মহামারী উত্তর শিক্ষাঃ প্রযুক্তি এবং বৈষম্য - অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ...

২৯ আগস্ট ২০২১ (রবিবার)

কোভিড -১৯ এর বিপর্যয়কর প্রভাবগুলির মুখোমুখি ভারত।। এই কারণে শিক্ষায়ও ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছর মার্চ মাস থেকে, অতিমারীর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ বিগত প্রায় ১৮মাস। দেশে ৩০ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যহত হয়েছে। ‘আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশন’-র একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে ভারতের প্রায় ৬০ শতাংশ স্কুলছাত্রী অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পায় না। অনেক পরিবারের স্মার্টফোন নেই অথবা তাদের নিজস্ব একটি স্মার্টফোন নেই।
অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মোবাইল/কম্পিউটারের সংখ্যা এবং গুণমানকে বাদ দিয়ে, অন্যান্য যেসব পরিকাঠামো অনলাইন শিক্ষার জন্য দরকার, তার অপ্রতুলতা সকলের কাছে অনলাইন শিক্ষা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রধান বাধা। ‘অক্সফাম ইন্ডিয়া’-র একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে শহরের বেসরকারি স্কুলে পড়াশুনা করে এমন পরিবারের মধ্যেও অর্ধেক অভিভাবক ইন্টারনেট সিগন্যাল এবং গতি নিয়ে সমস্যার কথা জানিয়েছেন এবং এক তৃতীয়াংশ পরিবার মোবাইল ডেটার খরচ সামলানো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের এবং নিম্নবর্ণের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বেশি।
ডিজিটাল বিভাজন শুধু ভারতে একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা নয়, বরং একটি লিঙ্গভিত্তিক সমস্যাও। যে পরিবারে একাধিক শিশু আছে অথচ একটি মাত্র মোবাইল/কম্পিউটার আছে, সেক্ষেত্রে ভাইবোনেরা নিজেদের মধ্যে সেটি ভাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে ছাত্রটিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ছাত্রীটিকে নয়। কিছু প্রয়োজনীয় অ্যাপ হয়তো বর্তমানে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা হল বেশীরভাগ পরিবারের না আছে মোবাইল/কম্পিউটার কেনার সামর্থ, না আছে সব সন্তানের জন্য আলাদা যন্ত্র কিনে দেবার আর্থিক সঙ্গতি। ফলে প্রযুক্তির জনহিতকরী ভূমিকা অস্থায়ী এবং মূলত বাজার দখলের জন্য তা ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে এবং বিশ্বব্যাপী EdTech (প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা পরিষেবা দানকারী সংস্থা) কোম্পানিগুলোর জন্য শিক্ষায় বৈষম্য বাড়তে পারে।
২০২০ সালে শিক্ষা পরিষেবা প্রদানকারী নতুন কোম্পানীগুলির (স্টার্টআপ) ব্যাপক উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে।। ভারতে প্রায় ৪,৫৩০ টি EdTech স্টার্টআপ কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ৪৩৫ টি ২০১৯ থেকে ২০ এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। এদের মাধ্যমে সরাসরি লগ্নি পুঁজি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে গেছে। বর্তমানে ভারতে EdTech ব্যবসার পরিমান প্রায় ৫০০০-৬০০০ কোটি টাকা।
এই বছর ‘বিএআরসি ইন্ডিয়া’ এবং ‘নিয়েলসেন’ -এর যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী লকডাউনের পর থেকে স্মার্টফোনে শিক্ষার ‘অ্যাপ্লিকেশনের স্ক্রিন টাইম’ (ব্যবহারের সময়) ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। লকডাউনের পর থেকে, বাইজু নামক অ্যাপ টিতে ৩.৩কোটিরও বেশি নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে এই অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭.৫ কোটি। ‘আনঅ্যাকাডেমি’ নামে একটি অ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা জানুয়ারী ২০২১ সালের মধ্যে ৪কোটি হয়ে গেছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি কেবল K-12 (কেজি থেকে ক্লাস ১২) এবং K-12 পরবর্তী শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছিল না, উপরন্তু সাম্প্রতিক ‘লিঙ্কডইন’-র সমীক্ষা অনুসারে, লকডাউন চলাকালীন সময়ে পেশাদাররা নিজেদের দক্ষতা আরও বাড়ানোর (upskilling) জন্য বা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাজারে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য অনলাইন শিক্ষায় প্রায় ৬৩% সময় ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ৯মাসে, ‘আপগ্র্যাড’-র মতো আপস্কিলিং কোম্পানির অনলাইন কোর্স ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘ব্লুমবার্গ’-র প্রতিবেদন অনুসারে, বাইজু’র বর্তমানে শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ৭০০০কোটি টাকা সংগ্রহ করার কথা ঘোষণা করেছে। এই EdTech হাঙরের সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,৫০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে, ‘আনঅ্যাকাডেমি’ নামে আর এক শিক্ষা ব্যবসায়ী হাঙর, ‘টাইগার গ্লোবাল, ড্রাগনিয়ার ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ, স্টেডভিউ ক্যাপিটাল এবং জেনারেল আটলান্টিক-র মতো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার নিজেই কিনে নিয়েছে। ‘ডাউটনট’ হ’লো একটি বহুভাষিক পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করে অর্থের বিনিময়ে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই কোম্পানি ‘সিকুইয়া ক্যাপিটাল ইন্ডিয়া’, ‘ওমিডিয়ার নেটওয়ার্ক ইন্ডিয়া’ এবং ‘ওয়াটারব্রিজ ভেঞ্চারস’, ‘এসআইজি’ এবং ‘লুপা সিস্টেম’-র মতো বিনিয়োগকারীদের থেক ২২৪ কোটি টাকা (প্রায় ৩০মিলিয়ন মার্কিন ডলার) উদ্যোগ মূলধন (Venture Capital) সংগ্রহ করেছে। এই বাজারে পিছিয়ে নেই আম্বানীরাও। মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বাধীন ‘রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ (আরআইএল) ভারতের বিশাল EdTech মার্কেট দখলের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে। বেঙ্গালুরু ভিত্তিক একটি স্টার্টআপ কোম্পানি ‘এমবিবে’। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৮ সালে এদের ৭৩% শেয়ার কিনে নিয়েছে। আম্বানীদের লক্ষ্য ভারতের ‘পরীক্ষা প্রস্তুতি’ নিয়ে শিক্ষা ব্যবসায়ের শীর্ষ স্থান দখল করা। এরা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সমর্থিত (Artificial Intelligence) প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যা শিক্ষার্থীদের প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করাতে সাহায্য করে । গত বছর এপ্রিল মাসে, ‘এমবিবে’ তার মূল বিনিয়োগকারী রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল পেয়েছে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল এবং এমবিবে, এক্সট্রা মার্কস এডুকেশন এবং জিও ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সাতটি রাজ্যে জাতীয় ও রাজ্য ভিত্তিক বিষয়বস্তু নিয়ে ৬৫টিরও বেশি শিক্ষামূলক চ্যানেল চালু করেছে জিও টিভিতে। EdTech সেক্টরের সর্বশেষ ‘Inc42 প্লাস’ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০২০ সালের আগেই ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষার্থী সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৫.৫ কোটি। এই শিক্ষা ব্যবসায়ী হাঙড় কোম্পানিগুলি আশা করছে শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলি স্কুল ফি বাদে, EdTech কোর্স এবং পরিষেবার জন্য আরও বেশি অঙ্ক খরচ করবে। শেখার উপকরণ এবং কোর্সের খরচের বাইরে আরও অন্যান্য খরচ রয়েছে। ডিজিটাল শিক্ষার জন্য প্রয়োজন আরও উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, দ্রুতগামী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং EdTech পরিষেবার সাবস্ক্রিপশন মূল্য। সাধারণভাবে একটি ভারতীয় পরিবার তাদের আয়ের মাত্র ১৫.৫% শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। ‘পাবলিক ডেটা নিউজ প্ল্যাটফর্ম ফ্যাক্টলি’-র সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক উভয় স্তরে একটি শহুরে এবং গ্রামীণ ভারতীয় পরিবারের বার্ষিক ব্যয়ের মধ্যে ব্যপক পার্থক্য রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় গড় গ্রামীণ ব্যয় বর্তমানে ৫,৬০০ টাকার কাছাকাছি এবং শহুরে পরিবারগুলি এর ৩গুণ বেশি অর্থাৎ প্রায় ১৪,৫০০ টাকা খরচ করে । প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য গ্রামীণ ভারতীয় পরিবার বছরে ৩,৪৫৪ টাকা খরচ করে, যেখানে একটি শহুরে পরিবার প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১৩,৫০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে। এখান থেকেই স্পষ্ট গ্রাম ও শহরের বৈষম্য।
EdTech কোম্পানিগুলির নির্ধারিত বিপুল ব্যয় যে পরিবারগুলি বহন করতে পারবে, তাদেরই এই হাঙড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার আওতায় নিয়ে আসতে চায়। সন্তানের ভালো শিক্ষার জন্য সব পিতামাতারাই প্রয়োজনে ধার করতেও পিছপা হয়না। এটাকে ব্যভার করেই একটি বাচ্চা স্কুল ছাড়ার আগেই তাকে ‘ছাত্র ঋণ’-এর (student loan) নামে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে, বেশ কয়েকটি ঋণদানকারী কোম্পানি ঋণদানের পরিষেবা চালু করেছে, যা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলিকে ডিজিটাল শিক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সহায়তা করার নামে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলছে।। ‘এডুভানজ’, ‘লিপ ফাইন্যান্স’, ‘জেস্টমনি’ এবং আরও অনেকগুলি কোম্পানি সম্প্রতি এই বাজারে প্রবেশ করেছে। এরা অনলাইন সাবস্ক্রিপশন অর্থাৎ ডিজিটাল শিক্ষা কিনতে ইচ্ছুক পিতামাতাদের ঋণ দিচ্ছে।
যেমন ‘জেস্টমনি’, কর্মরত পেশাদার এবং ছাত্র যারা অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নিজ্রদ্র upskilling দক্ষতা বাড়াতে চাইছে, তাদের ঋণ দিচ্ছে। এই কোম্পানিটি জুলাই মাসে একটি বিবৃতিতে বলেছিল যে, ৫৭% এরও বেশি আবেদনকারী যারা পুনরায় দক্ষতা বাড়ানোর শিক্ষা-প্রোগ্রাম বেছে নেয়, তাদের গড় ঋণের পরিমান ৫০,০০০ টাকা। প্রতি মাসে এই কোম্পানির ঋণ দানের পরিমান ৫০কোটি টাকা এবং এখনও পর্যন্ত k-12 শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ২৫০ থেকে ৩০০কোটি টাকা লোন দিয়েছে। মুম্বাই-ভিত্তিক ঋণপ্রদানকারী কোম্পানি ‘এডুভানজ’ অফলাইন K-12 অর্থাৎ স্কুল পড়ুয়াদের ঋণ দেয়। এদের ঋণদানের পরিমান ২০২০-র মার্চ মাসে লকডাউনের পরে ১৫গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের এবং তাদের পরিবারগুলিকে।
 যদি অনলাইন বা ডিজিটাল শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা লাভের মাধ্যম হয়ে যায়, তাহলে শিক্ষার খরচ কম আয়ের পরিবারগুলির নাগালের বাইরে চলে যাবে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিগত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। এখন প্রয়োজন শিক্ষার পরিকাঠামোকে উন্নত করার জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। অথচ চলতি বছরে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ ৬,০৮৮ কোটি টাকা কমিয়েছে। বিজেপি সরকারের কাছে শিক্ষা একটি নিম্ন-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় - এই নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০-২০২১ বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ সম্পূর্ণভাবে ব্যয় করেনি। যখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে হিমশিম খাচ্ছিল এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ যখন সীমিত, তখন ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কেন্দ্র সরকার শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ৯৯,৩১২কোটি টাকার মধ্যে  মাত্র ৮৫,০৮৯কোটি টাকা খরচ করেছে। কোভিড পরিস্থিতিতে আরও অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০-২০২১ বাজেটে শিক্ষার জন্য মাত্র ৯৩,২২৪ কোটি টাকা (স্কুল শিক্ষার জন্য ৫৪,৮৭৩.৬৬ কোটি টাকা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ৩৮,৩৫০.৬৫ কোটি টাকা) বরাদ্দ করেছে। 
