ভাবুন, পৃথিবীর সুস্বাস্থ্যের জন্য - শমীক লাহিড়ী

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল,২০২০

করোনার ধাক্কায় মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো লক্ষ ছাড়াবে। পৃথিবীর ১৯৫ দেশের কেউই ছাড় পায়নি এই সংক্রমণের হাত থেকে। ১৬ লক্ষেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত। কিন্তু এর ভয়াবহতা এখানেই থেমে থাকবে না।

পৃথিবীর ১২১ দেশে যাতায়াত বন্ধ হয়েছে সংক্রমণ ঠেকাতে। শুধুমাত্র দেশ থেকে দেশান্তরে যাওয়াই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও প্রায় বন্ধ এই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে।

ফল - বিশ্বজুড়ে কয়েক লক্ষ কোটি শ্রমদিবস নষ্ট, উৎপাদন প্রায় স্তব্ধ।এর অর্থ এক কথায় - থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বিশ্ব। বার্ষিক গতি বা আহ্নিক গতি প্রকৃতির নিয়মে অব্যাহত থাকলেও, মানুষের নিয়মে তৈরী উৎপাদন-পরিষেবার ব্যবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে সর্বত্র - প্রবল পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাক লাগানো চীন-কোরিয়া। এত বৈভব-পরাক্রম -শক্তির আস্ফালন চুপসে গেছে খালি চোখে দেখা যায়না এমন একটি ভাইরাসের আক্রমণে। করোনা পরবর্তী অধ্যায়ও এক কঠিন হিমশীতল সময়। বাজার গরম হতে কত সময় লাগবে - বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও হলফ করে বলতে পারছেন না।

কি হল এত পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা বানিয়ে? আমেরিকার বি-স্টেলথ বোমারু বিমান নাকি আলপিনের ডগায় বোমা ফেলতে পারে কয়েক কিলোমিটার উঁচু থেকে, রাশিয়ান এস৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, নাকি পৃথিবীকে কয়েক চক্কর কেটে ফেলার ক্ষমতা ধরে, এ.কে ১০৭ রাইফেল নাকি আস্ত ট্যাংক উড়িয়ে দেয় এক নিমেষে। তা এগুলো দিয়ে মানুষ মারা যায়, পৃথিবীও ধ্বংস করা যায়, কিন্তু চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা ভাইরাস মারতে পারা যায়না। তাহলে কি হ'ল এই সব বানিয়ে!

সুইডেনের স্টকহোমে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে ২০১৮ সালে পৃথিবীতে কেবলমাত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য খরচ হয়েছে - ১.৮২২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। মানে - ১৩,৬৮,১৩,৪৯,৯৯, ৯৯, ৯৯৯.৯৮ টাকা। হিসাব কষুন, লকডাউনের বাকি কটা দিন কেটে যাবে।

এত অস্ত্রের ভান্ডার নিয়ে প্রবল পরাক্রমশালীরা অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কোটের কলার ফাটা বিজ্ঞানীর দিকে অথবা রাতজাগা ক্লান্ত অবসন্ন কিন্তু হার না মানা জেদি ডাক্তারের দিকে !

বৈভবে মোড়া দুবাই-এর ৮২৮ মিটার উঁচু মিটারের বুর্জ খলিফা নাকি খাঁ খাঁ করছে। শোনা যাচ্ছে সৌদি রাজ পরিবারেও নাকি ঢুকে পড়েছে করোনা। সোনা আর পেট্রো ডলারে মুড়ে রাখা অহংকার থরথর করে মৃত্যুভয়ে কাঁপছে। ফোর্বস পত্রিকা প্রকাশিত অতিধনী তালিকায় স্থান পাওয়া ৮৫০ জন অতিধনী ব্যক্তির বাস ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরের কান্ট্রি ক্লাবে। দেশের মাত্র ০.০০০৪১% মানুষের প্রবেশাধিকার আছে সেখানে। সেই অতিধনীদের অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়েছে করোনা। এখানে নাকি ৬০ জন অতিধনীর শরীরে কোভিট ১৯ এর সন্ধান পাওয়া গেছে। এক অতিধনী বৃদ্ধা মিড়না বান্দেইরা ডি মেলো সম্প্রতি করোনা সংক্রমণে মারা গেছেন। তাঁকে কবরস্থ করার সময়ে তাঁর একমাত্র সন্তান ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। টাকার পাহাড়ে চড়েও বাঁচতে পারছে না অতিধনীরা। শেষকৃত্যের সময়েও কাঁদার লোক নেই।

