April 2,2020
(১)
৩০শে জানুয়ারী, ২০২০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের বাইরের দেশেগুলির জন্য করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত চূড়ান্ত সতর্কবার্তা জারি করেছিল (Public Health Emergency of International Concern (PHEIC)) । তার মধ্যে অবশ্যই ছিল ভারতবর্ষও।
৩০ শে জানুয়ারী থেকে ২০ শে মার্চ, প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষন – প্রায় ২মাস পাওয়া গেছিল প্রস্তুতির জন্য। দেশের সরকার – রাজ্যের সরকার আচমকা এই বিপদে পড়েনি। ৩০শে জানুয়ারী আমাদের দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মেলে।
গোটা ফেব্রুয়ারী-মার্চ পেরিয়ে আজ ২রা এপ্রিল।
প্রশ্ন উঠবেই ২ মাস প্রস্তুতির জন্য সময় পেয়েছিলাম আমরা, কি করলাম?
৩০শে জানুয়ারী বিদেশ যোগে করোনা আক্রান্ত’র সন্ধান পাওয়ার পরেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিদেশ থেকে ফেরার পর বিনা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ঢুকতে দেওয়া হল কেন, বিশেষত ৩০শে জানুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা পাওয়ার পরেও? যা জানা যাচ্ছে এই সময়ে ২৬ লক্ষ মানুষ বিদেশ থেকে এদেশে এসেছেন। এই ২৬ লক্ষ মানুষের উপর নজরদারি সুবিধাজনক না কি ১৩৩ কোটি মানুষের কাজকর্ম লাটে তুলে গোটা দেশকে ঘরবন্দী করে রাখাটা সুবিধাজনক হচ্ছে? পৃথিবীর ধুলো-কাদা কার্পেট বিছিয়ে ঢাকা সুবিধাজনক, নাকি সবার পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়া সুবিধাজনক – বলুক দেশের সরকার।
এখন গরীব খেটে-খাওয়া সবর্হারার দল লকডাউন ঘোষণার পরে নিজের বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরতেই মাথা খারাপ দেশের সরকার ও কেষ্টবিষ্টুদের! ২ মাসেরও বেশি সময় দেওয়া হল বিত্তশালীদের ঘরে ফিরতে এবং জামাই আদরে সোজা ঘরে ঢুকে গেল তাই নয়, মল-কফি শপ-সিনেমাহল-ড্যান্সবার সর্বত্র অবাধ বিচরণ করে করোনা ছড়ানোর অবাধ লাইসেন্স দেওয়া হল এদের, ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে। আর দেশের সর্বহারাদের জন্য মোদিজি সময় দিলেন ৪ ঘন্টা মাত্র। ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় ভাষন আর রাতেই লকডাউন। এখন খেটে খাওয়া সর্বহারা লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকো, নয়তো কোথাও রাস্তার ধারে, ফ্লাইওভারের তলায় স্কুলঘরে ঠাসাঠাসি হয়ে বন্দী জীবন যাপন করো ন্যূনতম সুবিধাটুকুও না পেয়ে!
দেশ এক – নাম ভারতবর্ষ। কিন্তু বিত্তশালীদের জন্য এক নিয়ম, আর সর্বহারাদের জন্য আর এক।
আজ পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত মৃত মানষের সংখ্যা ৩৮ জন আর লকডাউনের কারণে মৃত্যু? না রাষ্ট্র এদের হিসাব রাখছে না।
লকডাউনে মানুষ যখন ঘরবন্দী,খাবে কি, বাঁচবে কিভাবে – এইসব জীবনমরণ প্রশ্নের মোকাবিলায় ব্যস্ত, সেই ফাঁকে মোদিজি বাড়িয়ে দিলেন পেট্রোল-ডিজেলের দাম! অথচ বিগত ২ দশকে আর্ন্তজাতিক বাজারে তেলের দাম এত কম কখনো হয় নি। কমিয়ে দিলেন স্বল্পসঞ্চয়ে সুদের হার! কেন? কোন যুক্তিতে? বিপর্যস্ত মানুষের উপর এই খাঁড়ার ঘা দিলেন কেন মোদিজি? ব্যাঙ্কে ৩ মাসের ইএম আই রদ করার অর্থ এইভাবে সাধারণ মানুষকে নিংড়ে ছিবড়ে করে তুলে নিতে হচ্ছে!! অথচ ১৩৮ জন বিলিওনিয়ারকে ছুঁয়েও দেখলেন না? ওদের ছাড় দিয়ে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের রক্তজল করে সঞ্চিত অর্থ লুঠ করার সিদ্ধান্ত কেন? বছরভর তো এদের উপর স্টীমরোলার চালান, এই দুঃসময়েও সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষগুলোকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না?
এইসব ধামাচাপা দিতে এখন সরকার আর অনুগত মিডিয়া নেমে পড়েছে নিজামুদ্দিন নিয়ে। এই কয়েকদিন অমিত শাহ -র টিকিও দেখা যায় নি। এখন আবার আসরে নেমে পড়েছেন, নিজামুদ্দিনের গন্ধ পেয়েই, যেমন শকুন ভাগাড়ে মরা গরু দেখলেই ভীড় জমায়।
১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে বিশ্ব মহামারী বা প্যানডেমিক ঘোষণা করে। তা সত্ত্বেও ১৩ই মার্চ ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানায় ‘ভারতে করোনা মেডিকেল এমারজেন্সি নয়’। কেন? ১৬ই মার্চ সব ধর্মীয় সংগঠনকে নোটিশ দেওয়া হয়। ২৪শে মার্চ দিল্লি পুলিশ নিজামুদ্দিন মার্কাজ চত্বর বন্ধের নোটিশ দেয়। শীতকাল তো চলে গেছে, তাও দিল্লি পুলিশের এই দীর্ঘ শীতঘুম কেন? একইভাবে ১৭-১৮ই মার্চ তিরুপতি মন্দিরেও ৪০০০০ হাজার মানুষের ধর্মীয় সমাবেশ হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির আইকন যোগী আদিত্যনাথ দলবল নিয়ে ২৫শে মার্চ ধর্মীয় অনুষ্ঠান সংগঠিত করেন। দেশের স্বরাষ্ট্র দপ্তর কি ঘুমোচ্ছিলেন? এখন নিজেদের ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য দায়ভার সংগঠকদের উপর চাপাচ্ছে? নিজামুদ্দিনের মার্কাজের বিরুদ্ধে FIR এত দেরীতে কেন? আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে FIR নয় কেন? একই অপরাধে অপরাধী তো তিনিও! তিরুপতির মেলা সংগঠকদের ছাড় কেন? এই দুঃসময়েও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছাড়তে পারছে না দেশের সরকার – এর চাইতে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে? এই ভাইরাস কিন্তু হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান শিখ বৌদ্ধ জৈন পার্সি নাস্তিক কাউকে ছাড়ে না – এটা জানেন না মোদিজি? খবরে প্রকাশ পাঞ্জাবের এক স্বঘোষিত বাবাজী জলন্ধরের কাছে নাওয়াশহর জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্ম প্রচার করে বেড়িয়েছেন বিদেশ থেকে ফিরেই। তিনি নিজেই ছিলেন করোনা আক্রান্ত এবং তিনি এই রোগে মারাও গেছেন। এখন এই বাবাজীর সন্তানদের কি হবে কে জানে! ভ্যাটিকান-মক্কা-পুরী সবাই তো বুঝছে এই বিশ্ব মহামারীর মোকাবিলা করতে পারে একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান। তাও দিল্লির বুকে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে গোমূত্র পার্টি হয় ১৬ই মার্চ পুলিশের নাকের ডগায় কি ভাবে? অমিত শাহ জি কি বলবেন?
এদিকে মানুষের কাছে খাবার নেই। অর্থ নেই। এরপর কোটি কোটি মরীয়া মানুষ খাবারের জন্য রাস্তায় নেমে আসবে। পুলিশ মিলিটারি বন্দুক দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে দেশের সরকার?
দেখেছেন আজ পশ্চিম বাংলার হাল? রেশন দোকানের সামনে শ’য়ে শ’য়ে লোক জড়ো হয়ে গেছে। কিসের ৩ ফুট দূরত্ব! খাবার তুলে না দিলে, দেশের গরীব মানুষ ঘরে ছিটকিনি তুলে বসে থাকবে না – এই সহজ সরল সত্যটা কি দেশের – রাজ্যের সরকার বোঝে না!
বারবার বলা হচ্ছে যে লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমান অবস্থায় আবশ্যকও বটে, তার সাফল্য নির্ভর করছে, কয়েকটা শর্ত সরকার পূরণ করতে পারছে কি না তার উপরে। খাদ্য, বেঁচে থাকার ন্যূনতম অর্থ দেশের ৮০ কোটির হাতে এখনই তুলে দিতে না পারলে দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে দ্রুত, যা সামাল দেওয়া হবে অসম্ভব।
(২)
রাজ্যে আজ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত সংখ্যা ৩৭। এই কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩জনের, ৬ জনের নাকি নয়। হঠাৎ ৬ কি করে ৩ হয়ে গেল? National Portal এখনো পশ্চিম বাংলায় করোনা সংক্রমণ জনিত কারণে মৃতের সংখ্যা তো ৬ দেখাচ্ছে। কোন যুক্তিতে সংখ্যা কমিয়ে দেখানো? কোনো পাগলেও কি বলেছে এই ভাইরাস আপনার সরকার এনেছে? তাহলে পরিসংখ্যান নিয়ে এই নয় ছয় কেন? মিডিয়াও দুপুর পর্যন্ত ৬ দেখাচ্ছিল হঠাৎ আপনার সাংবাদিক সম্মেলনের পরে ৩ দেখাতে শুরু করল। ওদের মালিকদের কাছে সামাজিক দায়বদ্ধতার চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিজ্ঞাপনের অর্থ পাওয়া। তাই এই ডিগবাজি। এই বিশ্ব মহামারীর সময়ে পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ এমন ছেলেখেলা করে!!ভাবুন মুখ্যমন্ত্রী এবং মিডিয়া মালিকরা।
এই কারণেই কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে।
১. মুখ্যমন্ত্রী ১০দিন আগেই ঘোষণা করেছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজকে কেবলমাত্র কোভিট১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত হাসপাতাল করা হবে। এর শয্যা সংখ্যা প্রায় ৩০০০। আজও তা করা গেল না কেন? শোনা যাচ্ছে শাসকদলের চিকিৎসক ও নার্স সংগঠনের রাজ্য নেতৃত্ব, যারা এই হাসপাতালেই কর্মরত, তাঁদের প্রবল আপত্তির জন্যই নাকি ঘোষণার ১০ দিন বাদেও এই কাজ করা যায় নি। মুখ্যমন্ত্রী রোজ নিয়ম করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, সাথে সব সময় অনুগত চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান সাংবাদিক থাকে – কিন্তু এই নিয়ে টুঁ শব্দটি করছেন না কেন? সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
২. সমগ্র দেশে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নির্ণায়ক পরীক্ষা হয়েছে প্রতি ১০ লক্ষে ৩১.৭ জনের। জাতীয় গড়ের নীচে অবস্থানকারী ১৪ টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিম বাংলার স্থান সর্বনিম্ন। প্রতি ১০লক্ষে মাত্র ৫.২ জনের এই পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ এই রাজ্যে প্রথম দিকে পরীক্ষা করবার কীটস-এর অভাব থাকলেও জানা যাচ্ছে এখন পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে – প্রায় ১৪০০০। তাহলে কেন পরীক্ষায় এত অনীহা? কেন এখনো জেলায় জেলায় পরীক্ষা কেন্দ্র তৈরী করা গেলনা? কি উত্তর দেবেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী? ডেঙ্গুর মতোই করোনা নিয়েও তথ্য গোপনের কাজ হচ্ছে কি? এই আগুন নিয়ে খেলবেন না, দোহাই আপনার।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে কম পরীক্ষার প্রশ্নটা জোরালো হয়েছে, গত ৩১ শে মার্চ হাওড়া হাসপাতালে মৃত্যুর পরে একজন রোগিনীর কোভিট ১৯ আক্রান্তের পরীক্ষার ফল জানার ঘটনা সামনে আসায়। এমন আরও অনেক মৃত্যু হচ্ছে কি না বোঝা যাবে কি ভাবে, যদি না রোগের প্রাথমিক লক্ষ্মণগুলো দেখা গেলেই সাথে সাথে তাঁর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা না হয়? এর ফলে সেই সব সম্ভাব্য রোগীদের আত্মীয় বন্ধু অথবা হাসপাতালের সহরোগী বা চিকিৎসায় নিযুক্ত সকলের মধ্যেই এই রোগ সংক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। হাসপাতালের সুপারের অনুমতি ছাড়া নাকি ডাক্তারবাবুরা কোভিট ১৯ পরীক্ষার সুপারিশ লিখতে পারছেন না। এ যদি সত্যি হয়, তাহলে তো ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’।সমগ্র রাজ্যবাসীকে এই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত করা থেকে বিরত করুন আপনি স্বাস্থ্য দপ্তরকে, যেটার দায়িত্বে আপনি স্বয়ং। অবিলম্বে সব জেলায় অন্তত ১টি পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলুন। পরীক্ষা পরীক্ষা পরীক্ষা – লকডাউনের সাথে এটাও তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা।সেটা মানছেন না কেন? অনেকদিন দাগ কেটে ছবি তুলে সময় কাটানো হয়েছে। এবার এটা করুন, না হলে কত বড় বারুদের স্তুপে রাজ্য বসে আছে, জানতেই পারা যাচ্ছে না। জেলাগুলোতে ভযানক অবস্থা। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ। মানুষ পাগলের মতো ঘুরছে, কিন্তু কোন রোগীর চিকিৎসা নেই। এই অচলাবস্থা ভাঙুন। না হলে করোনায় মৃত্যুর কয়েকগুণ মানুষের মৃত্যু হবে অন্যান্য রোগে।
৪. মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন আপনি আমাদের কনুই ভাঁজ করে হাঁচতে কাশতে শেখাচ্ছিলেন, তখনই বলেছিলেন আপনার সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে PPE, N95 মাস্ক সহ সব ধরনের উপকরণ মজুত আছে। তাহলে রেইনকোট দিলেন কেন? কেন বেলেঘাটা আই.ডি হাসপাতালে স্বাস্থ্য কর্মীরা আত্মসুরক্ষার উপকরণ না পেয়ে বিক্ষোভে নামলেন? কেন হাওড়া হাসপাতালের নার্সরা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখালেন? কোথায় গেল আপনার হিসাব দেওয়া হাজার হাজার মজুত PPE আর মাস্ক? আপনার সরকারের বরাদ্দের ২০০ কোটি টাকার কত অর্থ (ক) চিকিৎসক-স্বাস্থ্য-সাফাই কর্মীদের সুরক্ষা,(খ) কেবলমাত্র করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নিবেদিত হাসপাতালের জন্য খরচ হল আর (গ) কত বিজ্ঞাপনে খরচ হলো? ডাঃ ইন্দ্রনীল খানের মত আমার বাড়িতেও কি পুলিশ পাঠাবেন এই প্রশ্ন করার জন্য, নাকি স্বচ্ছ প্রশাসক হিসাবে আপনি তথ্যসম্বলিত উত্তর দেবেন?
৫. রেশন দোকানের সামনে মানুষের ভীড় সংক্রমণের আশঙ্কাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটাই যদি ২৫ শে মার্চ লকডাউন ঘোষণার পরের দিন থেকে শুরু করতেন, তাহলে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তো না এই ভীড়। বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা প্রথমদিন থেকেই বলে আসছেন খাবার নিশ্চিত করতে না পারলে লকডাউনে মানুষের ঘরে থাকাটা নিশ্চিত করা যাবে না। বলুন এই কথা সর্বদলীয় সভায় বলেন নি বিরোধীরা! বিরোধীরা তো আপনাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছে, সুপরামর্শ দিলে শুনুন। ভোট কুশলী ভোট প্রচারের রাস্তা দেখাতে পারেন, কিন্তু মানুষকে সাথে নিয়ে এই বিশ্ব মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাস্তা তো দেখাতে পারবেন না। কারণ তার কোম্পানির দায়বদ্ধতা কেবলমাত্র আপনার দলকে নির্বাচনে জেতানোর, রাজ্যের মানুষের প্রতি নয়। আর বাজারী সংবাদমাধ্যমকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, যেমন পয়সা, তেমন নাচ – এই তাদের কাজ। কিন্তু এই বিরাট যুদ্ধ কি সবাইকে জড়িয়ে না নিয়ে করা যাবে? ভাবুন আপনি দয়া করে। আপনার বিজ্ঞাপন পুষ্ট সংবাদমাধ্যম তো বলে আপনি নাকি যথেষ্ট সংবেদনশীল।
৬. রেশন নিয়ে নেমে পড়েছে আপনার দলের গুণধর ভাইয়েরা। বিডিও-পুলিশের একাংশও বলে দিচ্ছে শাসক দলের ছাপ্পা না থাকলে কিছু পাবেনা, কার্ড থাকলেও পাবে না, আর না থাকলেও পাবে না। অন্য কথা বললেই মার, যেমনটি হয়েছে গতকাল মুর্শিদাবাদ জেলায়। আপানার অনুগত টিভিও দেখিয়েছে।
আবার রেশন ডিলারদের কাছে ফতোয়া পাঠানো হচ্ছে, যা মাল আসবে ২৫% শাসকদলের মাতব্বরদের হাতে তুলে দিতে হবে। কারণ তারা আপনার ছবি সেঁটে ত্রাণ দেবে। এই দুঃসময়েও আপনার ভাইদের নিয়ন্ত্রণ করবেন না? সারাবছরই তো চেটেপুটে লুটে খায়। এই ৩/৪ মাস একটু ছাড় দিতে বলুন দয়া করে। যেমন ব্যাঙ্ক ৩ মাসের ই.এম.আই স্থগিত রেখেছে, তেমনই আপনার বাহিনী এই জিজিয়া কর স্থগিত রাখতে কি পারে না, এই ৩/৪ টে মাস মাত্র! ভোট কুশলীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন উনিও নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন, কারণ ইমেজ বিল্ডিং এক্সারসাইজের মধ্যেই তো এটা পড়ে। গোস্তাকি মাপ করবেন।
৭. আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই সময়ে নাকি অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন। খুব ভালো, যদিও আমার মাথায় ঢুকছে না, স্ব ইচ্ছায় সেবা করার বিনিময়ে অর্থপ্রদানের ব্যাপারটা। সে না হয় এই সময়ে কাজকম্ম কম, কি করবে সিন্ডিকেট পার্টি, তাই করোনার বাজারে ২/৪ পয়সা না হয় সরকারের তহবিল থেকে দিলেন। জনগণের থেকে করোনার আগে সোজা টাকা নিত এখন একটু বাঁকা পথে না হয় পাবে। মানে জনগণ আপনার রিলিফ তহবিলে অর্থ দেবে, সেখান থেকে কিছু খরচ হবে আপনার ছবি দিয়ে হোর্ডিং, ট্যাবলো এসবে, আর কিছুটা এরা পেল। এরপরেও যদি কিছু অর্থ বেঁচে থাকে তাহলে আর এক দফা রেইনকোটও না হয় চিকিৎসক – স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য কিনে দেওয়া যেতে পারে। সে হোক গিয়ে।
কিন্তু রাজ্যের অনেক রাজনৈতিক সামাজিক ক্লাব অসরকারী সংগঠন নিজেদের পকেটের পয়সাকে পুঁজি করেই নেমে পড়েছে মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য। এরা চাল-ডাল-ওষুধ এনেও দিচ্ছে আবার কিনেও দিচ্ছে। এরা রক্তদান করছে। আপনাকে নিশ্চয়ই ডি.আই.বি-র গোয়েন্দারা এই খবর দিয়েছে। খোঁজ নিন – এরা কিছু চায় না আপনার কাছ থেকে, শুধু সরকারের সহযোগিতা চায়। সেটা করলে আপনার ইমেজ বিল্ডিং এক্সারসাইজ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ বাজারী টিভি-কাগজ এদের কথা বলবে না। তাই অনুগ্রহ করে এদের কাজ আটকাতে মানা করুন আপনার ভাই আর তাদের বশংবদ পুলিশের যে সব আধিকারিকরা আছেন, তাদের।
৮. আপনার সরকারের অজানা নয় যে রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষ ভিন রাজ্যে কাজ-চিকিৎসা- পর্যটন ইত্যাদি কাজে গিয়ে আটকে পড়েছেন হঠাৎ জাতীয় লকডাউনের জন্য। অসহায় মানুষ প্রতিদিন ফোন করছেন। খাবার নেই-অর্থ নেই-থাকার জায়গা নেই। এদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এদের উদ্ধার করে ফেরত আনতে হবে, না হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসনের সাথে কথা বলে থাকা-খাওয়া-ওষুধের ব্যবস্থা করতেই হবে। প্রেস রিলিসের মতো চিঠি লিখে কাজ হচ্ছে না দেখছেন। অতিরিক্ত মূখ্য সচিব পর্যায়ের কোনও অফিসারকে দায়িত্ব দিয়ে একটা টীম করুন। এরা পঞ্চায়েত /পৌরসভা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সরাসরি অন্য রাজ্যের আধিকারিকদের সাথে কথা বলে এদের বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করুক। প্রয়োজনে আমাদের রাজ্যের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপনার সরকার ক্যাম্প চালাবার খরচ বহন করার প্রস্তাব দিক। আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই কাজ না করলে এদের লাশ এক এক করে রাজ্যে ঢুকবে।
৯. রাজ্যে বহু কারখানায় ঝাঁপ পড়েছে। শ্রমিক কর্মচারীরা মজুরি পাবেন কি না অনিশ্চয়তায়। মাসের ২ তারিখ। এদের মাইনে বা মজুরি দেওয়ার জন্য এখনো আপনার সরকারের শ্রম দপ্তর নির্দেশিকা জারি করছে না কেন? এতগুলো রাজ্যের সরকার এই নির্দেশিকা জারি করলেও আপনার সরকার এই প্রশ্নে নীরব কেন? বলুন কিছু – রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ, শ্রমিক – কর্মচারী ফাঁকা পকেটে তাকিয়ে আছে।
১০. আপনার সরকারের লকডাউন পদ্ধতিটাও খুব জটিল। রেশন দোকান সকাল থেকে বিকেল খোলা, অন্য দোকান সকাল ১০টা পর্যন্ত খোলা, ১২- ৪টে মিস্টির দোকান খোলা, ৪-৬টা আর এক দফা দোকান খুলতে পারে। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টা থেকে লকডাউন। কোভিট ১৯ এমন ঘড়ি ধরে চলে, এই তথ্য কোথায় পাওয়া গেল? সারাদিন ভীড় জমানোর সব রাস্তা খুলে রেখে সূর্য ডুবলে লকডাউনের রাস্তায় লাভ কি? করোনার সাথে না মানুষের সাথে এই ফাঁকিবাজির খেলা চলছে? কোন বারুদের স্তুপ তৈরী হচ্ছে – বুঝতে পারছেন না?
স্তাবক মিডিয়া দিয়ে আপনার জবরদস্ত প্রচার হতে পারে, কিন্তু ফাঁক ফোকরগুলো চিহ্নিত হবে না। তাই বিরুদ্ধের মত-পরামর্শগুলো একটু শুনুন ধৈর্য ধরে, সহিষ্ণুতার সাথে। এতে রাজ্যের মানুষের উপকারই হবে। তারা সুস্থ সবল থাকলে তো আপনি কৃতিত্ব পাবেন।
তাহলে করছেন কেন এমন!!
বোঝাই যাচ্ছে না মাইবাপ সরকার কি করতে চাইছে!!! সত্যি হচ্ছেটা কি দেশ-রাজ্য জুড়ে।