Fiscal Transfer PP Cover

সরকারী কোষাগার হতে পুঁজিপতিদের উপহার দেওয়ার বন্দোবস্ত

প্রভাত পট্টনায়েক

আজকাল কর্পোরেট দ্বারা আরও বেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে ও তার সুবাদে জাতীয় অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করতে দেশের সরকারের তরফে কর্পোরেটদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটা জলভাতের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। করের হার কমানোর মাধ্যমে বা সরাসরি নগদ ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের ‘ফিসক্যাল ট্রান্সফার’ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম কার্য্যকালের সময় এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই কর্পোরেট ট্যাক্সের হার কমানো হয়েছিল। একই উদ্দেশ্যে ভারতেও মোদি সরকার কর্পোরেটগুলিকে ব্যাপক কর ছাড় দিয়েছে। অর্থনীতির ন্যূনতম জ্ঞানও যার রয়েছে সেই জানে যে নয়া-উদারবাদী শাসনব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের সুবিধার্থে এধরনের হস্তান্তর (ট্রান্সফার) ঠিক বিপরীত ফলই দেয়।

কারণ, এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে ‘রাজস্ব নীতি’ আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। সেই নীতি বলে যে মোট দেশীয় পণ্যের শতাংশ হিসাবে রাজস্ব ঘাটতির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা উচিত। সাধারণত সরকারগুলি এই সর্বোচ্চ সীমা অনুসারেই কাজ করে। তাই পুঁজিপতিদের কাছে যে অর্থ যাচ্ছে সেগুলি অন্য খাতে ব্যয় হ্রাসের দ্বারা পূরণ করতে হবে। শ্রমজীবী ​​দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ কল্যাণখাতে ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ বাবদে সাধারণত ঐ হ্রাস ঘটে, অথবা শ্রমজীবী ​​দরিদ্রদের কাছ থেকে অর্জিত ট্যাক্স রাজস্বের সমতুল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে করা হয়। এখন, শ্রমিকদের খাতে ১০০ টাকা কমিয়ে পুঁজিপতিদের খাতে ১০০ টাকা হস্তান্তরের প্রভাবে সামগ্রিক চাহিদার মাত্রা কমানো কর্মসংস্থান ও উৎপাদন কমে যাওয়া এবং অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা তো দূরের কথা, পুঁজিপতিদের খাতে ঐ হস্তান্তর অর্থনীতিকে আরও সংকুচিত করতেই প্রভাব খাটায়। এই ঘটনাগুলি পরস্পরের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত তার ব্যখ্যা নিচে দেওয়া হল।

যে কোন সময়কালে গৃহীত বিনিয়োগ হল অতীতে নেওয়া বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ফসল, কারণ বিনিয়োগ প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন/রূপায়ণের জন্য দীর্ঘ সময় আবশ্যিক এবং এটি সরকারী বিনিয়োগের মতো বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সত্য। যদি বিনিয়োগের গতি বাড়াতে হয়, তাহলে বর্তমান সময়ের মধ্যে এটি করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং প্রকৃত গতি শুধুমাত্র পরবর্তী সময়ে বাড়বে। তাই যে কোনও সময়ের বিনিয়োগকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা হিসেবে নিতে হবে যা প্রশ্নোত্তর সময়কালে পরিবর্তিত হয় না। প্রশ্নে থাকা সময়ের মধ্যে যেটা পরিবর্তন হয় তা হল খরচের মাত্রা; এবং এখানে, যেহেতু শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের তুলনায় তাদের আয়ের বেশি অংশ গ্রহণ করে, তাই শ্রমিকদের থেকে পুঁজিপতিদের কাছে ক্রয় ক্ষমতার যে কোনও স্থানান্তরের ফলে ভোগ হ্রাসের প্রভাব রয়েছে (যদি সরকার পুঁজিপতিদের কাছে স্থানান্তর করার জন্য তার ব্যবহার কমিয়ে দেয় তবেও একই ঘটনা ঘটে)।

আরও একটি কথা, শ্রমিক থেকে পুঁজিপতিদের কাছে (এবং এমনকি সরকার থেকে পুঁজিপতিদের কাছেও) স্থানান্তর নীট রপ্তানি কমিয়ে দেয় (অর্থাৎ আমদানির তুলনায় রপ্তানির আধিক্য), কারণ পুঁজিপতিদের ব্যবহার বেশি আমদানি-নিবিড়। কিন্তু আসুন আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের যুক্তিকে সরল করে ধরে নিই যে পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তর, শ্রমিকদের খরচে অর্থায়ন, নীট রপ্তানি পরিবর্তন করে না।

যেহেতু একটি দেশের মোট জাতীয় আয় = Y, এবং খরচ = C, বিনিয়োগ = I, সরকারী ব্যয় = G, এবং তার ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস (X-M) এর কারেন্ট অ্যাকাউন্টের উদ্বৃত্তের সমান হবে।

অর্থাৎ, Y = C+ I + G + (X-M) ...(i)

পুঁজিপতিদের কাছে স্থানান্তর, C-এর মান কম করে, ডানদিকের রাশিটিকে কম করে (যেটা আবার সামগ্রিক চাহিদার স্তরকে চিত্রিত করে)। অতএব, উপরের সমীকরণের সমতা তখনই হবে কেবলমাত্র Y-এর মান কম করার মাধ্যমে, অর্থাৎ আউটপুট এবং কর্মসংস্থান হ্রাসের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন অর্থনীতিতে অব্যবহৃত ক্ষমতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা বর্তমান সময়ে গৃহীত পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে হ্রাস করার প্রভাব ফেলে এবং তাই পরবর্তী সময়ে তাদের প্রকৃত বিনিয়োগও হ্রাস পায়। অতএব, অর্থনীতি উদ্দীপিত হওয়া তো দূরস্থান, আসলে সংকুচিত হয়।

কিন্তু গল্পটা সেখানেই শেষ হয় না। নিজের মধ্যে এই ধরনের কোন সংকোচন, অর্থাৎ, যদি অন্যান্য খাতগুলি একই থাকে, তাহলে লাভ হ্রাস হবার প্রভাব রয়েছে। এইভাবে, পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তর করার সময়, মুনাফা বৃদ্ধির প্রভাব থাকে, বাস্তবে এই ধরনের হস্তান্তর শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে প্রাপ্ত হয়, মুনাফা হ্রাসের বিপরীত প্রভাব ফেলে। এবং মোটামুটি বাস্তবসম্মত অনুমানের অধীনে, এই দুটি প্রভাব একে অপরকে একেবারে বাতিল করে দেয়, যাতে পুঁজিপতিদের মোট মুনাফা একই থাকে যা ‘ফিসক্যাল ট্রান্সফার’ ছাড়াই পাওয়া যেত। এই ফলাফল যে অনুমানের উপর নির্ভর করে তা হল ‘শ্রমজীবী ​​মানুষ তাদের পুরো আয়টাই ভোগ করে’। এটা মোটামুটি বাস্তবসম্মত অনুমান কারণ; জনসংখ্যার নীচের অংশের মালিকানাধীন অর্থনীতির মোট সম্পদের অনুপাতটি কণামাত্র। উদাহরণ স্বরূপ ভারতে নিম্নআয়ভুক্ত ৫০ শতাংশ লোক দেশের মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশের মালিক। যেহেতু সমস্ত সম্পদই সঞ্চয় থেকে উদ্ভূত হয়, এই প্রস্তাবনা দেখায় যে শ্রমজীবী মানুষেরা খুব কমই কিছু সঞ্চয়  করতে পারে। তাই আমাদের অনুমান যে শ্রমজীবী ​​মানুষ সঞ্চয় করে না এবং অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ সঞ্চয় সরকার ব্যতীত ধনীদের কাছ থেকে আসে, এটি বেশ বাস্তবসম্মত।

আসুন, ক্ষণিকের জন্য ধরে নিই যে ধনীরা (এক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা) তাদের সম্পূর্ণ আয়ই সঞ্চয় করে, এবং ব্যক্তিগত সঞ্চয় সমান লাভ। যেহেতু যেকোন অর্থনীতিতে, মোট দেশীয় সঞ্চয় অবশ্যই মোট দেশীয় বিনিয়োগ এবং মোট বৈদেশিক সঞ্চয়ের বিনিয়োগের বিয়োগফলের পরিমাণের সমান হবে। সরকারী বিনিয়োগ এবং সরকারী সঞ্চয়ের বিয়োগফল  যাকে ‘রাজস্ব ঘাটতি’ বলা হয়। তাই এটা বলাই যায় যে বেসরকারী সঞ্চয় বা মুনাফার পরিমাণ, বেসরকারী বিনিয়োগ এবং রাজকোষ ঘাটতির যোগফলের থেকে বৈদেশিক সঞ্চয় ‘F’-কে বিয়োগ করলে সেই বিয়োগফলের সমান হতে হবে।

অর্থাৎ অর্থনীতির ভাষায়, লাভ = ব্যক্তিগত বিনিয়োগ + রাজস্ব ঘাটতি – F ...(ii)

যেহেতু আমরা যুক্তি দিয়েছি যে বেসরকারী বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সঞ্চয়ের প্রবাহ (যা উপরের X-M-এর ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ ঋণাত্মক X-M) এই সময়ের মধ্যে অপরিবর্তিত থাকবে, যেমন ‘রাজস্ব নীতি’ আইনের কারণে রাজস্ব ঘাটতি থাকবে, লাভ অবশ্যই একই থাকবে পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তর সত্ত্বেও। সমস্ত মুনাফাটাই সঞ্চয় করা হয়েছে এই অনুমান বাদ দিলে উপরের যুক্তিতে কোন সমস্যা নেই। যদি লাভের একটি অংশ ‘α’ সঞ্চয় করা হয়, তাহলে সমীকরণ (ii)টি সহজভাবে হয়ে দাঁড়ায়:

α লাভ = ব্যক্তিগত বিনিয়োগ + রাজস্ব ঘাটতি – F… (iii)

যদি সমীকরণ (iii)-এর ডানদিকের দিকটি অপরিবর্তিত থাকে (যেটা আমরা এইমাত্র আলোচনা করেছি) তবে α-র মান ১ না হলেও লাভ অপরিবর্তিত থাকবে। সংক্ষেপে বলা যায়, একটি নব্য উদারবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের কাছে পয়সার হস্তান্তরের নামে এই ধরনের ট্রান্সফারের জন্য রাজস্ব ঘাটতি বাড়ানো যায় না এবং যেখানে একইসঙ্গে শ্রমিকদের আয় কমিয়ে আনতে হয়, এটা শুধুমাত্র উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে সংকোচনের প্রভাব ফেলে তাই নয়, পুঁজিপতিদের আয়ের পরিমাণও বাড়বে না যদি শ্রমিকরা তাদের সম্পূর্ণ আয় ব্যবহার করে। অন্যভাবে বলতে গেলে পুঁজিপতিদের কাছে এই আর্থিক ট্রান্সফারগুলি পুঁজিপতিদের আয় না বাড়িয়েও একটি অর্থনীতিতে বৈষম্য বৃদ্ধি করে, কারণ তারা সামগ্রিক চাহিদার সংকোচনের ফলে উত্পাদিত দ্রব্যের পরিমাণের সংকোচন ঘটায় যা এই ধরনের স্থানান্তরের লাভ জনিত ক্রমবর্ধিত লাভের প্রভাবকে খন্ডন করে।

তবে সরকার কেন এই পদ্ধতি অবলম্বন করে তার প্রকৃত কারণ হলো, পুঁজিপতিদের মধ্যে মুনাফার বণ্টনকে একচেটিয়া পুঁজির পক্ষে করা এবং একইসাথে ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের থেকে দূরে রাখা। এটা নিম্নলিখিত কারণে হয়; আমরা দেখেছি যে পুঁজিপতিদের কাছে বাজেট স্থানান্তর সত্ত্বেও মোট মুনাফা অপরিবর্তিত থাকে কারণ এই ফিসক্যাল ট্রান্সফারের ফলে লাভের পরিমাণে সংযোজন হলেও, সেটা আখেরে গিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে আয় কেড়ে নেওয়ার সাথে জড়িত এবং সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস করে, মুনাফাকে ঠিক সমান পরিমাণে কমিয়ে দেয়। সামগ্রিকভাবে এটি সত্য হলেও, যে পুঁজিপতিরা চাহিদা হ্রাসের সম্মুখীন হয় এবং পুঁজিপতিরা যাদের কাছে হস্তান্তরের সিংহভাগ জমা হয় তারা এক নয়। বিশেষ করে, বৃহৎ পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের ভোগের চাহিদা হ্রাসের দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয় না; কিন্তু তারা বাজেটের ট্রান্সফারের সিংহভাগ পায়, তাই তারা আসল লাভবান হয়। যেহেতু ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের উৎপাদিত দ্রব্যের উপস্থিতি শ্রমিকদের ভোগ্যপণ্যের জন্য বাজারে বেশী তাই পণ্যভোগের মাত্রা কমার ফলে তারা লোকসানে পড়ে (যদিও মোট মুনাফা সামগ্রিক স্তরে অপরিবর্তিত থাকে)।

এইভাবে মার্কস যাকে ‘পুঁজির কেন্দ্রীকরণ’ বলেছিলেন, পুঁজিপতিদের কাছে অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে বৃহত্তর পুঁজির দ্বারা ছোট পুঁজির (ক্ষুদ্র উৎপাদক যারা শ্রমিকদের ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদন করে) প্রতিস্থাপনকে ত্বরান্বিত করার একটি উপায়। এটাই ‘ফাটকা পুঁজিবাদীরা’ চায় এবং সরকার তাদের কথা শুনতে বাধ্য। অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার নামে এই ধরনের স্থানান্তর করা হয়, কিন্তু এই ট্রান্সফার সেরকম কিছুই করে না; বরঞ্চ তারা কেবল অর্থনীতিকে সংকুচিত করতে সফল হয়, কিন্তু এমন একটি সংকুচিত অর্থনীতিতেও তারা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।

যদিও মিডিয়া এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে এই বক্তব্যের একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে যে ‘দেশের ক্ষুদ্র উৎপাদকরা নোটবন্দীকরণ এবং পণ্য ও পরিষেবা কর (জি.এস.টি) প্রবর্তনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল’। তবে পুঁজিপতিদের ট্যাক্স মকুব এবং অন্যান্য ধরনের বাজেট হস্তান্তর দ্বারা ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা যে ক্ষতির সন্মুখীন হয় সেই বক্তব্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার লোকজন কমই রয়েছেন।

 
২৪শে নভেম্বর ২০২৪-এ পিপলস ডেমোক্রেসি-তে প্রকাশিত
ভাষান্তরঃ অঞ্জন মুখোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

উত্তর দিন