এত অহংকার, এত পরাক্রম, এত অস্ত্র সম্ভার, এত ধন সম্পত্তি কি কাজে লাগছে!

পৃথিবীতে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৭.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মানে এটা নয় যে রাষ্ট্রগুলি বা সরকারগুলির সম্মিলিত খরচ এটা। এই খাতে সরকারগুলি, রোগী নিজের পকেট থেকে, বীমা বাবদ, কর্মদাতার দেয়, অসরকারী সংগঠনগুলোর খরচ - সব মিলিয়ে এই খরচ হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের রিপোর্টে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছে সরকারগুলির ভূমিকা নিয়ে। সরকার বা রাষ্ট্রেগুলির স্বাস্থ্যখাতে খরচ করায় বিশাল পার্থক্য আছে। মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩-১৪% ব্যয় করে বিভিন্ন দেশের সরকার। নিম্ন এবং মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলোতে এই খাতে খরচ কমছে। আর জনস্বাস্থ্যে খরচের পরিমাণ খুবই কম। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে এইডস/ম্যালেরিয়া /টিবি রোগ মোকাবিলায় সরকারি খরচের ২০% ব্যয় হচ্ছে, ৩৩% ব্যয় হচ্ছে আঘাত/ অসংক্রমণ জনিত রোগ চিকিৎসায়। জনস্বাস্থ্যর জন্য খরচ ক্রমশ কমছে। আমার এক ডাক্তার বন্ধু যিনি দীর্ঘদিন জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন, আক্ষেপ করে বলছিলেন - তিনি যে চিকিৎসক এটাই অনেকে মানতে চায় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর টেড্রস আধানম গ্যাব্রেসিয়েসাস একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন এই রিপোর্টে। " স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় আসলে সরকারের খরচ নয়, এটা দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যবান, নিরাপদ ও সুন্দরতর পৃথিবী তৈরির জন্য বিনিয়োগ।"

এই রিপোর্টে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। প্রথমত, নিম্ন ও মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোতে গড়ে ৪-৬% হারে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বেড়ে চলেছে প্রতি বছর। এই খরচ সরকার, রোগী নিজের পকেট থেকে, বীমা, কর্মদাতার ব্যয়, অসরকারী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত ব্যয়। দ্বিতীয়ত ,এই খরচের ৫১% বহন করে সরকারগুলি এবং ৩৫% ব্যয় করতে হয় রোগীকে নিজের পকেট থেকেই। এই কারণে পৃথিবীর ১০ কোটি মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে গভীর দারিদ্র্যের মধ্যে চলে যাচ্ছে।

নিম্ন ও মধ্য আয়ভুক্ত দেশগুলিতে সরকার মাথাপিছু গড় ৪৪২ টাকা ($৬০) খরচ করে। আমাদের দেশে সরকার মাথাপিছু খরচ করে ১১১২ টাকা( ২০১৮)। অর্থাৎ মাসে ৯৩টাকা, দিনে ৩টাকা।

বুঝুন এবার কি হবে আমাদের দেশে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই!!! যেখানে চীন স্বাস্থ্যখাতে মাথা পিছু খরচ করে ৪৫,৬৬১ টাকা।
কোন রাস্তায় হাঁটা উচিত আমাদের?
বিচারের ভার আপনার বোধ-বুদ্ধি-যুক্তি-বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। ভাবুন - ভালো করে ভাবুন। লকডাউনের সময় তো অখণ্ড অবসর।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন