Site icon CPI(M)

Why Such Purporting?

সংবিধান লঙ্ঘন দিবস – রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর বিবাদের আড়ালে চলুক ভোট লুট

শমীক লাহিড়ী

১২ফেব্রুয়ারী,২০২২

আজ হঠাৎ রাজ্যপাল সংবিধানের ১৭৪ ধারার ২ক ধারা অনুযায়ী বিধানসভার স্থগিত করলেন কেন? এর আইনি কি বিশ্লেষণ আছে সেটা জানার চাইতেও আগে এটা জানা জরুরী – বিধানসভার অধিবেশন স্থগিত করে ভোট লুটের বিব্রতকর আলোচনা থেকে তৃণমূলকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যই কি একনিষ্ঠ বিজেপি কর্মী জগদীশ ধনকড় বিধানসভা স্থগিত করলেন? একই সাথে নির্বাচনের দিন চিঠিটা প্রকাশ করলেন ভোট লুটের খবর করা থেকে তৃণজীবী মিডিয়াকে বিরত থাকার সুযোগ করে দিলেন?

কি আছে সংবিধানের ১৭৪ নং ধারায়? এই ধারা অনুযায়ী রাজ্যপালকে রাজ্যের বিধানসভার অধিবেশন ডাকার এবং স্থগিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিধানসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে Summon বা অধিবেশন তলব করেন রাজ্যপাল। একইভাবে বিধানসভা অধিবেশন শেষে Prorogue বা স্থগিত রাখার ঘোষণাও রাজ্যপালই করেন ১৭৪ধারার ২খ উপধারা অনুযায়ী।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এই ধারা প্রয়োগ করে নিজের দায়িত্বে বিধানসভার অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন আজ, রাজ্যের মন্ত্রীসভার মত না নিয়েই।

প্রশ্ন হ’লো এটা কি আইন সম্মত? অর্থাৎ রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ ছাড়া কি তিনি এই কাজ করতে পারেন? সংবিধানের ১৭৪ ধারা কি সংবিধানের ১৬৩ ধারার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায়?

এই বিতর্ক সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণ পরিষদেও (Constituent Assembly) হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ২রা জুন খসড়া সংবিধানের ১৫৩ নং ধারা (বর্তমান ১৭৪) নিয়ে বিতর্ক হয় এবং ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়। সেই বিতর্কের সময় একজন মাননীয় সদস্য প্রশ্ন তোলেন যে, রাজ্যপালের হাতে বিধানসভার অধিবেশন স্থগিত বা বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত করা উচিত নয়, কারণ রাজনৈতিক কারণে এই আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে। যাই হোক গণ পরিষদে এই আইন গৃহীত হয়, প্রস্তাবিত খসড়ার ৩নং উপধারা বাদ দিয়ে। এই বাতিল হওয়া প্রস্তাবিত ৩নং উপধারায় রাজ্যপালদের হাতে discretionary power অর্থাৎ নিজস্ব বিচার অনুযায়ী বিধানসভার অধিবেশন তলব করা বা স্থগিত রাখা বা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কেন এই ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেও গণ পরিষদ এই ধারা বাতিল করেছিল তা বোঝাপড়ায় আনা দরকার।

রাজ্যপালরা কি এই প্রশ্নে স্বাধীন বা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?

১৯৭৩ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করে – ১৭৪ নং ধারাকে ১৬৩ নং ধারা থেকে পৃথক করে দেখা যায় না। ২০১৬ সালে অরুনাচল রাজ্যের নাবাম রেবিয়া সংবিধানিক মামলায় সুপ্রীম কোর্ট স্পষ্ট রায় দেয় – ”শুধুমাত্র মন্ত্রীসভার পরামর্শের ভিত্তিতেই রাজ্যপাল বিধানসভার অধিবেশন তলব, স্থগিত এবং বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন”।

১৬৩ নং ধারায় রাজ্যপালের ভূমিকা, কাজের পরিধি এবং সুযোগ উল্লেখ করা আছে। সেখানে স্পষ্টভাবেই লেখা আছে – রাজ্যপাল মন্ত্রীসভার পরামর্শ ও সহযোগিতা অনুযায়ী চলবেন।

১৫৩ – ১৫৫, ১৫৭ – ১৬১, ১৬৩-১৬৬, ১৭৪-১৭৬, ২০০, ২০২, ২০৩, ২০৫, ২১৩ এই সব সাংবিধানিক ধারায় রাজ্যপালের ভূমিকা, কাজ, এক্তিয়ার, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বর্ণনা করা আছে।

কিন্তু মূল কথা হলো – রাজ্যপাল যদি মনে করেন যে, রাজ্যের মন্ত্রীসভা বা মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন তবেই তিনি ১৭৪ ধারা অনুযায়ী একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিধানসভার অধিবেশন তলব করতে বা স্থগিত করতে বা বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করতে পারেন। এছাড়াও যদি রাজ্যপাল মনে করেন যে রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরী হয়েছে, তবেও তিনি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করতে পারেন।

রাজ্যপাল পদ ঘিরে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন। কেন্দ্র- রাজ্য সম্পর্ক খতিয়ে দেখার জন্য ১৯৮৩ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি রঞ্জিত সিং সারকারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিশন তৈরী করে। সংবিধানের বর্তমান কাঠামোর মধ্যে থেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুণর্বিন্যাস কোন কোন ক্ষেত্রে করা যায় তা খতিয়ে দেখা ও তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সুপারিশ করার জন্যই এই কমিশন গঠন করা হ’য়েছিল। বিচারপতি সারকারিয়ার নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন রাজ্যপাল পদ নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল, আরও ২৪৬ টি সুপারিশ সহ।

কিন্তু এসব কিছুই মানা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালদের রাজনৈতিক কাজে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৬৭ আর ১৯৬৯ এ গঠিত যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা ভেঙে দেওয়া, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে সর্ববৃহৎ দল হওয়া সত্ত্বেও সিপিআই(এম)-কে সরকার গঠনের সুযোগ না দেওয়া থেকে শুরু করে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসন কালে বারে বারে অন্যায়ভাবে রাজ্যপাল পদকে ব্যবহার করা হয়েছে।

সেদিন আজকের তৃণমূল দল ছিল কংগ্রেস দলেরই অংশ। পরে হয়েছে বিজেপির সহযোগী। কিন্তু কোনো সময়েই এরা রাজ্যপাল পদে রাজনৈতিক নিয়োগ, রাজ্যপালের রাজ্য রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের বিরোধিতা তো করেই নি, বরং রাজ্যপালকে ব্যবহার করে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়েছেন বারেবারে সেদিনের তৃণমূল নেত্রী আজকের মুখ্যমন্ত্রী।

আবার বিজেপি নিজেদের সরকার ভাঙতে রাজ্যপাল পদকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও, বিগত সাড়ে সাত বছরের রাজত্বকালে বিজেপি অন্তত ১৭টি রাজ্যে মানুষের রায়ে নির্বাচিত সরকারকে পালটে বিধায়ক কেনাবেচা করে বিজেপির সরকার গঠনে নির্লজ্জভাবে রাজ্যপাল পদকে ব্যবহার করেছে।

আজ শিলিগুড়ি, আসানসোল, বিধানগর ও চন্দননগর এই ৪টে কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। ২৭শে ফেব্রুয়ারী হবে আরও ১০৮টি পৌরসভার ভোট।

এই সমগ্র নির্বাচনই হচ্ছে আদালতের হস্তক্ষেপে। তৃণমূল সরকার ২০১৮ সাল থেকে ক্রমশ মেয়াদ শেষ হতে থাকা কর্পোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনের ব্যবস্থা না ক’রে পেছনের দরজা দিয়ে প্রশাসকমন্ডলীর মাধ্যমে পৌরসভাগুলি চালিয়েছে। অথচ ৭৩ ও ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের স্থানীয় সায়ত্ত্ব শাসিত সংস্থাগুলিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে১৯৯৩ সালেই।

নির্বাচন তো আদালতের হস্তক্ষেপে করতে বাধ্য হ’লো তৃণমূল সরকার, কিন্তু ভোট কি হচ্ছে! দেখছেন মানুষ। এটা গণতন্ত্র? নির্বাচনে শুধু তৃণমূলের সিন্ডিকেট বাইক বাহিনী ভোট দেবে? সাধারণ ভোটদাতাদের ভোট দেওয়ার অধিকার নেই? সাধারণ ভোটদাতাকে তৃণমূলী সশস্ত্র বাইক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ভোট দিতে হবে? ভোট দিতে গিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে মহিলাদের লাঞ্চিত হতে হবে এই লুম্পেন তৃণমূল বাহিনীর হাতে?

এসব দেখে নির্বাচন কমিশন মুক-বধির হয়ে থাকবে? রাজ্যের ২০টি জেলা পরিষদ এবং ১টি মহাকুমা পরিষদের ৮২৫টি জেলা পরিষদ নির্বাচনী এলাকা, ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯২৪০টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৩৩৫৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮৭৫১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন, ৭টি পৌর কর্পোরেশন এবং ১১৯টি পৌরসভার নির্বাচন সঠিক সময় শান্তিপূর্ণ ভাবে সংগঠিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের।

ভারতের সংবিধানের ২৪৩কে(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজ্যপাল রাজ্যের রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করেন। এই ধারায় সাংবিধানিক ক্ষমতা, দায়িত্ব দেওয়া আছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। এদের একটাই কাজ সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠভাবে পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচন সংগঠিত করা।

ভোট লুট হচ্ছে, মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছে না, মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও বন্দুকের ডগায় প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করানো, পুলিশ বা সাধারণ প্রশাসনের একটা অংশ নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হ’য়ে কাজ করা – এসব সবাই দেখতে পাচ্ছে, একপেশে হলেও সংবাদমাধ্যমেও কিছুটা প্রতিফলিত হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন দেখতে পাচ্ছে না?

গণতন্ত্র হত্যার এই কাজ যখন রাজ্যে সংগঠিত হচ্ছে, তখন নির্বাচনের দিনই রাজ্যপাল-সরকার বিরোধ সামনে নিয়ে আসা হ’ল কেন? বিজেপি কি গণতন্ত্র হত্যার ঘটনা পর্দার আড়ালে ঠেলে দিতে সাহায্য করলো তৃণগামী সংবাদমাধ্যমগুলোকে রাজ্যপাল-সরকার বিরোধ সামনে নিয়ে এসে? আগেও রাজ্যবাসী একই ঘটনা দেখেছে, কিভাবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই ধরনের কাজ তৃণভোজী সংবাদমাধ্যম বারে বারে করেছে।

আজ ১২ই ফেব্রুয়ারী ‘সংবিধান লঙ্ঘন দিবস’ পালন করলো বিজেপি তৃণমূল দুই দল। রাজ্যপাল যেমন নিজের সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন, একই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার বন্দুকের ডগায় কেড়ে নিয়ে, ভোট লুট করিয়ে, দেশের সংবিধানের মূল ভাবনা ‘গণতন্ত্র’-র ওপর নির্মম আক্রমণ চালালেন। বিজেপি তৃণমূল এই দুই দলই দেশের সংবিধানের মূলেই কুঠারাঘাত করছে, ভাঙতে চাইছে দেশের গণতান্ত্রিক-যুক্তরাষ্ট্রীয়- ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই।

সারাদিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে রাজ্যপাল-রাজ্য সরকারের ছায়াযুদ্ধের খবর প্রচার করে অবাধ ভোট লুটের খবর আড়ালে পাঠাবার চেষ্টা চালানো হ’লো। আশ্চর্য রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রী বা বিধানসভার স্পীকার কেউ বিবৃতি দিয়ে এই প্রচার খন্ডন করলেন না এবং এই নিয়ে তৃণভোজী মিডিয়াকে বাজার গরম করতে দিলেন। ভোট পর্ব মিটে যাওয়ার পরে প্রকৃত সত্য জানা যাচ্ছে। ঘটনা হ’লো – বিগত বিধানসভার অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা (prorogue) করা হয়নি, সেটা এতদিন বাদে করা হ’লো যাতে বাজেট অধিবেশনের তলব ঘোষণা করা যায়। প্রশ্ন হ’লো – কেন সারাদিন এই অসত্য প্রচার চালাতে দেওয়া হ’লো, বিশেষ করে ভোট চলাকালীন পুরো সময় জুড়ে? গতকাল বা আগামীকাল না ক’রে কেনই বা ঠিক নির্বাচনের দিনই এই ঘোষণা করা হ’লো? এই ছায়াযুদ্ধে অসত্যের ছায়া আরও প্রলম্বিত হ’লো।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word