গত জুলাই মাসে ‘সংগ্রামী হাতিয়ার’ পত্রিকার ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে কলকাতায় আসেন পি সাইনাথ। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচকের ভূমিকায় আজকের ভারতে মিডিয়ার ভুমিকা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করেন তিনি।
সেই বক্তব্যেরই মূল অংশটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হল
পি সাইনাথ
পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ায় আমার সহকর্মীদের কিছুদিন আগেই একটি নির্দিষ্ট কাজ করতে বলি। গত জুন মাসের ২৬ তারিখ নাগাদ। আগামী দুই সপ্তাহে দেশের সমস্ত বড় খবরের কাগজের সম্পাদকীয় কলামে কি লেখা হচ্ছে সেইসব একজায়গায় এনে খুঁটিয়ে পড়াই ছিল আমাদের কাজ। কাজটি শেষ করতে তিন সপ্তাহ মত সময় যায়।
আসলে আমরা কি করতে চাইছিলাম?
২৫ জুন, অত্যন্ত নির্লজ্জ কায়দায় তিস্তা শীতলবাদ’কে গ্রেপ্তার করা হয়, এর কিছুদিন পরেই আটক করা হয় মহম্মদ জুবেইর’কে। তাই ২৬ তারিখ থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহে কোথায় কি লেখা হচ্ছে সেইসব খুঁজে দেখা হবে বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের সাথে কর্মরত কমবয়সী সাংবাদিকরা কাজ করার পাশাপাশি এতে কাজ শেখারও সুযোগ পাবে, তাই তারাও উৎসাহের সাথেই কাজটি শেষ করে। আমি তাদের বলেছিলাম খবরের কাগজে দুটি নির্দিষ্ট অংশে বাড়তি গুরুত্ব দিতে, একটি হল সম্পাদকীয় কলাম- আরেকটি সম্পাদকের উদ্দেশ্যে লেখা চিথিপত্র (কাগজের জগতে যাকে অপ-এড পেজ বলা হয়)। আসলে এতে বোঝা যায়, কাগজ যারা চালাচ্ছেন তারা কি ভাবছেন এবং সেইসব কাগজ যারা পড়ছেন তাদের মাথায় কি প্রতিক্রিয়া চলছে। কর্তৃপক্ষেরা যদিও সব মতামতকে গুরুত্ব দেন না, তাহলেও কিছুটা ভারসাম্য রাখতে দু একজন বামপন্থীদের চিঠিও কখনো কখনো ছাপা হয়। দু’সপ্তাহ পরে প্রায় ৭০টি সম্পাদকীয় প্রতিবেদন জড়ো হয়। দেখা গেল, প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা থাকলেও তিস্তা শীতলবাদ ও মহম্মদ জুবেইর সম্পর্কে একটি শব্দও ছাপা হয় নি। মতামতের কলামে ঐ প্রসঙ্গে দু’একটি কথা থাকলেও কার্যত কোনও সংবাদ সংস্থাই দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রসঙ্গে একটি কথাও লিখলেন না। তিস্তা এবং জুবেইর দুজনেই সাংবাদিকতা, তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার মতো কাজে যুক্ত ছিলেন, তাও সবাই চুপ করে রইলেন।
এমনটা হলে জনমানসে তার কি প্রভাব পড়ে? এতে মানুষের মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সংশয় তৈরি হয়। এই কারনেই সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এতবড় অন্যায় দেখেও সংবাদমাধ্যমগুলি মোদী সরকারের সামনে মাথা নিচু করে রইল, এতেই বোঝা যায় আজকের পরিস্থিতি কেমন। এহেন চুপ থাকার কারণ কতটা ভয় আর কতটা যা চলছে তার প্রতি সম্মতি, সেই নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যম যে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ একথায় কোনও বিতর্ক নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে ২৫জুন তারিখটি আরও একটি কারনে গুরুত্বপূর্ণ। ঐ দিনেই আমাদের দেশে ‘জরুরী অবস্থা’ জারী করা হয়েছিল। বিগত সাত বছরে আমাদের দেশের পরিস্থিতি ‘জরুরী অবস্থা’র চাইতেও খারাপ হয়েছে। ইদানিং ‘অঘোষিত জরুরী অবস্থা’ বলে একটা কথা চালু হয়েছে, এসব বলে আসল কথাটাকেই আড়াল করা হচ্ছে। আজকের ভারত একটি চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র এই প্রসঙ্গে কোনও বিতর্কই নেই, এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের কর্মসূচী কি হবে সেই নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গেই কিছুটা পিছনে ফিরে দেখা যাক।
স্বাধীনতার পর থেকে কারা আমাদের দেশ শাসন করেছে? গত কুড়ি বছর ধরে এই বিতর্কে আমি কিছু কথা বলে এসেছি। দুঃখের বিষয় এটাই যে, এতদিন ধরে আমি যা বলেছি সেইসবই এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে। আমার বক্তব্য ছিল আমরা এমন এক জোট শাসনে রয়েছি যার একদিকে রয়েছে সামাজিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা, আরেকদিকে মুক্তবাজার ব্যবস্থার অন্ধ সমর্থকেরা- এদের আমি ‘বাজারি মৌলবাদী’ই বলি। এই দুপক্ষের নির্বিঘ্ন বিবাহের ফলাফল আজকের কর্পোরেট মিডিয়া। বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিতদের কথা মনে রাখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। এইসব বিশিষ্টজনেরা আগেও ভালো অবস্থায় ছিলেন, এখনও ভালোই রয়েছেন। এদের জীবনে কোন প্রভাব পড়েনি। এরাই যোজনা কমিশনের উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন, ইদানিং নীতি আয়োগের সাথেও রয়েছেন। একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ আরেকদিকে বাজারি মৌলবাদের মাঝে সেতু হিসাবে কাজ করছেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরা দুজন একইসাথে ঐ দ্বিবিধ গুণেরই অধিকারী- ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং মুক্ত বাজার সমর্থনের নীতি। এরা এই দুয়েরই মুখপাত্র। বুক ঠুকে দুজনেই সেই কথা তারা বারে বারে ঘোষণাও করেছেন। সংবাদসংস্থাগুলি এইসব প্রসঙ্গে দুরকম অবস্থান নিয়েছে, হয় তারা এই নিয়ে মুখ বন্ধ রেখে চলছে, নাহলে, যা ঘটছে তাকেই সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে।
দেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর বদল ঘটছে, এটুকু বললেই চলবে না। আজকের শাসক আসলে সেইসবকিছুকেও বদলে দিচ্ছে যা আজ থেকে কূড়ি বছর আগে তারা নিজেরাই প্রচার করত। একেই বলা হয় নট অনলি রিরাইটিং দ্য হিস্টরি, বাট অলসো রিরাইটিং দেয়ার ওন রিরাইটিং। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে একটি ওয়েবসাইট নির্মিত হয়েছে, আমি চাইব সকলেই এই ওয়েবসাইটে চোখ রাখুন। ‘আজাদি কে অমৃত মহোৎসব’ নামের এই ওয়েবসাটের কাজে বাজেট নির্ধারিত হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। আগামী দিনে ওয়েবসাইটের ‘কাজ’ এবং খরচ আরও বাড়তে চলেছে, ফলে সেই বাজেট ১১০ কোটি টাকা অবধি বৃদ্ধি পাবে। পাঁচটি জরুরী বিষয়ে প্রচারের অসাধারণ কাজ করবে এই ওয়েবসাইট। কি কি সেই বিষয়? স্বাধীনতার সংগ্রাম, ৭৫ বছরে চিন্তাধারা, ৭৫ বছরে সমাধানকল্প (এটির অর্থ কে বুঝেছেন আমার জানা নেই), ৭৫ বছরে কর্মসূচী, ৭৫ বছরে আমাদের প্রাপ্তিসমূহ ইত্যাদি। তিরিশ মিনিট অন্তর এই ওয়েবসাইটে নতুন কিছু আপলোড হবে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে দেশজুড়ে অসংখ্য ইভেন্ট উঠে আসবে এই ওয়েবসাইটের হোম পেজে। যেমন, কোন ব্যাক্তি কোথাও বেড়াতে গিয়ে নিজের ইচ্ছায় বন্দেমাতরম গাইলে সেই ঘটনাকে এরকম একটি ইভেন্ট ধরা হবে। এই ‘কাজ’ করতে ১০০ কোটি টাকার বাজেট। ইতিমধ্যেই ৬৭০০টি ইভেন্ট ‘কভার’ করা হয়েছে।
কর্ণাটকে ছোটদের পাঠ্য ইতিহাস বই থেকে টিপু সুলতান এবং ভগত সিং’কে বাদ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গায় সাভারকরের নাম যুক্ত করা হয়েছে। এই বিষয়ে সরকারের ব্যখ্যা হল তারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনুচ্চারিত কতিপয় মহান ব্যক্তিত্বের কথা প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এইবার সাভারকরের প্রসঙ্গে কিছু কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ১৯১১ সাল অবধি তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন, পরে তাকে গ্রেপ্তার করে আন্দামানের কারাগারে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ প্রভুদের কাছে একের পর এক মুচলেখা লিখতেই আন্দামানের কারাগারে বন্দী থাকার সময়টুকু ব্যয় করেছিলেন তিনি। সেইসব মুচলেখায় তিনি নিজেকে