Site icon CPI(M)

Modi Government and The PSU’s: The Story (Part I)

PSU Cover 1

বাবিন ঘোষ

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের উদ্ভব

আমেরিকা’র মুক্তিযুদ্ধের বছর, অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে অ্যাডাম স্মিথের বিখ্যাত বই “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations” প্রকাশিত হয়। স্মিথের এই বই প্রকাশিত হওয়ার আগে অবধি শিল্প বিপ্লবোত্তর পশ্চিম ইউরোপ অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে মানসিকতা নিয়ে চলেছিল’, তা হল’ তাদের দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে উপনিবেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকা যাতে অর্থনীতির আয়তনগুলো বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে সে সময়ের এই সকল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলি তাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে উপনিবেশ থেকে অর্জিত (লুন্ঠিত) সম্পদের কোনো সুষম বন্টনের কথা ভাবেনি, বরং শুধু এইটুকুই ব্যবস্থা রেখেছিল’ যাতে বিক্ষুব্ধ মানুষের সংঠিত ক্ষোভ কোনো ভাবেই কায়েমী স্বার্থসমূহকে খুব বেশি  চ্যালেঞ্জ না করে এবং পুঁজিবাদী উৎপাদনের গতি অব্যাহত থাকে। এই গোটা নীতির মধ্যে “জাতীয় স্বার্থ” নির্ধারণ করার মাপকাঠি ছিল রপ্তানি বৃদ্ধি করে আমদানী কমানোয়। রপ্তানী কে উৎসাহ দেওয়া হত’ আর আমদানীর উপর বাড়তি হারে কর বসানো জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অন্যতম উপায় মানা হত’। স্মিথের উপরোক্ত লেখায় এই গোটা ধারণাটাকে ধাক্কা মারা হল’। ব্যাক্তি-স্বার্থ, শ্রমবিভাজন এবং বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো রকম দেওয়াল-বিহীন খোলা বাজার, এই তিন স্তম্ভের উপর একটি দেশের অর্থনীতির “সীমাহীন” উন্নতি দাঁড়িয়ে আছে, এমনটাই ঐ বিখ্যাত লেখার মূল প্রতিপাদ্য। এতকাল একটি দেশের অর্থনীতি কে যেমন “সীমিত” একটি ধ্রুবক ভাবা হত’, স্মিথের দর্শন তাকেই খন্ডন করে “সীমাহীন” প্রতিপন্ন করতে চাইল’। এই সীমাহীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি হল’ বাণিজ্যিক বিনিময় এবং অর্জিত মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ। এই গোটা প্রক্রিয়ায় অন্যতম উপাদান হল’ “ব্যাক্তিস্বার্থ” অর্থাৎ ব্যাক্তির তরফে তার মুনাফার সর্বোচ্চায়নের আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খাকে “লোভ” বাদে অন্য কিছু বলা সম্ভব না। কিন্তু স্মিথ ব্যাখ্যা করলেন যে এই লোভ-ই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। যত  বেশি এই লোভ, তত বেশি অর্থনীতির গতিপ্রাপ্তি এবং তার ফলেই অর্থনীতির সকল অংশের, এমন কী, শ্রমিক/মজদুরদের ও স্বার্থ সিদ্ধি ঘটে। আধুনিক পৃথিবীতে, ফরাসি বিপ্লবের দর্শনের অনেকখানি বিপ্রতীপে স্মিথের এই দর্শন প্রতিষ্টিত হল’। মানুষের সাথে মানুষের সাম্য-মৈত্রীর পরিবর্তে ব্যাক্তি মানুষদের মধ্যেকার সম্পর্কের বুনিয়াদ হিসাবে সামনে আনা হল’ ব্যাক্তি’র মুনাফার প্রতি অদম্য আকাঙ্খাকে। বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ কে পুঁজিবাদ সাদরে গ্রহণ করল’ তার বনেদ হিসাবে। ব্যাক্তির এই “স্বার্থ” নির্ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র সেই ব্যাক্তির, অর্থাৎ রাষ্ট্রের এক্তিয়ার নেই কোনো ব্যাক্তির হয়ে এই “স্বার্থ” নির্ধারণ করার। বিষয়টা দাঁড়ালো যে রাষ্ট্রের এক্তিয়ার নেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনোরকম হস্তক্ষেপের, এবং সেই কারণে পুঁজিবাদ ব্যাক্তি-স্বাধীনতার সমার্থক। এর সাথে যুক্ত হল’ শ্রমবিভাজনের নীতি। সকল শ্রমিককে কোনো পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদনের সকল অংশের কাজ করার প্রয়োজন নেই, বরং কোনো একটি খন্ডাংশের উপর তার ব্যুৎপত্তি জন্মালেই তা যথেষ্ট। উৎপাদক, অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর তার শ্রমের ফলে উৎপাদিত ফলের থেকে বিচ্ছিন্নতার একটি কারণের জন্ম হল’ এই দর্শনে। স্মিথের দর্শন জন্ম দিল’ পরবর্তীতে রাষ্ট্রের নীতির, যা অর্থনীতিকে “রাষ্ট্রীয়ু হস্তক্ষেপের” বাইরে রাখবে। এই “উদারনীতি” একটা বড় সময় ইউরোপীয় অর্থনীতির দর্শন হিসাবে গৃহীত হল’। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল’ চুক্তির স্বাধীনতা (“ফ্রীডম অফ কন্ট্র্যাক্ট”) কে শুধুমাত্র enforce করার শক্তি হিসাবে। এ বিষয়ে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে প্রণীত ইন্ডিয়ান কন্ট্র্যাক্ট এক্ট উল্লেখযোগ্য। এর আগে মুঘল আমলে এবং কোম্পানীর রাজত্বকালে দেখা যায় যে সম্রাট বা কোম্পানীকে প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়িক চুক্তির ক্ষেত্রে হয় অংশীদার রাখতে হত’ নয়তো চুক্তির স্তরেই সেই চুক্তির ফলে সম্ভাব্য আর্থিক লভ্যাংশের খানিকটা কর হিসাবে দিতে হত’। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের কন্ট্র্যাক্ট এক্ট রাষ্ট্র/ প্রশাসন কে শুধুমাত্র যে কোনো চুক্তির enforcer হিসাবে দাঁড় করালো। উল্লেখযোগ্যভাবে, স্মিথ নিজেও বেশ খানিকটা ওয়াকিবহাল ছিলেন যে তার এই দর্শনে সমাজে আর্থিক বৈষম্য বড় আকার নেবে। এ বিষয়ে “ওয়েলথ অফ নেশন্স” বইয়ের পঞ্চম খন্ডের প্রথম পরিচ্ছদে তিনি লিখেছিলেন যে বৃহৎ সম্পদ অবশ্যম্ভাবী ভাবেই বৃহৎ বৈষম্যের জন্ম দেবে এবং মুষ্টিমেয় মানুষের প্রাচুর্য্য বৃহৎ সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য ব্যাতিরেকে সম্ভব হবে না।  এই বই লেখার মাত্র এক শতকের মধ্যেই শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলি অনুভব করল’ যে এই উদারনীতি আর্থ-সামাজিক বৈষম্যসঞ্জাত অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে যার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটল’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসেদের বিদ্রোহ যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ঘটল’ আমেরিকার গৃহযুদ্ধে এবং ক্রীতদাসত্বের অবসানের মধ্যে দিয়ে।

