জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার কাল থেকে গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে চিন্তা-চেতনার প্রসারের পাশাপাশি রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমূখ ব্যক্তিত্বেরা তার ও আগে সংস্কারবাদী আন্দোলনকে ধীরে ধীরে বাংলার প্রেক্ষিত কে অতিক্রম করে সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে উপনীত করতে শুরু করেছিলেন তা ক্রমশ একটা পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সংস্কার আন্দোলনের এই প্রেক্ষিত গুলি আলোচনা প্রসঙ্গে সেই আন্দোলন বাংলায় যতখানি বিস্তার লাভ করেছিল তাই আমাদের আলোচনাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বাংলার বাইরে ও এই সংস্কার আন্দোলনের যে প্রসারণ, তা নিয়ে কিন্তু আমরা তেমন একটা আলোচনা করি না ।
বাংলার বাইরে মহারাষ্ট্রে যেমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে চিন্তাধারার বিকাশ এবং ব্রিটিশ কে ভারত বর্ষ থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত যুব সমাজের নেতৃত্বে আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ -ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তেমনি ই, মহারাষ্ট্র জুড়ে সংস্কারবাদী আন্দোলনের ভূমিকা ,ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষিত টিকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।আবার আরএসএসের ভিত্তিভূমি হিসেবেও মহারাষ্ট্র যে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দুসম্প্রদায়ের চিন্তাচেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে, সংস্কারবাদী আন্দোলন কে ব্যবহার করে, সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিত্বেরা ভারতবর্ষের প্রবাহমান বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ,কিভাবে একটি বিভাজনের মানসিকতাকে ,রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিবেদনের রত থেকেছেন-- এই প্রেক্ষিতে আলোচনার প্রসঙ্গেও মহারাষ্ট্রের ভূমিকার কথা আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে হয় ।
মহারাষ্ট্রের সংস্কারবাদী আন্দোলনের বিকাশ ,প্রসারণ ,প্রভাব- ইত্যাদির ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র প্রার্থনা সমাজ এবং তার কর্মকাণ্ড বিশেষ রকমের উল্লেখের দাবি রাখে ।রাণাডে- টেলাংয়ের যৌথ প্রভাব, সেটিও কিন্তু মহারাষ্ট্রের সামাজিক সংস্কারের প্রেক্ষিত কে অতিক্রম করে ,ভারতবর্ষের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক সংস্কারের প্রেক্ষিতটিকে আরো সফল, বেগবান করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
এঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে প্রতিবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানসিকতা বিকাশ লাভ করেছিল ,সেই প্রতিবাদের মানসিকতা কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের ভেতর জন্মলগ্ন থেকে কখনোই বিকাশ লাভ করে নি। মহারাষ্ট্রের সংস্কারবাদী আন্দোলনকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করবার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা চেষ্টার কোনো কসুর করেন নি। অথচ, এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের চিন্তাধারার , কর্ম ভাবনার ভিতরে যে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি মানসিকতা সব সময় তার বিজয় বৈজন্তী উড়িয়েছে ,সেই পথে কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির তার জন্মলগ্নে বা পরবর্তী কালেও কখনই কোনভাবে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেনি।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ১৮৯০ সাল নাগাদ এবং সেই নয়ের দশকে মহারাষ্ট্রের সংস্কারপন্থীরা এবং সনাতনপন্থী ,যারা পরবর্তীকালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তা- চেতনার অন্যতম প্রধান ভিত্তিভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, উভয় গোষ্ঠীর ভেতর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমশ একটা চরম আকার ধারণ করে ।বেহরাম জী মালবারি নামক এক মারাঠি সংস্কারক ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাল্যবিবাহ বন্ধের পক্ষে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
