসু বললেই হবে না, তাঁর কোন লেখা সেই নির্বাচনও ছিল একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। আজ যেভাবে দেশীয় শিল্প-সাহিত্য বলতেই সবকিছুকে সংকীর্ণ, একপেশে ও রীতিমত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় মদতেই হচ্ছে- এমন পরিস্থিতিতে আমরা চেয়েছি আজকের আর্টিস্টই হয়ে উঠুন নন্দলাল বসু’কে চিনে নেওয়ার মাধ্যম।

এমন ভাবনা থেকেই ওয়েবডেস্কের তরফে তৌসিফ হকের সাথে যোগাযোগ করা হয়। মূলত ছবি আঁকার জন্যই তাঁর পরিচিতি। অনেকেই হয়ত জানেন না তৌসিফ ইতিহাসেরও একজন কৃতি শিক্ষার্থী। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন নন্দলাল বসু’র ছবিতে কোথায়, কিভাবে বৌদ্ধ দর্শন, চিন্তাভাবনা এবং চীনের শিল্প ঐতিহ্যের ব্যপক প্রভাব রয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর মতবাদ সম্পর্কে বিশেষরকম সতর্ক থেকেও তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আবার অন্তজ আদিবাসী প্রান্তিক মানুষও তাঁর ক্যানভাসে উঠে এসেছে।

১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউ এডুকেশন ফেলোশিপ’র বাংলা শাখায় নন্দলাল বসু একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর সে বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘শিক্ষায় শিল্পের স্থান’। ওয়েবডেস্ক’র ভাবনাটি জেনে তৌসিফ ঐ বক্তৃতাকেই প্রকাশের জন্য সঠিক বলে নির্বাচন করেন। আমরা তার পরামর্শ মেনে নিই। এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত দু লাইনের শিরোনামটিও তারই দেওয়া।

শিক্ষায় শিল্পের স্থান

নন্দলাল বসু

মানুষ আনন্দ পাবার জন্য এবং জ্ঞান-অনুশীলনের জন্য যত রকম উপায় উদ্ভাবন করেছে, তার মধ্যে ভাষা একটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চা চলছে ভাষাকেই বাহন করে। সাহিত্য মানুষকে আনন্দ দেয়, কিন্তু তার প্রকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। তার সেই অভাব পূরণ করছে রূপশিল্প সংগীত নৃত্য ও অন্যান্য কলা। সাহিত্যের যেমন একটা নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি আছে তেমনি রূপশিল্প সংগীত নৃত্যেরও আছে। মানুষ ইন্দ্রিয় দিয়ে, মন দিয়ে, বহির্জগতের সকল বস্তুর তত্ত্ববোধ ও রসবোধ করে এবং শিল্পে তা অপরের কাছে প্রকাশ করে; শিক্ষার ক্ষেত্রে শিল্পের চর্চার দ্বারা মানুষের তত্ত্ববোধ ও রসবোধের উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং শিল্পের প্রকাশভঙ্গি আয়ত্ত হয়। চোখের কাজ যেমন কানের দ্বারা হয় না, তেমনি ছবি গান ও নাচের শিক্ষা কেবল লেখাপড়ার দ্বারা সম্ভব নয়।

আমাদের শিক্ষাদানের আদর্শ যদি সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাদান হয়, কলাচর্চার স্থান এবং মান বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সমান থাকা উচিত। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিক দিয়ে এ পর্যন্ত যা ব্যবস্থা হয়েছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস- শিল্পচর্চা একদল পেশাদার শিল্পীরই একচেটিয়া কারবার, সাধারণের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। শিল্প না বোঝার জন্য অনেক শিক্ষিত লোকও অগৌরব বোধ করেন না- আর জনসাধারণের তো কথাই নেই, তারা ফোটো ও ছবির তফাত বোঝে না। জাপানি বোকা পুতুলকে শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মনে করে অবাক হয়ে থাকে। বিশ্রী-রঙ-করা লাল নীল বেগুনি জর্মান র‍্যাপার দেখতে চোখের পীড়া তো বোধ করেই না, বরঞ্চ উপভোগ করেই থাকে। সহজপ্রাপ্য সন্তা মাটির কলসীর বদলে প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে টিনের ক্যানেস্ত্রা ব্যবহার করে। এর জন্য দায়ী দেশের শিক্ষিতসমাজ এবং প্রধানতঃ বিশ্ব-বিদ্যালয়বিদ্যালয়। আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যার ক্ষেত্রে দেশবাসীর সংস্কৃতি যেমন বাড়ছে বলে মনে হয়, রসবোধের দৈন্যও তেমনি ক্রমশ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এর প্রতিকারের উপায় এ কালের শিক্ষিতসমাজে কলাশিক্ষার প্রচলন ব্যাপক- ভাবে করা; কারণ, এই শিক্ষিতসমাজই জনসাধারণের আদর্শস্বরূপ।

