শমীক লাহিড়ী
আদানি সংক্রান্ত রিপোর্ট
২৪শে জানুয়ারি, ২০২৩ হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট তৈরি করার জন্য তারা ২বছর ধরে অনুসন্ধান চালায়। ১০০ পাতারও বেশি এই অনুসন্ধান রিপোর্টে তারা কতগুলি গুরুতর সাংঘাতিক প্রতারণার অভিযোগ তোলে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর বিরুদ্ধে। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের তদন্তে উঠে আসা মূল অভিযোগগুলি নিম্নরুপ –
১. ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা) সম্পদের মালিক গৌতম আদানি সাংঘাতিকভাবে শেয়ার বাজারে দুর্নীতি করেছেন। প্রতারণা, অন্যায় ও বেআইনি কৌশল গ্রহণ সহ নানাবিধ অপরাধের মাধ্যমে বিগত ১ দশক ধরে এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।
২. এই ১২০ (মতান্তরে ১৪০) বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে বিগত মাত্র ৩ বছরে। আর এই সম্পদ বৃদ্ধি মূলত ঘটেছে আদানির বিভিন্ন কোম্পানিগুলির অস্বাভাবিক হারে শেয়ারদর বা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। এদের ৭টি স্টক এক্সচেঞ্জ ভুক্ত মূল কোম্পানির শেয়ারগুলির বাৎসরিক বৃদ্ধির গড় ছিল ৮১৯%।
৩. আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিগুলির শীর্ষে বসে থাকা প্রায় সবাই গৌতম আদানির পরিবারেরই সদস্য। অর্থাৎ এক কথায় এটি মূলত পারিবারিক ব্যবসা।
৪. এর আগে ৪টি সরকারি তদন্তে এদের জালিয়াতির কথা প্রকাশ্যে এসেছিল। মোট জালিয়াতির পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা)।
৫. বিভিন্ন ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানি (Shell Company) তৈরী ক’রে মরিশাস, সংযুক্ত আমিরশাহী ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের নানা দেশের মাধ্যমে বেআইনী লেনদেন এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজেদের শেয়ার মূল্যকে দেখানোর কাজ করেছে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ।
৬. গৌতম আদানির ভাই রাজেশ আদানি ২০০৪-২০০৫ সালে হীরা ব্যবসার ক্ষেত্রে এই ধরণের ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানীর মাধ্যমে লেনদেন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। Directorate of Revenue Intelligence তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং রাজেশ আদানি ২বার গ্রেফতারও হন, কর ফাঁকি ও প্রতারণার অভিযোগে। একইভাবে গৌতম আদানির শ্যালক সমীর ভোরাও Directorate of Revenue Intelligence দ্বারা অভিযুক্ত হন ঐ একই মামলায়।
৭. গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি একটি অত্যন্ত রহস্যময় চরিত্র। এর মূল কাজ বিদেশে বিভিন্ন ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির মাধ্যমে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের মূল কোম্পানিগুলিতে বেআইনী টাকার লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার মূল্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে দেখানো। শুধুমাত্র মরিশাসেই বিনোদ আদানি এবং এর ঘনিষ্ঠদের এরকম ৩৮টি ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির হদিশ পাওয়া গেছে। এছাড়াও সাইপ্রাস, সংযুক্ত আমিরশাহী, সিঙ্গাপুর ও বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এই রকম আরও অনেক ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি চালায় বিনোদ আদানি এবং তার ঘনিষ্ঠরা। এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির কর্মচারী, ঠিকানা ইত্যাদি অদ্ভুতভাবে হয় একইরকম, নয় অনুল্লেখিত। উদাহারণ স্বরুপ এই কোম্পানিগুলির ১৩টা ওয়েবসাইট সন্দেহজনক ভাবে একই দিনে তৈরি করা হয়েছে এবং কোম্পানিগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য অত্যন্ত ভাসাভাসা অথবা অনুপস্থিত।
৮. ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ ভারতের তথ্য সংক্রান্ত আইনে সেবি’র কাছ থেকে জানতে পারে যে এই বিদেশী কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সম্পর্কে তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এই নিয়ে বিগত দেড় বছর ধরে নানা প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও সেবি নিজে থেকে কোনও তদন্ত শুরু করেনি।
৯. ‘ইলারা ক্যাপিটাল’ নামক একটি শেয়ার বাজারে বিলিয়োগকারী কোম্পানি প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে আদানি’র নানা কোম্পানিতে। এদের কার্যকলাপ অত্যন্ত সন্দেহজনক। (অভিযোগ, এই কোম্পানির মাধ্যমে টাকা আনার বিনিময়ে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পুত্র এই সস্থার উচ্চ পদে আসীন হন। বরিস জনসনও এই কারণেই ভারতে এসেই আদানি’র সদর দপ্তরে সভা করতে আমেদাবাদে যান – লেখক।)
১০. বর্তমানে জেলবন্দী শেয়ার বাজারের কুখ্যাত জালিয়াত ও প্রতারক কেতন পারেখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির গোপন ই-মেল পত্রালাপ ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ধর্মেশ দোশী নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির সাথে ‘ইলারা ক্যাপিটাল’ কোম্পানির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা এই ই-মেলগুলি থেকে প্রমাণিত হয়। ধর্মেশ দোশী বর্তমানে গ্রেপ্তারী এড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন।
১১. ‘মন্টেরোসা’ নামক আর একটি বিনিয়োগকারী সংস্থা, আদানি গ্রুপের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির ৩৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার নিজেদের দখলে রেখেছে। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও এমন ৩টি কোম্পানির ডাইরেক্টর, যেগুলির মালিক বর্তমানে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত একজন হীরা ব্যবসায়ী। ইনি বর্তমানে ৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানির মেয়ের সাথে আবার এই পলাতক জালিয়াত হীরা ব্যবসায়ীর ছেলের বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