বাল্যবিবাহ কিভাবে দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, এবং শিশুর কন্যার সন্তান ধারণের বিষয়টি কিভাবে শিশু কন্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় ,এবং বৃদ্ধের সঙ্গে বালিকার বিবাহ কিভাবে শিশু কন্যার ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনজনিত বৈধর্ব্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়-- এই ঘটনাক্রমের ওপর লেখা প্রবন্ধ টি তৎকালীন মহারাষ্ট্রের সামাজিক প্রেক্ষিতে অত্যন্ত বিতর্কের অবতারণা করে।মহারাষ্ট্রের প্রেক্ষিত কে অতিক্রম করে বিতর্ক সর্বভারতীয় আঙ্গিকে একটি বিতর্কের ও অবতারণা করেছিল।
ভারতবর্ষে সাম্প্রতিক অতীতে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ, বিস্তার, প্রভাব - ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের সামাজিক প্রেক্ষিত কে ঘিরে আলাপ আলোচনা করতে গিয়ে, বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের দিকে আমরা বেশি নজর দিয়ে থাকি। অথচ মহারাষ্ট্র ,যেখানে আরএসএস তার ভিত্তিভূমি কে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করেছিল, জন্মলগ্ন থেকে তাদের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের কর্মস্থান যে অঞ্চলে ,যে নাগপুর শহরকে কেন্দ্র করে হেডগেওয়ারের জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষিত আলোচনা হয়, সেই প্রসঙ্গে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক ভাবনা কে একটা সামাজিক দর্শনের মুখোশ পরিয়ে ,রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের গভীর ষড়যন্ত্র কে গোপন রাখে, সেই মহারাষ্ট্র সন্নিহিত অঞ্চল ,সেইসময় বোম্বাই প্রেসিডেন্সি নামে পরিচিত ছিল ভৌগোলিক ।
রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ভাবে সেই অঞ্চলের সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আমরা খুব একটা আলাপ-আলোচনার তে অবতীর্ণ হই না। অথচ ওই অঞ্চলের সামাজিক প্রেক্ষিতের বিবর্তন কিন্তু মহারাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে ,গোটা ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষিত কে একটা ইতিবাচক অভিমুখে পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বাল্যবিবাহ বিধবা বিবাহ রোধ, সহমরণ প্রথা রদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাংলার মনীষী রামমোহন ,বিদ্যাসাগর প্রমুখের ভূমিকা আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরণ করি। অথচ মহারাষ্ট্রের সামাজিক আন্দোলনে বাল্যবিবাহ ,নারীর অধিকারের প্রশ্ন, যেভাবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সামাজিক প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে, তার সম্যক আলোচনা ইতিহাসের বিভিন্ন আঙ্গিকে সেভাবে কিন্তু হয় না ।
উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত বোম্বাই প্রেসিডেন্সির একটি আদালতে রুখমাবাঈ বনাম তার স্বামী দাদাজির মামলাটিকে কেন্দ্র করে যে আলোড়ন, এবং সেই মামলাটিকে পরবর্তীকালে বোম্বের উচ্চ আদালতে নিয়ে আসা-- সব ঘিরে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে আলোড়ন, সে সম্পর্কে কিন্তু আমাদের খুব একটা ধ্যানধারণা নেই।
সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশের অন্যতম প্রাচীন ভিত্তিভূমি হিসেবে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি কে নিয়ে আলোচনা করলেও ,সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা বিকাশ লাভের পাশাপাশি ,প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনার বিকাশ এবং সে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রতিরোধ করার জন্য ,মোকাবিলা করবার জন্য ,যে একটি প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ধীরে ধীরে সম্যক ভাবে বিস্তার ঘটতে শুরু করে ,এই প্রেক্ষিতে কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক হিন্দুদের ক্ষমতা দখলের রাজনীতির গোটা প্রেক্ষাপট টি র ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা উল্লেখ করতে হয়।
সংশ্লিষ্ট সময়কালে মাত্র ২২ বছরের রুখমাবাঈ , তিনি তাঁর স্বামীকে, স্বামীর সামাজিক-পারিবারিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে , আদালতে টেনে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। রুখমাবাঈ কিন্তু অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন না ।তিনি ছিলেন নিম্নবর্গীয় হিন্দু ।জাতিতে কাঠমিস্ত্রি ,অর্থাৎ ;যাদের ছুতোর বলা হয়। রুখমাবাঈ আদালতে দাঁড়িয়ে স্বামীর দাম্পত্য অধিকার কে অস্বীকার করবার মতো মানসিক ,সামাজিক শক্তির এক অসামান্য পরিচয় দিয়েছিলেন ।
বয়স ,বোধ বিকশিত হবার অনেক আগেই, অত্যন্ত শিশুকালের বিয়ে হয়েছিল তাঁর।প্রথম জীবনে তাদের মধ্যে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক ছিলনা। ১১ বছর ধরে তাঁরা আলাদাভাবে বসবাস করতেন। সেই বিবাহ কে তিনি অপূর্ণ বিবাহ হিসেবে দাবি করে, আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। রুখমাবাঈ আদালতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে; যৌবনে পা দিয়ে ,শেষ শিশু কালের বিয়ের দায় তিনি কোনো অবস্থাতেই বহন করতে রাজি নন। আদালত কিন্তু এইরকম দাবি কে ঘিরে প্রাথমিক স্তরে আদৌ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে নি। অত্যন্ত শ্লথগতিতে প্রায় চার বছর ধরে মামলাটিকে চালানো হয়েছিল ।সামাজিক প্রেক্ষিতের রক্ষণশীল ভাবধারার প্রতি সাযুজ্য রেখেই আদালত রুখমাবাঈ এর পক্ষে একটিও কথা বলেনি ।
রুখমাবাঈ আদালতে হেরে যান। তাঁকে জেল বাসের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয় ।খানিকটা আপোসের প্রেক্ষিতের মধ্য দিয়ে রুখমাবাঈকে জেলের থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়। ব্রিটিশ শাসনে ,আইনের পরিকাঠামো তে কিভাবে সেই সময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের অন্ধত্ব ,গোড়ামি এবং পুরুষতান্ত্রিকতা, একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল ,সেই বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে ।পুরুষ যে তাদের নিজের ইচ্ছে মতো নিজের জীবনকে সুরক্ষিত রাখতে কোনরকম সামাজিক আইনি, প্রশাসনিক সমস্যার সম্মুখীন হবে না --এই বিষয়টিকে সরাসরি ব্রিটিশ আদালত কিন্তু স্বীকৃতি দেয় ।
মহারাষ্ট্রের সংস্কারবাদী, প্রগতিশীল ভাবধারার যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু রুখমাবাঈয়ের বিষয়টি ,আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে এককথায় মেনে নিতে রাজি হন না ।তাঁদের উদ্যোগে রুখমাবাঈ ডিফেন্স কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন মালাবারি। তাঁরা ব্রিটিশের উপর যুক্তিসিদ্ধ একটি সামাজিক চাপ অত্যন্ত সফলভাবে তৈরি করতে পেরেছিলেন ।পরবর্তীকালে যাঁরা আরএসএসের প্রতিষ্ঠা এবং সেই সংগঠনটিকে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে, চিন্তাভাবনার প্রসারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ,সেই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের ব্যক্তিত্বরা, মহারাষ্ট্রের ভেতর এবং মহারাষ্ট্রের মারাঠি অস্মিতা জনিত ভাবাবেগের বাইরে, রুখমাবাঈয়ের বিষয়টিকে ঘিরে অত্তপ্ত প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রেখেছিলেন।