সৌন্দর্যবোধের অভাবে মানুষ যে কেবল রসের ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয় তা নয়, তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৌন্দর্যজ্ঞানের অভাবে যাঁরা বাড়ির উঠানে ও ঘরের মধ্যে জঞ্জাল গুড়ো করে রাখেন, নিজের দেহের এবং পরিচ্ছদের ময়লা সাফ করেন না, ঘরের দেয়ালে পথে ঘাটে রেলগাডিতে পানের পিক ও থুথু ফেলেন, তাঁরা যে কেবল নিজেদেরই স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেন তা নয়- জাতির স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করেন। তাঁদের দ্বারা যেমন সমাজদেহে নানা রোগ সংক্রামিত হয় তেমনি তাঁদের কুৎসিত আচরণের কু-আদর্শও জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের মধ্যে একদল আছেন যাঁরা কলাচর্চায় বিলাসী ও ধনী ব্যক্তিরই একমাত্র অধিকার ব'লে তাকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রা থেকে অবজ্ঞাভরে নির্বাসিত করে রাখতে চান। তাঁরা ভুলে যান যে, সুষমাই শিল্পের প্রাণ, অর্থমূল্যে শিল্পবস্তুর বিচার চলে না। গরিব সাঁওতাল তার মাটির ঘরটি নিকিয়ে মুছে মাটির বাসন ও ছেঁড়া কাঁথা গুছিয়ে রাখে। আবার কলেজে-পড়া অনেক শিক্ষিত ছেলে প্রাসাদোপম হোস্টেলের বা মেসের ঘরে দামি কাপড়- জাম। তৈজসপত্র এলোমেলো ছড়িয়ে জবড়জঙ্গ করে রাখে। এখানে দরিদ্র সাঁওতালের সৌন্দর্যবোধ তার জীবনযাত্রার অঙ্গীভূত ও প্রাণবস্তু, ধনীসন্তানের সৌন্দর্যবোধ পোশাকি এবং প্রাণহীন। শিল্প-উপাসনার নামে ক্যালেণ্ডারের মেমসাহেবের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো হয়ে শিক্ষিত লোকের ঘরে সত্যকার ভালো ছবির পাশে স্থান পেয়েছে দেখতে পাই। ছাত্রমহলে দেখি ছবির ফ্রেম থেকে জাম। ঝুলছে- পড়ার টেবিলে চায়ের কাপ, আশি, চিরুনি ও কোকোর

টিনে কাগজের ফুল সাজানো। প্রসাধনে কাপড়ের উপর বুক খোলা কোট, শাড়ির সঙ্গে মেমসাহেবি ক্ষুরওলা জুতো- এরূপ সর্বত্রই সংগতি ও সুষমার অভাব, আমাদের বিত্ত থাক্ আর না-থাক্, সৌন্দর্যবোধের দৈন্য সূচিত করে।

আবার আর-একদল লোক আছেন যাঁরা বলেন, 'আর্ট, করে কি পেট ভরবে?' এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। ভাষাচর্চার যেমন দুটো দিক আছে, একটা আনন্দ ও জ্ঞানের দিক, আর-একটা অর্থলাভের দিক, তেমনি শিল্পচর্চারও দুটো দিক আছে- একটা আনন্দ দেয়, আর-একটা অর্থ দেয়। এই দুটি ভাগের নাম চারুশিল্প ও কারুশিল্প। চারুশিল্পের চর্চা আমাদের দৈনন্দিন দুঃখদ্বন্দ্বে-সংকুচিত মনকে আনন্দলোকে মুক্তি দেয়, আর কারুশিল্প আমাদের নিত্য-প্রয়োজনের জিনিসগুলিতে সৌন্দর্যের সোনার কাঠি ছুইয়ে কেবল যে আমাদের জীবনযাত্রার পথকে সুন্দর করে তোলে তাই নয়, অর্থাগমেরও পথ করে দেয়। কারুশিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক দুর্গতির আরম্ভ হয়েছে। সুতরাং, প্রয়োজনের ক্ষেত্র থেকে শিল্পকে বাদ দেওয়া জাতির অর্থাগমের দিক দিয়েও অত্যন্ত ক্ষতিকর।