১২. ‘নিউ লিয়াইনা’ নামক একটি সাইপ্রাসস্থিত ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি ‘আদানি গ্রীন এনার্জি কোম্পানি’তে ৪২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে ২০২১ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। ‘নিউ লিয়াইনা’ মূলত আদানির শেয়ার মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর জন্যই তৈরি করা এবং এটা পরিচালনা করে ‘এমিকর্প’ নামে একটি পরিষেবা দেওয়ার কোম্পানি। ‘এমিকর্প’ অন্তত ৭টি আদানি গ্রুপের কোম্পানি এবং ১৭টি বিদেশী ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির স্রষ্টা, যেগুলির সাথে মূলত বিনোদ আদানি যুক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘এমিকর্প’ আর্ন্তজাতিক প্রতারণায় অভিযুক্ত এবং মালেশিয়ার কর দাতাদের ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।
১৩. ২০০৭ সালে ‘সেবী’ তাদের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল – আদানি গ্রুপের প্রোমোটাররা কুখ্যাত জালিয়াত কেতন পারেখকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে, এটা প্রমাণিত। এই রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ১৪টি আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, কেতন পারেখ নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে শেয়ার লেনদেনের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল।
১৪. আদানির বিভিন্ন সংস্থা নানা রকম গোপন বেআইনী লেনদেন চালিয়েছে নানা ছদ্ম-বেনামী কোম্পানীগুলির সাথে। যেমন বিনোদ আদানি নিয়ন্ত্রিত মরিশাসস্থিত একটি কোম্পানির সাথে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকার লেনদেন করেছে, কিন্তু তার কোনও উল্লেখ কোথাও নেই। এছাড়াও আরও ৯৮৪ কোটি টাকার একটি লেনদেনেরও কোনও উল্লেখ নেই। একইভাবে বিনোদ নিয়ন্ত্রিত সংযুক্ত আমিরশাহীস্থিত একটি সংস্থার মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎ কোম্পানিতে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগেরও কোনও উল্লেখ নেই।
১৫. আদানির বিভিন্ন সংস্থার অডিট করে ‘শাহ ধান্ধারিয়া’ নামক একটি অডিট কোম্পানি। এই কোম্পানির বর্তমানে কোনও ওয়েবসাইট নেই। পুরানো ওয়েবসাইট আর্কাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে এই কোম্পানির ৪জন অংশীদার ও মাত্র ১১জন কর্মচারী ছিল। মাত্র ৩২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে এর মূল অফিস ছিল। অথচ এদের শেয়ার মূল্য নাকি ৬৪কোটি টাকা। মাত্র ১১জন কর্মচারী নিয়ে ১৫৬টা আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থার অডিট কি করে করা সম্ভব? আদানি টোটাল গ্যাস কোম্পানির বাৎসরিক অডিট রিপোর্টে যে অডিটরের স্বাক্ষর আছে, তাঁর বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর।
১৬. আমাদের তদন্ত প্রমাণ করে যে আদানিগ্রুপ একটি বিশাল জালিয়াতি এবং প্রতারণা চালাতে পেরেছে বছরের পর বছর ধরে মূলত বিনিয়োগকারী, সাংবাদিক, নাগরিক এমনকি রাজনীতিবীদদেরও অনেকেই এদের দাপটে ভীত বলেই।
এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠে এসেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তদন্তে, যার সবটা উল্লেখ করা সম্ভব নয় একটি প্রবন্ধে।
রকেট গতিতে উত্থান
২০১৪ সালে আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আদানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ গুণ। ২০২১ সালেও মুকেশ আম্বানী গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ, আদানির চাইতে ২লক্ষ কোটি টাকা বেশি ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৬১২ কোটি টাকার সম্পদ বাড়িয়ে আম্বানীর চাইতে ৩ লক্ষ কোটি টাকা বেশি সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন গৌতম আদানি। ২০১৪ সালে আদানী এন্টারপ্রাইজ এর যে শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ৪১ টাকা, ২০২৩ সেই শেয়ারের মূল্য বেড়ে হয়েছিল ৩৮০০টাকা। কোভিডের আগে ২০১৯ সালেও এই শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ১৬০ টাকা। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশের পরের দিনই আবার এর দাম কমে দাঁড়িয়েছে ২,১১৮ টাকায়।
উত্থান কিভাবে?
২০০২ সালে গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে অভিযুক্ত তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশ থেকে সরে যায় বহু দেশি-বিদেশী শিল্প গোষ্ঠী। এই সময়েই আদানির মঞ্চে প্রবেশ। নরেন্দ্র মোদীর বৃত্তে অনুপ্রবেশ ক’রে সরকারী দাক্ষিণ্যে অনেকগুলি সরকারী প্রকল্প এবং জমি হস্তগত করেন গৌতম আদানি। সখ্যতা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে সময়ের সাথে সাথে।
২০১২ সালে ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’ শীর্ষক শিল্প সম্মেলনে প্রথম নরেন্দ্র মোদীকে জাতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন গৌতম আদানি সহ আরও কয়েকজন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলে নরেন্দ্র মোদী হন দেশের প্রধানমন্ত্রী। গুজরাটের বৃত্ত ছাড়িয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে একই সাথে প্রবেশ ঘটে গৌতম আদানিরও।
অতি দক্ষিণ পন্থার উত্থান এবং বাছাই করা কর্পোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পরস্পরের হাত ধরেই চলে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।