মমতার জয়ে মোহন ভাগবতের খুশির রাজনৈতিক তাৎপর্য
গৌতম রায়
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তখনও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি , মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট।ইতিমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে অভিনন্দন জানালেন রাজনাথ সিং। রাজনাথ সিংহ হলেন বিজেপির সেই ঘরানার মানুষ ,যে ঘরানার বিজেপিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে থাকেন । যে বিজেপির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসবার পরে রাজনাথ সিং’কে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করলেও ২০১৯ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর বিজেপির অতীত ঘরানার রাজনাথকে কিন্তু আর মন্ত্রী করেননি মোদি। বস্তুত বাজপেয়ি ঘরানার কোন ব্যক্তিকে কিন্তু মোদি আর মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে আনেন নি। এহেন রাজনাথ সিংয়ের মমতার বিজয়ের অব্যবহিত পর, প্রথম বিজেপি নেতাদের পক্ষ থেকে তৃণমূল নেতৃত্ব কে অভিনন্দিত কর। এই ঘটনার ভিতর কিন্তু আরএসএসের মমতার প্রতি যে প্রত্যক্ষ সমর্থন ,সেই বিষয়টি আবার পরিস্কার হয়ে উঠেছিল।
নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ , তারা মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা সরকারি প্রটোকল অনুযায়ী অভিনন্দন জানিয়েছেন। কারণ; নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী , আর অমিত সাহা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মোদি- শাহের বাইরে তখনও কিন্তু বিজেপির কোনো প্রথম সারির নেতা ,যারা মোদী জমানায় বিজেপিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা মমতাকে অভিনন্দন জানান নি ।
এই অবস্থাতেই রাজনাথ সিংয়ের যে মমতাকে অভিনন্দন জানানোর বিষয়টি তাঁর রাজনৈতিক প্রেক্ষিত আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা। রাজনাথ সিংয়ের এই অভিনন্দনের অল্প কিছু সময় পরেই আরএসএসের সদরদপ্তর নাগপুরের রেশম বাগের ‘কেশব ভবন’ থেকে সরসঙ্গচালক মোহন ভাগবতের মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের জয় সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমরা সংবাদ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে জানতে পারলাম। মোহন ভাগবত কোন রাখঢাক না করেই মমতারই জয় ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যে বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন, সেই বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের জন্য ।কিন্তু তারপরও তারা ক্ষমতা দখল করতে পারেনি ।যদিও সত্তরের বেশি আসন পেয়ে বিরোধী দল হিশেবে উঠে এসেছে।এই বিজেপির পক্ষ থেকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী সমস্ত রকমের শিষ্টাচার ভেঙে, সমস্ত রকমের রাজনৈতিক সৌজন্য কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কার্যত দিল্লি আর পশ্চিমবঙ্গের ভিতর নিত্য যাত্রী তে পরিণত হয়ে ও বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে দলকে রাজ্যপাটে এনে দিতে পারেননি।
একই কথা প্রযোজ্য বিজেপির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্পর্কেও। এরপরেও মোহন ভাগবতের এই প্রকাশ্যে মমতার জয়ের আনন্দ প্রকাশ ,মমতাকে অভিনন্দিত করা, তার থেকেই এটা পরিস্কার হয়ে আসছে যে ; মোদির বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের যে ঠান্ডা লড়াই চলছে ,তার প্রেক্ষিতে সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে আরএসএস সব রকম ভাবে চেয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি আরএসএসের অত্যন্ত স্বাভাবিক অথচ অদৃশ্য বন্ধু , তিনি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ফিরে আসুন। আরএসএস কখনই চাইনি যে , মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি, যে বিজেপি অতীতের বিজেপির মতো আরএসএস কে সেইভাবে মান্যতা দেয় না, যারা সর্বতোভাবে বিদেশি বহু জাগতিক এবং দেশীয় ধনকুবেরদের দ্বারা করায়ত্ত, সেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসুক , যার ফলে নরেন্দ্র মোদি আরো ক্ষমতাশালী হোক। সেই কারণ থেকেই নির্বাচনের আগে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, আরএসএস চাইছে না পশ্চিমবঙ্গে মোদির বিজেপি জিতুক। আরএসএস চাইছে, তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন , গোপন বন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ফিরে আসুন ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করে ,ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করে, আরএসএসের যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সেই রাজনীতিকে প্রসারিত করার কাজটি সংঘের পক্ষে অত্যন্ত সহজ হবে। তার পাশাপাশি যদি মোদির বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে পরাজিত হয় ,তাহলে বিজেপি তে যে নেতৃত্বের জায়গায় ধীরে ধীরে মোদী অমিত শাহ জুটি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন, সেই প্রতিষ্ঠার জায়গাটি ভীষণ রকম ভাবে ধাক্কা খাবে। এই আশঙ্কা থেকেই কিন্তু আমাদের অনুমান ছিল যে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আরএসএস সব রকম ভাবে মমতাকে সাহায্য করে চলছে ।সেই লক্ষ্যেই কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিতে আরএসএস ,বিজেপি প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের যে পুরনো সংগঠনগুলি ,সংঘ পরিবার বলে আমরা অভ্যস্ত, সেই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তারা প্রার্থী দিয়েছে। গত ২০১৩ সালের শেষ দিকে যখন পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন ,এই নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে, তখনই বিজেপির পুরনো ধারার নেতৃত্ব বনাম নতুন ধারার উঠে আসা নেতৃত্বের ভেতরে বিতর্কটা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। বিজেপির পুরনো ধারার নেতৃত্ব ,অর্থাৎ ; এল কে আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী, নীতীন গড়করি ,রাজনাথ সিং প্রমুখের দ্বারা ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হবে না মনে করেই আরএসএস তখন তাদের যাবতীয় সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল নরেন্দ্র মোদির প্রতি।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালের ধীরে ধীরে আরএসএস কে ছাপিয়ে নিজের কর্তৃত্ব বিজেপির উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেন। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়েদের স্বার্থবাহী বিজেপি ধীরে ধীরে বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্পূর্ণ করায়ত্ত হয়ে যাচ্ছে মোদীর নেতৃত্বে , এটা কিন্তু মোদির শাসনকালের প্রথমদিকে আরএসএস এর পক্ষে মেনে নেওয়া খুব সহজ সাধ্য হয়নি।
সাম্প্রদায়িকতা ঘিরে আরএসএসের অবস্থান হল অত্যন্ত উগ্র। কিন্তু আরএসএস কোন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি নির্মাণের চরম জায়গায় যেতে চায়, নাকি সাম্প্রদায়িকতার জিগির কে অত্যন্ত সক্রিয় রেখে ,তার ভিত্তিতে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নানা ধরনের শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে তারা বেশি যত্ন দিয়ে দেখে –এই প্রশ্নটিই মোদির শাসনকালের প্রথম দফাতে ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংস স্তুপের উপর মন্দির নির্মাণের থেকে ওই ধ্বংসস্তূপের ওপর মন্দির নির্মাণের জিগির তুলে ,গোটা দেশে সাম্প্রদায়িকতার পারদকে অত্যন্ত উচ্চগ্রামে রাখাটাই আরএসএসের কাছে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সবথেকে বড় উপায় হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। তাই সাম্প্রদায়িকতার জিগির কে বজায় না রেখে, সাম্প্রদায়িকতাকে ঘিরে এক ধরনের নির্ণায়ক অবস্থান নেওয়া মোদির ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রাম মন্দির নির্মাণের শিলান্যাস বা সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ এ ধারার অবলুপ্তি, এগুলি আরএসএস এর কাছে কতটা আন্তরিক ভাবে গ্রহণযোগ্য ,আর কতটা তাদের সমর্থন করতে হয় বলেই সমর্থন, এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলের বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে।
এই অবস্থাতে ধীরে ধীরে নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহ জুটি যেভাবে আরএসএস নেতৃত্বকে কার্যত অস্বীকার করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং আদানি আম্বানি, প্রমূখ ধনকুবেরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করছে , সেই বিষয়টি কিন্তু আরএসএসের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জিগির বজায় রাখার যে মানসিকতা, সেই মানসিকতাকে অনেকখানি ক্ষুণ্ণ করছে।
যদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি জয়লাভ করে , তাহলে নরেন্দ্র মোদি আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়বেন এবং কোনো অবস্থাতেই সংঘকে পরোয়া করবেন না , এই অনুভূতি থেকেই কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শীর্ষ নেতৃত্ব সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাদের সব ধরনের সমর্থন বজায় রেখেছিল। আরএসএসের এই মমতার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনে অভিশ্রুতি ছিল কিন্তু দিলীপ ঘোষের নানা ধরনের অরাজনৈতিক এবং প্ররোচনামূলক কথাবার্তা, বিশেষ করে শীতলকুচির কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানোর মতো মর্মান্তিক ঘটনার পর যেভাবে দিলীপ ঘোষ ,’সর্বত্র শীতলকুচি করে দেবো ‘ বলে হুমকি দিয়েছিলেন, সেই বিষয়টি যে বিজেপি পক্ষে আদৌ ইতিবাচক হবে না , মমতার পক্ষে নানা ধরনের সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করবে, যার ইতিবাচক দিক মমতার ভোটের রাজনীতিতে পাবেন– এটা আলাদা করে বলে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
দিলীপ ঘোষ পরিপূর্ণভাবে একজন আরএসএসের ঘরের লোক এবং আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপির লোক। তাই দিলীপ ঘোষ নির্বাচনের আগে বা পরে যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছেন, সেই সমস্ত কথাবার্তা আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন ব্যতীত তিনি বলেছেন, এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।
দিলীপ ঘোষের এই ধরনের কথাবার্তা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছে না ,মোদির নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করুক। আরএসএস নেতৃত্ব চাইছে যে, তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ফিরে আসুক ।এই টা দিলীপ ঘোষের ওই ধরনের প্ররোচনামূলক কথা বার্তা ,মমতার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। মমতাকে বারমুডা পড়ার পরামর্শ বা ‘শীতলকুচি করে দেবো সর্বত্র’- এই ধরনের কথাবার্তা ভেতর দিয়ে যে মমতার প্রতি সহানুভূতি তৈরি হবে সেটা না বোঝার মত ছেলে মানুষ কিন্তু আরএসএস নেতৃত্ব নন।
তা স্বত্তেও তাহলে এই ধরনের কথা কেন তাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দিলীপ ঘোষ বললেন? এই ধরনের কথা কেন দিলীপ ঘোষ বললেন তার সদুত্তর কিন্তু মেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বিজয়ী হওয়ার পর ,তৃণমূল কংগ্রেস আবার পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসবার পর ,আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে।
‘দি হিন্দু’ পত্রিকার একটি সমীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে( ৬ ই মে, ২০২১,পৃষ্ঠা -৭) ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে তারা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে একটি ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসে যে ,পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন যারা বিজেপিকে সমর্থন করছে, তারাও কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নের অত্যন্ত উগ্র অবস্থান নিচ্ছে না। মন্দির – মসজিদ ইস্যু বা সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে তারা কিন্তু কট্টর আরএসএস- বিজেপির যে অবস্থান , সেই অবস্থানের সঙ্গে সহমত নয় । অথচ তারা কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছে বিজেপিকে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এই যে আপাত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র , যা একদিকে কট্টর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অবস্থানে আসছে না , অথচ আরএসএসের যে ধর্মান্ধ মানসিকতা, সেই মানসিকতার প্রচার-প্রসার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সঙ্ঘকে সব রকমের সাহায্য করে ,আরএসএসের যে সংস্কৃতি ,সেই সংস্কৃতিকে প্রসারিত করতে ম,মতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা — এটি আরএসএসের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। এটি