ক্রুপস্কায়া : সংগ্রামী ও শিক্ষাবিজ্ঞানী

লেখকঃ দীপক নাগ

শিক্ষা সমাজের অগ্রগতির চাবিকাঠি — সমাজবদলের হাতিয়ার । তাই শিক্ষা ও শ্রেণিসংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । সমাজের চরিত্র অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় । সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা আর পুঁজিবাদী সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা একরকম নয় । পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা একটি পণ্য । অন্যান্য জিনিসের মতো শিক্ষাকেও চড়া দামে বাজার থেকে কিনতে হয় । যার অর্থ নেই সে শিক্ষা কিনতে না পেরে নিরক্ষর থাকে । কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ।  তাই বিনা খরচায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর লেনিন নজর দিলেন সে দেশে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর । ক্যালিনিন ও লুনাচারস্কি এব্যাপারে প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করলেও লেনিনের ‘কমরেড-ইন-আর্মস’ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিজ্ঞানী নাদঝেদা কনস্টানটিনোভা ক্রুপস্কায়া (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৯-২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯) খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন । শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রুপস্কায়ার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রসংঘের অন্যতম প্রধান সংস্থা ইউনেস্কোর তরফ থেকে তাঁর নামে প্রতি বছর শিক্ষায় বিশেষ অগ্রগতির জন্য কোনো দেশকে পুরস্কার দেওয়া হয় ।

ক্রুপস্কায়া মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিরীশ্বরবাদী ও সাম্যবাদে বিশ্বাসী তাঁর বাবা কনস্টান্টিন ইগনাটোভিচ ক্রুপস্কি-কে হারান । আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর মা এলিজাবেতা ভেশিলেভনা ত্রিশতোভা বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালাতেন । ক্রুপস্কায়া নিজে খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন । মাকে সাহায্য করার জন্য ক্রুপস্কায়াও  ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন । তাই ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি শিক্ষকতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন । পড়া শেষ করার পর ১৮৯১ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ-এ শ্রমিকদের সান্ধ্য রবিবারের স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন । প্রায় ৬০০ শ্রমিককে নিয়ে স্কুল চলতো । এই সময়েই প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বিশেষ দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট করতে বাধ্য হলে মালিকপক্ষ শ্রমিক স্কুল বন্ধ করে দেয় । ক্রুপস্কায়ার নিজের কথায় : “আমরা মার্কসের নাম না করেই শ্রমিক-ছাত্রদের  মার্কসবাদের শিক্ষা দিতাম । মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কঠিন বিষয়কেও কত সহজ করে শ্রমিকদের বোঝান যায় তা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যেতাম । সে সময়ের পরিস্থিতিটাই ছিল শ্রমিকদেরকে মার্কসবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করার পক্ষে অনুকুল”

একটা মার্কসীয় আলোচনা চক্রেই ভ্লাদিমির ইলিচের (লেনিন) সঙ্গে তাঁর পরিচয় । বছর পাঁচেক শিক্ষকতা করার পরেই ১৮৯৬ সালে  কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয় । লেনিনও তখন জেলে । পরে লেনিনকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয় । ১৮৯৮ সালে লেনিনের প্রেমিকা হিসেবে ক্রুপস্কায়া সাইবেরিয়া যাওয়ার আবেদন করেন এবং সেখানেই তিনি লেনিনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।

একজন শিক্ষাবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি শিক্ষা সম্বন্ধে  রুশো ও টলস্টয়ের পদ্ধতিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন । তিনি মনে করতেন শিক্ষাশাস্ত্র একটা বিজ্ঞান ।  টলস্টয়ের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, শুধু গৎবাঁধা শিক্ষায় কোনো ছাত্রের ব্যক্তিত্বের পুরোপুরি বিকাশ ঘটতে পারে না । ছাত্রদের মধ্য থেকে তাদের সবচাইতে ভালো দিকটার পুরোপুরি বিকাশ ঘটানোই একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ । গৎবাঁধা শিক্ষার বাইরের বৃহত্তর জগতটাই সবচাইতে বড়ো শিক্ষাক্ষেত্র । তিনি রাশিয়া ছাড়াও ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের   শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পড়াশোনা করেন । রুশ বিপ্লবের আগেই তিনি শিক্ষা সম্বন্ধে ৪০টির বেশি বই প্রকাশ করেছেন । তারমধ্যে ‘পাবলিক এডুকেশন অ্যান্ড ডেমক্রেসি’ বইটি সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।  তাঁর মতে, “ যতদিন পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষার দায়িত্ব বুর্জোয়াশ্রেণির হাতে থাকবে, ততদিন শিক্ষাকে একটা অস্ত্র হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে । শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই পারে সমাজব্যবস্থা বদলানোর কাজে শিক্ষাকে ব্যবহার করতে”। ক্রুপস্কায়া সারা জীবনে ৩ হাজারের বেশি প্রবন্ধ, প্রচার পুস্তিকা, বই ইত্যাদি প্রকাশ করেছেন । ১১ খণ্ডে তাঁর সংগৃহীত রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে । তাঁর ‘লেনিন স্মৃতি’, ‘লেনিন কীভাবে মার্কস পড়তেন’ ইত্যাদি বইতে লেনিন সম্বন্ধে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে । কারণ পার্টি কমরেড হিসেবে ক্রুপস্কায়া  লেনিনের ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন ।

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি রুশ দেশের শিক্ষা দপ্তরের ডেপুটি কমিশার (মন্ত্রী) হিসেবে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার তত্ত্ব ও তার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । তাঁর মতে সমাজতান্ত্রিক মানুষ তৈরি করতে না পারলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল হতে পারে না । সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার জন্য চাই নতুন চিন্তাভাবনায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক । তাই তিনি শিক্ষকশিক্ষণ পদ্ধতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন । নিরক্ষরতা সমাজের অভিশাপ । তাই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য সরকারকে বিনামূল্যে শিক্ষা, প্রতি এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, বয়স্কদের জন্য রাতের বিদ্যালয় স্থাপন এবং সমস্ত শ্রমিকদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ।  শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা গড়ে তোলার প্রতি নজর দেওয়া, সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা, শিশুকে ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলা, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করা, পলিটেকনিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা, ছাত্র ও অভিভাবকদের  বিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত করা, সবাইকে বই পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পাঠাগার তৈরি করা — শিক্ষানীতিতে ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপর ক্রুপস্কায়া বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষাব্যবস্থার একটা শক্ত ভিত গড়ে তুলেছিলেন ।  ক্রুপস্কায়া তাঁর ‘অন সেলফ এডুকেশন’ নামক বইতে বলেন,“সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য এবং দুনিয়াব্যাপী সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার  লড়াইয়ে শিক্ষা  খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করবে”


শেয়ার করুন

উত্তর দিন