শিল্পশিক্ষার অভাবে যে আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা অসুন্দর করে তুলেছে তাই নয়, আমাদের অতীত যুগের রসস্রষ্টাদের সৃষ্ট সম্পদ থেকেও আমাদের বঞ্চিত করেছে। আমাদের চোখ তৈরি হয় নি. তাই দেশের অতীত গৌরব-স্বরূপ যে চিত্র ভাস্কর্য ও স্থাপত্য এতদিন আমাদের কাছে অবোধ্য ও অবজ্ঞাত ছিল, বিদেশ থেকে সমঝদার আসবার প্রয়োজন হল সেগুলি আবার আমাদের বুঝিয়ে দিতে। আধুনিক যুগের শিল্পসৃষ্টিও বিদেশের বাজারে যাচাই না হলে আমাদের দেশে আদৃত হয় না, এ আমাদের লজ্জার কথা।

এর প্রতিকারের সম্বন্ধে এইবার মোটামুটি ভাবে আলোচনা করা যাক। শিল্পশিক্ষার গোড়ার কথা হচ্ছে- প্রকৃতিকে এবং ভালো ভালো শিল্প- বস্তুকে শ্রদ্ধার সহিত দেখা, সে-সবের সঙ্গ করা এবং সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হয়েছে এমন লোকের সঙ্গে আলোচনা করে শিল্পকে বুঝতে চেষ্টা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য- প্রত্যেক স্কুলে ও কলেজে অন্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পশিক্ষার স্থান রাখা, শিল্পকে পরীক্ষাগ্রহণকালে অবশ্যশিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে গণ্য করা এবং প্রকৃতির সঙ্গে ছেলেদের যাতে পরিচয় ঘটতে পারে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা ও অবকাশ রাখা। অঙ্কনপদ্ধতি-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বাড়বে; ফলে তারা সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন প্রভৃতির ক্ষেত্রেও সত্যদৃষ্টি লাভ করবে। বিদ্যালয়ে কাব্যচর্চার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কাব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাস করলেই কেউ বড়ো কবি হন না, তেমনি বিদ্যালয়ে শিল্পশিক্ষার আয়োজন থাকলেই যে সকল ছেলে শিল্পী হবে এবং ভালো শিল্প সৃষ্টি করতে পারবে এমন আশা করা অবশ্য ভুল হবে।

প্রথমতঃ, ছেলেদের বিদ্যালয়ে, গ্রন্থাগারে, পড়ার ঘরে এবং বাসগৃহে কিছু- কিছু ভালো ছবি মূর্তি এবং অন্যান্য চারু ও কারুশিল্পের নিদর্শন (অভাবে ঐ-সকলের ভালো ফোটো বা প্রতিচ্ছবি) সাজিয়ে রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত:, ভালোভালে! শিল্পনিদর্শনের ছবি ও ইতিহাস-দেওয়া সহজ- বোধ্য ছেলেদের বই উপযুক্ত লোক দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখাতে হবে। তৃতীয়তঃ, ছায়াচিত্রের সাহায্যে মাঝে মাঝে স্বদেশের ও বিদেশের বাছাই-করা ভালো ভালো শিল্পবস্তুর সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

চতুর্থতঃ, মাঝে মাঝে উপযুক্ত শিক্ষকের সঙ্গে গিয়ে ছেলেরা নিকটস্থ যাদুঘর বা চিত্রশালায় অতীত শিল্পকীর্তির নিদর্শন দেখে আসবে। বিদ্যালয় থেকে ফুটবল ম্যাচ খেলতে যাওয়ার ব্যবস্থা যখন হতে পারে তখন চিত্রশালা বা যাদুঘর দেখে আসাও অসম্ভব হবে না। এ কথা মনে রাখতে হবে- একটা ভালো শিল্পবস্তু নিজের চোখে দেখলে এবং বুঝলে শিল্পদৃষ্টি যতটা জাগ্রত হয়, একশোটা বক্তৃতা শুনলে তা হয় না।

ভালো ছবি বা ভালো মূর্তি ছেটোবেলা থেকে দেখতে দেখতে কিছু বুঝে কিছু না বুঝে ছেলেদের চোখ তৈরি হবে, পরে আপনা থেকেই তাদের শিল্পের ভালোমন্দ বিচার করবার শক্তি জন্মাবে এবং ক্রমশই সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হবে।

পঞ্চমত:, প্রকৃতির সঙ্গে ছেলেদের যোগসাধন করবার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতে হবে। সেই আয়োজনের মধ্যে। থাকবে সেই সেই ঋতুর ফুলফলের সংগ্রহ এবং শিল্পে ও কাব্যে সেই সেই ঋতু সম্বন্ধে যে-সমস্ত শুন্দর সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে ছেলেদের যতদূর সম্ভব পরিচয় ঘটাবার ব্যবস্থা।

ষষ্ঠতঃ, প্রকৃতিতে যে ঋতু-উৎসব চলছে তার সঙ্গে ছেলেদের পারচয় করিয়ে দিতে হবে। শরতের ধানখেত ও পদ্মবন, বসন্তে পলাশ-শিমুলের মেলা, তারা যাতে নিজের চোখে দেখে আনন্দ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ ক'রে শহরবাসী ছেলেদের জন্য এ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক; গ্রামের ছেলেদের এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই চলবে। এই-সব ঋতু-উৎসবের জন্য বিশেষভাবে ছুটি দিয়ে বনভোজনের এবং ঋতু-উপযোগী বেশভূষা ও খেলাধূলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে যোগসাধন একবার হলে, প্রকৃতিকে সত্যকার ভালোবাসতে শিখলে, ছেলেদের অন্তরে রসের উৎস আর কখনো শুকোবে না; কারণ, প্রকৃতিই যুগে যুগে শিল্পীকে শিল্প- সৃষ্টির উপাদান জুগিয়ে এসেছে।

শেষ কথা এই যে, বৎসরের কোনো-এক সময়ে বিদ্যালয়ে একটি শিল্পস্বষ্টির উৎসব করতে হবে। তাতেপ্রত্যেক শিক্ষার্থী কিছু না কিছু শিল্পবস্তু নিজের হাতে তৈরি করে এনে শ্রদ্ধার সঙ্গে যোগ দেবে- তা, সে শিল্পবস্তু যতই সামান্য হোক। ছেলেদের সৃষ্ট শিল্পবস্তুগুলি উৎসবের অর্ঘ্যরূপে সংগৃহীত হয়ে সাজানো থাকবে। নৃত্যগীত শোভাযাত্রা প্রভৃতির দ্বারা উৎসবটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলবার চেষ্টা করা দরকার। উৎসবের নির্দিষ্ট একটা কালনির্ধারণ করা শক্ত, দেশভেদে সেটা বদলাবে। বাংলাদেশে শরৎ- কালই প্রশস্ত মনে হয়।

আমরা যতদূর জানি তাতে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ কলাচর্চাকে উপযুক্ত স্থান দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির ব্যবস্থায় তিনিও পদে পদে বাধা পেয়েছেন। কলাচর্চার স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকায় অভিভাবকগণ কলাচর্চাকে অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় বোধ করেন; ফলে যে-সমস্ত ছেলেদের ছোটোবেলায় নানা কলাবিদ্যার চর্চায় বিশেষ অনুরাগ দেখা গেছে তারাও প্রবেশিকা পরীক্ষার দু-এক বৎসর আগে থেকে কলাচর্চার অপ্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সজাগ হয়ে ওঠে এবং তাদের শিল্পানুরাগ এই সময় থেকে কমতে কমতে অবশেষে একেবারেই তিরোহিত হয়। এ বিষয়ে আমাদের সকলপ্রকার-জ্ঞানচর্চার-কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহিত হবার সময় এসেছে।

এই প্রসঙ্গে আর-একটি কথা বলতে চাই। যে-সমস্ত সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক অপরিণত হাতের কাঁচা কাজ কোনো বিশেষ ধারার শিল্পের নাম করে বাজারে বার করেন তাঁদের রুচিহীনতার অন্য নিন্দা না করে কেবল এই বললেই যথেষ্ট হবে যে, ভালো নূতন ছবি না পেলে তাঁরা বরং ভালো পুরাতন ছবি ছাপাবেন, কিন্তু বন্ধুত্বের বা আত্মীয়তার খাতিরে লোককে ভ্রান্তপথে চালিয়ে অপরাধী হবেন না। চিত্রনির্বাচনে সমঝদার সৌন্দর্যবোধ- সম্পন্ন লোকের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হলে নিতে হবে; কারণ, লোক- শিক্ষার ক্ষেত্রে সাময়িক পত্রসমূহের ভালো বা মন্দ প্রভাব বিস্তার করবার শক্তি সামান্য নয়।

মোটকথা, শিল্প সম্বন্ধে শিক্ষিত সমাজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔদাসীন্য কমলেই শিল্পচর্চার প্রসার হবে এবং ফলে দেশবাসীর সৌন্দর্যবোধ এবং পর্যবেক্ষণশক্তি বাড়বে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

 

বক্তৃতাটি বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত ‘শিল্পকথা’ বই থেকে সংগৃহীত

প্রবন্ধগুলি নন্দলাল বসু তাঁর শিক্ষক

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’কে উৎসর্গ করেছেন,

সাথে শিল্পবন্ধুদেরও।

 রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন