সৌভিক ঘোষ
‘গাড়ি এমন শোঁ-শোঁ করে ছুটছে যার গতি শুধু নিরীহ পথচারীদের জন্যই বিপদ এমন নয়, যারা সেই গাড়িতে চেপেছে বিপদ তাদেরও…’ না, এসব লেনিনের কথা নয়। ১৮৪৮-৭০’র জার্মানিতে পুঁজিবাদী পরিস্থিতির সাথে ১৮৭০-১৯০৫ সালের অবস্থার তুলনা করে এই কথা লেখেন জেকব রিজার। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা বই ‘দ্য জার্মান গ্রেট ব্যাঙ্কস অ্যান্ড দেয়ার কনসেন্ট্রেশন ইন কানেকশন উইথ দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ জার্মানি’। জার্মানিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সমানুপাতে ব্যংক পুঁজির বিকাশ কিভাবে ঘটছে- এই ছিল বইটির প্রধান প্রতিপাদ্য।
ইম্পিরিয়ালিজমঃ দ্য হায়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম (সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) প্রকাশিত হয় আরও ছয় বছর পরে। বইটি লেখার সময় লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে ছিলেন। জেকব রিজারের লেখা বইটি তো বটেই, একটা লম্বা সময় ধরে লেনিন বিশ্ব পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতি অনুশীলন করেছিলেন। ১৯১৫ সাল নাগাদ বার্নে থাকার সময় ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ বইটির খসড়া লিখতে শুরু করেন তিনি। বইটি লেখার কাজে কতটা মনোনিবেশ করেছিলেন তা একটি ছোট তথ্যেই স্পষ্ট হয়, সমসাময়িক পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে মোট ১৪৮টি বই ও ২৩২টি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে তার নোটবুকের আকার প্রায় ৮০০ পাতার। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বার্ন থেকে জুরিখে পৌঁছন লেনিন, সেখানেই ক্যান্টোনাল লাইব্রেরীতে বাকি পড়াশোনা ও লেখার কাজটি শেষ করেন। ১৯১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া থেকে বইটি প্রথম প্রকাশ পায়। সেই বইয়ের ইংরেজি শিরোনাম ছিল ‘ইম্পিরিয়ালিজমঃ দ্য লেটেস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম’।
এই বই লেখার অনেক আগেই জন অ্যাটকিন্স হবসনের লেখা ‘দ্য ইভলিউশন অফ মডার্ন ক্যাপিটালিজম’ বইটির অনুবাদ করেছিলেন লেনিন, ১৯০৪ নাগাদ। যদিও হাতে লেখা সেই পাণ্ডুলিপি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সর্বহারা শ্রমিক আন্দোলনের সামনে এক বিরাট বাধা তৈরি করেছিল। দেশরক্ষার আহ্বানের সামনে সেদিন অনেক সমাজতান্ত্রিক পণ্ডিতই টলেছিলেন, ভেসে গেছিলেন। কার্ল কাউটস্কির মত আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন সোশ্যালিস্টরা নিজেদের দেশে সর্বহারা শ্রমিক আন্দোলনের প্রকৃত কর্তব্য ভুলে সেই যুদ্ধে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বহারা বিপ্লবের সাথে এই বেইমানিকে চিহ্নিত করেছিলেন লেনিন, জাতিয়তাবাদের আড়ালে এহেন সুবিধাবাদী রাজনীতিকে দুরমুশ করে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের আসল চরিত্র তুলে ধরতে, সাম্রাজ্যবাদের প্রাণভোমরা হিসাবে পুঁজিবাদী লুঠকে স্পষ্ট কথায় প্রকাশ করার জন্যই কলম ধরেছিলেন।
আজকের পৃথিবীতে ‘লেনিনের যুগ চলে গেছে’ খুবই জনপ্রিয় কথাবার্তার অন্যতম। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় এহেন বক্তব্যের পিছনের রাজনীতি কোথায়, কিভাবে সক্রিয়। পরিবর্তিত সময়ের সাথে মার্কসীয় দার্শনিক বিশ্ববিক্ষাকে যাচাই করে নেওয়ার কাজটি বামপন্থী রাজনীতির চিরায়ত নিয়ম- সেটুকু ভুলিয়ে দিয়ে লেনিন আর নেই তাই তাকে মনে রাখারও আর দরকার নেই, এই হল ধান্দার পুঁজিবাদ। লেনিনের সময়ের পৃথিবীর সাথে আজকের দুনিয়ার ফারাক রয়েছে একথায় কোনও বিতর্ক নেই, কিন্তু লেনিন মানে তো শুধু অতীত চর্চা নয়! লেনিন মানে ভবিষ্যতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে আজকের কর্তব্য নির্ধারণ করা। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত তার লেখা সেই বইতেই তো বলা হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বলে আসলে যা দেখা যাচ্ছে তার গোড়ায় মুনাফার লুটের উদ্দেশ্যে নতুন করে দুনিয়াকে, মানবসমাজকে ভাঙাগড়ার লক্ষ্যে পুঁজিবাদের নয়া কৌশল ব্যাতীত আর কিছুই নেই। দেশ আক্রান্ত বলে রাইফেলের নলের দুদিকে যাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা দুজনেই আসলে শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। সুতরাং রাইফেলের নল ঘুরিয়ে দাও, যারা যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে তাদেরই উৎখাত করো। সব যুদ্ধ শেষের যুদ্ধ শুরু করো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মাও সে তুং একেই সহজ কথায় ‘We are advocates of the abolition of war, we do not want war; but war can only be abolished through war…’ বলেছিলেন। নয়া-উদারবাদী পৃথিবী তাই আজও লেনিনের ভূত দেখে!
কোন যুক্তিতে সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় বলা হল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে ১৮৭০ থেকে ১৯১০ পর্যায়ের বিশ্ব-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকাতে হয়। ঐ পর্যায়ের মুল প্রবণতা পুঁজির কেন্দ্রীভবন- যার দিকে লেনিন বারে বারে দিকনির্দেশ করেছিলেন। এহেন কেন্দ্রীভবনকে নির্ধারণ করতে তিনি সাম্রাজ্যবাদের পাঁচটি বৈশিষ্ট চিহ্নিত করেন-
১) উৎপাদন ও পুঁজি উভয়ই ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং এহেন কেন্দ্রীভবন দুনিয়াজুড়ে একচেটিয়া পুঁজির জন্ম দিয়েছে। সেই একচেটিয়া পুঁজিই আজকের পৃথিবীতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল।
২) ব্যাংক পুঁজি ও শিল্প পুঁজি একে অন্যের সাথে মিলেছে এবং জন্ম দিয়েছে লগ্নী পুঁজির। এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী।
৩) পণ্য রপ্তানি ব্যবস্থার পাশাপাশি পুঁজির রপ্তানিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পোঁছে গেছে।
৪) দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠিত একচেটিয়া পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বিশ্ববাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে।
৫) শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলি গোটা পৃথিবীকেই নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে।
উপরোক্ত পাঁচটি বৈশিষ্টের ব্যখ্যায় লেনিন তালিকা (পণ্য ও পুঁজি রপ্তানি, ব্যাংক পুঁজির সাথে শিল্প পুঁজির মীলিত লগ্নী ইত্যাদি প্রসঙ্গে) সহ তথ্যও দেন। সেইসব তথ্য কমিউনিস্টদের মনগড়া না, শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশেরই ব্যবসা-বাণিজ্যের সরকারি খতিয়ান থেকে সংগৃহীত। এই যুক্তির জোরেই লেনিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চরিত্র নির্ধারণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবীও বলেছিলেন। সেই সময় মার্কসীয় দার্শনিকদের মধ্যে সুপরিচিত কার্ল কাউটস্কিও পুঁজিবাদের সমসাময়িক পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করেছিলেন- যদিও লেনিনের সিদ্ধান্তের অনেকটাই বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি যুক্তি হাজির করেছিলেন বিশ্বযুদ্ধ আদৌ হবে না কেননা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি শেষ অবধি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেবে। নিজের এহেন ব্যখ্যাকে কাউটস্কি বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক পর্যালোচনার ফলাফল বলতেন। সাম্রাজ্যবাদ থাকবে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হবে না- এমন অবস্থাকেই তিনি ‘আলট্রা ইম্পিরিয়ালিজম’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু যুদ্ধ হয়েছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাসের পরিহাস এই যে কাউটস্কি শেষ অবধি যুদ্ধের সময় পবিত্র কর্তব্য হিসাবে সর্বহারা শ্রেণিকে জাতীয় সেনাবাহিনীতে নাম লেখানো উচিত বলে মতামত দিলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ঘটবে না বলে কাউটস্কির অদ্ভুত আশাবাদ অনেকটা পুঁজিবাদের সমীপেই মুনাফা সংক্রান্ত লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রত্যাশা প্রার্থনার মত। তিনি আশা করতেন ফিনান্স পুঁজির আন্তর্জাতিক চরিত্রের জন্যই পুঁজিবাদী বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলি অকেজো হয়ে থাকবে বা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিজেরাই সেইসব দ্বন্দ্বগুলিকে চাপা দিয়ে রাখবে। লেনিন বললেন ফিনান্স পুঁজির জন্যই বিদ্যমান সামাজিক দ্বন্দ্বসমূহ ক্রমশ বাড়তে থাকবে যার ফলে যুদ্ধ হয়ে পড়বে অবশ্যম্ভাবী। কাউটস্কির যুক্তিকে লেনিন মার্কসবাদ হতে বিচ্যুতি বলেই চিহ্নিত করেছিলেন, ‘আলট্রা ননসেন্স’ বলে পরিহাসও করেছিলেন।
কাউটস্কিরা একচেটিয়া পুঁজির ক্রমবর্ধমান পরিণতি হিসাবে ফিনান্স পুঁজির লুটেরা চরিত্রকে বুঝতে ভুল করেছিলেন। এখানেই লেনিনের অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে প্রখর দূরদৃষ্টি। বিশ্বপুঁজিবাদই ফিনান্স পুঁজির জন্ম দিয়েছে- একে স্বয়ম্ভূ গোছের কিছু ভেবে বসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনকেই অস্বীকার করা হয়। বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেই পুঁজিবাদের কাজ শেষ হয় না, প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তনও করতে হয় তাকে। সেইসব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য একটাই- আরও আরও বেশি মুনাফা। এই চক্র একদিকে যেমন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সমাহার গড়ে তোলে, তেমনই একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বিদ্যমান বাজারকে করে ক্রমাগত সংকুচিত করতে থাকে। সেই কারনেই নিত্যনতুন বাজার দখল করা তার একান্ত প্রয়োজন। সেই দখলদারির প্রতিযোগিতাই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মূল কারন। মার্কস এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারেই উল্লেখ করা ছিল – ‘উৎপাদনের উপকরণে অবিরাম বিপ্লবী বদল না এনে, এবং তাতে করে উৎপাদন-সম্পর্ক ও সেইসঙ্গে সমগ্র সমাজ-সম্পর্কে বিপ্লবী বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্ৰেণী বাঁচতে পারে না। অপরদিকে অতীতের শিল্পজীবী সকল শ্রেণীর বেচে থাকার প্রথম শর্তই ছিল সাবেকি উৎপাদন-পদ্ধতির অপরিবর্তিত রূপটা বজায় রাখা। আগেকার সকল যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্ট্যই হল উৎপাদনে অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক অবস্থার অনবরত নড়চড়, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং উত্তেজনা।... নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণীকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।’
দুনিয়ার বাজার নিজেদের দখলে রাখতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যে সাধারণ গোষ্ঠী (কার্টেল)-র অন্তর্ভুক্ত হয় তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন স্থানীয়, দেশীয় ছোট ছোট উৎপাদন কিংবা বণ্টনের কেন্দ্রগুলিকে দখলে নিয়ে আসা অথবা পন্যের দাম কম রেখে তাদের উচ্ছেদ করা (যে কারনে আজকের পৃথিবীতেও বড় বড় শপিং মলে সপ্তাহে একদিন অভাবনীয় কম দামের অফার দেখতে পাওয়া যায়)। একবার সেই লক্ষ্য পূরণ হলে গোটা বাজারে পণ্য পরিবহনের একচেটিয়া যোগানদার হয়ে বসা যায়। এই কাজে নিজেদের এবং সহযোগীদের কল্যাণে পুঁজির ন্যুনতম দুটি বন্দোবস্তের প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল-
১) দ্রুত ও নিরাপত্তা রয়েছে এমন কায়দায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পুঁজির আদানপ্রদান (এ হল পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ) ।
এবং
২) বিশ্ববাজারে আপাত স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা (এটিই বিশ্বরাজনীতিতে পুঁজিবাদের তরফে শান্তির বানী) ।
এই উদ্দেশ্যেই ফিনান্স পুঁজির জন্ম হয়েছে। আপাত শান্তির পর্যায়কে পুঁজির চুড়ান্ত মনোভাব হিসাবে বিবেচনা যে এক বিরাট ভুল সেকথাই লেনিন দেখিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের মুনাফার স্বার্থেই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়, একটা সময় সেই স্বার্থই তাদের যুদ্ধে প্রবৃত্ত করে। সহজ কথায় এক বিরাট পরিমান ধ্বংস চাপিয়ে দিতে না পারলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুঁজিবাদ নতুন বাজার তৈরি করতে পারে না- মার্কসই একেই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পুঁজিবাদ প্রতিবার আগের চাইতে বৃহত্তর সংকট সৃষ্টি করে বলে উল্লেখ করেছিলেন। কমিউনিস্ট ইশতেহারে পাওয়া যায়- ‘যন্ত্রশিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণী কেবল সংখ্যায় বাড়ে না; তারা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে বৃহত্তর সমষ্টিতে, তাদের শক্তি বাড়তে থাকে, আপন শক্তি তারা বেশি করে উপলব্ধি করে। কলকারখানা যে অন, পাতে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের পার্থক্য মুছে ফেলতে থাকে আর প্রায় সর্বত্র মজুরি কমিয়ে আনে একই নিচু স্তরে, সেই অনুপাতে প্রলেতারিয়েত বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থ ও জীবনযাত্রার অবস্থা ক্রমেই সমান হয়ে যেতে থাকে। বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং তৎপ্রসত বাণিজ্য-সংকটে শ্রমিকের মজুরি হয় আরও বেশি দোদুল্যমান। যন্ত্রের অবিরাম উন্নতি ক্রমেই আরো দ্রুততালে বাড়তে থাকে, মজুরের জীবিকা হয়ে পড়ে আরও বিপন্ন; এক একদল মজুরের সঙ্গে এক একজন বুর্জোয়ার সঙ্ঘর্ষ ক্রমেই বেশি করে দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্বের রূপ নেয়। তখন মজুরেরা মিলিত সমিতি গঠন শরে, করে (ট্রেড ইউনিয়ন) বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে; মজুরির হার বজায় রাখার জন্য জোট বাঁধে; মাঝে মধ্যে ঘটা এই বিদ্রোহের আগে প্রস্তুতির জন্য স্থায়ী সংগঠন গড়ে। এখানে ওখানে দ্বন্দ্ব পরিণত হয় অভ্যুত্থানে।
মাঝে মাঝে শ্রমিকেরা জয়ী হয়, কিন্তু কেবল অল্পদিনের জন্য। তাদের সংগ্রামের আসল লাভ আশু ফলাফলে নয়, মজুরদের ক্রমবর্ধমান একতায়। এই একতার সহায় হয় যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা, আধুনিক শিল্প যার সৃষ্টি করেছে এবং যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মজুরেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। এক জাতীয় অসংখ্য স্থানীয় লড়াইকে দেশব্যাপী এক শ্রেণী- সংগ্রামে কেন্দ্রীভূত করার জন্য ঠিক এই সংযোগটারই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটা শ্রেণী-সংগ্রামই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। শোচনীয় রাস্তাঘাটের দরুন যে ঐক্য আনতে মধ্যযুগের নাগরিকদের শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগেছিল, আধুনিক শ্রমিকেরা তা অর্জন করে রেলপথের কল্যাণে মাত্র কয়েক বছরে।’
লেনিন দেখালেন আধুনিক পুঁজিবাদ (তার নিজের সময়কে ধরে আধুনিক বুঝতে হবে) দুনিয়াজুড়ে এক শোষণের এক অভিন্ন শিকল পেঁচিয়ে রেখেছে। শিকলটি কোথাও আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে আবার কোথাও একটু ঢিলে রয়ে গেছে। তারই দুর্বলতম অংশকে খুঁজে বের করতে হবে, সেখানেই আঘাত হেনে শোষণের শৃঙ্খলকে ছিঁড়ে ফেলা যায়। রাশিয়াকে সেই যুক্তিতেই বিশ্বপুঁজিবাদের দুর্বল অংশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে- শাসকের বিরুদ্ধে জনগনের যুদ্ধ জয়ী হল- শ্রমিকরাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হল।
আজকের পৃথিবীতে লগ্নী পুঁজি আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির স্তরে উন্নীত হয়েছে। প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমান লগ্নী এক ব্যবসা থেকে আরেক ব্যবসায় আদানপ্রদান এখন খুবই সহজ। ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’ও আসলে অতি ধনীদের জন্য সম্পত্তি কিংবা আয়কর সংক্রান্ত নিয়মবিধির আওতার বাইরে থাকারই উপায়। মুনাফা লোটার পদ্ধতিগত অভিযোজন ঘটেছে নিশ্চিত। কোভিড মহামারী ও তার পরবর্তীতে দুনিয়াজুড়ে উৎকট বৈষম্য আজকের পৃথিবীকে আরেকবার ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। আমরা দেখছি, শুনছি, জানছি – অন্যান্য দেশের মতো ভারতের সরকারও চাইছে জনসাধারণ মেনে নিক মানুষের আসল সমস্যা খাদ্য নয়, স্বাস্থ্য নয়, চাকরি নয় এমনকি মানুষের মতো বেঁচে থাকাও নাকি সরকারের জন্য ভাবার মত কিছু বিষয় নয়- আসল সমস্যা হল কিভাবে এবং কোথায় বিনিয়োগ হবে!
এহেন নির্লজ্জ রাজনীতি আর তার ধামাধরা অর্থনীতিই পুঁজিবাদের চরিত্র, আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির স্বরূপ। কার্ল মার্কস প্রমাণ করেছিলেন মুনাফা আসলে চুরি, লেনিন দেখালেন ফিনান্স পুঁজির নামে পুঁজিবাদ কিভাবে নিজেকে ডাকাতের পর্যায়ে উন্নত করেছে। সেই ডাকাত নিয়মিত পোশাক পাল্টাচ্ছে, কিন্তু ডাকাতি থামাচ্ছে না।
আজও অনেকেই (বিশেষত বুদ্ধিজীবীরা) সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন, তাদের অনেকেই চলতি ব্যবস্থায় নিপীড়িত জনসাধারণের দুরবস্থা বর্ণনায় সহানুভূতির তুবড়ি ছুটিয়ে দেন। পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে আলাদা আলাদা করে দেখতে চাওয়া আসলে কাউটস্কির পেশ করা যুক্তির মতোই একটা ভ্রান্তি- শেষ বিচারে আজও যা 'আলট্রা ননসেন্স' ছাড়া কিছুই না।ডাকাত আটকাতে না পারলে যে ডাকাতি বন্ধ হয় না এটুকুই লেনিনের শিক্ষা।