তাদের সমস্ত রকমের ভূমিকা, প্রতিক্রিয়া কে অস্বীকার করে, মহারাষ্ট্রের সংস্কারবাদী সমাজ যেভাবে রুখমাবাঈ এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তার সম্যক আলোচনা কিন্তু ভারতবর্ষের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে হয় না বললেই চলে। সংস্কারবাদীদের এই আন্দোলনের চাপে ১৮৯১ সালে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বয়সের নিরিখে মেয়েদের সম্মতির বিষয়টি কিন্তু আইন সিদ্ধ হয় ।যে আইনটিকে এজ অফ কনসেন্ট বিল বলা হয় ।অল্প বয়সে মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে তাঁদের জীবন যাতে সংকটাপন্ন না হতে পারে, তার জন্য মহারাষ্ট্রের সংস্কারবাদীদের এই আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক আলোচনার নিরিখেই আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে ,বোম্বাই প্রেসিডেন্সির সামগ্রিক ভৌগলিক এলাকা কিন্তু কেবলমাত্র কুসংস্কারচ্ছন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তে আবদ্ধ, বহুত্ববাদী ভারতীয় দর্শনের বিরোধী, মধ্যকালীন ভারতের সমন্বয়ী চেতনার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতার ভেতরেই নিজেদেরকে সংকীর্ণ করে স্থাপন করে নি।
সংকীর্ণতা ,সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী চিন্তা-চেতনার প্রশারনের পাশাপাশি ,একটা প্রগতিশীল, আধুনিক, সংস্কারবাদী ,ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে সমাজ-সংস্কৃতি কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও কিন্তু বোম্বাই প্রেসিডেন্সি অন্তর্গত ভৌগোলিক এলাকার একটি বিশাল অংশের মানুষ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ভেবেছিলেন। এজ অব কনসেন্ট বিল তৈরীর আগে ১৮৬০ সালে কিন্তু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রথম আইন তৈরি হয়েছিল। সেই আইনে ১০ বছরের নিচে কোনো হিন্দু মেয়ের সঙ্গে বিবাহের সম্পর্ক, অর্থাৎ ;কোনো যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি প্রবল নিষেধাজ্ঞা ছিল ।সংস্কারবাদী আন্দোলনকারীদের চাপে সেই আইনের বয়স সীমা ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশরা। ১৮৬০ সালে যখন এই আইনটি অনুমোদিত হয়, তখন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ১৮৯১ সালের আইনের মতো এত তীব্র বিরোধিতা করেনি।
উনিশ শতকের ছয়ের দশকের সামাজিক প্রেক্ষিতে সঙ্গে ,সেই শতকের নয়ের দশকের সামাজিক প্রেক্ষিতে র যে বিবর্তনের ধারাটি লক্ষ্য করা যায় ,সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক কালপর্ব অনুযায়ী, ইতিবাচক দিকে সেই বিবর্তন ধাবিত না হয়ে ,একটা নেতিবাচক প্রবণতা কিন্তু সেই প্রেক্ষিতে আমরা জোরদার হয়ে উঠতে দেখি। অর্থাৎ; বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালে যখন আইন তৈরি হয় ,রামমোহন -বিদ্যাসাগর প্রমুখের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং জীবিত থাকা থাকার কারণে যে সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে সেই সময় বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন টিকে ঘিরে, সমাজের রক্ষণশীল অংশ কিন্তু খুব বেশী রকমের প্রতিবাদে দেখাতে সাহস করেনি ।
অপরপক্ষে আরো একটি কথা বলা যায় যে, এই সময়কালে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হিন্দু সমাজের রাজনৈতিক দিকগুলি, ততবেশি সংগঠিত ছিল না , যেটা ১৮৯১ সালে আইনটির সংশোধনী তৈরি হওয়ার সময়কালের সক্রিয় হয়ে উঠতে আমরা দেখেছি ।তবে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার মোকাবিলায় সংস্কারবাদী চেতনাও কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকের এই আইনটির সংশোধনী কালে অত্যন্ত বেশী রকমের প্রবল হয়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ভেতরে চিন্তা-চেতনার বোধ কে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্যায়ের নরমপন্থী নেতারা তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রক্ষণশীল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদে সোচ্চার চিন্তা হিসেবে উঠে আসতে শুরু করে। রক্ষণশীল সমাজের ভেতরেও কিন্তু ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে তখন ধীরে ধীরে একটা বোধ বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছে। ভারত বর্ষ এবং ভারতবর্ষের মানুষদের ধর্মীয় রীতিনীতি ,সামাজিক প্রেক্ষিত ,বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংস্কার, নানা ধরনের প্রথা --ইত্যাদির ব্যাপারে বিদেশি শাসকদের হস্তক্ষেপ কে ঘিরে ভারতীয় জনগণের ভেতর কিন্তু ধীরে ধীরে একটা প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিরোধের সংকল্প তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে ।
যদিও সামগ্রিক সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্রিটিশের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একেবারে সর্বাত্মক একটা রূপ লাভ করেছিল এমনটা মনে করার কোনো কারণ না থাকলেও ,হিন্দু সমাজের সামাজিক বিধি বিধাএর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি যে আইন ,সেই আইনকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে, প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু সমাজের ভেতরে খুব একটা ওজর আপত্তি ছিল না ।
যদিও গোহত্যার বিরোধী আইন তৈরীর ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ, হিন্দু মুসলমানকে বিভাজিত করবার যে একটি সূক্ষ্ম কৌশল উনিশ শতকেই ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষিতের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল ,যার রেশ আজও আমাদের বয়ে বেড়াতে হয় ,সেই বিষয়টিকে সম্যকভাবে ভারতবর্ষের মানুষদের কাছে তুলে ধরে ,ব্রিটিশের এই অপচেষ্টা ঘিরে, ভারতবর্ষের মানুষদের সচেতন করার প্রশ্নে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতাদের ভেতর যথেষ্ট বাস্তব বুদ্ধির অভাব ছিল ।
অপরপক্ষে মহারাষ্ট্রে এই রুখমাবাঈ মামলা কে কেন্দ্র করে ব্রিটিশের তৈরি আইন ব্যবস্থার ভেতরেই কিন্তু হিন্দু সমাজের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ,রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ভেতর একটা বিশেষ রকমের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ।হিন্দু সমাজে গৃহের অভ্যন্তরে, পারিবারিক জীবনের প্রেক্ষিতে ,যাতে ব্রিটিশ কোনো অবস্থাতেই ঢুকে পড়তে না পারে ,তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য, আরএসএসের চিন্তা ধারাকে যারা বিকাশলাভ ঘটিয়েছিল, সেইসব ব্যক্তিত্বরা, কিন্তু প্রথম থেকেই অত্যন্ত সচেতন ছিল ।
হিন্দু সমাজের তথাকথিত সামাজিক পবিত্রতাকে ঘিরে এক ধরনের ছুৎমার্গ ,সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ,হিন্দু সমাজের যে সার্বভৌমত্বে র চিন্তায় বিশ্বাসী ছিল ,সেই বিশ্বাস ও কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের চিন্তা চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
হিন্দুসমাজের সার্বভৌমত্ব এবং পবিত্রতা চিন্তায় প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুসমাজ বিশেষভাবে বিশ্বাসী ছিল ,সেই পরিকাঠামো তে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা কোনো অবস্থাতেই , কোন রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না --এটাই ছিল রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সব থেকে বড় বিশ্বাসের জায়গা ।সেই বিশ্বাসের জায়গা, একজন ছোট জাতের মহিলার রুখমাবাঈ এভাবে একটি প্রতিরোধের পন্থা হিসেবে উপস্থাপিত করে ,সংস্কারবাদী আন্দোলনকারীদের ভেতর একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, ব্রিটিশ কেও সার্বিক পরিমণ্ডল নিয়ে নতুনভাবে ভাবাবে --এই গোটা ঘটনাপ্রবাহ টিকে মেনে নেওয়া কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু সমাজ ,যারা পরবর্তীকালে আর এস এস সহ যাবতীয় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, তাদের পক্ষে হজম করা আদৌ সম্ভব ছিলনা ।
তাদের এই আপত্তির পেছনে ধর্মীয় বিধি-বিধানের থেকেও অনেক বেশি কার্যকরী ছিল লিঙ্গ ভিত্তিক চিন্তা অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা হারানোর চিরন্তন ভয়।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)