Lenin Cover 2025 III

দৈনিক লাভ-ক্ষতিতে নয়, ইলিচের রাজনীতি ভাবতে শেখায় দশকে

রবিকর গুপ্ত

“অবশেষে অনেক দেরি করে গাড়ি এসে দাঁড়ালো প্ল্যাটফর্মে। ‘মার্সেই’ গাওয়া শুরু হল। অনেকে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে এলেন। চতুর্দিকে স্বাগত চিৎকার। আমরা ইম্পেরিয়াল ওয়েটিং রুমে বসে রাইলাম। বলশেভিক নেতারা শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। বিজয়ী তোরণগুলির নিচ দিয়ে প্ল্যাটফর্ম বরাবর মিছিল চলেছে। সারিবদ্ধ সৈনিকদল এবং তাদের ফাঁকে ফাঁকে শ্রমিকরা স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে। ব্যাজার মুখে চাইদ্জে (জর্জিয়ান মেনশেভিক নেতা ও পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী সমিতির সভাপতি) উঠে দাঁড়ালেন এবং তার পেছন পেছন আমরাও ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম মিটিং-এর জন্য।…শ্লিয়াপনিকভ পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। যেন পুলিশের দারোগা গভর্নরের আগমন ঘোষণা করছেন, এইরকম ভাব নিয়ে তিনি হন্তদন্ত পায়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন আর অপ্রয়োজনীয় ভাবে চিৎকার করতে লাগলেন – ‘দয়া করে রাস্তা দিন কমরেড ! কমরেডরা পথ ছাড়ুন !’

Lenin's Political Lesson 2025

শ্লিয়াপনিকভের পেছন পেছনই একটি ছোটো দল ঘরে পা দিল। তারপরেই ওয়েটিং রুমের দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন বা বলা ভালো দৌড়ে এলেন লেনিন। মাথায় একটা গোল টুপি, মুখ ঠান্ডায় জমে গেছে আর হাতে একটা চমৎকার ফুলের তোড়া। দৌড়ে ঢুকেই ঘরের মাঝামাঝি চাইদ্জের সামনে লেনিন এমনভাবে দাঁড়ালেন যেন কোনও অপ্রত্যাশিত প্রতিবন্ধক তাঁর গতি রোধ করেছে। চাইদ্জে, সেই ব্যাজার মুখেই, একটি ‘স্বাগত ভাষণ’ পাঠ করলেন যার শব্দচয়ন ও পাঠের সুর দুই-ই ছিল ধর্মোপদেশের মতো  -

‘কমরেড লেনিন, পিটার্সবার্গ সোভিয়েতের নামে এবং বিপ্লবের পক্ষ থেকে আপনাকে আমরা রাশিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি…কিন্তু – আমরা মনে করি বিপ্লবী গণতন্ত্রের বর্তমানে প্রধান কাজ হল বাইরে থেকে বা ভেতর থেকে তাকে আক্রমণ করার সকাল চেষ্টা প্রতিহত করা। আমরা বিশ্বাস করি এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনৈক্য একেবারেই কাম্য নয়, বরং সকল গণতন্ত্রী শক্তিকে একত্র করা প্রয়োজন। আমাদের আশা, আপনি এই উদ্দেশ্য সাধনে আমাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করবেন।’

চাইদ্জে থামলেন। আমি তো অবাক। এ আবার কেমন ‘স্বাগত’ জানানোর কায়দা আর তার সঙ্গে এই ‘কিন্তু’ জোড়ার অর্থ কি ?