১৭৭৬ থেকে ১৮৭৬ এই একশো বছরের সময়কালে পৃথিবীর রাজনৈতিক/সামরিক এবং তার সাথে সাথে বৌদ্ধিক ইতিহাসেও বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছিল’। অষ্টাদশ শতকের শেষে ফরাসী বিপ্লব, ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ সাল অবধি অবিরত “নেপোলিয়নিক যুদ্ধ”, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে “মানরো ডক্ট্রিনের” ঘোষণার মাধ্যমে পশ্চিম গোলার্ধে সরাসরি মার্কিণ আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের পশ্চাদপসরণ, ভারতের ইঙ্গ-মারাঠা এবং ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধসমূহ, ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ, প্যারি কমিউন, ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, প্রাচ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে গেছিল। এই প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে “লাইজিফেয়ার” পুঁজিবাদের অভাবনীয় উৎপাদনী সংগঠনের সাথেই তার ভয়ঙ্কর আগ্রাসী দিকও পরিলক্ষিত হল’। উৎপাদন ক্ষমতা এবং প্রযুক্তির মারাত্মক উল্লম্ফনের ফলে যুদ্ধ’ও হয়ে উঠল’ আগের সকল সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি ধ্বংসাত্মক। বল্গাহীন পুঁজিবাদের লাগামাছাড়া শোষণ এবং ধ্বংসাত্মক রূপ, প্রতিক্রিয়ায় জন্ম দিল’ পুঁজিবাদ-বিরোধী দর্শনের ও। নৈরাজ্যবাদ, ইউটোপিয়ান সমাজবাদ, নারোদবাদ যেমন ইউরোপের খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থন লাভ করতে শুরু করল’ ঠিক তেমনই এই উপমহাদেশে হিন্দু পুনরুত্থানবাদ এবং প্যান-ইস্লামিজমের পক্ষেও সমর্থন বাড়তে শুরু করল’। ভারতে একই সাথে ব্রিটিশ সরকার গৃহীত পুঁজিবাদের সহায়তাকারী ঔপনিবেশিক কৃষি নীতি (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা বলপূর্বক নীল চাষ) সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মত কৃষক বিদ্রোহের জন্ম দিতে থাকল’। এই সকল রাজনৈতিক বিরোধীতার অন্যতম আদর্শগত বুনিয়াদ ছিল “ব্যাক্তিস্বার্থ”-এর বিপ্রতীপে সমাজনীতিতে সমষ্ঠিগত পরিচয়, অধিকার এবং তার প্রয়োগ। প্রভেদ ছিল’ “সমষ্ঠির” নির্মাণে। ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদের ক্ষেত্রে এই “সমষ্ঠির” সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়ালো জন্ম পরিচয় এবং সেই পরিচয়ের জন্য এক অভিন্ন জীবনশৈলীর পক্ষে প্রচার (হিন্দু পুনরুত্থানবাদের ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদ, ইস্লামিক পুনরুত্থানবাদের ক্ষেত্রে ওয়াহাবিজম/ সালাফিজম)। নারোদবাদের ক্ষেত্রে প্রাক-পুঁজিবাদী রাশিয়ার কৃষি নির্ভর গ্রাম সমাজের সমষ্টিগত যাপন হল’ এই “সমষ্ঠির” কল্পিত চেহারা। নৈরাজ্যবাদ এবং ইউটোপিয়ান সমাজবাদের ক্ষেত্রে (দুটি’র মধ্যে মতাদর্শগত প্রভেদ এবং রাজনীতির পন্থার ও বহু প্রভেদ) ভৌগলিকভাবে একই স্থানে কর্মরত শ্রমিকদের ছোট ছোট গোষ্ঠীর হাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকানার (রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বাদ দিয়েই) মধ্য দিয়ে এই “সমষ্ঠির” নির্মাণ।

“ব্যাক্তিস্বার্থ” বনাম “সমষ্ঠির” এই বৌদ্ধিক/ রাজনৈতিক লড়াইয়ে সবচাইতে গুরুত্ত্বপূর্ণ অবদান রইল’ মার্ক্সবাদের। ১৮৪৪ এর “ইকোনমিক এন্ড ফিলজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস” থেকে ১৮৪৮ এর কমিউনিস্ট ইশ্তেহার হয়ে ১৮৫৮ অবধি রেখে যাওয়া “গ্রুণ্ডরিশে” অবধি মার্ক্স-এঙ্গেলস পুঁজিবাদ বিরোধী একমাত্র বৈজ্ঞানিক দর্শনের জন্ম দিলেন এবং ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথেই উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে এবং সেই পরিবর্তিত সম্পর্ক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে একমাত্র পুরাতন সম্পর্ককে ধ্বংসের মাধ্যমেই। ইংল্যান্ডের ক্রমওয়েলের নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া বিপ্লব কিংবা ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি’র পেছনে সামন্তবাদের উচ্ছেদে পুঁজিবাদের উৎপাদন সম্পর্কের ভূমিকা ব্যাখা করল’ মার্ক্সবাদ। মার্ক্স-এঙ্গেলস দেখিয়ে দিলেন যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মূল নীতিসমূহ সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং সেই নিয়মে সমষ্ঠিগত উৎপাদনের উপর ব্যাক্তিগত মালিকানা আদতে এক absurdity সৃষ্টি করে, যা কিনা শ্রেণীদ্বন্ধের জন্ম দেয়। সেই দ্বন্ধের কারণসমূহ দেখিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই সেই দ্বন্ধের নিরসনের রাস্তাও তাঁরা দেখালেন যা কিনা এক শ্রেণীর (সর্বহারা) দ্বারা কায়েমী ক্ষমতাবান শ্রেণী (বুর্জোয়া) কে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করে অর্জন করা সম্ভব নয়। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব সেই বৌদ্ধিক সিদ্ধান্তকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করে গোটা দুনিয়া কে দেখিয়ে দিল’ যে শ্রেণী রাজনীতি নৈরাজ্যবাদ এবং ইউটোপিয়ান সমাজবাদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এক সমষ্ঠি-কেন্দ্রিক রাজনীতি। এসবের মধ্যে দিয়েই আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে সবচাইতে শক্তিশালী পুঁজিবাদ বিরোধী মতাদর্শের জন্ম হল’ যেখানে “সমষ্ঠির” সংজ্ঞা হল’ “শ্রেণী”। একটি সমাজের সকল উৎপাদন সম্পর্কের যোগফল হল’ সেই ভিত্তি যার উপর তার সংস্কৃতি, প্রশাসন, রাজনীতি সব কিছুর উপরিকাঠামো নির্মাণ হয়। এই ব্যাখ্যাই মানব সভ্যতার ইতিহাসের বস্তুবাদী সারমর্ম।  

