Mandella 1

লড়াইয়ের নক্ষত্র: মাদিবা ( ১ম পর্ব)

সমন্বয় রাহা

‘প্রতিটি কাজই শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত অসম্ভব বলে মনে হয়’— দীর্ঘ ২৭-বছরের কারাজীবনে শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের ব্লু প্রিন্ট তৈরির সময় এমনই ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার চিন্তা। আদতে তাঁর লড়াই শুরু হয়েছিল আরও আগে। আফ্রিকার শোষিত মানুষের লড়াইয়ের আকাশের ‘মাদিবা’, বাংলায় যার মানে ‘নক্ষত্র’।

ম্যাণ্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে, ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সকি অঞ্চলে। বাকি আর পাঁচটা কৃষাঙ্গ শিশুর মতোই তার বড় হয়ে ওঠা চরম দারিদ্র ও শোষণের সাথে লড়াই করতে করতে। কিন্তু মাদিবা বড় হয়ে যে লড়াইটা লড়লেন এবং জিতলেন, তা তাঁকে আলাদা করে স্মরনীয় করে তুললো। আইনের ছাত্র হওয়ার সুবাদেই তিনি আরো ভাল করে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করলেন বর্ণবৈষম্য, বিভেদ, শোষণের চিত্রগুলি— সর্বোপরি রাষ্ট্রের শোষণ। ১৯৪৪, তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাথে সরাসরি যুক্ত হন। এবং শোষণ বিরোধী, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সারাদেশের মানুষকে যেভাবে তিনি সংগঠিত করছিলেন তাতে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীন দল তাঁকে ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এবং প্রথম ১৮-বছরে রবসন দ্বীপে বন্দি থাকেন। এবং পরবর্তী ৯ বছর নিজের দেশে বন্দি থাকেন। ১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন।

ম্যান্ডেলা স্বপ্ন দেখতেন পৃথিবীকে শোষণের কারাগার থেকে মুক্তি করার, শোষণের পৃথিবীতে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম বড় শোষণের অস্ত্র হল বর্ণবৈষম্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করার জন্য নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করতে চায়।পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির মাধ্যমে গায়ের চামড়ার রঙের পার্থক্যকে কেন্দ্র করেই বর্ণবৈষম্য। আসলে বর্ণবৈষম্যের মাধ্যমে পুঁজিবাদীরা নিপীড়িত শোষিত মানুষের বৃহৎ ঐক্যকেই ভাঙতে চায়। মানুষের গায়ের চামড়ার রঙ যা কিনা সম্পূর্ণ রূপে জিন ও ভৌগোলিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল তাকে কেন্দ্র করে শোষণ। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন এ পৃথিবীতে নিজের কায়েম টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবেও শোষণ করছে। আমেরিকার বুকে দু’বছর আগে প্রকাশ্য রাস্তায় কালো চামড়া হওয়ার ‘অপরাধে’ খুন হতে হয় জর্জ ফ্লয়েডকে।

ম্যান্ডেলা সেই শোষণ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে শুধু নিজের দেশের মানুষের মুক্তির কথা ভেবেই ক্ষান্ত থাকেননি। বরং তিনি সারা পৃথিবীতে নানা জায়গায় শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।

প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েলের আগ্রাসন আজকের না। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে গত শতাব্দী থেকেই এই দখলদারি চলছে। গাজা স্ট্রিপে ইন্তিফাদা বা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য একই। মানুষের মুক্তি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নেলসন জানিয়েছেন প্যালেস্তাইনের পাশে তিনি আছেন এই লড়াইতে। আমেরিকার বুকে দাঁড়িয়ে সোচ্চারে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে ম্যান্ডেলা বলেছেন কমরেড আরাফতের পক্ষে।প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ। গাজা স্ট্রিপে ইজরায়েল দখলদারি থেকে মুক্ত করার দাবিতে সরব হয়েছেন।

তাঁর এই অবদানের কথা স্মরণ করে প্যালেস্তাইনে নেলসন আসলেই যুদ্ধবিরোধী ‘আইকন’—পুঁজিবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া আইকন না। সমাজের নিপীড়িত মানুষের লড়াকু সহজাত আইকন। তিনি বলছেন লাতিন আমেরিকার কিউবার কথা। ফিদেল কাস্ত্রোর কথা। শোষিত মানুষের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করা ফিদেলের সাথে যেন নেলসন নিজের লড়াইকে সম্পৃক্ত করছেন। আসলেই ফিদেল আর নেলসন একই অংশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

ভারতবর্ষের সাথে ম্যান্ডেলার সম্পর্ক বরাবরই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। ম্যান্ডেলা ১৯৯০ তে প্রথম অভারতীয় হিসাবে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন গ্রহন করেছেন।

পৃথিবী ঘুরছে তার নিজের নিয়মে। বিজ্ঞান মেনে। তাই এই পৃথিবীর সৃষ্টি কোনও ভগবানের বদান্যতায় নয়, কোনও দৈবিক শক্তিতে নয়। পৃথিবীর সৃষ্টির নিয়মও বিজ্ঞান অনুসরণেই।

যারা এই পৃথিবীর শোষণের কারাগার গুলিকে ভেঙেছেন, তাঁরাও কোনো ফরিস্তা নন! পয়গম্বরও নন। তারা সাধু সন্ন্যাসীও নন। মানুষ! রক্ত মাংসের মানুষ। নেলসন ম্যাণ্ডেলাও রক্ত মাংসের মানুষ।

বারবার তাঁর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে তিনি বামপন্থী কিনা। আরো স্পষ্ট করে বললে কমিউনিস্ট কিনা।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন


শেয়ার করুন

উত্তর দিন