কিন্তু লেনিন জানতেন এর প্রত্যুত্তরে কেমন আচরণ করতে হবে। স্বাগত ভাষণ পাঠের সময় তিনি এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন যেন এখানে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছুই এখানে হচ্ছে না। এদিক ওদিক দেখছিলেন আশেপাশের লোকজনদের দিকে, মাঝে মাঝে ওয়েটিং রুমের ছাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কখনও বা ফুলের তোড়াটা (যা তাঁর বাকি বাহ্য পরিচ্ছদের সঙ্গে একেবারেই বেমানান) ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলেন। ‘স্বাগত ভাষণ’ শেষ হলে লেনিন কার্যনির্বাহী সমিতির প্রতিনিধিদলকে কার্যত উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং তারপর তাঁর ‘প্রত্যুত্তর’ দিলেন –

‘প্রিয় কমরেডরা- সৈনিক, নাবিক আর শ্রমিকরা ! আমি ভীষণ আনন্দিত যে আমি আপনাদের ব্যক্তিগত ভাবে অভিনন্দন জানাতে পারছি বিজয়ী রুশ বিপ্লবের নায়ক রূপে আর একই সঙ্গে আপনাদের আমি  অভিনন্দন জানাচ্ছি বিশ্বব্যাপী সর্বহারা সেনার অগ্রগামী বাহিনীর ভূমিকা গ্রহণের জন্য…এই বোম্বেটে সুলভ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আদতে ইউরোপ ব্যাপী গৃহযুদ্ধের সূচনা…সেই সময় দূরে নেই যখন আমাদের কমরেড, কার্ল লিবনিখ‌্ট-এর আহ্বানে জনতা হাতিয়ার ঘুরিয়ে দেবেন তাঁদের পুঁজিবাদী শোষকদেরই দিকে…বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভোর আসন্ন…যে কোনও দিন ইউরোপীয় পুঁজিবাদ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আপনারা যে রুশ বিপ্লবকে সফল করেছেন তা একটা নতুন পথ আর একটা নতুন যুগের রাস্তা খুলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক !’

এ আদৌ চাইদ্জের ‘স্বাগত ভাষণ’-এর উত্তর ছিল না এবং এতকাল অবধি রুশ বিপ্লবের যে ‘প্রেক্ষিত’ আমরা সবাই মেনে এসেছিলাম তার সঙ্গে এর কোনও সঙ্গতি-ই ছিল না। উপস্থিত সকলেই, দল-মত নির্বিশেষে, এই বিষয়ে সহমত ছিলেন।

কিন্তু আমার মনে হল, কি আশ্চর্য ভাষণ ! আমাদের সকলের চোখের সামনে বিপ্লবকে গ্রাস করে ফেলেছিল যে দৈনন্দিন উঁচ্ছবৃত্তির অভ্যাস, তাকে সরিয়ে এক উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো আর অপূর্ব মশাল জ্বলে উঠল দপ করে, যাতে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেল যে ‘সত্য’-গুলি আঁকড়ে আমরা বেঁচেছিলাম তার সবকিছু। ট্রেনে আগত লেনিনের কন্ঠ ছিল এক ‘বহিরাগত স্বর’। এই কন্ঠ রাশিয়ার বিপ্লবের সঙ্গীতে বয়ে নিয়ে এসেছিল এমন একটি সুর যার মধ্যে কোনও বৈপরিত্য ছিল না, যা ছিল অভিনব, কঠোর ও অপ্রস্তুত কানকে বধির করে দেওয়ার মতো।”

দিনটা ছিল ১৬-ই এপ্রিল। দীর্ঘ দশ বছরের নির্বাসন শেষে পেট্রোগ্রাদের ফিনল্যান্ড স্টেশনে পা রেখেছিলেন লেনিন। উপরে বর্ণিত তাঁর এই ভাষণ এখন ইতিহাসে পড়ানো হয় রুশ বিপ্লবের একটি মাইলফলক হিসেবে। অথচ এই ভাষণ যাঁদের সামনে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কিন্তু মোটেই তেমন মনে হয়নি। শত্রুপক্ষের কাছে তো বটেই, এমনকি বলশেভিকদের কাছেও এই ভাষণের গুরুত্ব ধরা পড়েনি। ফিসফাস কথা ছড়িয়ে গেছিল সর্বত্র। বলশেভিকদের এই নবাগত নেতাটি একেবারেই ‘বাস্তব রাজনীতি’ বোঝেন না। ইনি শুধু ‘তত্ত্ব’-ই বোঝে। শত্রুরা হয়েছিল উল্লসিত। বন্ধুরা হয়েছিল বিমর্ষ। এই তাহলে লেনিন ? এত বাস্তব বিবর্জিত ? রাশিয়ায় তখন জার্মানদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমের জোয়ার বইছে, মেনশেভিক, এস-আর এমনকি বলশেভিক নেতাদের অনেকেই জার্মানদের বিরুদ্ধে ‘বিপ্লবী প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার আহ্বান করছেন। জার্মান সরকার তাঁর রাশিয়া ফেরার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বলে ইতিমধ্যেই লেনিনের ‘জার্মান চর’-এর তকমা জুটেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কাছ থেকে একটা সংযত ও রাজনীতির ‘বাস্তবতা’-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাষণই প্রত্যাশিত ছিল। ওদিকে না গিয়ে লেনিন স্টেশনে নেমে প্রথম বক্তৃতায় কি বললেন ? জার্মানির বিরুদ্ধে কিছু বললেন ? না। বরং বললেন জার্মান জনতা লিবনিখটের নেতৃত্বে বন্দুক তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেবে, তারা রাশিয়ার শত্রু নয়। আসল শত্রু ঘরে, বাইরে নয়। বলশেভিক নেতাদের অনেকে নামলেন সর্বত্র ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এ। ‘না,না - উনি ঠিক ওভাবে বলতে চাননি।’ ‘একদম না ! আমরাও জার্মানদের সমান ঘৃণা করি, আমরাও সাচ্চা রাশিয়ান। আমরা জার্মান দালাল নই।’ – ইত্যাদি প্রভৃতি কথা ভেসে বেড়ালো স্থানীয় বলশেভিক বক্তৃতায়।

শুধু উপস্থিত দুইজন তৎক্ষণাৎ বুঝেছিলেন, এই বক্তৃতার গুরুত্ব কি। শুধু দুইজন বুঝেছিলেন, রাশিয়াতে ঠিক কি ধরণের লোক পা রেখেছেন। একজন তাঁর বন্ধু, আরেকজন তাঁর প্রবল সমালোচক। বন্ধুটি হলেন বলশেভিক বিপ্লবী আলেকজান্দ্রা কোলনতাই। আর শত্রু ? তিনি হলেন উপরে যাঁর আত্মজীবনী থেকে অনুবাদ করে উদ্ধৃতিটি দেওয়া হল, সেই মেনশেভিক নেতা ন. ন. সুখানভ। সুখানভ বলশেভিকদের ঘৃণা করতেন। তিনি লেনিনের তিনি প্রবল সমালোচক। ব্যক্তি লেনিনেরও, লেনিনের আদর্শেরও। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের তাৎপর্য তিনি ধরতে পেরেছিলেন। তিনি এবং কোলনতাই, দুজনেই বুঝেছিলেন রাশিয়ায় পদার্পন করেছেন এমন এক নেতা, যিনি স্বল্প মেয়াদের রাজনীতির লাভ ক্ষতিতে ভাবছেন না, যিনি এমন একটি প্রকল্প খাড়া করতে বদ্ধপরিকর যা ইতিহাসে আগে কখনও কেউ খাড়া করতে পারেনি, যাঁর জনতার চেতনা ও ক্ষমতার প্রতি রয়েছে প্রবল বিশ্বাস। তাঁরা দুজনেই বুঝেছিলেন স্বল্পমেয়াদী লাভক্ষতির দিকে নজর রেখে দৈনিক কথার মার-প্যাঁচ মারার রাজনীতি লেনিনের নয়, তিনি দিনে ভাবেন না, ভাবেন দশকে, এমনকি শতাব্দীতেও।

আজ, ইলিচের জন্মদিনে তাঁর বহু গুণের মত এই গুণটিও স্মরণ করা কর্তব্য।

ইলিচ মহামানব ছিলেন না, মার্কসবাদী হয়ে মহামানবের তত্ত্বে কেউ বিশ্বাসীও হতে পারে না। কিন্তু দিকনির্দেশক বিলক্ষণ ছিলেন। যে গোলকধাঁধাঁয় আজ কেউ কেউ দিশেহারা, তাঁর এই গুণ সেখান থেকে উদ্ধারেরই কম্পাস।

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন