ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
নোয়াম চমস্কি সতর্ক করেছেন যে জলবায়ু সংকট, পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের কারণে বিশ্ব মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহুর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘নিউ স্টেটসম্যানের’ সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে, ৯১ বছর বয়সী মার্কিন ভাষাবিদ ও সমাজকর্মী বলেছেন যে বর্তমানের বিপদ ১৯৩০ এর দশকের চেয়েও বেশি ।
চমস্কি বলেছেন, “মানব ইতিহাসে এর আগে এমন পরিস্থিতি হয়নি”। “আমি যথেষ্ট বয়স্ক তাই মনে করতে পারি, খুব স্পষ্টতই, নাৎসিবাদ ইউরেশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলকে দখলে নেওয়ার যে হুমকি ছিল তা কোন অহেতুক উদ্বেগ নয়। মার্কিন সামরিক পরিকল্পনাকারীরা ধারণা করেছিলেন যে যুদ্ধটা মার্কিন আধিপত্যের অঞ্চল এবং জার্মান আধিপত্যের অঞ্চল এ বাঁটায়ারার মাধ্যমে শেষ হবে। তবে এটা,যথেষ্ট ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি হলেও, বর্তমানে যেমন পৃথিবীতে সংগঠিত মানব জীবনের সমাপ্তির মতো অবস্থা ছিল না ।
ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স এবং প্রাক্তন গ্রীক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারোফাকিস প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন সংস্থা ‘প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালের’ প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের (১৮-২০ সেপ্টেম্বর) আগে চমস্কির এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।এই আন্দোলনের স্লোগান “আন্তর্জাতিকতাবাদ বা বিলুপ্তি” এর প্রতিধ্বনিতে চমস্কি সতর্ক করেছেন: “আমরা একাধিক খুব মারাত্মক সংকটের অবাক করা মেলবন্ধনের মধ্যে এখন আছি।
বিপদের ব্যাপ্তিটা বিখ্যাত ‘ডুমসডে ক্লকে’র শেষ সেটিং দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে।এটি পরমাণু বোমা হামলার পর থেকে প্রতি বছর ঠিক করা হয় যেখানে মিনিটের কাঁটাটা আগুপিছু করেছে। তবে গত জানুয়ারিতে তারা মিনিট পরিত্যাগ করে সেকেন্ড থেকে মধ্যরাতে চলে যায়, যার অর্থ সমাপ্তি এবং এটি মহামারীর বিস্তারের আগের ঘটনা।”
চমস্কি বলেছিলেন, এই পরিবর্তনটা “পারমাণবিক যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান হুমকির প্রতিফলন, এটি সম্ভবত ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার চেয়ে আরও মারাত্মক। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান হুমকি, এবং তৃতীয় যে বিপদটার কথা অনেকেই গত কয়েক বছর ধরে তুলছিল তা হল গণতন্ত্রের তীব্র অবনতি।শুরু অতটা জরুরি মনে না হলেও বাস্তবে প্রথমদুটো বিপর্যয়কে সামলাতে এবং মানবজাতির এই অস্তিত্বের সঙ্কটকে আটকাতে ভীষণভাবে প্রয়োজন সচেতন ও জাগরূক জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে শক্তিশালী একটা প্রানবন্ত গণতন্ত্র।
চমস্কি যোগ করেছেন যে “[ডোনাল্ড] ট্রাম্প বেশ চিত্তাকর্ষক কিছু অর্জন করেছেন: তিনি তিনটি বিপদের প্রত্যেকটির হুমকি বাড়াতে সফল হয়েছেন।ট্রাম্প পরমাণু অস্ত্র সংবরণের থেকে বেড়িয়ে এসে বাস্তবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলেছেন। এরফলে শেষ বিপর্যয়ের থেকে রক্ষা পাওয়ার যে সামান্য রক্ষাকবচ ছিল তা আজ বিপন্ন।তিনি নতুন, বিপজ্জনক, আরও মারাত্মক অস্ত্রের বিকাশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছেন, যার অর্থ অন্যরাও তাই করছে, যা আমাদের সকলের জন্য বিপদ বাড়িয়ে তুলছে।
“পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনায়, তিনি জীবাশ্ম জ্বালানীর সর্বাধিক ব্যবহার এবং নিয়মিত বিধি-নিষেধের অবসান ঘটাতে তাঁর প্রচেষ্টা আরও বাড়িয়েছেন,এই বিধি নিষেধগুলো আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয়ের থেকে আমাদের কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারত।”
“গণতন্ত্রের অবনতির দিকে বলতে গেলে , এটি একটি মারাত্মক রসিকতায় পরিণত হয়েছে।(মার্কিন)সরকারের নির্বাহী দিকটি থেকে যে কোন ধরণের বিরোধী কন্ঠস্বর মুছে ফেলা হয়েছে, এটি এখন একদল স্তাবকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।”
চমস্কি ট্রাম্পকে ব্রাজিল, ভারত, ইউনাইটেড কিংগডম, মিশর, ইস্রায়েল এবং হাঙ্গেরি সমন্বিত একটি নতুন “প্রতিক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক” এর মাথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।”পশ্চিম গোলার্ধে শীর্ষস্থানীয় প্রার্থী হলেন [জাইর] বলসোনারোর ব্রাজিল, বলসোনারোকে ট্রাম্পের একটা ছোটখাটো ক্লোন বলা চলে। মধ্য প্রাচ্যে এটি পারিবারিক স্বৈরশাসনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে, যা বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গণ্য হয়। [আবদেল আল-] সিসির মিশর সেদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম একনায়কতন্ত্র।ইস্রায়েল এতোটাই দক্ষিণপন্থার চরমে চলে গেছে যে একে দেখতে এখন টেলিস্কোপ প্রয়োজন ! এটা বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে তরুণরা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল।”
তিনি আরও যোগ করেছেন: “[নরেন্দ্র] মোদী ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে, মুসলিম জনগণকে মারাত্মকভাবে দমন করছে, কাশ্মীরে ভয়াবহ ভারতীয় দমনকে প্রসারিত করেছে।ইউরোপে শীর্ষস্থানীয় প্রার্থী হলেন হাঙ্গেরির [ভিক্টর] অর্বন, তিনি একটা প্রোটো-ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরি করছেন।ইতালিতে (মাত্তেও)সালভিনির মত লোকও এই তালিকায় আছেন যিনি ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের ডুবতে দেখে উৎফুল্ল হন।”
ইউনাইটেড কিংগডম প্রসঙ্গে তিনি বলেন -“বরিস জনসন লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে (নাইজেল)ফারাজ তার যোগ্যতম বিকল্প প্রার্থী হিসাবে উঠে আসবেন।”তিনি আরও যোগ করেছেন যে ইউকে-এর সরকারের “আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার” হুমকি “একটি বিবর্ণ ব্রিটেনকে যা ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুচর তাকে মার্কিনদের সামন্তরাজ্যে পরিণত করবে”।
চমস্কি প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালের বর্ণনা দিয়েছেন, যার কাউন্সিলে প্রাক্তন ছায়া চ্যান্সেলার জন ম্যাকডোনেল, উপন্যাসিক অরুন্ধতী রায় এবং ইকুয়েডরের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, “ন্যায়বিচার, শান্তি, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, পরিবর্তিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থার প্রতি জনগণের জোট সংস্থা হিসাবে যাতে অল্প কিছু লোকের ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয় বরং সাধারণ জনগণের চাহিদা ও উদ্বেগের জন্য তৎপর হওয়া সম্ভব হয়।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২ টি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়ে চমস্কি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বিডেনের কাছে পরাজিত হলে ট্রাম্পের পদ ছাড়তে অস্বীকার করার হুমকি নজিরবিহীন।
“তিনি ইতিমধ্যে বারবার ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচনের ফলাফল তার মনোমত না হলে তিনি ছাড়বেন না।এই বক্তব্য দুজন উচ্চ-স্তরের সামরিক কর্মকর্তা, প্রাক্তন-সামরিক নেতারা খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন, তারা জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যানকে পত্রমারফত এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন ।যদি রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়তে অস্বীকার করেন এবং তার চারপাশে আধা-সামরিক বাহিনী জড়ো করেন যা তিনি পোর্টল্যান্ডের লোকদের আতঙ্কিত করতে ব্যবহার করছেন তাহলে যেন তার( জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান ) সাংবিধানিক দায়িত্ব পর্যালোচনা করা থেকে তিনি বিরত না হন।”
“সেই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর একটি দায়িত্ব, ৮২ তম এয়ারবর্ন বিভাগ, তাকে জোর করে অপসারণ করা। একটি রূপান্তর অখণ্ডতা প্রকল্প রয়েছে, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটস থেকে উচ্চপদস্থ লোকেরা সেখানে যুক্ত; ট্রাম্প অফিস ছাড়তে অস্বীকার করলে কী হবে তা জিজ্ঞাসা করে তারা যুদ্ধের খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন । এবং ট্রাম্পের বিজয় ছাড়া অন্য যেকোন পরিস্থিতিই আসলে গৃহযুদ্ধের দিকে আমেরিকাকে চালিত করবে এই উপসংহারে তারা পৌঁছেছেন। এটি কোনও রসিকতা নয় – সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব।”
“বরিস জনসন যখন সংসদ ভেঙে দিযেছিলেন তখন সেটাও খুব খারাপ একটা উদাহরণ তৈরি করেছিল।সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছিল তবে অনেক দেরি হয়েছিল।(মার্কিন) সুপ্রিম কোর্ট এখানে হস্তক্ষেপ করছে না,ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে ডানপন্থীদের নিয়োগের পরেও করেনি তাই আমরা এমন এক মুহুর্তে এসেছি যা কখনও ঘটেনি।”
“বামেদের তাই করা উচিত যা তাদের সবক্ষেত্রেই করা উচিত, বাস্তবের রাজনীতিকে মান্যতা দিয়ে যেকোন রূপে নিরন্তর সক্রিয় থাকা প্রয়োজন। প্রতি কয়েক বছর অন্তর নির্বাচন হয়, আপনি কার বিপক্ষে ভোট দেবেন তা সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মিনিট সময় নেওয়া উচিত, কারও পক্ষে ভোট দেওয়ার থেকেও এটা জরুরি।ইংল্যান্ডে আমি কর্বিনকে ভোট দিতাম, তবে বেশিরভাগ সময় প্রশ্নটি হয় ‘আপনি কার বিপক্ষে ভোট দিচ্ছেন?’ “
এবারে সেই প্রশ্নের জবাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট:ট্রাম্প রিপাবলিকানরা ঠিক এতটাই ভয়ানক, বৃত্তের থেকে দূরে, যাতে তাদের ভোট দেওয়ার বিষয়ে কোনও প্রশ্নই আসে না।সুতরাং আপনি কয়েক মিনিট সময় নিন, ভোটকেন্দ্রে যান, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দিন, দ্বি-দলীয় পদ্ধতিতে যার অর্থ আপনাকে অন্য প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে হবে।তবে পরবর্তী কাজটি হল তাদের চ্যালেঞ্জ জানানো, প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলোর দিকে চালিত করার জন্য চাপ রাখা।”