সংশোধনের কথা যেমন বলেছিলেন, তেমনই জানিয়েছিলেন মুক্তি পেলে বাকি জীবনটা নওজোয়ানদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই ব্যয় করবেন। মুচলেখা সহ তার ঐ পর্বে লেখা যাবতীয় চিঠিপত্র এখন বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যে কেউ চাইলে সেসব পড়তে পারেন। উপরোক্ত ওয়েবসাইটের কথা ছেড়ে এবার ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক। ১৯২৬ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়। দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ব্যারিস্টার সাভারকর- বইটি লেখেন জনৈক চিত্রগুপ্ত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে চিত্রগুপ্ত নামটি কিছু গুরুত্ব বহন করে, পৌরাণিক গাথায় রয়েছে চিত্রগুপ্ত হলেন যমরাজের হিসাবরক্ষক। ঐ বইতে সাভারকর’কে এক অসামান্য মেধাসম্পন্ন বিপ্লবী বীর বলে ব্যখ্যা করা হয়েছিল। বইটি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪২ সাল নাগাদ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংস্করণ। প্রথম দুটি সংস্করণে চিত্রগুপ্তের নাম ছিল, তৃতীয় সংস্করণে সেই নাম বদলে ছাপা হয় সাভারকর। অর্থাৎ, সাভারকর নিজেই নিজের সম্পর্কে বই লিখে প্রচার করেছেন তিনি কত মহান বিপ্লবী ছিলেন! আমি সবাইকেই এই বইটি অন্তত একবার পড়তে বলবো, একজন ব্যক্তি কিভাবে নিজের মহান আত্মজীবনী’কে কার্যত জীবনী’মূলক গ্রন্থে পর্যবসিত করেন, নিজেই নিজেকে মহান প্রতিপন্ন করেন সেইসবের এক অসামান্য নিদর্শন সাভারকরের এই রচনা। ১৯১১ সালের আগে সাভারকরের যতটুকু যা ভূমিকা ছিল তাকে নাকচ না করেও বলা যায় এমন কাজ সাহিত্যের দুনিয়ায় অপরাধ হিসাবে গন্য করা হয়।
টিপু সুলতান’কে বিজেপি সরকার নাকচ করছে কেন? কেন আমি বলছি ‘দে আর রিরাইটিং দেয়ার ওন রিরাইটিং’? আমাদের অনেকেরই মনে আছে ১৯৯২ নাগাদ দূরদর্শনে ‘দ্য সোর্ড অফ টিপু সুলতান’ বলে একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক চলত। সঞ্জয় খান সেই ধারাবাহিকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তখনও সেই নিয়ে কিছু বিতর্ক হয়েছিল। এই ধারাবাহিকের কিছু দৃশ্য কর্ণাটকে শ্যুট করা হয়েছিল, সেই রাজ্যেও কিছু ঝামেলা পাকানো হয়। তখন সবে কিছুদিন হল জনসংঘ ভেঙ্গে বিজেপি গড়ে তোলা হয়েছে। তখন সেই পার্টির বয়ানে লেখা হত তারা গান্ধীবাদ সম্মত সমাজতন্ত্রের ধারনায় বিশ্বাসী। যদিও কিছুদিন পরেই নিজেদের বক্তব্য থেকে তারা ‘গান্ধীবাদ’ শব্দটি বাদ দেয়, আপাতত আমাদের আগ্রহের বিষয় হল সেই ‘সমাজতন্ত্র’। টিপু সুলতানের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে নিজেদের অবস্থা নির্ধারণ করতে তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টি একটি এক সদস্যের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ গড়েছিল। সেই ব্যক্তি ছিলেন বিজেপি’র প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট কে আর মালকানি। তিনি নিজে একজন সাংবাদিক ছিলেন। আরএসএস’র ইতিহাসে তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সংঘের ইংরেজি এবং হিন্দি মুখপত্র অর্গানাইজার ও পাঞ্চজন্য উভয়েরই সম্পাদক ছিলেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ডাংকেল প্রস্তাব ইত্যাদির সময় বামেদের মতো তিনিও সেইসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ঐ সময়েই টিপু সুলতান প্রসঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়। মনুস্মৃতি’র গোঁড়া সমর্থক, কট্টর আরএসএস কর্মী মালকানি সেই এক সদস্যের কমিটির কাজ শেষ করে লিখেছিলেন, ‘টিপু সুলতান সম্পর্কে যত বেশি পড়াশোনা করেছি ততই বেশি তার ব্যাক্তিত্বের প্রতি আকর্ষিত হয়েছি। টিপুই একমাত্র ভারতীয় রাজা যিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে প্রাণ বিসর্জন দেন। ইনি সেই রাজা যার রাজত্বে বাধ্যতামূলক দাসত্ব রোধ করতে আইন প্রণীত হয়। এর সময়েই প্রতি চার মাইল অন্তর বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, একেই বলা যায় ভারতের প্রথম পরিবেশ সচেতন শাসক। সরকারী অস্ত্রকারখানার প্রভাবে কাবেরি নদির জল দূষিত হতে শুরু হলে তিনি দ্রুত সেই কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।’- জেনে রাখা উচিত টিপু সুলতান সম্পর্কে মালকানি এইসব যা লিখেছেন সবকটিই ঐতিহাসিক সত্য। এইসব কথা তখন বিজেপি’ই বলেছিল, আজকের বিজেপি অন্যান্য অনেককিছুর পাশাপাশি নিজেদের ইতিহাসও ভুলিয়ে দিতে চাইছে।
আজকের ভারতে সংবাদমাধ্যমের একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা যা কিছু শাসকের পছন্দের তাকেই প্রচার করে চলা। আগে শাসকের বিরুদ্ধে জরুরী অনেক সমালোচনাই রেখে ঢেকে কিংবা নরম পন্থায় পরিবেশিত হত। আজকের মিডিয়ায় সেটুকুও আর অবশিষ্ট নেই, সরাসরি ধামধরা বলতে যা বোঝায় তাই চলছে। মোদী সরকার আসলে কি করছে? যা কিছু অনৈতিক, তারা সেইসবই বিরাট অহংকারের বিষয় হিসাবে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরছে। এইসব ক্ষেত্রে বড় বড় মিডিয়া সংস্থার বর্তমান ভূমিকা কার্যত অনুগত ভৃত্যের পর্যায়ে পরিণত হয়েছে।
এদেশে সাংবাদিকতার কাজে আমাদের পথ দেখিয়েছেন কারা? ভারতে সংবাদমাধ্যমের ইতিহাস অন্তত ২০০ বছর পুরানো। নবজাগরণের প্রথিকৃৎ রামমোহন রায় 'মিরাতুল অখবার' কাগজ প্রকাশ করতেন। সেই কাগজ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করলে ব্রিটিশ সরকার প্রেস আইন পাশ করে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে রামমোহন রায় সেই কাগজ প্রকাশ বন্ধ করে দেন, শাসকের আক্রমণ নেমে আসার ভয়ে কোনো আপস করেননি। করোনা মহামারীর সময়ে উত্তরপ্রদেশে কি ঘটল? মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য যাতে জনসমক্ষে না আসে সেই উদ্দেশ্যে যোগী সরকার ফতোয়া জারী করেছিল। একমাত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’ সেই ফতোয়া উড়িয়ে নিজেদের কাগজে সঠিক তথ্য সহ খবর প্রকাশ করে। পরে সেই সংস্থার দপ্তরে পুলিশ পাঠিয়ে, আয়কর সংক্রান্ত তদন্তের নামে কর্মরত সবাইকে হেনস্থা করা হয়েছে।
আমাদের কিছু বুনিয়াদি সত্য বারে বারে ঝালিয়ে নিতে হয়। এমনই এক জরুরি উপলব্ধি হল সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকতা এক না। সাংবাদিকতা একটা আদর্শনিষ্ঠ কর্তব্য যা পেশা হলেও একই লক্ষ্যে কাজ করে। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় সংবাদ সংস্থাগুলি নিজেরাই বিরাট মুনাফার মালিক হয়ে উঠেছে। বলা ভালো সংবাদ সংস্থাগুলি নিজেরাই বর্তমানে একেকটি কর্পোরেট ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আজকের ভারতের মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির আর্থিক মূল্য প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আগামী দুই বছরের মধ্যে সেই আর্থিক মূল্য বেড়ে হবে প্রায় ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এটুকু মাথায় রাখলেই বোঝা যায় এহেন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কাদের স্বার্থ রক্ষা করবে, কাদের স্বার্থে পরিচালিত হবে।
আজ যাদের আমরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে দেখছি না, শুনছি না- এরা আসলে কারা? এরাই ব্রিটিশ শাসনে আমাদের দেশের বিপ্লবীদের ডাকাত, লুঠেরা বলে খবরের কাগজে শিরোনাম সাজাত। ব্রিটিশ শাসনের সমীপে এদের ভূমিকা ছিল অনুগত প্রচারকের। আজ প্রভু বদলেছে ঠিকই, কিন্তু ভৃত্যের সেই মনোভাব একই আছে।
আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সংবাদমাধ্যমের গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। প্রখ্যাত সংবাদ সংস্থাগুলির পাতায় ১৯৪৩ সালে আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে খবর বেরোয়। প্রকৃত সত্য হল তার আগের বছরেই ঐ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেই তথ্য পাওয়া যাবে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকায় যারা তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও প্রকৃত সত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময় কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন না হলেও কিছু ছোটখাট সংবাদ সংস্থা (মূলত বাংলায় প্রকাশিত) একই ভূমিকা পালন করেছিল। এর চাপেই স্টেটসম্যান’র মতো সংস্থা ৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের খবর ছাপতে বাধ্য হয়।
আজকের ভারতে আমরা দ্বিবিধ আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছি। একদিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা যার অপব্যবহার করে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল নিজেদের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে মুনাফার শৃঙ্খলে সবকিছু জড়িয়ে ফেলায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতাটুকু কার্যত কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছে যার সুবাদে যা কিছুই হোক না কেন, কোথাও কোনও প্রতিবাদ নেই, কোনও বিরুদ্ধ স্বর নেই। এমনকি বুদ্ধিজীবীরা অবধি একই কারণে চুপ রয়েছেন। এই পরিস্থিতিকেই আমি ‘পলিটিক্যালি ফ্রি বাট ইম্প্রিসন্ড বাই প্রফিট’ বলতে চাইছি। আসলে এই অশুভ চক্র একদিকে আমাদের রাজনৈতিক চেতনার অবনমন ঘটাচ্ছে, আরেকদিকে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সবকিছুই লাভের অংকে, টাকার মূল্যে বিচার করার সংস্কৃতি নির্মাণ করছে।
আজকের ভারতে মিডিয়ার অবস্থা বুঝতে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। কোনও দেশে গণমাধ্যমের কাজে কতটা স্বাধীনতা রয়েছে সেই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একটি মাপকাঠিতে আমরা ইতিমধ্যেই অনেকটা নিচে নেমে রয়েছি। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের মধ্যে ২০২১ সালে ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে, গতবছর আমরা ছিলাম ১৩৯ নম্বর- আগামী বছর ১৫০ নম্বরে নামতে চলেছি। এর পরেও বলতে হবে আমাদের দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন?
এই পরিসংখ্যানের বিরুদ্ধে মোদী সরকার নিজেদের জবাব প্রস্তুত করতে জরুরী ভিত্তিতে একটি কমিটি তৈরি করেছিল। ঠিক জানিনা কোন ভাবনা থেকে তারা আমাকেও সেই কমিটিতে রেখেছিলেন। সেই কমিটির গুটিকয়েক সভায় আমি উপস্থিত হই। দেখা গেল, আমি এবং রজত শর্মা ব্যতীত উপস্থিত সকলেই উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা। এদের মনোভাব সম্পর্কে কিছু না বললেও চলে। অনেক জরুরী কথাবার্তার পরে সভায় আমার কিছু বলার সুযোগ হয়, প্রথমে আলোচনা করে পরে লিখিত আকারে কয়েক দফা প্রস্তাব জমা দিই। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় আমার পেশ করা প্রস্তাবগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ঠিক এর পরের সভায় সেই নিয়ে কোন কথাই হয় না। আগামীদিনে আমার প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে বলে দেওয়া হয়। রজত শর্মা প্রথম দিন থেকেই কোনো কথা বলেন নি, কয়েক দিন পরেই ‘কাজের চাপে’ ব্যস্ত থাকায় কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়ে নেন। সেই বিস্তৃত আলোচনা আজও হয়নি, এমনকি ঐ সরকারি কমিটির অফিসিয়াল ইমেইল আই ডি’টুকুও আর কাজ করছে না বলে শুনেছি। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গণমাধ্যম ও তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এটাই আজকের ভারত।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে- সৌভিক ঘোষ
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া