সোভিয়েত রাশিয়ার নির্মাণ, তার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নির্মাণ, সেই নির্মাণের উপর ভর করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার তাক লাগানো বিজয়, এ সবই বল্গাহীন পুঁজিবাদকে ক্রমাগত প্রশ্ন এবং চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়। কল্পনা থেকে সূত্রায়ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাস্তবের মাটিতেও যে “ব্যাক্তিস্বার্থ” দ্বারা মুনাফার লোভে চালিত পুঁজিপতিদের বাদ দিয়ে একটি আধুনিক অর্থনীতির নির্মাণ সম্ভব, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার সম্ভব, সাংস্কৃতিক ঔৎকর্ষ সম্ভব, তা বলশেভিক বিপ্লব দেখিয়ে দিল।

রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণীর এই উত্তরণ, তাদের দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীকে সন্ত্রস্ত করল’ এবং তারা সতর্ক হতে শুরু করে শ্রেণী রাজনীতির নতুন এই শক্তিকে দেখে। আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্ধের ফলে সৃষ্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে আর্থ সামাজিক ভাবে বিদ্ধ্বস্ত ইউরোপের শাসকশ্রেণী’র চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বলশেভিক বিপ্লব ইউরোপীয় পুঁজিবাদকে খানিক মানবিক  হতে বাধ্য করল’ তাদের দেশেও বলশেভিক উপদ্রব কে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। সার্বজনীন ভোটাধিকার, সামাজিক সুরক্ষার খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ এবং বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সরকারি দায়বদ্ধতা এ সময়ে রূপায়িত হতে শুরু করে। তবে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির এই সকল জনহিতকর ব্যবস্থা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের দেশেই রূপায়িত করা হয়, তাদের আফ্রো-এশীয় বা লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে এর ছিটেফোঁটাও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯২৯ সালের পুঁজিবাদী মহামন্দা আবারো বাধ্য করল’ পশ্চিমী শিল্পন্নত রাষ্ট্রগুলিকে বল্গাহীন পুঁজি আর খোলা বাজারের হাতে দেশের মানুষের বাঁচামরা ছেড়ে না রাখতে। সামাজিক সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি শ্রমিক/কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে বেশ কিছু অধিকারকে স্বীকার করতে বাধ্য হল’ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশের সরকার। জণকল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই প্রথম দিকের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প গ’ড়ে উঠতে শুরু করে। অথবা এভাবেও দেখা সম্ভব যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন ব্যবস্থাই জণকল্যাণকামী রাষ্ট্রর বুনিয়াদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হল’।  এই সময়ের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্সের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা জেনেরাল থিওরি অফ এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এন্ড মানি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হল’। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন এবং প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করলেন কেইন্স, যার মূল ভাবনা ছিল প্রথমতঃ মন্দার মোকাবিলায় বাজারের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করতে শ্রমনিবিড় শিল্প/ পরিকাঠামো প্রকল্পে সরকারি ব্যায়বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং বাজার তেজি থাকার সময় আয়ের উপর কর বৃদ্ধি করে মুদ্রাস্ফীতিকে প্রতিরোধ করা। কেইন্সীয় নীতির প্রয়োগে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের প্রয়োজন আরো বৃদ্ধি পেল’ সরকারের তরফে দ্রুত এবং বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপের স্বার্থে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্টের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাট পার্টির সরকার তাদের নিউ ডীল নীতির আওতায় বিদ্যুৎ এবং রেল কে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রে এনে “টেনেসি ভ্যালি অথরিটি”র মত অতিবৃহৎ সরকারি বিদুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে সুলভে বিদ্যুৎ যোগান দিতে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করতে। ১৯৪৫ সাল থেকে পরবর্তী প্রায় ৬ বছরের মধ্যে ক্লিমেন্ট এটলি’র নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির সরকার ব্রিটেনে কয়লা, বিদ্যুৎ, রেল এবং ইস্পাত শিল্প কে জাতীয়করণ করে। উল্লেখ্য যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী প্রায় আড়াই দশকের ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার আর্থিক পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে এই সকল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প বড় ভূমিকা পালন করে। সাতের দশকের শুরু থেকে পশ্চিমী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে ব্যাক্তিপুঁজি ঠিক যে মুহুর্তে আবারো শক্তিশালী হতে শুরু করে, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধীতাও শুরু হয় তাদের তরফে কারণ বিবিধ পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের উপস্থিতি তাদের মুনাফা বৃদ্ধি করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। শুরু হল’ রোনাল্ড রেগান-মার্গারেট থ্যাচারদের নেতৃত্বে বেসরকারিকরণের যুগ এবং রাষ্ট্রের জনকল্যাণকামী ভূমিকা থেকে পশ্চাদপসরণ।

তথ্যসূত্রঃ

1. Public Sector Enterprises in India: Evolution, Privatisation and Reforms; Govind Bhattacharya (2020); SAGE Publications.

2. The Wages of Destruction: The Making and Unmaking of the Nazi Economy; Adam Tooze (2206); Allen Lane.

3. CPIM Party Programme

4. Website of Department of Investment and Public Asset Management (DIPAM)

5. “Government Not in Business”; The Print (2022); TCA Sharad Raghavan

দুই পর্বে প্রকাশিত। দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

শেয়ার করুন