চন্দন দাস
রাজ্যের সেচ দপ্তরকে চিঠি লিখেছিলেন সন্দেশখালির খুলনা পঞ্চায়েতের প্রধান রিন্টু সান্যাল। লিখেছিলেন প্রায় ৬ মাস আগে। জবাব তো দূরের কথা, চিঠির প্রাপ্তি স্বীকারও জোটেনি তাঁর নিজের দলের সরকারের থেকে।
বিষয়— নদী বাঁধ। বৃহস্পতিবার রিন্টু সান্যাল বললেন, ‘আমার পঞ্চায়েতের শিতুলিয়া সহ কিছু এলাকার প্রায় ৫০০ মিটার নদী বাঁধের খুবই খারাপ অবস্থা। সামনে বর্ষা। বিডিও’র মাধ্যমে বাঁধ মেরামতির জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু হয়নি।’
সন্দেশখালির নাম দেশের মানুষ জানতে পেরেছেন তারপর, তবে নারী নির্যাতনের জন্য। কিন্তু একদিকে সন্দেশখালির জমি লুট করে ভেড়ি বানিয়েছে তৃণমূলের সেখ শাহজাহান, অন্যদিকে সন্দেশখালির নদীবাঁধ লাগাতার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষায়, বানে, জলোচ্ছ্বাসে নদীবাঁধের ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের এই এলাকার।
কাহিনী শুধু খুলনার নয়। এই বিবরণ শুধু সন্দেশখালির নয়। সুন্দরবনের ১৯টি ব্লক এলাকার এটিই অবস্থা। রাজ্যের তিনটি লোকসভায় জড়িয়ে আছে এই ব্লকগুলি। বসিরহাট, জয়নগর, মথুরাপুর— দুই ২৪ পরগনার এই তিনটি লোকসভায় আগামী শনিবার নির্বাচন। পাথরপ্রতিমার জিপ্লটের উপপ্রধান, তৃণমূল নেতা আশিস কুমার বর্মণের কথায়, ‘ভোট পেরোলেই বর্ষা শুরু। তারপর ভাদ্রে ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসবে। আমার পঞ্চায়েতের ২৩টি জায়গায় নদীবাঁধ বিধ্বস্ত। খুব খারাপ অবস্থা। একটি কালভার্টের হালও খারাপ। আয়লার বাঁধের কাজ ২০০৯-১০-এ শুরু হয়েছিল। তারপর কিছু দিন হয়েছিল। কিন্তু পরে বন্ধ হয়ে যায়।
রাজ্যের সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা। তিনি মনে করছেন না সুন্দরবনের বাঁধের দুর্দশা নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলবে। প্রস্তাবিত ৭৭৮ কিমির মধ্যে মাত্র ৮৫ কিমিতে পাকা বাঁধ তৈরি করা গিয়েছে গত ১৩ বছরে, এই কথা মেনে নিয়ে সাগরের বিধায়ক বঙ্কিম হাজরার কথায়, ‘কিছু জায়গায় বাঁধের অবস্থা খারাপ। জল উপচে আসে বাঁধ। তা সাগরে আছে। গোসাবা সহ অন্য এলাকাতেও আছে। কিন্তু তাতে কোনও রাজনৈতিক দলের লাভ কিংবা ক্ষতি হবে না। কারণ মানুষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।’
সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রীর এলাকায় ভাঙন বিধ্বস্ত এলাকা ধসপাড়া সুমতিনগর-১ পঞ্চায়েত এলাকা। প্রধান রাধারানি পাত্র জানা এবং উপপ্রধান অমিত ঘোড়ুই, দু’জনেই অবশ্য জানাচ্ছেন, মাটির বাঁধের হাল খারাপ। চিঠি দিয়েও কোনও লাভ হয়নি। জল ঢুকে ফসলের, বাড়ির ক্ষতি করে। গ্রামবাসীরা খুবই আশঙ্কিত।
সুন্দরবনের নদীবাঁধ তৃণমূলের কাছে ‘সমস্যা’ নয়। বিজেপি’র ১৮ জন সাংসদও গত পাঁচ বছরে সুন্দরবনের ১৯টি ব্লকের কয়েক লক্ষ মানুষের এই অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেননি। বামফ্রন্ট লাগাতার এই দাবিতে আন্দোলন করেছে। পার্টির দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সম্পাদক রতন বাগচীর বক্তব্য, ‘দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের কাছে আয়লার পরে সুন্দরবনের পাকা বাঁধের জন্য সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। মমতা ব্যানার্জি সেই প্রতিনিধিদল বয়কট করেছিলেন। এমনকী সেই সময়ে তৃণমূলের মথুরাপুরের সাংসদ চিঠি লিখে রাজ্যকে যাতে টাকা না দেওয়া হয়, সেই দাবি জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। আজ সুন্দরবনের মানুষের বাঁধের সমস্যা ওদের কাছে গুরুত্বহীন হবে, সেটিই স্বাভাবিক। আমরা বাঁধের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব। কেন্দ্রে ইন্ডিয়া মঞ্চের সরকার হলে সুন্দরবনের এই সমস্যা সমাধানে আমরা পুরোদস্তুর চেষ্টা চালাবো।’
২০০৯-১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। সেবার গ্রামবাসীদের ‘জমি কেড়ে নেওয়া হবে’ বলে ভুল বুঝিয়ে পোক্ত বাঁধের কাজে বাধা দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জির দলের নেতারা। শুধু তাই নয়, রাজ্যকে টাকা দিতে বারণ করে চিঠি দিয়েছিলেন তৃণমূলের সাংসদ। মমতা ব্যানার্জি নিজেও আয়লার পরে কেন্দ্র যাতে ১০০০ কোটি টাকা না দেয়, তার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১১-র মে মাসে মুখ্যমন্ত্রীর কাঙ্ক্ষিত চেয়ারে পৌঁছে গিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। ২০১১-র মে মাসে মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হন। তার কয়েক দিন পর, ৪ জুন মন্ত্রীসভার বৈঠক শেষে সুন্দরবনে জমি অধিগ্রহণ করে পাকা বাঁধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ঘোষণা করেছিলেন, সুন্দরবনে আইলা বিধ্বস্ত এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য জমিদাতা পরিবারের সদস্যদের এক জনকে রাজ্য সরকারের চাকরি দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিল বামফ্রন্ট। আবার ২০১২-র ১ ফেব্রুয়ারি গোসাবার সভাতেও একই ঘোষণা ছিল তৃণমূল নেত্রীর মুখে। কিন্তু এর কিছুই হয়নি।
আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৭৭৮ কিমি পাকা, কংক্রিটের বাঁধ বানানোর পরিকল্পনা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার ৫০৩২ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁধ বানানোর জন্য রাজ্যও ১০ শতাংশ টাকা দেবে বলে কেন্দ্রকে জানিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। ইউপিএ সরকার জানিয়েছিল, রাজ্যকে অন্তত ২৫ শতাংশ টাকা দিতে হবে। সুন্দরবনবাসীর কথা মাথায় রেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই প্রস্তাবও মেনে নেন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জি সুন্দরবনের জন্য টাকা বরাদ্দে কোনও উদ্যোগ নেননি। বাঁধ তৈরির জন্য বামফ্রন্ট সরকার একটি টাস্ক ফোর্সও গঠন করেছিল। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ তুষার কাঞ্জিলাল, বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সেই টাস্ক ফোর্সে। কংক্রিটের বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় তখন। প্রাথমিকভাবে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছিল রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। এরপর কেন্দ্রের টাকা আসতেই শুরু হয় বাঁধ নির্মাণের কাজ। টাকা বরাদ্দের এক বছরেরও কম সময়ে বামফ্রন্ট সরকার বাঁধ মেরামতিতে প্রায় ১৮৫ টাকা খরচ করেছিল।
গত ১৩ বছরে সেই বাঁধের ৮৫ কিমি নির্গাণের কাজ করতে পেরেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। গত দু’বছর সেই কাজ বন্ধ। ইতিমধ্যে ২০১৪-তে বরাদ্দ প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা ফেরত চলে গিয়েছে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতায়। মোদী সরকারও কোনও উদ্যোগ নেয়নি সুন্দরবনে পাকা বাঁধ নির্মাণের।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া