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মনে করেছেন স্কুল শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য এই লকডাউনের সময়টাই উপযুক্ত। তিনি ঘোষণা করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্মসূচীর অধীনে একশো সরকারী সৈনিক স্কুল অন্তর্ভুক্ত করবে এবং সারা ভারতে প্রায় ৭৫০টি ‘একলব্য’ স্কুল খুলবে । নানাভাবে প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে ডিজিটাল শিক্ষার ক্ষেত্রকে অবাধ মুনাফা লুঠের মৃগয়া ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার কথাও নয়া শিক্ষা নীতিতে ঘোষণা করেছে বিজেপি সরকার।
ব্যাপক বিজ্ঞাপনী প্রচারের আড়ালে এই সত্যকে গোপন করা সম্ভব নয় যে বিশ্বব্যাপী EdTech কোম্পানিগুলোর জন্য শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন ছিল এই EdTech কোম্পানীগুলির সর্ববৃহৎ বাজার। চীনের অভিজ্ঞতা হল, শিক্ষায় বিশেষত স্কুল শিক্ষায় এই EdTech কোম্পানীগুলির অনুপ্রবেশ এবং বিশেষ কোনো বিধিনিষেধ না থাকার ফলে চীনে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। সাথে সাথে চীনের মতন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখানে সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত সেখানেও বেড়ে চলেছিল শিক্ষার খরচ। একই সাথে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক নেতীবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তাই চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ থেকে EdTech কোম্পানীগুলির উপর প্রায় ১২০বিলিয়ান ডলার (৮হাজার ৪০০কোটি টাকা) জরিমানা চাপিয়েছে। এর সাথে সাথে এই অনলাইন শিক্ষাকে বাজারের নিয়ন্ত্রনের হাত থেকে রক্ষা করতে একগুচ্ছ সরকারি বিধি-নিষেধ চালু করেছে। শুধু চীন নয়, এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য বাড়ছে। সম্প্রতি MIT বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০টি গবেষণার মাধ্যমে এই সত্য উঠে এসেছে - EdTech কোম্পানীগুলির জন্য শিক্ষায় নিম্ন আয় ও উচ্চ আয় যুক্ত পরিবারগুলির মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বাড়ছে । একই সাথে আমেরিকায় শিক্ষার এই অতিরিক্ত খরচের জন্য সেদেশের প্রতি ৬ জন ছাত্রের এক জনকে ঋণ নিয়ে তাদের পড়াশুনা চালাতে হচ্ছে।সেদেশে মোট শিক্ষা ঋণের পরিমান ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার (১লক্ষ ১৯হাজার কোটি টাকা), যা নিয়ে সে দেশের সরকার গভীর বিপদে পড়ে এখন মাথাপিছু ২০হাজার ডলার শিক্ষা ঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এই ঋণ জর্জরিত পরিবারগুলির অর্থনৈতিক দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে।
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহন করা উচিত কারণ আম্বানী সহ দেশি-বিদেশী লগ্নি পুঁজির মালিকরা এই অনলাইন শিক্ষাকে অবাধ মুনাফা লোটার হাতিয়ার করতে চায়। অবিলম্বে এই EdTech ক্ষেত্রে সরকারি বিধি-নিষেধ লাগু করতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রেমী মানুষের অবিলম্বে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন –

১. যেসব কোম্পানী-সংস্থা-প্রতিষ্ঠান স্কুলের পাঠ্যক্রম শেখায় তাদের অবশ্যই অলাভজনক হতে হবে।

২. এই প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার বাজারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না বা মুনাফার উদ্দেশ্যে কোনো বিদেশী পুঁজি সংগ্রহ করতে পারবে না।

৩. ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য অনলাইন পাঠ্যক্রম নিষিদ্ধ।।

৪. কোনও সংস্থা-প্রতিষ্ঠান বিদেশী পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষাদান করতে পারবে না।

*বিঃদ্রঃ- ১ মার্কিন ডলার এর টাকায় রূপান্তরের মূল্য ভারতীয় মূদ্রায় ৭০টাকা ধরা হয়েছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন