অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
মথুরাপুর (তপঃ) লোকসভা কেন্দ্রটি যে সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত সেগুলি হল— পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, রায়দিঘী, কুল্পি, মন্দিরবাজার ও মগরাহাট পশ্চিম। এই লোকসভা আসনটি সুন্দরবন ও উপকূল এলাকার অনেকখানি অংশ জুড়ে বিস্তৃত। যেমন-পাথরপ্রতিমা,কাকদ্বীপ,সাগর, রায়দিঘী, কুল্পি। আর মন্দিরবাজারের অধিকাংশ ও মগরাহাট পশ্চিমের পুরোটাই উপকূল দূরবর্তী। ভৌগোলিক অবস্থানে যেমন বৈচিত্র্য, তেমনই বৈচিত্র্য জনবিন্যাসে। এই লোকসভা এলাকায় বিচিত্র জনসমাজের বসবাস। এখানকার হিন্দু জনসমষ্টির মধ্যে আছে তপশিলী জাতি-উপজাতির বিভিন্ন অংশের মানুষের বাস। রয়েছে মুসলিম জনসমষ্টি। অর্থনৈতিক মানের বিচারে বিরাজমান বিরাট অসম বিকাশ। পেশাগত বিচারে রয়েছেন বড়ো সংখ্যায় কৃষিজীবি, মৎস্যজীবি, শিক্ষক-চাকুরিজীবী, আর রয়েছেন অসংগঠিত পেশার ভ্যানরিক্সা-আটো-টোটোচালক, মুটিয়া-মজদুর,ইট ভাটার শ্রমিক ইত্যাদি নানা ধরনের শ্রমজীবীরা। এই বিভিন্ন অংশের মানুষের দাবি, চাহিদা কোনও কিছুই গুরুত্ব পায়নি এতদিন সাংসদ থাকা চৌধুরী মোহন জাটুয়ার কাছে।
এখন অনেক মানুষকে বলতে শোনা যায়, তিনি নাকি ছিলেন অনেক উচ্চপদের মানুষ। তাঁর কাছে পৌঁছনোই ছিল সমস্যা। তিন-তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হয়ে প্রতিবারই তিনি যে দিল্লিমুখো হয়েছেন, আর এই দিকে আসেন নি। ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ফি বছরের অভিশাপ সুন্দরবনবাসীর। কিন্তু দুর্গত মানুষের কান্না তিনি শোনার চেষ্টা করেন নি। যখন প্রশ্ন উঠেছে, জাটুয়া সাহেবের দল পরিচালিত রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় সুন্দরবনের কংক্রিটের বাঁধের জন্য বরাদ্দকৃত সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ না হয়ে ফেরত গেছে। ওঁরা নিরুত্তর থেকেছেন। যখন দাবি উঠেছে কুল্পিতে বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব কার্যকর করার, তখন তৎকালীন জাহাজ মন্ত্রী নেত্রীর অঙ্গুলি হেলনে চোখ বন্ধ করে থেকেছেন। আজও সে দাবি কার্যকর হল না। ‘বিকশিত ভারত’-এর শ্লোগান দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরেও হল না। ওরা সব নাকি সোনার বাংলা গড়বে! তৃণমূল, বিজেপি সব দলের থেকেই কেবল সীমাহীন বঞ্চনা জুটেছে মথুরাপুরের মানুষের।
মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের আপামর মানুষের দাবি হিসেবে উঠে এসেছে মথুরাপুর থেকে রায়দিঘী পর্যন্ত এবং নামখানা থেকে ফ্রেজারগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কথা। এই দাবি কার্যকর হলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেমন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে বিপুল মাছের ভাণ্ডার কলকাতা সহ দেশ-বিদেশের বাজারে যোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এতে জেলার মৎস্যজীবিদের আর্থিক সুরাহা হবে এবং একইসঙ্গে রাজ্য ও দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই রেলপথ পর্যটন শিল্পেও অনুকূল প্রভাব ফেলবে। এখন প্রশ্ন হল এই নতুন কথা, নতুন দাবি সংসদে তুলে ধরবে কে বা কারা? তৃণমূল ও বিজেপির এক্ষেত্রে সদিচ্ছা কতটা মানুষ দেখেছেন। সুন্দরবনকে রক্ষার কার্যকর ভাবনা বামপন্থীদেরই আছে একথা মানুষ বুঝতে পারছেন। সেই কাজের অনুসারী সরকার কেন্দ্রে গড়ে তুলতে হবে একথাও মানুষ বুঝতে পারছেন। তাই মথুরাপুরের বামফ্রন্ট মনোনীত জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী ডাক্তার শরৎচন্দ্র হালদার বেশি বেশি মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ ডাক্তার হিসেবে তাঁর বিপুল সুনাম তাঁকে লড়াইয়ে এগিয়ে রেখেছে। ‘রেমাল’ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ত্রাণ শিবিরেও স্টেথো গলায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিপন্ন মানুষকে চিকিৎসা প্রদানের জন্য। তার গলায় ঝোলানো স্টেথোই যেন দলের প্রতীক আঁকা উত্তরীয়! দেশ ও রাজ্যের শাসকদলের চুরি-দুর্নীতি-প্রতারণা-মিথ্যাচারের রাজনীতির সঙ্গে সৎ ও নিষ্ঠাবান ডাক্তার তথা সৎ আদর্শের লড়াই ক্রমশ জমে উঠছে মথুরাপুরে।