ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত
মাথা পিছু আয়ের ভিত্তিতে বাংলা ঠিক কোন সময় থেকে গোটা দেশের নিরিখে পিছিয়ে যায়?
অনেকেই দাবি করেন দেশের স্বাধীনতার সময়টাতে বাংলার মাথা পিছু আয় ঐ একই মাপকাঠিতে দেশের মাথা পিছু আয়ের চাইতে বেশি ছিল। ঠিক কতটা বেশি? ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিল বলে দাবী করা হয়। কিন্তু ৪৭ সাল কিংবা ৫০’র দশকের জন্য এধরনের কোনো নির্দিষ্ট রাজ্যওয়াড়ি আয়ের তথ্য, যা দিয়ে আজকের দিনের সাথে তুলনা চলে আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। এই বিষয়ে সবচাইতে ভরসা যোগ্য কিছু তথ্য পাওয়া যায় ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডেটা সেটে। সেখানে চলতি হিসাব ২০১১-১২কে ভিত্তীবর্ষ (বেস ইয়ার) ধরে ১৯৬০-৬১ থেকে ২০২০-২১ অবধি প্রতি বছরের স্থির মূল্যমান (কনস্ট্যান্ট প্রাইস), অর্থাৎ প্রকৃত মাথা পিছু আয়ের হিসাব পাওয়া যায়।
এই ডেটা সেট ব্যবহার করে যদি ২০১০-১১ বর্ষের স্থির মূল্যমান (কনস্ট্যান্ট প্রাইস) ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মাথা পিছু শুদ্ধ সম্মিলিত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (নেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) – কে দেশের মাথা পিছু শুদ্ধ আয় (নেট ন্যাশনাল ইনকাম) এর শতাংশের হিসাবে কষা যায় তবে তবে আমরা যা পাই সেগুলি নিচের চিত্রে ধরা পড়েছেঃ
বিভিন্ন বছরের শতাংশের হিসাব এমনঃ
৬০-৬১: ৯৪%, ৭০-৭১: ৭৯%, ৮০-৮১: ৮১%, ৯০-৯১: ৭২%, ২০০০-০১: ৮১%, ২০১০-১১: ৮২% এবং ২০১৯-২০: ৭৬%
এর মানে কি দাঁড়াল? ১৯৬০-৬১ সালেই আমাদের রাজ্যে মাথা কিছু প্রকৃত আয় গোটা দেশের মাপাকঠিতে পিছিয়ে পড়েছিল। যদি ধরেও নিই যে ১৯৪৭ সালে দেশের তুলনায় আমাদের রাজ্যের মাথা পিছু প্রকৃত আয় দেড় কিংবা ১.২৫ গুন বেশি ছিল তার অর্থ হবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবনমনে কংগ্রেস এবং বিধান রায়ের সরকারের ভূমিকাই আমাদের মাথা নিচু হওয়ার প্রধান কারণ। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে এমন হারে অবনমন পশ্চিমবঙ্গে অন্য কোনো সময়েই হয় নি তার মানে! এমনকি ঐ পর্বেই গোটা দেশের অন্য কোনো রাজ্যেই অবনমনের এমন হার নেই।
৬০এর দশকও সেই একই অবনমন তুলে ধরে। ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৭০-৭১ এর মধ্যে মাথা পিছু প্রকৃত আয় দেশের মাথা পিছু প্রকৃত আয়ের ৯৪% থেকে নামতে নামতে ৮০% এরও নিচে চলে গেছে। এই ক্রমশ অবনমনের ছবি উপরের চিত্রে স্পষ্ট। ৪৭-৭০ এই সময়কে একটি পর্ব হিসাবে বিচার করলে দেখা যাচ্ছে গোটা দেশের আর কোথাও এমন ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবনমন হয় নি। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে একমাত্র লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার মুষ্টিমেয় কিছু দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে অন্ধকারময় যুগের সাথেই এমন অবস্থার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি পশ্চিমবঙ্গ কোনো আলাদা দেশ হত তবে এই পর্বের অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলায় বহু বছর ধরে বহু হাজার কোটি টাকার বহুবিধ দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে থাকাই স্বাভাবিক হত। বাংলাদেশের জন্মের পর সেই দেশের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছিল। দিল্লীর বদান্যতায় পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু তার ৪৭-৭০’এর মারাত্মক সংকটের সময়ে এতটুকুও সুবিধা পায় নি, পরিকাঠামোর উন্নয়নে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোন দিক থেকেই বিশেষ কোনরকম আর্থিক সাহায্য মেলেনি।
উপরে ব্যবহৃত চিত্রটি থেকে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কুখ্যাত হত্তয়া সত্বেও ৭০ এর দশকেই প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ তুলনামূলক অর্থনৈতিক অবনমন কাটিয়ে সামান্য হলেও মাথা তুলতে পারে। অবশ্য ঐ একই সময়ে দেশের অন্য সকল জায়গায় উন্নয়ন রুদ্ধ হওয়াও এমন অবস্থার পিছনে একটি অন্যতম কারণ। এর পরের দশকে (৮০ র) দশকে সারা দেশে উন্নয়ণের জোয়ার এলো। তখনও আমাদের রাজ্যের মাথা পিছু প্রকৃত আয় দেশীয় গড়ের চাইতে কিছুটা কমই ছিল আপেক্ষিক নিম্নগামী অবস্থা চলতে থাকে, যদিও পশ্চিমবঙ্গে তখন আর্থিক বৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়েছে – আমরা এগলেও অন্যরা বেশি গতিতে এগিয়েছে।
১৯৯০-২০১০ সময়কালে কিন্তু বেশিরভাগ লোকজন যেমনটা ভাবেন আসল ঘটনা তার বিপরীত। মাথা পিছু প্রকৃত আয়ের নিরিখে সারা দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম ১৯৯০-২০১০ এই পর্বেই। কভিড মহামারী শুরু হওয়ার অনেক আগেই আমাদের সেই এগিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেই এমনটা ঘটেছে, এই লেখায় ব্যবহৃত লেখচিত্রেই তা স্পষ্ট।
সুতরাং ৪৭ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সংকটের ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠতায় স্বীকার করে সেই প্রসঙ্গে যদি কাউকে দায়ী করতেই হয় তবে দেশভাগ থেকে সেই আলোচনা শুরু করতে হবে। সেখান থেকে বিধান রায়, জহরলাল নেহরু এবং প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ… – পণ্ডিত নেহরুর অর্থনৈতিক মডেলের প্রতিটি ব্যবহারিক তথা বৌদ্ধিক কর্ণধার অবধি সেই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই অর্থনৈতিক মডেলই সমৃদ্ধির প্রসঙ্গে ১৯৪৭-এ সামনের সারিতে থাকা আমাদের রাজ্যকে পরবর্তী অন্তত আড়াই দশকের জন্য অবনমনের খাদে ঠেলে দিয়েছিল।
ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের ইকোনমিক রিসার্চ ইউনিটে অধ্যাপক। তিনি ইন্সটিটিউট অফ লেবর ইকনমিকস (আই জেড এ), বন’র রিসার্চ ফেলো।