Wolrd Draught Day

World Day to Combat Desertification and Drought: A Report

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

‘তিসরা ফসল’

গ্রামীণ ভারত ও বিকাশ কিংবা উন্নয়নের আন্তঃসম্পর্কটি অর্থনীতি কিংবা সমাজবিদ্যার গবেষকদেরই বিষয় রয়ে যেত যদি স্বাধীনতার ৭৫ তম বার্ষিকীর দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেও ‘খরা’ আমাদের দেশে একটি জলজ্যান্ত সমস্যা না হত। এই তথ্যে নাগরিক সমাজ শুধুমাত্র তখনই বিচলিত হয় যখন টিভির পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের শিরোনামে একটি বা একাধিক দুর্দশাগ্রস্থ কৃষিজীবী ভারতীয়ের মৃত্যু হঠাৎ খবর হয়ে ওঠে। উদ্ভুত সমস্যার সমাধান হিসাবে সরকারী, বেসরকারী পরিষেবায় ত্রানের কাজ শুরু হয়। সেইসব ত্রানসামগ্রী কখনো এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যেখানে খরা আদৌ নেই, আবার কখনো দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় সেঁকের পুঁটুলি হিসাবেও কাজে লাগে। ত্রান জুটলেও পরিত্রান জোটে না।

সারা বছর রক্ত, ঘাম, ক্ষুধা এবং প্রয়োজন পড়লে সর্বস্ব বাজি রেখেও আমাদের দেশে কৃষকরা চাষ করেন। গড় পরিসংখ্যানে আমাদের জমির চরিত্র দুই ফসলি। তাই সর্বস্ব দিয়ে চাষের কাজ করার পরে ‘খরা’ এলে ‘ত্রান’কেই বলা হয় ‘তিসরা ফসল’।

বৃষ্টির পরিমান ও জলের অভাব

‘খরা’ কোন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। ভারতে গড় বৃষ্টিপাত হয় প্রায় ১১৮০ মিলিমিটার, জলের সমস্যা দেশের যেসমস্ত জায়গায় সর্বাধিক সেই সব জেলাগুলিতেও (যেমন ওড়িশার কালাহান্ডি, নুয়াপদা, কোরাপুট, পালামৌ কিংবা মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চল) বৃষ্টিপাতের অভাব আসলে কোন সমস্যাই নয়। সমস্যা অন্যত্র, উদারনীতির তিন দশক পেরিয়ে ভারতে খরাপ্রবণ এলাকার (ব্লক হিসাবে) পরিমান ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পাঁচ বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বদল হলেই দেশের খরাপ্রবন এলাকার মানচিত্রে নতুন এলাকার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। তাহলে কি খরা এবং জলাভাব মোকাবিলায় অর্থের সংস্থানই দুর্দশার মূল কারন? সেকথাও বলা যায় না, ১৯৯৪-৯৫ সালে শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রেই জলাভাব রয়েছে এমন অঞ্চলগুলির কল্যানার্থে ১১৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এর পরেও খরা কবলিত এলাকার ম্যাপ ছোট হয়নি, বেড়েই চলেছে। মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহার সর্বত্র একই অবস্থা।

আসলে একবার খরা প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা গেলেই সেইসব এলাকার সরকারী দপ্তরের বাবুগণ কিংবা যাদের আরও বেশি ক্ষমতা রয়েছে (পড়ুন মন্ত্রী, এমএলএ কিংবা এম পি) তারা নিজেদের একান্ত বিবিধ প্রয়োজনগুলি সহজেই মিটিয়ে নিতে পারে, মোটামুটি একটা সেমি-পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট হয়ে যায় আর কি। রইল পড়ে ‘খরা’ – তার জন্য তো সরকার আছেই।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশের ৪৮.৮ শতাংশ কৃষিজমি সেচের সুবিধাযুক্ত। বাকি জমিতে বৃষ্টির জলের উপরেই নির্ভর করতে হয়। যদি প্রশ্ন ওঠে এখনও এত জমি সেচের সুবিধার বাইরে কেন – নিশ্চিন্ত থাকুন, দেশে কমিউনিস্ট শাসনের বিপদ আসন্ন মনে হচ্ছে না।

তাই ‘খরা’।

তথ্য, সংবাদ এবং একজন সাংবাদিক

যদি কেউ তথ্যনিষ্ঠ হতে চান তবে তার জন্য আমাদের হাতে রয়েছে Draught Prone Areas Programme (DPAP), কিংবা তার অনুসারি Employment Assurance Scheme (EAS) অথবা আরও উৎকর্ষতা সমৃদ্ধ Anti Disertification Project’র বিস্তারিত প্রতিবেদন। এগুলিতে আমরা পাব কতদিন ধরে কত টাকাপয়সা ব্যয় করা হয়েছে, হচ্ছে কিংবা হবে এবং নির্দিষ্ট এলাকাগুলিতে কেউ যদি হাজির হন তিনি দেখবেন খাতায় লেখা আর কৃষকদের নসিবের লিখন কতটা আলাদা।

যেমন মহারাষ্ট্রে ফসলি জমির এলাকায় সেচসেবিত জমির অংশ ১৫ শতাংশ অথচ খরাপ্রবণ অঞ্চলে সেচ জমি রয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। এর থেকেই বুঝে নেওয়া যায়, আসলে কাদের কিভাবে বিকাশ ঘটছে (১৯৯৫ সালের হিসাব)।

আঞ্চলিক সংবাদদাতা, ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার হয়ে দুর্দশার করুণতম অবস্থার রগরগে সব ফাইল চিত্র প্রতিবেদন সম্বলিত হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবধি পৌঁছায়। প্রশাসনের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার যোগ্য খবর নির্মাণের এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে নির্ধারিত ইনসেন্টিভের বন্দোবস্ত থাকে। অসামান্য দক্ষতায় পরিবেশিত পেশাদার কলমচিদের ক্ষোভ অচিরেই রুপান্তরিত হয় সংগঠিত জনরোষে – যতক্ষণ সেই খবর মোটা বিজ্ঞাপনকে আকর্ষিত করে রাখে। তারপরে নির্দিষ্ট এলাকাগুলি পরিণত হয় উঠতি সাংবাদিকদের হাত পাকানোর ফিল্ডে।

‘খরা’ কাটে না।

১৯৯৩ সালের মে মাস থেকে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে আমাদের দেশের সেইসব রাজ্য, জেলা, ব্লক এবং মানুষের কথা যারা সরকারী হিসাব থাকুক আর নাই থাকুক দরিদ্রতম ভারতীয়। সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঐসব এলাকাগুলিতে দীর্ঘ সময় কাটানো সাংবাদিকের মাথায় এবং মুখে একই প্রশ্ন, বছরের ২৪০ দিনই কৃষিকাজ বন্ধ থাকে – তখন সবাই কি করে?

সারা দেশের সাতটি রাজ্যের প্রায় ৮০,০০০ কিলোমিটার এলাকায় ঘুরে বেড়ান সেই সংবাদদাতা। সেই অভিজ্ঞতালব্ধ ৮০টি ধারাবাহিক প্রতিবেদন পরবর্তীকালে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয় – Everybody Loves a Good Drought শিরোনামে।

আজ ১৭ই জুন, বিশ্ব খরা ও মরুভূম প্রসার রোধ দিবস। সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং পুঁজিবাদী সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের বোঝাতে চাইছে – খরা হল আসলে অযোগ্য মানুষদের হাতে থাকা বিবিধ প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের ফলাফল আর নয়ত প্রকৃতির খামখেয়ালী। প্রয়োজন রয়েছে খরা, অনাহার এবং দারিদ্যের প্রকৃত কারন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার, অন্যদের অবহিত করার।

১৯৯৩ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়া থেকে ফেলোশিপ অর্জন করে পি সাইনাথ ভারতের প্রেক্ষাপটে তেমনই একটি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। সেইসব প্রতিবেদন সম্বলিত বই আমাদের দেশকে ম্যাগসেসে পুরষ্কার এনে দেয়, একই সাথে ভারতে সবচাইতে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষদের সম্পর্কেও আমাদের সচেতন করে। গত দুই বছর ধরে চলা বিভীষিকা কোভিড মহামারী কাটিয়ে উঠতে চলেছে ২০২২ সালের পৃথিবী। কয়েকশো বছর ধরে চলা মহামারী ‘খরা’ নিয়েই বেঁচে আছেন এমন ভারতীয় এবং বিশ্ববাসীদের কথা ভেবে শুধু একটি দিন হিসাবে নয়, ‘খরা বিরোধী দিবসে’ আমাদের সতর্ক হতে হবে প্রতিদিন। না হলে বছর বছর খরা’র প্রত্যাশায় ঢেউ গুনে চলার মত স্থিতধী মুনাফাখোরদের হারানো যাবে না, প্রতিরোধ করা যাবে না ‘খরা’ও।

সৌভিক ঘোষ

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word

Leave a Reply