স্বাধীনতা পূর্ব ভারত। বর্ধমানের একটি শিক্ষিত ছেলে সরকারী চাকরি ছেড়ে যোগ দিল সত্যাগ্রহে। মহাত্মার আহ্বানই তাকে উজ্জ্বল জীবনে মোহ ত্যাগ করতে সাহস যুগিয়েছিল। নিজের জেলায় খিলাফৎ কমিটির সম্পাদক, আবার একই সাথে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য। উত্তরবঙ্গের আত্রেয়ী নদীর জলে বাণভাসি মানুষকে বাঁচানো ও ত্রানের কাজে ইতিমধ্যেই পরীক্ষা দিয়েছে, ভালোভাবে পাশও করেছে। ভবিষ্যতের উন্নততর সমাজসেবি হিসাবে নিজেকে গড়েপিটে নেওয়ার কাজ চলছে।
নিজের ইচ্ছায় গান্ধীজী সারা দেশের অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন, সত্যাগ্রহ সম্পর্কে মোহ কেটে গেল। জীবন ও সত্যের গভীরতর উপলব্ধি অনুসন্ধানে সেই ছেলে পাড়ি দিল লাহোর। উদ্দেশ্যে সেখানকার আহমদিয়া মিশন থেকে ইসলামের ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষাগ্রহণ। পড়াশোনার জন্য লাহোরে প্রায় চার বছর বসবাস, থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাতে ‘দ্য লাইট’ পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ। নতুন জগতের আলো এসে লাগল চোখে।
সেই সময় লাহোরের মানুষজন এক বিশেষ ‘কালচার’এ অভ্যস্ত ছিলেন। প্রতিদিনকার নমাজ পাঠ সেরে ছোট ছোট দল বেঁধে হাঁটতে বেরোতেন সবাই, সকাল আর বিকালের সময়টাতে। সেই হাঁটার সাথেই চলত ধর্ম থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ, আলোচনা – বিতর্ক। রীতিমত পন্ডিত হিসাবে পরিচিতজনেরাও এমন হাঁটার অভ্যাসে সাধারণের পাশেই চলতেন। এমন কালচার’ শিখে নিতে দেরি করেনি সে। বিভিন্ন আলোচনায় ঢুকে পড়া শুরু হল, কথা শোনা থেকে কথা বলা অবধি এগিয়ে যাওয়ার পথেই হাতে এল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য থিংকার’ – তাতেই লেনিনের লেখা বই ‘মেটিরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও ক্রিটিশিজম’র রিভিউ ছেপে বেরোয়। এরই সাথে দৈনিক হাঁটাচলার কালচারে পরিচিতদের থেকে সোশ্যালিজম ও অর্থনীতি সম্পর্কিত আরও কিছু বই পড়াও হল। আকাশের দিকে চেয়ে মাটির উপরে চলা যুদ্ধের দিশা খুঁজতে বর্ধমান থেকে লাহোর গিয়েছিল যে, সে কলকাতায় ফিরে এল মানুষের লড়াইতে মানুষকে সংগঠিত করে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে স্থিত হয়ে।
এই ছেলেই মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যার পরিচয় রসুল সাহেব বলে।
বর্ধমানের মেমারি থানা এলাকার সালদা গ্রামে মামাবাড়িতে ১০ই জুন, ১৯০৩ সালে জন্ম হয় মহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুলের। বাবা আবদুল কাদের, মা সুফিয়া খাতুন। মেমারিতেই বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির বিদ্যালয়ে পড়াশোনা, দাদা ওহাজুর রসুল তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। তারই সাথে মামা গনি সাহেবের কাছ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মশিক্ষা। পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে দেবীপুরে শিক্ষকতা, পরে এ জি বেঙ্গলে সরকারী চাকরি।
লাহোরে থাকতেই সিদ্ধান্ত নেন আসলে যাদের দেশ তাদের সাথে থেকেই লড়াই করতে হবে। কলকাতায় ফিরে আরেকবার কংগ্রেসের সাথে যোগাযোগ, প্রথমে ‘খাদেম’ পরে ‘বম্বে ক্রনিকল’ পত্রিকার কলকাতার করেস্পন্ডেন্ট। লন্ডনে গান্ধী- আরউইন বৈঠক ব্যর্থ হলে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়, এবার গ্রেপ্তার এবং ছয় মাস কারাবাস। জেলে বসেই কার্ল মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’র ১ম খন্ড পড়ে ফেলেন এবং আগামী লড়াইতে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কৃষক আন্দোলনের সাথে চেনা-জানা, লড়াইয়ের ময়দানে থেকেই লড়াই শেখার শুরু। ১৯৩৮’এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ। বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলায় দিনের পর দিন হাজির থেকে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ, তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস নির্মাণের সৈনিক হয়ে ওঠা। সেই চঞ্চলস্বভাব তার সারা জীবনেও কাটেনি, মুজফ্ফর আহ্মদের ভাষায় ‘ওর খড়মের তলায় চাকা লাগানো, বসে থাকতে পারেন না। সারাক্ষণ এ জেলায়, ও জেলায় ঘুরে বেড়ান’।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গাকারিরা চেষ্টা করছে সেই বীভৎসাকে রাজ্যের সব জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার। কলকাতা থেকে দু মাইল দুরে কুমিল্লার হাসনাবাদ গ্রাম, সেখানকার কৃষকসভার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত যাই হয়ে যাক না কেন, এখানে দাঙ্গা হতে দেব না। ইতিমধ্যেই যারা দাঙ্গায় সব হারিয়েছেন তাদের আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার। কৃষকসভার যুগ্ম সম্পাদক তখন রসুল সাহেব। দাঙ্গার ইতিহাস যেমন রয়েছে, তার উল্টোদিকে মানুষের সম্প্রীতির ইতিহাসও আছে, আর আছে সেই ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা।
মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল একইসাথে কৃষকসভার রাজ্য এবং সর্বভারতীয় সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এভাবে কাজে অসুবিধা হয় বলে সর্বভারতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে নেন। কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করেছেন দুইভাবে, প্রথমে হাতে-কলমে সংগ্রামের ময়দানে, পরে শুধু কলমে ‘হিস্টরি অফ অল ইন্ডিয়া কিষাণসভা’ লিখে। এছাড়াও লিখেছেন মার্কসীয় অর্থশাস্ত্রের বই, সাঁওতাল আন্দোলনের ইতিহাস থেকে শুরু করে ‘গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে’ নামে উপন্যাস অবধি। লাহোরে থাকতে লেখাপড়ার যে অভ্যাস রপ্ত করতে হয়েছিল আন্দোলনের পথে তাকেই কাজ লাগিয়েছেন সারা জীবন। জেল খেটেছেন, আত্মগোপন করছেন, আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ-মিলিটারির হাতে। পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের জমানাতেই পথ চলা শুরু করে ‘লেখক-শিল্পী সংঘ’, এর অন্যতম স্থপতি ছিলেন রসুল সাহেব, তারই সঙ্গে জ্যোতি বসু।
কৃষকসভার প্রতিনিধি হয়ে বার্মা, পাকিস্তান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভাকিয়া এবং ইরাকে গেছেন। পরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে গেছেন সিরিয়া। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীও হয়েছেন।
পাজামা আর বাড়তি পট্টি দিয়ে সেলাই করা পাঞ্জাবি পরে ৯নং দিলখুশা স্ট্রীটের কমিউনে থাকতেন, কমিউনিস্টদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় সহজ-সরল জীবন যাপনকে শেখার বিষয়ে পরিণত করেছেন যারা তাদেরই একজন ছিলেন আবদুল্লাহ রসুল।
আত্মত্যাগ কখনো কখনো মোহেরও জন্ম দেয়। ত্যাগের মহিমা কখনো বাড়িয়ে তোলে গর্বের অনুবভব। এই সত্য জানতেন বলেই বোধহয় আত্মজীবনীতে নিজেকে ‘হারানেপরাণে’ বলে মস্করা করে গেছেন।
সৌভিক ঘোষ