তাদের রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্য ,রাজনৈতিক প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হয়ে উঠছে ,এটা কিন্তু নানা ধরনের সূত্রের মাধ্যমে বুঝতে পেরে ,আরএসএস কোনো অবস্থাতেই চায় নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যান। ‘দি হিন্দু ‘ পত্রিকায় তাদের ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়কালের এক ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে(ঐ) , ১৯৯২ সালে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়েছিল, তখন প্রতি পাঁচজনের মধ্যে মাত্র একজন হিন্দু জানিয়েছিল যে, এই ধ্বংস সঠিক কাজ হয়েছে ।বাকি চারজন কিন্তু জানিয়েছিল , এই ধ্বংসের কাজ সঠিক হয়নি।
অপরপক্ষে গোটা দেশের চিত্রটি ছিল কিন্তু তার থেকে ভিন্ন। গোটা দেশের হিন্দু জনমতের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন এই ধ্বংসযজ্ঞকে সঠিক বলে বর্ণনা করেছিল, তখন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে কোনো অবস্থাতেই ইতিবাচক বলে বর্ণনা করে নি।
পশ্চিমবঙ্গে এই যে ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা ছিল, নৈতিক পরিবেশ ছিল, সেটিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ধীরে ধীরে তার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিতে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন ,সেটি আরএসএসের রাজনৈতিক কার্যকলাপ, যাকে তারা সামাজিক কাজের আবরণে ঢেকে রাখে, সেইটি চালানোর পক্ষে অত্যন্ত ইতিবাচক হয়েছে।
আরএসএস এই ধর্মান্ধ রাজনীতির জিগিরকে একটা জায়গায় থামিয়ে দিতে চায়না। তার এই সাম্প্রদায়িকতার জিগিরকে এমন একটা প্রবাহিত ধারায় রেখে দিতে চায়, যার ফলে ,তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যেতে পারে। সেই বিজেপি কোন অবস্থাতেই আরএসএসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বিজেপি হোক ,এটা কিন্তু সংঘের শীর্ষ নেতৃত্ব চায়না। তাই তারা মোদিকে আনতে চায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ এর ভিতর। সংঘের সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মোদি ,বিদেশি বহুজাতিকদের হস্তগত হয়ে যাচ্ছে মোদি ,দেশীয় ধনকুবেরদের হস্তগত হয়ে যাচ্ছে মোদি এটা কোন অবস্থাতেই আরএসএসের পক্ষে কাম্য নয়।
অটল বিহারী বাজপেয়ী যেভাবে আরএসএসের মুঠোর মধ্যে থেকে, আরএসএসের নির্দেশ মেনে বিজেপিকে পরিচালিত করেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে পরিচালিত করেছিলেন ,সেই ভাবেই মোদিকে দেখতে চাই আরএসএস। তাই মোদির এই বল্গাহীন নেতৃত্বে রাশ টানতেই তারা নিজেদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাদের যাবতীয় সমর্থন উজাড় করে দিয়েছে। আরএসএস খুব ভালভাবেই জানে, মমতার নিজের প্রয়োজনে নিরিখেই কখনোই কোনো অবস্থাতেই সংঘের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না। সংঘের নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে মোদির মতো এককভাবে আরএসএস কে অস্বীকার করে মমতা নিজের আধিপত্যকে মেলে ধরবেন না। এই বিশ্বাস থেকেই কিন্তু মোদির বিজেপির তুলনায় অনেক বেশি আরএসএস আস্থাশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি। সেই কারণেই তারা সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে সব রকম ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে সাহায্য, সহযোগিতা করেছে। তারা চেয়েছে মমতা যাতে শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী তারা তাদের সমস্ত সমর্থন উজাড় করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি।
এটি হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের পর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের খুশি হওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য । কেন মোহন ভাগবত খুশি হন নি তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি না জেতাতে , আর কেন মোহন ভাগবত খুশি হয়েছেন তাদের স্বাভাবিক মিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়ী হওয়াতে, এই তাৎপর্যের ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে আছে আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তথা গোটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।