Two Atrocities

The Tell Of Two Atrocities: A Report

সৌম্যজিৎ রজক

মনসামঙ্গলের পালা হয় প্রত্যেক বছর। পাড়ার ছেলেরাই করে। সারা পাড়া— ছেলে, বুড়ো, মহিলারা ভিড় করে দেখে সারারাত। প্রত্যেক বছর এই একদিন পাড়ায় উৎসব। প্রতিবার এই এক পালা, একই গল্প, একই স্ক্রিপ্ট, একই অ্যাক্টর। দর্শকদেরও সব ডায়লগ, গানগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে। তবুও বিরক্তি নেই, এই একদিন সকলেরই সে কী উত্তেজনা। উৎসবে মেতে ওঠে পাড়াটা রীতিমতো।

প্রায় প্রত্যেক বছরই ভোট আসে। লোকসভা, বিধানসভা, গ্রামসভা, পৌরসভার। প্রত্যেক বছর ভোটের আগে এই এক পালা, একই গল্প, একই স্ক্রিপ্ট, একই অভিনেতা-নেত্রী। এই নেতা এই দল ছাড়ে, ওই দলে যায়। ওই নেতা ওই দল ছেড়ে কোন্ দলে যাবে, টিভির চ্যানেলে সারাদিন সে কী জল্পনা! রাজ্যের সমস্ত লোক জানে, ব্যাটা চোর, এখন বাঁচতে দল বদল করছে। দল বদল করছে দুই হাতে আরও মাল লোটার লালসায়। সকলেই জানে, পোষাক পালটালেও চোর চোরই থাকে। পাবলিকের ভোটে জিতে এরা সব আখের গোছাবে নিজের। তবু নাকি এগুলোই ইস্যু! এসব ইস্যুর পেছনেই নাকি দৌড়তে হবে সাধারণ মানুষগুলোকে!

যে মানুষ কাজের খোঁজে ফ্যাফ্যা করে ঘুরে মরছে পথে পথে। যে মানুষ মরণাপণ্ণ বাপের ওষুধ কেনার চিন্তায় নাজেহাল, বাচ্চার দুধের বোতল কেনার। সরকারি ইস্কুলে তালা ঝুলে যাচ্ছে বলে যে মানুষের সন্তান লেখাপড়ার সুযোগ হারাচ্ছে। চাষের খরচ বাড়ছে আর ফসলের নায্য দাম মিলছে না বলে যে মানুষ রাতে ঘুমোতে পারে না। ফলিডল কিনে আনার কথা ভাবে। যে মানুষ দিনে দশ বারো ঘন্টা খাটতে বাধ্য হয় ঠিকাদারের অধীনে, তবু মাস শেষে দশ বারো হাজারও জোটে না। ডিজেল, পেট্রল, বিদ্যুত, সবজির দামে নাভিশ্বাস উঠছে যাদের। কেরোসিন তেলে, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি উঠে গেছে। এমনকি প্রাপ্য রেশনও মেলে না। রেগায় মাটি কেটেও মজুরি পায়নি যারা, ভিন রাজ্যে চলে গেছে যাদের ঘরের লোক রোজগারের আশায়। তিন পুরুষের দলিল দস্তাবেজ খুঁজে হয়রান, যে মানুষ বেনাগরিক হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে। দাঙ্গার, উচ্ছেদের ভয় তাড়া করে মারছে যাদের। ফি বছর বন্যায় যে মানুষের ভিটে ডুবে যায়, চালা উড়ে যায় সাইক্লোনে। রাতেই কেবল নয়, দিনের বেলাও যে নারীরা নির্ভয়ে বেরোতে পারে না রাস্তায়। যে মানুষ হতাশায়, অবসাদে, দুশ্চিন্তা আর অপমানে বাঁচে মড়ার মতন, তাদের নিজস্ব কোনো ইস্যু নেই? দাবি নেই? রাজনীতির চর্চায় জায়গা হবে না এসব এজেন্ডার?

ইস্যু সেট করে দেবে শাসক শ্রেণিই। তাদের রাজনৈতিক দলগুলো, সেসব দলের মুখপাত্ররা। তাদেরই মিডিয়া, তাদেরই আইটি সেল। ইস্যু হবে মন্দির, ইস্যু হবে মসজিদ, অনুপ্রবেশ, ইস্যু হবে চোরেদের শিবির বদল। অমুক নেতার সাথে তমুক নেতার খিস্তিখেউড়। চাপা পড়ে যাবে মানুষের রুটি, রুজি, অধিকার, ইজ্জতের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলো। রাজনৈতিক গণআলোচনার পরিসরে মূল এই ইস্যুগুলো উঠে এলে ফ্যাসাদে পড়তে হবে যুগপৎ কেন্দ্রেরও, রাজ্যেরও শাসকদলকে।

মসনদে বসে যারা মানুষের পেটে লাথ, পিঠে ছোরা মেরেছে এতদিন, তাদের বাঁচাতে হলে ভুল ইস্যু চাই। ভুল ইস্যুগুলোকে সেন্টার স্টেজে এনে ফেলতে পারলেই এই দুই দলের বায়নারি বানানো সম্ভব, সহজ হিসেব।  একই ঝাড়ের দুটো বাঁশ; হয় এটা নয় ওটা বেছে নিতে বাধ্য করতে হবে জনগনকে। তারই জন্যে এত আয়োজন। বিপুল অর্থশক্তি এবং কৌশলে সেই এক ঘিষাপিটা যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করছে মিডিয়া‌। আরএসএস ও আইপ্যাক যৌথ নির্দেশনায়।

বানানো বাইনারি ভাঙতে এই ভুল ইস্যুগুলোর পর্দা সরিয়ে মূল ইস্যুগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রে তুলে এনেছেন বাম গণআন্দোলনের কর্মীরা। বহুদিন যাবৎ অক্লান্ত পরিশ্রমে। শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, মহিলা, দলিত, বস্তিবাসী মানুষের স্বার্থে রোজদিনের লড়াইতে। তারুণ্যের ইনসাফ যাত্রা থেকে ব্রিগেডের জনসমাবেশে। সন্দেশখালির লড়াইতে, জেলায় জেলায় আইন অমান্যতে মূল ইস্যুগুলো চলে আসছিল গণআলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ভেঙে পড়ছিল বিজেপি-তৃণমূল বায়নারি। স্বাভাবিক কারণেই কাঁপন ধরেছে বুকে শাসক শ্রেণির।

বিগত কয়েকদিন, তাই, সমস্ত শক্তি দিয়ে ওরা ফের সেই পুরনো সিরিয়াল চালু করেছে চ্যানেলে। সংবাদপত্র থেকে হোয়াটসঅ্যাপে, পাড়ার আড্ডায়। সেই এক স্ক্রিপ্ট। সেই এক পুরনো ধান্দা।

অবশ্য এবার খেলা অতটা সহজ নয়। বারবার এক স্ক্রিপ্টে পাড়ার বিনোদনের আসর জমতে পারে, রাজনীতির লড়াই জেতা যে যাবে না, সেই কথা জেনে রাখুন ওনারা। এ রাজ্যের গ্রাম গ্রামান্তর শহর শহরতলিতে মানুষকে সাথে নিয়ে সজাগ আমরা, বাম আন্দোলনের কর্মীরা।

যত খুশি ভুলভাল ইস্যু ওরা ছুঁড়ে দিক, মূল ইস্যুগুলোতেই ডেঁটে থাকতে আমরা বদ্ধপরিকর। কিছুতে নড়ব না, জনতাকেও বিভ্রান্তির ফাঁদে পড়তে দেব না।

অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জেনেছি, টার্গেটে অবিচল থাকা বিজয়ের প্রধান শর্ত।

Spread the word

Leave a Reply