শান্তনু দে
উনিশ শতকের একজন দার্শনিক, কার্ল মার্কস, যিনি দাস ক্যাপিটালের মতো বই-ও লিখেছিলেন, আজ একুশ শতকের মানুষের কাছে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কতটা?
মার্কসের জন্মের পর ২০৫ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে পৃথিবী। আর পুঁজিবাদের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ, পুঁজির প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর কেটে গিয়েছে ১৫৫টা শীত-বসন্ত।
সেকারণে, আজকের বিশ্বে মার্কসের চিন্তা ও কাজ কেন প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে জিজ্ঞাসার ভিত্তি আছে বৈকি।
মার্কসের চিন্তার ধারাবাহিক প্রাসঙ্গিকতা এবং যথার্থতাকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ২০০৮ সালের দিকে। সেই বছরটা দেখেছিল একটি বিশ্বায়িত আর্থিক সংকট, যা গ্রাস করেছিল তামাম বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে। আজ তার প্রায় দেড় দশক পরেও, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতি সেই সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। এমনকী, সুরঙ্গের শেষে দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনও আলোর রেখাও।
বরং, সম্প্রতি দুনিয়া দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্কের পতন। ক্রেডিট সুইসের মত বহুল পরিচিত ব্যাঙ্কেরও শেয়ারের দামে ধ্বস। শুধু তাই নয়, তাদেরই ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইৎজারল্যান্ডের কাছে বিক্রী হয়ে যাওয়া।
যাইহোক, ২০০৮ সালের এই সংকট মার্কসের তাক লাগিয়ে দেওয়া অস্তিত্বকে বুর্জোয়া চিন্তাবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের কাছে আরও একবার স্পষ্ট করেছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা গভীরভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন, তাঁরা পুঁজিবাদ নিয়ে মার্কসের বিশ্লেষণের দূরদর্শিতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সুপরিচিত মার্কিন অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘কার্ল মার্কস সঠিকই ধরেছিলেন, একটা সময় পুঁজিবাদ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করতে পারে।’ যোগ করেছিলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম বাজার অবিরাম কাজ করবে, কিন্তু তা করেনি।’ যে রুবিনি ২০০৬ সালে আইএমএফের এক অনুষ্ঠানে ভয়াবহ মন্দার পূর্বাভাস শুনিয়েছিলেন। এই রুবিনিই ২০১৮ সালে শুনিয়েছেন আরেকটি বিশ্বমন্দা আসছে।
সাম্প্রতিক পর্যায়ে সমস্ত প্রধান বিষয়, যা আমাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তা হতে পারে বিশ্বায়নের প্রভাব, কিংবা অসাম্যের বেনজির উত্থান, অথবা পরিবেশের সংকট— এই সমস্ত কিছুই আগেভাগে দেখে গিয়েছিলেন মার্কস।
মার্কস এবং এঙ্গলেস কমিউনিস্ট ইশ্তেহার লিখেছিলেন ১৮৪৮ সালে। যাকে কমরেড স্তালিন বলেছিলেন, ‘দ্য সঙ অব দি সঙস অব মার্কসিজম’। মার্কসবাদের সমস্ত সঙ্গীতের মহাসঙ্গীত হল কমিউনিস্ট ইশ্তেহার। পুঁজিবাদের বিশ্বায়িত প্রক্রিয়াকে তাঁরা বর্ণনা করেছিলেন,
‘নিজেদের প্রস্তুত পণ্যের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, সর্বত্র স্থাপন করতে হয় যোগসূত্র।’
আজকের দুনিয়াতেও কী নিদারুন বাস্তব!
মার্কস-এঙ্গলেস কখন লিখছেন একথা? আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে। পুঁজিবাদের একেবারে গোড়ায়।
ইশ্তেহার প্রকাশের শতবর্ষে, আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে ব্রিটিশ লেবার পার্টির একটি পুস্তিকার ভূমিকায় বিশিষ্ট রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাস্কি লিখেছিলেন, ‘কমিউনিস্ট ইশ্তেহারের মতো দলিল খুব অল্পই আছে, যা ভবিষ্যতের যাচাইয়ের পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। এটি প্রকাশনার পর থেকে মূলগতভাবে এর প্রধান প্রস্তাবনাগুলির কোনটিই আজ পর্যন্ত কেউ নস্যাৎ করতে পারেননি। তারপর বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের সংকট আরও বেড়েছে, এবং তা হচ্ছে আরও ঘন-ঘন ও গভীরতর— উভয় দিক থেকেই।’
এরও প্রায় তেতাল্লিশ বছর পরে সোভিয়েত সহ পূর্ব ইউরোপের একগুচ্ছ দেশে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর ১৯৯১-এ ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে ‘মার্কিন বিবেক’ নোয়াম চমস্কি বললেন, ‘পুঁজিবাদের তুলনায় কমিউনিজমকে আমার স্বর্গের মতো সুন্দর বলে মনে হয়।’
আর এই সেদিন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক বলেছেন, ‘আমি মনে করি মার্কসবাদ যেভাবে সমসাময়িক বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছে সেভাবে আর কেউ করেনি। লেনিন বলতেন: মার্কসবাদ সত্য, সেটাই তার শক্তি। আসল কথা হল, এটা যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত আবিষ্কার।’
আমরা সবাই জানি, মার্কস বেঁচে থাকতে প্রকাশিত হয়েছিল পুঁজির প্রথম খণ্ড। বাকি দু’টি খণ্ড পরে প্রকাশ করেন এঙ্গলেস। উৎপাদনের নতুন প্রণালী— পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে মার্কসের তাত্ত্বিক কাজের এটি ছিল শীর্ষবিন্দু। এটি বেআব্রু করেছে পুঁজিবাদের গতিশীলতা, শ্রমের থেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের শোষণ, উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার হাতে পুঁজি ও সম্পদের পুঞ্জীভবন, ক্রমবর্ধমান অসাম্য, অতি উৎপাদনের সংকট এবং পুঁজিবাদের ব্যবস্থাগত পতনকে, যা পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসে সংকটকে।
তাই সংকট পুঁজিবাদের নিত্যসঙ্গী। পুঁজিবাদের এই সংকট অনিবার্য। কারণ, এই ব্যবস্থার জঠরেই রয়েছে এর বীজ। এই ব্যবস্থাই সংকটের উৎস। কারণ, শোষণই পুঁজিবাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। ইউরোপ-আমেরিকায় প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৮২৫ সালে। তারপর থেকে একাধিকবার।
বিবিসি’র ২০১৬’র খবর। অক্সফামের প্রতিবেদনে আর্তনাদ: ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি।
আজকের পুঁজিবাদকে জোশেফ স্টিগলিৎজ বর্ণনা করেছেন, ‘অব দি ওয়ান পার্সেন্ট, বাই দি ওয়ান পার্সেন্ট, ফর দি ওয়ান পার্সেন্ট’, এক শতাংশের, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের জন্য। ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। (ভ্যানিটি ফেয়ার, ৩১ মার্চ, ২০১১)
স্টিগলিৎজ কি নতুন কিছু বলেছেন? মোটেই না। নতুন কিছুই বলেননি তিনি। ১৭৫ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন মার্কস।
পুঁজিবাদের মধ্যেই দারিদ্র্যের বৃদ্ধি। বস্তুত, মার্কস সেই ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ইশ্তেহারে ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের ব্যবধানের ভবিষদ্বাণী করেছিলেন। উৎপাদন উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানে কমিউনিস্টদের কর্মসূচী নিয়ে পুঁজিবাদীদের অভিযোগের জবাবে মার্কস বলেছিলেন:
‘আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চাই শুনে আপনারা আতঙ্কিত হচ্ছেন। অথচ, আপনাদের বর্তমান সমাজে জনগণের শতকরা নব্বই জনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। অল্প কয়েকজনের হাতে সম্পত্তি থাকার একমাত্র কারণ হলো ওই দশভাগের নয়ভাগ লোকের হাতে কিছুই না থাকা। সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের তীব্র ভর্ৎসনা এই কারণে যে, সম্পত্তির অধিকারে এমন একটা রূপ আমরা তুলে দিতে চাই, যা বজায় রাখার অনিবার্য শর্ত হলো সমাজের বিপুল সংখ্যাধিক্য লোকের কোনও সম্পত্তি না থাকা।
এক কথায়, আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের তীব্র ভর্ৎসনা এই কারণে যে আপনাদের সম্পত্তির উচ্ছেদ আমরা করতে চাই। ঠিক কথা, আমাদের সঙ্কল্প ঠিক তা-ই।’
পুঁজিবাদের একেবারে গোড়ায়, মার্কস লিখেছেন জনসংখ্যার দশভাগের একভাগ বনাম নয়ভাগের কথা।
যে বছর মার্কসের জন্ম, বিশ্ব তখনও রেল দেখেনি। ব্রিটেন তখন সবে বিশ্বের প্রথম রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করছে। আর মার্কসের বয়স যখন সাত, তখন এই বিশ্বে প্রথম চলে রেল। তখনও টেলিফোন আবিষ্কার হয়নি। ব্রিটিশ শিশুদের অর্ধেকই মারা যায় পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগে। তারও আগে কমিউনিস্ট ইশ্তেহার। এখন এই আই-ফোনের যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক।
আজ নয়, সেদিনই মার্কস বলেছিলেন: পুঁজি হল মৃত শ্রম। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো, জীবন্ত শ্রম শুষে সে বেঁচে থাকে, আর যত বেশি বেঁচে থাকে, তত বেশি শ্রম চুষে যায়। পুঁজির মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে অনবরত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে চলেছে পুঁজ-রক্ত। পুঁজির এই চরিত্রকে আরো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের ৩১তম অধ্যায়ের পরিশেষে একটি ফুটনোটে তিনি তুলে ধরেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা টি জে ডানিংয়ের একটি মূল্যবান বক্তব্য।
‘যথেষ্ট মুনাফা পেলেই পুঁজি খুবই সাহসী হয়। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যে কোনও জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০ শতাংশ হলে তার আকুলিবিকুলি বেড়ে যায়। ৫০ শতাংশ মুনাফা দেয় ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফা মানবিকতার সব নীতিগুলিকে পদদলিত করবার সাহস জোগায়। ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে হেন কোনও অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। এমনকি মালিককে ফাঁসিকাঠে পর্যন্ত ঝোলাতে পারে। যদি হাঙ্গামা ও সংঘর্ষ থেকে মুনাফা আসে, তবে অবাধে উভয়কেই দেয় উসকানি।’
পুঁজিবাদের বিকাশ— মার্কসের সময় থেকে কখনও মার্কসের পুঁজিবাদের গতিশীলতার তত্ত্বকে বাতিল করেনি। পরবর্তীতে, এর একচেটিয়া পর্যায়ে উত্তরণ এবং আজকের বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজিকে বিশ্লেষণ এবং অনুধাবন করা যেতে পারে মার্কসের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে। মার্কসের তাত্ত্বিক প্রয়োগ-কৌশলকে ব্যবহার করেই বিশ শতকের গোড়ায় লেনিন বিশ্লেষণ করেছিলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উত্থানকে।
ইতিহাসের প্রতিটি প্রধান স্রোত— ফ্যাসিবাদের উত্থান, উপনিবেশগুলির জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকে উপলব্ধি করা যেতে পারে মার্কসের প্রবর্তিত সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে।
আজ আবারও গুরুতর সংকটে বিশ্ব পুঁজিবাদ।
দ্য ইকনমিস্ট, লেনিনের কথায় ‘যে পত্রিকা ব্রিটিশ মিলিওনেয়ারদের কথা বলে’, সেই পত্রিকার পরামর্শ, মার্কসকে পড়ুন।
‘রুলার্স অব দি ওয়ার্ল্ড: রিড কার্ল মার্কস!’, বিশ্বের শাসকরা: কার্ল মার্কস পড়ুন! শিরোনাম ইকনমিস্টে (মে, ২০১৮)। অষ্টাদশ ব্রুমেয়ারে মার্কসের অমোঘ লাইন ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বটে, তবে ‘প্রথমবার যা হয় ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়বার তা হয়ে পড়ে প্রহসন।’ সেই বক্তব্য ধরেই পত্রিকার উপশিরোনাম, ‘দ্বিতীয়বার, প্রহসন।’ নিবন্ধের সারকথা: ‘তাঁর (মার্কসের) দ্বিশতবর্ষে, পুঁজিবাদের ত্রুটি সম্পর্কে মার্কসের রোগ নির্ণয় বিস্ময়করভাবে প্রাসঙ্গিক।’
এই আর্থিক সংকট অন্তত দু’টি কারণে ঐতিহাসিক।
প্রথমত, এটি আবারও প্রমাণ করেছে কার্ল মার্কস এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। এবং তাঁর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণ এখনই ইতিহাসের আস্তাকূঁড়ের জন্য প্রস্তুত নয়।
দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্ক ও খোলা বাজারকে তার নিজের থেকে বাঁচাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, অন্তত নয়া উদারবাদের বৌদ্ধিক নির্মাণে এখনও যতটুকু অবশেষ রয়েছে— তৈরি করেছে নতুন বিশ্ব বীক্ষার জন্য একটি মঞ্চ— যা গত শতকের তিনের দশকের পর থেকে আর কখনও দেখা যায়নি।
সেকারণেই কার্ল মার্কসকে পড়ার পরামর্শ। এবং শুধু ইকনমিস্ট নয়। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমসেরও।
যদিও, এই সংকটের আগেও মার্কস ছিলেন একনম্বরে।
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। বি বি সি’র অনলাইন ভোট। বেছে নিতে হবে ‘সহস্রাব্দের সর্বকালীন সেরা চিন্তাবিদ’। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, এমনকি চার্লস ডারউইনকে বিরাট ব্যবধাণে পিছনে ফেলে একনম্বরে মার্কস।
আর এখন ‘ক্যাপিটাল’ পড়ার হিড়িক।
সংকটের প্রথম বছর, ২০০৯। এই প্রথম দাস ক্যাপিটাল নিয়ে ছবি। করেছেন জার্মান পরিচালক আলেকজান্ডার ক্লুগ। তিন-ভাগে ৫৭০-মিনিট, সাড়ে ন’ ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি। এবং ‘এক মিনিটও বাড়তি নয়।’ বলেছেন হেলমুট মার্কার, ডাকসাইটে জার্মান দৈনিক ‘তাগেসপিগেল’-এ। ১২অক্টোবর, ১৯২৭। জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ নিয়ে বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র ‘অক্টোবর’ তৈরির পর সের্গেই আইজেনস্টাইন বলেছিলেন, ‘এবারে লক্ষ্য মার্কসের দাস ক্যাপিটাল।’ অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু, ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ ছবির পরিচালকের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। ৮১ বছর পর, আইজেনস্টাইনের সেই স্বপ্নপূরণ করলেন ক্লুগ। এতে আইজেনস্টাইনের করা খসড়া নোট, স্কেচকে ব্যবহার করেছেন তিনি।
আর সংকটের ৯-বছর, ২০১৭। জার্মানিতে বক্স অফিস হিট ‘দ্য ইয়ং মার্কস’। পরিচালক হাইতির রাউল পেক।
এটা ঠিক, মার্কস ফেসবুকের দূরদর্শন করেননি। কিন্তু তাঁর উপলব্ধিতে ছিল জুকেরবার্গের বিজনেস মডেল।
২০১৫, মেরিয়াম ওয়েবস্টার অনলাইন অভিধানে সবচেয়ে সন্ধানী শব্দ ছিল ‘সমাজতন্ত্র’।
২০১৬, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই সহস্রাব্দের তরুণদের অধিকাংশই প্রত্যাখ্যান করেছে পুঁজিবাদকে। তিনভাগের একভাগ সমাজতন্ত্রের পক্ষে। ওয়াশিংটন পোস্ট যখন এই তথ্য জানাচ্ছে, তার আগে ২০১১-তে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় ১৮-২৯ বছরের তরুণদের মধ্যে পুঁজিবাদ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষন করেন ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব জানিয়েছেন ৪৯ শতাংশ।
এই সেদিন (অক্টোবর, ২০১৭) ব্লুমার্গের খবর, নিউ ইয়র্কে জ্যাকোবিন আর রিজন নামে দু’টি পত্রিকা একটি সেমিনার করতে গিয়ে রীতিমতো মুশকিলে পড়ে যায়। বিষয় ছিল ‘পুঁজিবাদ: একটি বিতর্ক’। একদিকে রিজন, ফ্রি মাইন্ড ফ্রি মার্কেটের পক্ষে। অন্যদিকে জ্যাকোবিন, মার্কিন বামপন্থীদের কণ্ঠস্বর। সঞ্চালক নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত কলাম লেখক। টিকিটের দাম ১০ ডলার। এদিকে একদিনেই সমস্ত টিকিট শেষ। তারপরেও টিকিটের বিপুল চাহিদা। বাধ্য হয়ে আয়োজকরা ভাড়া করে কুপার ইউনিয়নের ৯৬০-সদস্যের গ্রেট হল। এবং আবারও সব টিকিট শেষ। এবার ৮ ঘণ্টায়।
যেমন ব্রিটিশ গার্ডিয়ানে শিরোনাম, ‘আমাদের আজকের সংকটের ভবিষদ্বাণী করেছিলেন মার্কস, দেখিয়েছিলেন এর মুক্তির পথ’ (২০ এপ্রিল, ২০১৮)। আর পাঁচবছর আগে এমনই এক পাঁচ মে-তে গার্ডিয়ানের উত্তর-সম্পাদকীয় পাতায় শিরোনাম: ‘দুই শতাব্দী হয়ে গেল, যে কোনও সময়ের তুলনায় মার্কস এখন নিজেকে মনে করছেন অনেক বেশি বিপ্লবী।’
নিউ ইয়র্কট টাইমসের উপসম্পাদকীয় পাতায় শিরোনাম ‘হ্যাপি বার্থডে, কর্ল মার্কস। ইউ ওয়ার রাইট!’ শুভ জন্মদিন, কার্ল মার্কস। আপনি ছিলেন সঠিক! (৩০ এপ্রিল, ২০১৮)
২০২০’র ফেব্রুয়ারি। অস্কার নিতে উঠে অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’র অন্যতম পরিচালক জুলিয়া রাইখার্টের গলায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অমোঘ আহ্বান, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। বারাক ওবামা ও তাঁর স্ত্রীর প্রোডাকশন কোম্পানি হায়ার গ্রাউন্ড প্রোডাকশানের প্রথম ছবি আমেরিকান ফ্যাক্টরি।
পুঁজি ছাড়াও মার্কসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মাকর্সের দর্শনের ভিত্তি হল দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং বস্তুবাদের মিশেল। এবং এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই মার্কস পৌছন কীভাবে মানব ইতিহাস উন্মোচিত হল, তার বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ায়।
মার্কস সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে সমাজের একটি উৎপাদনের ধরন পরিবর্তিত হয়ে একটি নতুন ধরনে পরিণত হয়, যা পুরনোকে রূপান্তরিত করে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থায়। সমাজ শ্রেণি বিভক্ত হওয়ার পর, শ্রেণি সংগ্রামই এনেছে পরিবর্তন। যেমন বিবৃত করা হয়েছে কমিউনিস্ট ইশ্তেহারে, ‘আজ পর্যন্ত, ইতিহাসে যত সমাজ দেখা গিয়েছে, তাদের সকলই হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।’
