বিমান বসু
খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস বর্তমানে গণআন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট খাদ্য চাই দাবীতে উত্তাল হয় কলকাতা। ক্ষুধার্ত মানুষের উপরে বর্বর আক্রমন নামিয়ে আনে কংগ্রেস সরকার। সেই ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী কমরেড বিমান বসু। মূলত স্মৃতিনির্ভর এই নিবন্ধটি ২০২০ সালে রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়
আজ থেকে ৬২ বছর আগে ৩১শে অগাস্ট আমাদের রাজ্য খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন ১৯৫৮ সালেও হয়েছিল, সেবারের আন্দোলন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই ১৯৫৯ সালের আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে বছরের জুন মাসে রাজ্যের পঞ্চায়েত এবং ব্লক এলাকায় প্রচার শুরু হয়, জুলাই মাসে একই কায়দায় প্রচার শুরু হয়েছিল জেলা ধরে ধরে। এভাবেই সারা রাজ্যের কৃষক – খেতমজুরদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অগাস্ট মাসের ৩১ তারিখে কলকাতায় বড় সমাবেশ আয়োজিত হবে। সেইমতো আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়।
১৯৫৯ সালে ৩১শে আগস্ট আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মানুষের মিলিত বিক্ষোভ প্রদর্শন ছিল খাদ্যের দাবীতে। তখন স্লোগান হিসাবে আওয়াজ উঠেছিল “আমরা বাংলার জনগন, খাদ্য চাই”, “ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও”। এই স্লোগানের ভিত্তিতে বিশাল জমায়েত হয়েছিল অক্টোরলোনি মনুমেন্টের তলায় – তখনও শহীদ মিনার নামকরণ হয় নি। কথা ছিল মহাকরণ অভিযান হবে দুপুরবেলা দেড়টার সময়। কিন্তু অনেকগুলি রেল বহু জায়গায় আটকে পড়ে (কিছুটা মালগাড়ির সমস্যা ছিলই বাকিটা ছিল রেল দপ্তরের বাহানা) – ফলে যে ট্রেনগুলো বেলা একটার মধ্যে কলকাতায় ঢুকে পড়ার কথা ছিল সেগুল দুপুর আড়াইটে নাগাদ এসে পৌঁছায়। আমরা সবাই ভলান্টিয়ার হিসাবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
মহাকরণ অভিযান শুরু হল সাড়ে তিনটে নাগাদ। রাজভবনের দেওয়ালকে একপাশে আর আরেকদিকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনের রাস্তায় মিছিল গিয়ে পড়লে পুলিশের ব্যারিকেড মিছিল আটকায়। মিছিলে তখন লক্ষাধিক মানুষ, স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আমরা সেই মিছিলের দুপাশে হাতে হাত রেখে শিকলির মতো করে এগোচ্ছিলাম। ঐ সময় জ্যোতি বসুর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী থাকায় তিনি কলকাতাতেই আত্মগোপন করেছিলেন – মিছিলে থাকতে পারেন নি। পুলিশ ঐ এলাকায় অসংখ্য প্রাইভেট বাস এবং প্রিজন ভ্যানের ব্যাবস্থা করেছিল। আমাদের ধারণা হয়েছিল পুলিশ ব্যাপক গ্রেফতারী চালাবে। মিছিল শুরু হবার দুঘন্টা পরে যখন বলা যায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে একদিকে লাগামহীন লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাস সেলিং শুরু করে পুলিশ, কেউ কেউ ঐদিনের মিছিলে গুলি চলার কথা বলেন, তা সঠিক নয়। টিয়ার গ্যাস সেলিং’র আওয়াজকেই ভুল করে হয়ত কারোর গুলি চালনার শব্দ বলে মনে হয়ে থাকতে পারে। টিয়ার গ্যাস সেলিং এত বেশি মাত্রায় করা হয় যে চোখে কিছু দেখাই যাচ্ছিল না, তার সাথে বীভৎস লাঠিপেটা চলতে থাকে। মিছিলের পিছনদিকের অংশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন – সামনের দিকে আমরাও আক্রান্ত হই। তখন আমি বয়সোচিত পোশাক অর্থাৎ শার্ট – প্যান্ট পরেছিলাম, সেই প্যান্টের নানা জায়গায় রক্তের ছাপ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, একই ঘটনা আমাদের আরও অনেকেরই হয়েছিল। লাঠির আঘাতে অনেকেরই হাত-পা ভেঙ্গে যায় – আমারও পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে। আমরা সকলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, নিউ মার্কেটের দিকে দৌড়তে থাকি। টিয়ার গ্যাসের প্রভাবে চোখে প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে একজন আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে নিজের দোকানের ভিতরে টেনে নিয়ে যান। হিন্দিতে বলেন শুনতে পাই “আঁখ মে পানি দো!” – আমি কোনোভাবে চোখে জল দিই এবং কিছুটা স্বস্তি পাই। আমার ট্রাউজার রক্তে ভিজে উঠেছিল, সেদিন ঐ অবস্থায় আর বাড়ি ফিরে না গিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিন ছাত্রদের কর্মসূচীতে ওখান থেকেই সকালে বেরিয়ে এসে যোগ দিই।
কার্জন পার্কে (তখন ওখানে এত গাছ-গাছালি ছিল না) অনেক আহত মানুষ পড়ে রয়েছেন, যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন সেই অবস্থাতেই লাঠির আঘাতে তাদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। সেই ভয়ানক দৃশ্যের বর্ণনা আমি শুনেছি আমার বন্ধু এবং কমরেড হরিনারায়ণ অধিকারির থেকে। সেদিনের মিছিলে সেও অন্যদের সাথে পুলিশের লাঠির আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল, তার সামনেই পুলিশ আহত কয়েকজনকে মাথায় লাঠি মেরে হত্যা করেছিল, ওরা সামনে এসে তার যখন দাঁড়িয়েছিল তখন সে নিজের শ্বাস চেপে শুয়ে থাকে, কিছুখন পরে তারা অন্যদিকে চলে যায়। এভাবেই সেদিন পুলিশ খুন করেছিল ৮০ জনকে।
এরই প্রতিবাদে ১লা সেপ্টেম্বর বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মিলিতভাবে ছাত্রধর্মঘটের আহ্বান দেয়, একইসাথে ছাত্রসমাবেশেরও ডাক দেওয়া হয়েছিল। ধর্মঘট হলে অনেকেই ঘরে বসে থাকে, ছাত্র সংগঠনগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা করলে চলবে না, সবাইকেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হতে হবে। ইউনিভার্সিটির লনে সবার জড় হবার পরিকল্পনা ছিল, তখন সেন্টেনারি ভবন ছিল না, হলটি অনেক বড় ছিল – ছিল শুধু সেনেট হল (সমাবর্তন অনুষ্ঠান সেখানেই হত)। মিছিল যাত্রা শুরু করে ধর্মতলার দিকে, তখনও সেই রাস্তার নাম ধর্মতলা স্ট্রীটই ছিল লেনিন সরণি নামকরণ পরে হয়েছে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সামনে মিছিলকে প্রথমবার বাধা দেয় পুলিশ, যদিও সেই বাধা টপকে মিছিলের একটা অংশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ি ছিল এখন যেখানে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার সেই জায়গায়, জমায়েত ঐদিকে এলে মিছিলের উপর একই সাথে টিয়ার গ্যাস সেলিং এবং বেপরোয়া গুলি চালনা করে পুলিশ। গুলীর আঘাতে ওখানেই একজন ছাত্রের মৃত্যু হয় – ছবি তোলা যায়নি, কিন্তু আমার চোখে সেই দৃশ্য এখনও স্পষ্ট। লোহার রেলিঙয়ের একদিকে একটি হাত-পা আরেকদিকে অন্য হাত-পা’দুটি আটকে থাকা অবস্থায় সেই ছাত্রের মৃতদেহটি দেখতে পেয়েছিলাম। মিছিলের উপরে গুলিচালনার ফলে ৭ জন খুন হয়েছিল সেদিন, গুলির আঘাতে আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে আরও অনেকে, তাদের কেউ কেউ সারাজীবনের মতো পঙ্গুও হয়ে গেছে। ৩১শে অগাস্ট খাদ্য চাইর দাবী তোলা জনগণকে লাঠিপেটা করে খুন করে, ঠিক তার পরের দিন ১লা সেপ্টেম্বর সেই নারকিয় ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রদের মিছিলেও অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল বিধান রায়ের সরকার। ২রা সেপ্টেম্বর আবার সারা রাজ্যে ছাত্রধর্মঘট ডাকা হয়, সেদিনও সারা রাজ্যজূড়ে পুলিশের অত্যাচার চলে, ব্যাপক গ্রেফতার করা হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর সমস্ত বামপন্থী দলগুলি সম্মিলিতভাবে রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।
খাদ্য আন্দোলন আমাদের রাজ্যে এবং দেশে মানুষের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য নজীর। নিজেদের অধিকারের ন্যায্য দাবীসহ শাসকের সামনাসামনি হলে খেটেখাওয়া-মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে শাসকের আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে – তখন সেই লড়াই দাবী মেটানোর স্তর অতিক্রম করে সংগ্রামী মানুষের চেতনাকে এক নতুন স্তরে পৌঁছে দেয়।
ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনকে এই আলোকেই দেখতে হবে, বিচার করতে হবে।
ছবিঃ ওয়েবসাইটের সংগ্রহ থেকে