The Stock Exchange: Note by Friedrich Engels

প্রাককথন

কার্ল মার্কসের জীবদ্দশায় পুঁজির প্রথম খণ্ডটিই কেবল প্রকাশিত হয়েছিল, সেই গ্রন্থ সম্পাদনার কাজ মার্কস নিজেই করেছিলেন। বাকি দুটি খণ্ডের লেখার খসড়া সহ প্রাথমিক একটি রূপরেখা বিবেচনা করেও মার্কস সে কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। ১৮৯৪ সালে জার্মান ভাষায় পুঁজির তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। তার পরের বছরই ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মৃত্যু। ১৮৯০ নাগাদ তিনি মার্কসের সেই খসড়া লেখাকে প্রকাশনার উপযুক্ত করার কাজ শেষ করেন। তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের সময় পুঁজিবাদের বাস্তবিক চেহারায় মার্কসের দেখে যাওয়া সময়ের চাইতে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে- এই উপলব্ধি এঙ্গেলসের ন্যায় আরও অনেকেরই ছিল। তারা সবাই এঙ্গেলস’কে পরামর্শ দেন তিনি যেন মার্কসের খসড়াকে নিজের বিবেচনাবোধ অনুযায়ী সম্পাদনা করেন- দরকার হলে বেশ কিছু জায়গা সরাসরি ছেঁটে বাদ দিয়ে দেন। সময়োপযোগী করার বিষয়ে একমত হলেও কোনওকিছু বাদ দেওয়ার বা বদলে দেওয়ার পথে এঙ্গেলস হাঁটেননি। ‘মার্কস এমনই একজন যার লেখা কেবলমাত্র তাঁরই সম্পাদনায় পাঠকের সামনে উপস্থিত হওয়া উচিত’- এই ছিল এঙ্গেলসের প্রতিক্রিয়া। সম্পাদনা করতে বসে তিনি নিজে কিছু সংযোজন করেন- মূল লেখার থেকে আলাদা করে, অ্যানেক্সচার হিসাবে। বর্তমান প্রবন্ধটি সেই সংযোজনীরই অন্যতম একটি। ১৮৬৫’র বাস্তবতার সাথে ১৮৯০’র পুঁজিবাদী দুনিয়াকে তুলনা করতে গিয়ে এঙ্গেলস অসাধারণ বুৎপত্তির পরিচয় দিয়েছেন- পাঠকের মনে হতে বাধ্য তিনি ছাড়া হয়ত আর কারও পক্ষেই এমনভাবে কাজটির সম্পাদনা করা সম্ভব হত না। এঙ্গেলস তুলে ধরেছেন ‘স্টক এক্সচেঞ্জ’র মাথাচাড়া দেওয়ার সময়কাল- যখন শেয়ার বাজারের দাপটে অন্য সমস্ত কিছুই ক্রমশ তার অনুসরণকারী অধস্তনে পরিণত হচ্ছে। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সংস্থা ইউনাইটেড অ্যালকেলি ট্রাষ্টের মোট পুঁজির পরিমান তখনকার সময়ে ছিল ৬০ লক্ষ পাউন্ড, তারাও শেয়ার বাজারের কৃপায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। বড় পুঁজি কিভাবে একচেটিয়া পুঁজির দিকে এগোচ্ছে এঙ্গেলসের লেখায় তারই প্রাথমিক ইঙ্গিত ছিল। এমনকি ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশগুলিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কেন ও কিভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে তারও প্রাথমিক উল্লেখ এ লেখাতেই রয়েছে। ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ লেখার সময় লেনিন সেই ইঙ্গিতকেই বহুমাত্রায় বিকশিত ও সুস্পষ্ট করেন, কার্যত তথ্য থেকে তত্ত্বের নির্মাণ করেন। এঙ্গেলসের লেখার গুরুত্ব সেখানেই। তিনিই প্রথম সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ইঙ্গিত’কে চিনতে পেরেছিলেন। এমন দুনিয়া মার্কস দেখে যাননি। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তর্গত ইন্সটিটিউট অফ মার্কসিজম-লেনিনিজম ১৯৪০ সালে এঙ্গেলসের লিখিত সেই সমস্ত সংযোজনী’কে এক জায়গায় নিয়ে এসে রাশিয়ান ভাষায় একটি ছোট বই প্রকাশ করে, তাতে পুঁজির প্রথম খণ্ড সম্পর্কে এঙ্গেলসের রিভিউ’ও যুক্ত ছিল। ১৯৫৬ সালে ‘এঙ্গেলস অন মার্কস’স ক্যাপিটাল’ শিরোনামে সেই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

আজ ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ২০৪-তম জন্মদিবস।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস

১৮৬৫ নাগাদ মার্কস পুঁজির তৃতীয় খণ্ডের খসড়া লেখার কাজ শেষ করেন। বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ের ২৩-তম পরিচ্ছেদে স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে সুস্পষ্ট আলোচনা ছিল। কিন্তু ১৮৬৫-র বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে আজকের সময়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় তার ভূমিকা অনেকটাই বলেছে। আজকের দুনিয়ায় পুঁজি নির্মাণ ও পরিচলনের ক্ষেত্রে পরিমান ও গুনগত উভয় দিকেই স্টক এক্সচেঞ্জের প্রভাব আগের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং নিরন্তর বৃদ্ধিও পাচ্ছে। ছোট-বড় শিল্প থেকে শুরু করে কৃষিজ উৎপাদন কিংবা বলা ভালো যাবতীয় বানিজ্যের প্রায় সর্বস্তরেই এক্সচেঞ্জে কর্মরত অপারেটর’রা ব্যস্ত থাকছে। পরিস্থিতি এমন যাতে বলা চলে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম বিশিষ্ট মুখপাত্রের নামই স্টক এক্সচেঞ্জ।

১৮৬৫-তে অবস্থাটা এমন ছিল না। তখনকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্টক এক্সচেঞ্জ’কে বড়জোর আনুষঙ্গিক এক বন্দোবস্ত ধরলেই চলত। এক্সচেঞ্জ সিকিউরিটির বেশিরভাগটাই সরকারী বন্ডের মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া যেত, টাকার মূল্যেও এর মোট পরিমান ছিল খুবই কম। আমেরিকা সহ বিভিন্ন মহাদেশে বেশ কিছু জয়েন্ট-স্টক ব্যাঙ্ক গড়ে উঠলেও সারা ইংলন্ড জুড়ে তখনও অভিজাত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলিরই রমরমা বজায় ছিল। কিছুটা ধীর গতিতে হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের দাপট এবং জয়েন্ট-স্টক ব্যাঙ্কের পুঁজি দুইই বেড়ে চলে- ফলে ইংলন্ডের অভিজাত ব্যাংকগুলিকে তারা সহজেই গিলে নেয়। যদিও জনসাধারণ এতে খুব একটা বিচলিত ছিলেন না, রেলওয়ের শেয়ারও আজকের মত দুর্মূল্য সামগ্রীতে রুপান্তরিত হয়নি। স্টক-এক্সচেঞ্জ কোম্পানি সমুহের নিত্যদিনের কর্মকান্ড সেভাবে কেউই খেয়াল করত না। এক্সচেঞ্জের বাজারে হাতে গরম আর্থিক পরিকল্পনার নামে কতিপয় ফন্দি-ফিকির (ডিরেক্ট প্রোডাক্টিভ এস্ট্যাব্লিশমেন্ট) কবে, কখন, কি এসে হাজির হচ্ছে সেসব নিয়ে তখনও কাউকে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়নি। জার্মানি, অস্ট্রিয়া কিংবা আমেরিকা’র ন্যায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবেচনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা দেশের ব্যাংকগুলি স্টক এক্সচেঞ্জের ওঠা-নামার দিকে প্রায় ফিরেও দেখত না। স্টক মার্কেটের চড়াই-উতরাই’র দিকে অর্থমন্ত্রকের তরফে হাল ফ্যশনের শ্যেন দৃষ্টি তখন অহেতুক কুসংস্কার বলেই বিবেচিত হত।

সেকালের স্টক এক্সচেঞ্জে আসলে যা ঘটত তাকে একে অন্যের জমানো সম্পত্তি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়াই বলা যায়, পুঁজিপতিরাই এসব করতেন। শ্রমজীবীরা এতে বাড়তি উত্তেজনা অনুভব করত না কেননা এ ছিল তাদের ঘাড়ে চেপে বসা পুঁজিবাদী জোয়ালেরই একটি রূপভেদ মাত্র। বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পুঁজিবাদ আসলে যা কিছু করে, স্টক-এক্সচেঞ্জে তার চাইতে খুব একটা আলাদা কিছু ঘটে না। ওরা যে শেষ অবধি লুঠই চালাবে শ্রমজীবীরা সেটুকু জানেই। সেই পাষণ্ডমতি চেপেচুপে রাখতে পুঁজিবাদ ক্যালভিনীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আশ্রয় নেয়। এর অর্থ- পাপ বা পূন্য সবই আসলে পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল, ইহজীবনে কে কি করল তাতে স্বর্গারোহণ কিংবা নরককুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া আটকায় না! অতএব চালাও লুঠ এবং নিজেদের বেলায় সেসবের নাম দাও সম্পত্তির পবিত্র অধিকার, ক্ষমতা ভোগের সুখ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে তারই সমার্থক হবে ক্লেশপূর্ণ জীবন ও দাসত্বের যাতনা।

