শ্রদ্ধায় ও স্মরণে ফাঁসির দিনে মৃত্যুজয়ী বীর গোপীনাথ সাহা

অঞ্জন বসু

"মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে "

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা,

তারা কি ফিরিবে আর এই সুপ্রভাতে যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে "।

" মা আরেকবার ক্ষুদিরাম বসুর গল্পটা বলো না " !

সস্নেহে হাসলেন জননী সুরবালা "আর কতবার শুনবি? এই তো সেদিন শুনলি, আজ আবার ক্ষুদিরামের গল্প শুনতে চাস?

ঝাঁকড়া চুলের, শ্যামলা বর্ণের ছেলেটি অনুনয়ের সুরে মাকে বললো "হ্যাঁ মা আরেকবার বলো না ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, সত্যেন্দ্রনাথের গল্পটা"?

দেশজননীর পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করতে চাই আমি, এদের মতো বিপ্লবী হবো ।

বুকটা কি কেঁপে উঠলো সুরবালার "এ ছেলে কোন পথে যেতে চাইছে "? যে পথে যেতে চায়, সে পথে যে শুধু জেল, দ্বীপান্তর আর ফাঁসির হাতছানি রয়েছে প্রতিমূহূর্তে ।

যাইহোক সালটা ১৯০৫ সাল ,ভারতের ইতিহাসে সবথেকে কুখ্যাত বছর, কারণ ১৯০৫ সালের ১৬ ই জুলাই ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন "বঙ্গভঙ্গের আদেশ "ঘোষণা করলেন, বাঙালীর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ঐক্যে আঘাত হানতে ব্রিটিশ সরকার এই ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্ত নিলো, ফলে সমস্ত দেশে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, কিন্তু সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে লর্ড কার্জন "বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে স্থায়ী " বলে ঘোষণা করলেন,অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় "এই স্থায়ী ঘটনাকে অস্থায়ী " করে দেবার পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিলেন।

ঠিক এই অগ্নিঝরা সময়ে অর্থাৎ ১৯০৬ সালের ৭ ই ডিসেম্বর পিতা বিজয়কৃষ্ণ সাহা ও মা সুরবালার কোল আলো করে জন্ম নিলেন ছোট্ট গোপীনাথ বা গোপীমোহন, শ্রীরামপুরের ক্ষেত্রমোহন সা স্ট্রীটের বাড়ীতে, কিশোর গোপীনাথ প্রথমে ভর্তি হলে বল্লভভাই হাইস্কুল ও পরে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে।

কিন্তু যতোই বড় হতে থাকেন গোপীনাথ ততোই তার মধ্যে ছটফটানির ভাব লক্ষ্য করা যায়, অন্যদিকে ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পান্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে বর্বরোচিত হত্যাকান্ড সারা দেশে ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রবল ঘৃণা, ক্ষোভ ও বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে, দেশবাসীর এই চরম অপমান ও ইংরেজের চরম ঔদ্ধত্য জাতিসুলভ তার মনে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী মানসিকতার জন্ম দিয়েছে।

দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং ইংরেজ সরকারের দম্ভ ও নিপীড়নের যোগ্য জবাব দিতে গোপীনাথ বাড়ী ছাড়লেন হুগলী বিদ্যামন্দির,কলকাতার শ্রী সরস্বতী লাইব্রেরী ও সরস্বতী প্রেস, দৌলতপুর সত্যাশ্রম, বরিশালের শঙ্কর মঠ, উত্তরপাড়া বিদ্যাপীঠ প্রভৃতি জায়গায় বিভিন্ন বিপ্লবী নেতাদের নির্দেশে কাজ করতে শুরু করলেন গোপীনাথ, অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয় ত্যাগ করলেন এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিজেকে সমর্পণ করলেন কিশোর গোপীনাথ যে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে "বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম" সহ সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

কিন্তু গোপীনাথের অস্থির মন কিছুতেই শান্ত হয় না যে, আসল কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এই ছটফটানি থেকেই যাবে।

অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর গোপীনাথ পেলেন মনের মতো কাজ, নির্দেশ এলো কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে হত্যা করতে হবে, যিনি বিপ্লবীদের উপর অকথ্য নিপীড়ন চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন ইতিমধ্যেই।

শুরু হলো টেগার্টের উপর নজর রাখা এবং গোপীনাথের টার্গেট "প্র্যাকটিস "।

"বুঝলি গোপী ব্যাটাকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিবি, যাতে বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, কি রে পারবি তো?

গোপীনাথের চোখ তখন জ্বলছে, দৃপ্ত কন্ঠে বললেন "পারবো, পারতে আমাকে হবেই"।

দিনটা ১৯২৪ সালের ১২ ই জানুয়ারীর এক কনকনে অথচ কুয়াশাভেজা সকাল, গোপীনাথ লুকিয়ে আছেন ময়দানের আশেপাশে, খবর পেয়েছেন প্রত্যেকদিন টেগার্ট এখানেই আসেন তার প্রাতঃভ্রমণ সারতে।

ওই তো ওই তো হাত পাঁচেক এক সাহেব এদিকেই হেঁটে আসছে না? চোয়াল শক্ত হলো গোপীনাথের, মূহূর্তের মধ্যে সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে তার পিস্তল পুরো খালি করে দিলেন, রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লো সাহেব, তৃপ্ত হলেন গোপীনাথ, যাক এতোদিনে টেগার্ট খতম হলো, ওদিকে গুলির শব্দে আশপাশ থেকে ছুটে এলো পুলিশ সার্জেন্ট ও কনস্টেবলরা, ধরা পড়লেন গোপীনাথ।

কিন্তু লালবাজারে আসতেই চমকে উঠলেন তিনি একি টেগার্ট এখানে কি করছে? তবে যাকে তিনি মারলেন সে কি টেগার্ট নয়? দুর্ভাগ্যবশত সেই সাহেবকে টেগার্টের মতো দেখতে হলেও তিনি ছিলেন কিড কোম্পানীর অধিকর্তা আর্নেষ্ট ডে, দু হাতে মুখ ঢাকলেন গোপীনাথ, লালবাজারে গোপীনাথের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু হলো, কিন্তু একটি শব্দও তার মুখ থেকে বেরোলো না।

অতএব "চৌরঙ্গী হত্যাকান্ড" এই গালভরা নাম দিয়ে গোপীনাথের বিরুদ্ধে মামলার নামে প্রহসন শুরু হলো, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গোপীনাথ দৃপ্তকন্ঠে বললেন "আমার প্রত্যেক রক্তবিন্দু ভারতের গৃহে গৃহে স্বাধীনতার বীজ বপন করবে "।

রিভলবার তাকে কে দিয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে ক্ষিপ্ত বাঘের মতোই গোপীনাথ বললেন "মিথ্যা কথা, কেউ আমায় রিভলবার দেয়নি, এ ব্যাপারে আমিই আমার দল, আমিই আমার নেতা, বিপ্লবীদের শত্রু টেগার্ট আমি তোমাকেই খতম করতে চেয়েছিলাম, নিরাপরাধ আর্নেষ্ট ডে'র জন্য আমি দুঃখিত"।

পরমুহূর্তে টেগার্টের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ মাখানো কন্ঠে গোপীনাথ বললেন "টেগার্ট সাহেব নিজেকে হয়তো নিরাপদ মনে করছেন, কিন্তু আমার আরব্ধ কাজ পূর্ণ করার জন্য রইলো ভারতবর্ষের অসংখ্য তরুণ, দেশমাতা আমাকে আহ্বান করিতেছেন "।

মা সুরবালাকে শেষ চিঠিতে গোপীনাথ লিখলেন "আমার জননীর মতো প্রত্যেক জননী যেন গোপীনাথের মতো সন্তানের জন্ম দেন "।

এই ছিলো তার শেষ চিঠি, ১৯২৪ সালের ১ লা মার্চ প্রেসীডেন্সী জেলের ফাঁসীর মঞ্চে দৃপ্ত পদক্ষেপে উঠলেন গোপীনাথ, দুচোখে শুধুই তার স্বাধীনতার স্বপ্ন, দুর্ভাগ্য সেই স্বাধীনতা আজোও আসেনি।

মাত্র আঠেরো বছরের স্বল্প জীবনে গোপীনাথ সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, সেদিন সারা দেশে সর্বত্রই গোপীনাথের আত্মত্যাগ এ শোকসভা পালিত হলো, আশ্চর্যের বিষয় গান্ধীজি আর্নেষ্ট ডে র মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করে শহিদ গোপীনাথের সমালোচনা করলেন কঠোর ভাষায়, এই দুমুখো নীতির কারণ কি ?

আজ শহিদ গোপীনাথ সাহার ১০০ তম আত্মবলিদান দিবসে তাকে জানাই শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

"কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো,

সাধক ওগো,প্রেমিক ওগো,পাগল ওগো ধরায় আসো"।

গোপীনাথের মতো মানুষেরা কখনো ব্যর্থ হন না, ওনারা মানুষকে জাগাতে আসেন তাদের যুগান্তর ব্যাপী নিদ্রা থেকে, এ যুগের যুবসমাজ কি বুঝবে কোনোদিনও এই শত শত তরুণ প্রাণের আত্মবলিদানের মূল্য?

স্বাধীনতা কেউ দেয় না তাকে ছিনিয়ে নিতে হয় সুকঠোর সংগ্রাম ও বলিদানের মাধ্যমে।

গোপীনাথ সাহা, মাষ্টারদা সূর্য সেন, বিনয়, বাদল, দীনেশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ভগৎ সিং, আশফাকউল্লা খানেরা সেই আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, সাহসের জ্বলন্ত উদাহরণ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন