"The internal machinery of life, the chemistry of the parts, is something beautiful. And it turns out that all life is interconnected with all other life." Richard Phillips Feynman
কোভিড-১৯ মহামারীর আকার নিয়েছে বিশ্বজুড়ে শেষ দুমাসে। এই প্রতিবেদন লেখা চলছে যখন পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৩৫৫৭০ জন, মারা গিয়েছেন ৭৪১৩৪ জন। এই মহামারী রুখতে এখনো অবধি কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায় নি, এটুকুই জানা গেছে যে আমরা একে অন্যের সাথে আগামী কয়েকটি দিন, মাস দূরত্ব বজায় রেখে চললে এই ভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে, মানুষ প্রতিদিন নিত্যনতুন খবর পাচ্ছেন এবং জানা-অজানা আশংকায় সন্ত্রস্থ হচ্ছেন। মাথার উপরে নিরাপদ আশ্রয় নেই, খাবার ও পানীয় জলের দুর্বিষহ অভাব যাদের রোজনামচা সেই মানুষগুলি সবচেয়ে দুর্দশার শিকার, একদিকে মহামারী অন্যদিকে ভুখমারি - এইদুয়ের মাঝখানে অপেক্ষা করতে করতে তারা হাঁটতে শুরু করেছেন দেশের জাতীয় সড়ক ধরে। দৈনিক রোজগারের ভরসায় বেঁচে থাকা মানুষগুলির একমাত্র চিন্তা কবে এই প্রতিবন্ধকতা কাটবে? এই অবস্থায় জনমানসে অজস্র কুসংস্কার, মিথ্যা ভয় এবং অবাঞ্ছিত ভুল প্রচার সহজেই জায়গা করে নেয়। আমাদের দেশে সেই প্রভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দুর্যোগের সময়ে মানুষ বেঁচে থাকতে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইবেন, এরকম হওয়া স্বাভাবিক - কিন্তু সেই সুযোগে অপবিজ্ঞান, অন্ধবিশ্বাস এসবকিছু জনমানসে হামলা চালায়। মনে রাখতে হবে এই পরিস্থিতিতে আমাদের ভরসা করা উচিত একমাত্র বিজ্ঞানচেতনার উপরে, সঠিক তথ্যের উপরে এবং সমস্ত অপপ্রচার কিংবা অন্ধবিশ্বাসকে দূরে সরিয়েই।
এই সময়ে আমাদের দেশের অবস্থাটা ঠিক কেমন? করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধ গবেষণার কাজ কতটা এগিয়েছে? বিভিন্ন সুত্র থেকে ভেসে আসা তথ্য এবং তত্বের মিল ঠিক কতটা? এধরনের কিছু জরুরী প্রশ্ন নিয়ে সাংবাদিক জ্যোতি মালহোত্রা কথা বলেছেন ট্রান্সলেশনাল হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডঃ গগনদীপ কাং'র সাথে। এই ট্রান্সলেশনাল হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আসলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীনে থাকা ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনলজি'র একটি স্বতন্ত্র গবেষণা শাখা। যেকোনো মহামারী সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতে ICMR কিংবা NIV'র পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য তথ্যসুত্র এরাই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ট্রান্সলেশনাল হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নিজেদের ওয়েবসাইটে এদের কাজ সম্পর্কে ঘোষণা করেছে "They exist to serve society through science" অর্থাৎ বিজ্ঞানের উপরে ভরসা করেই তারা কাজ করেন। সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে সঠিক তথ্য, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং এই সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতির চিত্র যা মানুষের মনে অযাচিত ভয়ের বদলে ভরসাই যোগাবে।
করোনা ভাইরাস সাধারণ অবস্থায় খোলা বাতাসে ঘুরে বেড়ায় না, Droplet Infection'ই এই সংক্রমনের প্রধান মাধ্যম। এই কোভিড-১৯ রোগের সাধারণ উপসর্গগুলী হল সর্দি (Cough), জ্বর (Fever) এবং শরীরে ব্যাথার অনুভব (Body Ache)। সংক্রামিত ব্যাক্তির থেকেই মূলত অন্যদের মধ্যে এই রোগ আক্রমন করে। এটি মূলত Droplet Infection, ফলে সংক্রামিত ব্যাক্তির কাছাকাছি যারা থাকবেন যেমন পরিবারের লোকজন কিংবা চিকিৎসক , নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা - তাদেরই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই মাস্ক এবং PPE (Personal Protective Equipment) বা সুরক্ষা পোশাকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে প্রথম সংক্রামিতদের, তারপরে তাদের পরিবারের লোকজনেদের এবং চিকিৎসক , নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের। জনসাধারনের জন্য, যারা এরকম রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে আসছেন না তাদের ক্ষেত্রে মাস্ক বা ঐধরণের কিছুর একান্ত প্রয়োজন নেই যদি না তারা সংক্রমণের আওতায় আসেন। এই জন্য সঠিক অর্থে Social Distancing'ই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনে একমাত্র উপায়। এই রোগের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে যারা বিভিন্ন গুরুতর শারীরিক সমস্যা যেমন Diabetics, Cardio-Vascular Disorder, Auto-immune Disorders কিংবা Hypertension'এ ইতিমধ্যেই ভুগছেন।
এই সংক্রমণ সাধারণভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলেই তার ফলাফল মৃত্যু এই ধারণা একেবারেই ভুল। ডঃ গগনদীপ কাং ব্যাখা করেছেন ৮০% মানুষের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ আদৌ প্রাণঘাতী নয়। তারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি এবং যথাযথ চিকিৎসার ফলে বাড়তি কোন ঝুঁকি ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। বাকি ২০%'র জন্য এই সংক্রমণ প্রধানত তিন ধরনের সমস্যা তৈরি করবে যখন খুব দ্রুত এবং গুরুতর চিকিৎসার কাজ শুরু করতে হবে।
১. সংক্রামিত কারোর যদি শ্বাসকষ্ট হয় তবে সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
২. হাসপাতালে ভর্তি আছেন যারা তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই যথাযথ চিকিৎসায় (নিয়মমতো সেবা-যত্ন এবং কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাবস্থা) তারা সুস্থ হতে পারেন। এদের মধ্যে কারোর অবস্থার অবনতি হলে ভেন্টিলেটর ব্যাবহার করতে হবে।
৩. আক্রান্তদের মধ্যে খুবই গুরুতর শ্বাসকস্ট যুক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে (অক্সিজেন নল কিংবা ভেন্টিলেটর ব্যাবহার করার পরেও অবস্থার অবনতি হতে থাকলে) মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
সারা পৃথিবীতে যত বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন তার বিভিন্ন পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসছে। এধরণের রোগের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান সবসময় সংখ্যার হিসাবে দুই দেশকে তুলনায় আনতে পারে না। দুটি বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে সামাজিক জীবনযাত্রার ঐতিহাসিক এবং বর্তমান অবস্থার তারতম্য, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার বিভিন্নতা ছাড়াও আরও অনেক প্রাচল (Parameters) কে হিসাবের মধ্যে না আনলে পরিসংখ্যান মানুষকে ভুল পথে চালিত করতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক হিসাব করার জন্য কিছু গাণিতিক মডেল (Mathematical Model) রয়েছে যেগুলি ব্যাবহার করে এক একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানার মধ্যে সংক্রমনের আসল চেহারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে ইউনাইটেড কিংডম'র ইম্পিরিয়াল কলেজের বানানো গাণিতিক মডেল (Mathematical Model) 'র উল্লেখ করেন ডঃ গগনদীপ কাং; মহামারী গবেষণায় এই মডেলটিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী ধরা যেতে পারে।
আমাদের দেশে এইধরনের মডেল ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা দুটি। ১. এখনও অবধি প্রাপ্ত তথ্যসমুহ এই পর্বে মূলত বিদেশ থেকে এসেছেন তাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা। ২. দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপকরকম পরীক্ষার কাজ এখনও শুরু না হবার ফলে কোনোরকম ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এই ধরনের মহামারী মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন বিষয় হল পূর্বপ্রস্তুতি( Preparedness)। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন জনগণকে এর মোকাবিলায় সঠিক নিয়ম-বিধি সম্পর্কে অবহিত করা এবং দূরত্ব বজায় রাখার নীতি মেনে চলা (Education and Distancing)। একই সাথে প্রয়োজন যত দ্রুত এবং যত বেশি সম্ভব মানুষের ব্যাপকহারে পরীক্ষা করার ব্যাবস্থা করা।
WHO (World Health Organisation) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সংক্রমনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ওষুধ বা ভ্যাকসিন গবেষণায় দ্রুত সাফল্য নিশ্চিত করতে খুবই গুরুত্বপুর্ন একটি পদক্ষেপ (Protocol) গ্রহন করেছে। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে Project Solidarity, যাতে যে কোন চিকিৎসক যার পক্ষে আক্রান্তদের চিকিৎসার যথাযথ সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তারা WHO (World Health Organisation) অথবা এদেশে ICMR নির্দেশিত ওষুধগুলির প্রয়োগ করে তার ফলাফলের সব খুঁটিনাটি ঐ Project Solidarity'র ওয়েবসাইটে সংযুক্ত (Data Feed) করতে পারেন, এর ফলে এই রোগের সঠিক ওষুধ আবিষ্কার হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত দ্রুত হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতে অনেকগুলি গবেষণা সংস্থা এই লক্ষ্যে একসাথে কাজ করছে। আমাদের দেশও Coalition of Epidemic Preparedness Innovations বা সংক্ষেপে CEPI গঠন করার মধ্যে দিয়ে এই কাজে যুক্ত হয়েছে। এই Coalition of Epidemic Preparedness Innovations বা সংক্ষেপে CEPI প্রতিষ্ঠা করা হয় ইবোলা ( Ebola) মহামারীর পরেই। ইতিমধ্যেই সেই কাজে অগ্রগতি হয়েছে। এখনও অবধি দুটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক গবেষণার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, একটি চীনের তৈরি করা ভ্যাকসিন - অন্যটি আমেরিকার। কিন্তু এধরনের ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন জনসাধারনের কাছে পৌঁছতে ন্যুনতম ১২ মাস সময়ের প্রয়োজন -ততদিন অবধি Social Distancing ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।
ICMR বা Indian Council of Medical Research একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে সংক্রামিত ব্যাক্তিদের চিকিৎসার কাজে যুক্ত চিকিৎসক , নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য Hydroxychloroquine ব্যাবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। জনসাধারনের মধ্যে এই Hydroxychloroquine ব্যাবহার করার হিড়িক পড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই ধরণের ব্যাবহার বিপদ ডেকে আনতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বেলাগাম ভাবে Hydroxychloroquine সেবন করা হলে শরীরে প্রভুত পার্শপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে যা সত্যিই বিপজ্জনক হতে পারে। এই Hydroxychloroquine'র ব্যাবহার শুধুমাত্র তাদেরই জন্য যারা সংক্রামিতদের চিকিৎসার কাজে যুক্ত রয়েছেন।
মহামারী একটি বিপদ, সেই বিপদের সম্মুখিন গোটা দেশ। এই অবস্থায় সঠিক চেতনাই একমাত্র আমাদের সহায় হতে পারে, বিজ্ঞানের উপরে ভরসা রাখতেই হবে। কোন ভোজবাজি, কুসংস্কার কিংবা অন্ধবিশ্বাস এই লড়াইকে মজবত করার বদলে আরও দুর্বল করবে।
বিজ্ঞান কোন জাদু নয়, আর কোন জাদুমন্ত্র মানুষকে এই বিপদের হাতে থেকে বাঁচাবে না। মানুষকে বাঁচাবে বিজ্ঞান, মানুষকে বাঁচাবে শেষ অবধি মানুষ নিজেই। আমরা যেন মনে রাখি "Science is the pursuit of knowledge and understanding of the natural and social world following a systematic methodology based on eviedence" - The Science Council in Britain.
তথ্যসুত্রঃ ১. দ্য প্রিন্ট ( The Print), ২. What Is Science - Sundar Sarukkai, Published by National Book Trust, India
ছবিঃ দ্য প্রিন্ট ( The Print)'র সাক্ষাতকার থেকে স্ক্রিনশট