মার্কস শুধু একজন অর্থনীতিবিদ অথবা রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন না। তিনি একটি বিপ্লবী দর্শনের সূচনা করেছিলেন। এমন এক দর্শন— যা জুড়ে শুধু রাজনীতি নয়, রয়েছে সমগ্র মানব ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজ এবং প্রকৃতি। যে দর্শন বস্তুবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বতত্ত্বের মিশেলে তৈরি করেছে তত্ত্ব ও অনুশীলনের একটি শক্তিশালী সংমিশ্রন, যা আনতে পারে বিপ্লবী রূপান্তর।
মার্কস যেমন নিজে বলেছিলেন, ‘দার্শনিকরা কেবল নানাভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু মূল বিষয় হল একে পরিবর্তন করা’।
মার্কস-এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘কোনও দেশ মুক্ত হতে পারে না, যদি সে অন্য দেশকে শোষণ করে’। বিশ শতকের উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটাই ছিল সূচনা কেন্দ্র। ভারত সম্পর্কে কার্ল মার্কসের কাছে যদিও তথ্য ছিল সীমিত, তবু তার উপর ভিত্তি করেই তিনি লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি নিবন্ধ, যাতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন ভারতীয়রা।
মার্কসের অন্তর্দৃষ্টি ইউরোপ-কেন্দ্রিক ছিল না। মানব সমাজ এবং ইতিহাসের বিকাশে তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আবৃত গোটা বিশ্বজুড়ে।
সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা ঘোষণা করেন, মার্কসবাদ মৃত। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইতিহাসের অবসান।’ জিতেছে পশ্চিমের পুঁজিবাদ। ধনতন্ত্রই ‘সার-সত্য’, এর কোনও বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের অবসান মানে দ্বন্দ্বের অবসান। সংকটের স্থায়ী অবসান।
আরও সুনির্দিষ্ট করে পরে টমাস ফ্রিডম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট’। বিশ্ব সমতল। ঠাণ্ডা যুদ্ধের বিজয়ী হিসেবে এই বিশ্বে উঠে এসেছে মুক্ত বাজার। এবং যেখানে ভবিষ্যত মানে— অর্থনীতিতে ন্যূনতম সরকারী হস্তক্ষেপ। জয়ী হবে সেই সমতল অর্থনীতি, যারা বাজারের সঙ্গে নিজেদের পুরোপুরি জুড়তে পারবে। আর হারবে তারা, যারা নিজেদেরকে এই মুক্ত বাজারের থেকে বাইরে রাখবে। পুঁজিবাদের উত্থান ও বার্লিনের পতন প্রমান করেছে মার্কস ভুল।
নিও-লিবারেল মিডিয়া শুনিয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইতিহাসের ‘একটি দুর্ঘটনা।’ পুঁজিবাদেরই একটি ‘অস্থায়ী উত্তরণ পর্ব’ মাত্র। ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তরের দীর্ঘতম উত্তরণ পর্ব।’
নিও-লিবারেল অর্থনীতিবিদরা আমাদের শুনিয়েছিলেন,‘বাজার’, ‘ব্যক্তি মালিকানা’ ঈশ্বরের মতো পবিত্র। কোনও অর্থনীতি ও সমাজকে সীমাহীন বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদের হাতে রয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। বলা হয়েছিল, ‘নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি।’ অর্থনীতি কখনোই বিনামূল্যে বা ভরতুকি দিয়ে চালানো উচিত নয়।
সেই লক্ষ্যেই ওয়াশিংটন সহমত। দশ-দফা প্যাকেজ।
কে জানতো এত দ্রুত খসে পড়তে শুরু করবে অ-বিকল্প বলে ঘোষিত বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের এহেন বাহারি পলেস্তারা। কে বলেছে ইতিহাসের অবসান হয়েছে? তিনদশক আগের সেদিন ইতিহাসের অবসান হয়নি, বরং ইতিহাস রচিত হয়েছে।
ছাব্বিশ-বছর পর, উদার অর্থনীতির এই বন্ধ্যা ও ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে সেই ফুকুয়ামাই বললেন, ‘এই সন্ধিক্ষণে কার্ল মার্কসের কথাগুলো কিছু বিষয়কে সত্য বলে আমার মনে হচ্ছে। মার্কস অতি উৎপাদনের সংকটের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শ্রমিকরা হবেন আরও গরিব, যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত চাহিদার অভাব।’ (সমাজতন্ত্রের ফিরে আসা উচিত, নিউ স্টেটসম্যান, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮)
সমস্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উচ্চ হারের অসাম্য নিয়ে নানা ক্ষেত্রের অর্থনীতিবিদরা এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি আয় ও সম্পদের অসাম্য গত সত্তর বছরে পৌছছে সর্বোচ্চ স্তরে। আয়ের অসাম্যের নিরিখে, ফরাসী অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেত্তি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসাম্যের হার ‘সম্ভবত, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে অতীতের যে কোনও সময়ে যে কোনও সমাজের চেয়ে বেশি’। বিশ্বায়িত স্তরে, প্রাপ্ত বয়স্কদের শীর্ষ স্তরের ১ শতাংশের হাতে রয়েছে দুনিয়ার সম্পদের ৫১ শতাংশের মালিকানা। এটা আসলেই বিশ্বায়িত ফিনান্স ক্যাপিটালিজমের ফসল।
এটা নিশ্চিত, আজকের বিশ্বের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে কার্ল মার্কস আদৌ বিস্মিত হতেন না। তিনি শ্রমিকশ্রেণি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী জনসাধারণকে দিয়েছেন সেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে কীভাবে শ্রেণি শোষণ ও সামাজিক নিপীড়ন মুক্ত একটি নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব, তার পথ নির্দেশিকা।
মার্কসবাদকে কেবলমাত্র তখনই অতিক্রম করা যাবে, যখন এই মতবাদের লক্ষ্য ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। সেই লক্ষ্য হলো শ্রেণীহীন কমিউনিস্ট সমাজের প্রতিষ্ঠা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু আত্মস্থ করতে ইতিমধ্যে একমাত্র মার্কসবাদই সফল হয়েছে। এবং এই মতবাদের উপরে ঐতিহাসিকরূপে ন্যস্ত আগামী কর্তব্যসমূহের পালনেও এই মতাদর্শ যথেষ্ট মজবুত।
সেকারণেই মার্কস আজও প্রাসঙ্গিক। আপনি তাঁকে সমর্থন করতে পারেন, অথবা বিরোধিতা। কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করতে পারবেন না।
যেমন বলেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ‘হোয়াই স্পেক্টার অব মার্কস স্টিল হান্টস দি ওয়ার্ল্ড’, কেন মার্কসের ভূত এখনও তাড়া করে বেরাচ্ছে বিশ্বকে’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে পোস্টের (৮ মে, ২০১৮) অকপট স্বীকারোক্তি: ‘সমস্ত অপ্রীতিকর শব্দবন্ধ সত্ত্বেও, একটি কেন্দ্রীয় বিষয় স্পষ্ট: তাঁকে আপনি যাই ভাবুন, মার্কস এখনও একটা ব্যাপার, মার্কসকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারবেন না।’
‘হোয়াটএভার ইউ থিঙ্ক অব হিম, মার্কস স্টিল ম্যাটার্স।’ ঠিকই, ‘মার্কস স্টিল ম্যাটার্স।’ মার্কস এখনও একটা ব্যাপার।
যেমন বলেছিলেন এঙ্গলেস তাঁর শেষকৃত্যে: ‘যুগে যুগে বেঁচে থাকবে তাঁর নাম, তেমনি তাঁর কাজও।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ৫ মে ঢাকায় ‘মার্কস ভাবনা আজ ও আগামীকাল’ শীর্ষক সেমিনারে ভাষণ।