সর্বগ্রাসী ক্ষমতার লালসায় সিক্কার এপিঠ ওপিঠ ....

৩, মার্চ ২০২১ বুধবার

পর্ব - ২

আরএসএস-বিজেপি’র প্রাথমিক লক্ষ্যই হলো, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির সমীকরনে ২০১৯ -এর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল অঙ্কে টানা দ্বিতীয়বার মসনদ দখলের পর ঝড়ের বেগে তারা সেই পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের অন্যতম সৌধ বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর, অযোধ্যার সেই বিতর্কিত জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের আইনী ছাড়পত্র হাসিল। সংসদের দুটি কক্ষ’কে বিকল করে রেখে জম্মু-কাশ্মীরের ভারত ভূক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল। এনপিআর-সিএএ-এনআরসি কায়েমের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক নাগরিকত্ব তাদের লক্ষ্য পথে একেকটি জোরালো পদক্ষেপ। দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় গৃহীত ৪২ তম সংশোধনী অর্থাৎ, ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক অধিকারকে লঘূ করতে রাজ্যপাল থেকে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি সচেষ্ট। একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মন্দির নির্মাণ তহবিলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর বেতনের অংশ দান করছেন, অতীতে কখনও দেখা যায়নি। কিংবা, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সেই রাজ্যের রাজ্যপাল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে নিকৃষ্ট উপহাস করছেন, এমনটা কখনও ভাবা যায়নি। প্রশাসন, বিচারবিভাগ, আইনসভা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর তিনটি মূল স্তম্ভেই এখন আরএসএস -এর বিস্তার। বেরোজগারি, অপুষ্টি, ক্ষুধা, গরিবী, ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য, কৃষক মৃত্যু, কৃষি সংকট, নারী নির্যাতনের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনৈতিক সমীকরন কার্যকর করার সর্বগ্রাসী প্রচেষ্টা। একের পর এক মাপা পদক্ষেপে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সুদূরপ্রসারি অ্যাজেন্ডা নিয়ে জাঁকিয়ে বসছে আরএসএস।


গুজরাটের পর এখন আরএসএস -এর রসায়নাগারে ‘রামরাজ্য’ তৈরির মহড়ায় দুটি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ। দু জায়গাতেই বিজেপি সরকার। এরমধ্যে উত্তরপ্রদেশে সরাসরি জনাদেশ পেলেও মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনের দু’বছর পর মোদী-শাহ’র যৌথ কারসাজিতে কংগ্রেসের বিধায়কদের ভাঙ্গিয়ে দল বদলু বিজেপি সরকার। দুই রাজ্য সরকারই এখন রামরাজ্যের প্রতিযোগিতায়। কেমন সেই ‘রামরাজ্য’? বেরোজগারি, অপুষ্টি, ক্ষুধা, গরিবী, আয়ের বৈষম্য, কৃষি সংকট, নারী নির্যাতন এরকম প্রতিটি সূচকেই এ বলে তো আমায় দ্যাখ, ও বলে তুই আমায় দ্যাখ! বহির্বিশ্বে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক নামকরণ, রেপ-স্টেট মানে, ধর্ষণের রাজ্য। সর্বশেষ প্রাপ্ত এনসিআরবি’র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে প্রতিদিন (২৪ ঘন্টায়) গড়ে ৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। আক্রান্তদের মধ্যে বড় অংশই সংখ্যালঘূ এবং দলিত। হাথরস, বলরামপুর, উন্নাও, আজমগড়, বুলন্দশর প্রতিটি ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠতে হয়। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই তদন্তে ব্যাপক কারচুপি করে উচ্চবর্ণের অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যোগী সরকারের পুলিশ। অপরদিকে, এনসিআরবি’র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ২০১৪-২০১৮ বিজেপি আমলে নারী ধর্ষণের ঘটনায় দেশের মধ্যে শীর্ষ স্থানটি ছিল মধ্যপ্রদেশের দখলে। পাঁচ বছরে ২৫,২৫৯ টি ধর্ষণের ঘটনা। সরকার পরিবর্তনের পর ২০১৯ -এ কংগ্রেস সরকারের সময় ধর্ষণের ঘটনা ১০ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০২০ তে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক ছিন্দওয়াড়ায় ৩ বছরের শিশুকন্যা, ভূপালে ২০ বছরের দলিত যুবতী, জবলপুরে ২ বছরের শিশুকন্যা, ভূপাল রেল স্টেশনে ২২ বছরের যুবতী, ইন্দোরে ৫ বছরের শিশুকন্যার ধর্ষণের ঘটনা এর বর্বরোচিত নিদর্শন।


দুটি রাজ্যেই আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। আইনের শাসনের কোনো বালাই নেই। তদন্তের আগেই এনকাউন্টারে খতম করে দেওয়া হচ্ছে অভিযুক্তকে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন অপরাধী দেখলেই তার পুলিশ গুলি করবে। ২০১৯ -এ উত্তরপ্রদেশে ৩,৮৯৬ টি এনকাউন্টার করেছে যোগীর পুলিশ। নিহত ৭৬ এবং আহত ১,১৫৪ জন। দেখা যাচ্ছে, নিহতদের বেশির ভাগই দলিত নয়তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বেশ কয়েকজন তো আবার পেটি কেসের আসামী। একটি ঘটনায় এক দলিত যুবক মোটরসাইকেল চালানো শিখছিল। আচমকা পুলিশ অস্ত্র নিয়ে তাড়া করলে সে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। এনকাউন্টারের পর নিজেদের দোষ ঢাকতে তার নামে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এনকাউন্টারের এফআইআর -এ প্রতিটি বয়ানই প্রায় এক ছাঁচের। বলাই বাহুল্য, বড়সর অপরাধ ঢাকতেই যোগী আদিত্যনাথের এই কৌশল। অপরাধের নেপথ্যে শাসক দলের বড় রাঘব বোয়ালদের আড়াল করতে বিচারাধীন বন্দীদের খুন করে দেওয়া হচ্ছে। লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯-২০ তে উত্তরপ্রদেশে কারাগারে অথবা, আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে ৪০০ জন বিচারাধীন বন্দীর মৃত্যু ঘটেছে। বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় উত্তপ্রদেশের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, ১৪৩ জন। আর তৃতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ, ১১৫ জন। সব জায়গাতেই মানবাধিকার কমিশন হয় শাসক দলের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়তো, নিষ্ক্রিয়। যোগীর ‘রামরাজ্যে’ যুব সমাজের ভালোবাসার অধিকারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা। তরুণ-তরুণী’দের মেলামেশার ওপর খবরদারি করতে পুলিশের সমান্তরালে ‘অ্যান্টি রোমিয়ো স্কোয়াড’। মূলত, আরএসএস -এর গুন্ডা বাহিনীকে সরকারি ভাবে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে উচ্চ বর্ণ এবং হিন্দুদের সঙ্গে যাতে কখনোই নিম্ন বর্ণ, দলিত, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্ক না গড়ে উঠতে পারে তার নজরদারি করতে। ‘লাভ-জিহাদ’ মধ্যযুগীয় বর্বরতার ভয়ংকর সংস্করন।

যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই উল্লেখজনক ভাবে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা। ২০১৭ তে একবছরেই ৮২২ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। দাঙ্গার বলী ১১১ জন, জখম হয়েছেন ২,৩৮৪ জন। অধিকাংশ জায়গাতেই আরএসএস -এর দাঙ্গাকারীরা গুজরাটের কায়দায় সরাসরি পুলিশের একাংশের সাহায্য নিয়ে সংখ্যালঘু অংশের মানুষের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়েছে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মুজফফর নগরে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সংঘর্ষেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিবারগুলিকে ধনে প্রাণে শেষ করে দেওয়ার জন্য মহল্লায় ঢুকে পুলিশ এবং দাঙ্গাকারীরা একযোগে আক্রমণ চালিয়েছে। তাঁদের দোকান, ঘর-বাড়ি লুটতরাজের পর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে। যাতে কয়েক প্রজন্ম ধরে এর আর্থিক দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকে। যোগী সরকারের রাজত্বে বেরোজগারি বেড়েছে হু হু করে। মাত্র দু’বছরে বেকারি বেড়ে দ্বিগুণ, ৯.৯৫ শতাংশ। নতুন করে কোনো ভারি শিল্প হয়নি। ২০১৮ -এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাহচর্যে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে লক্ষ্ণৌ’তে শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করে ১০৪৫ টি মৌ-স্বাক্ষর করেছিলেন যোগী। বিনিয়োগের অঙ্ক ৪,২৮,০০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের শিল্পমন্ত্রী জানিয়েছেন এর মধ্যে রূপায়নের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বড়জোর ৯০ টি চুক্তির ক্ষেত্রে। যার বিনিয়োগ মুল্য ৩৯,০০০ কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্য রকম হ্রাস পেয়েছে একশো দিনের কাজের সুযোগ। বেড়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র। ২০১৯ -এর অক্টোবর-নভেম্বর এই দুমাসে ক্ষুধাজনিত কারনে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চরম দূরবস্থা সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জন-স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। কোভিড অতিমারির সময় আগ্রায় ১৪৫ জন যক্ষা রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বিনা চিকিৎসায়। কোভিড আতঙ্কে তাঁদের চিকিৎসাটুকু করা যায়নি। ২০২০ -এর মে মাসে ছটি হাসপাতাল থেকে প্রতারিত হয়ে ১২ বছরের এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে বিনা চিকিৎসায়। ৮ মাসের এক শিশুর মৃত্যুও একইকারনে তিনটি হাসপাতাল থেকে প্রতারিত হওয়ার পর। সময় মতো অ্যাম্বুলেন্স না আসায় ৬ মাসের এক শিশুকে বাঁচানো যায়নি। এক প্রসূতি তাঁর সন্তান হারিয়েছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওটি-র গ্লাভস না থাকায়। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে এমনই করুণ দশা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবীকার।


তবে এর চেয়েও ভয়ংকর ঐ রাজ্যের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রতিটি স্তরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনৈতিক বিস্তার। প্রশাসন, আইনসভা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বত্র আরএসএস -এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। বিজেপি সরকারের কাজের ত্রুটি সমালোচনা, প্রতিবাদ করলেই দেশদ্রোহিতার দায়ে হাজতবাস। সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে খর্ব করে আরএসএস -এর ‘হিন্দুত্বের’ নিদান। সেটাই বাধ্যতামূলক। বিরুদ্ধ মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার শিকেয়। এটাই আরএসএস -এর ‘রামরাজ্য’, যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার। মধ্যপ্রদেশেও তাদের একই ধাঁচায় চেষ্টা চলছে। সরকারের প্রতিটি কাজে সাম্প্রদায়িকতার তাস ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার প্রশিক্ষণ পর্ব।


কোনো সন্দেহ নেই, আরএসএস-বিজেপি’র এই মুহুর্তের নিশানায় পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গের ভোট।





ধারাবাহিক লেখা , চলবে….


শেয়ার করুন

উত্তর দিন