ইদানিং সে পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। ১৮৬৬ সাল থেকে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা অতি দ্রুত জটিল থেকে জটিলতর চেহারায় রুপান্তরিত হচ্ছে। উদ্বৃত্ত সম্পদের আহরণ (অ্যাক্যুমুলেশন) কিভাবে ঘটবে তাকে কেন্দ্র করেই এই সংকটের সুত্রপাত। পরিস্থিতি ক্রমশ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অন্য অনেক শিল্পসমৃদ্ধ দেশ এমনকি ইংলন্ডকেও ভাবতে হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও কতদূর প্রসারিত করা যায়- সে কাজে তারা অনেকদূর চেষ্টাও করেছে, তবু সমস্যা মেটেনি। ব্যাপারটা আর শুধু দেশীয় বাণিজ্যের স্তরেই আটকে নেই, ব্যক্তিমালিকানাধীন যে কোনও ব্যবসার বেলাতেও খাটে। একজন মালিক উদ্বৃত্ত উৎপাদনের যতটা অংশে নিজের দখল কায়েম রাখে (যাবতীয় দেনা পাওনার হিসাব চুকিয়ে নেওয়ার পরে একেই সম্পদের আহরণ বা অ্যাকুম্যুলেশন বলা হয়) সেই মুনাফাকে কিভাবে পুনরুৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করা যাবে এটাই দুশ্চিন্তার প্রধান বিষয়। একাজটি না করতে পারলে ব্যবসা কিছুতেই বাড়ে না। এতদিন বানিজ্য ও তার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা নিয়ে অত বেশি না ভাবলেও চলত, ব্যাপারটা নিজের গতিতেই এগোতে পারত। কিন্তু ১৮৬৬ সালের সংকট সেসব সুখের দিনের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে! ইংলন্ডে কাপড়ের ব্যবসায় এমন সমস্যার শুরুয়াত হয় ১৯৪৫ সালেই, এখন রেলওয়ে থেকে আদায় হওয়া মুনাফার ক্ষেত্রেও ব্যাপারীদের প্রতারিত হতে হচ্ছে। এসব সওদায় যারা মূলধনের যোগানদার ছিলেন (অর্থাৎ ঋণ দিয়েছিলেন) তাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার কাজে এমন রোজকার অশান্তি সহ্য করতে না পেরে অনেকেই চাইছেন জীবনের বাকি দিনগুলি কিভাবে নিশ্চিন্তে কাটানো যায়- তারা যাবতীয় বন্দোবস্ত থেকে হাত গুটিয়ে ফেলছেন। এতে যেন কেউ না ভাবে এরা সব পালিয়েছেন! নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে বাবুরা সব অন্যান্য বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থায় কেউ ডিরেক্টর নাহলে গভর্নর বনে বসে গেছেন। এবার আসে নগদ পুঁজি হিসাবে কর্তব্যরত (মানে বাজারে ঘুরে বা উড়ে বেড়ানো) বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রসঙ্গ। নিজেদের ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য সেই পরের পয়সার দিকে সবারই নজর ছিল। এতদিন ডুবে যেতে বসা কোম্পানিদের বিশেষ কিছু দায়ভার স্বীকার করতে হত। বাবুরা বুঝলেন ওসব হলে আর ব্যবসা এগোয় না (লোকজন বিনিয়োগের নাম শুনলেই পালিয়ে বাঁচে আর কি), অতএব নতুন আইন-বিধিসমুহ মঞ্জুর হল। গড়ে উঠলো লিমিটেড লায়াবেলিটি কোম্পানি। এহেন বানিজ্য প্রতিষ্ঠানে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ বিশেষভাবে সুরক্ষিত। আগেকার নিয়মে কোম্পানি ডুবলে শেয়ার হোল্ডাররাও দেনার দায় স্বীকার করে ডুবে যাবেন এমনই বন্দোবস্ত ছিল, এবার তারা গলা অবধি চুবিয়ে রেখেই শ্বাস নেওয়ার অধিকার পেলেন। ১৮৯০’র জার্মানি’তেই জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে বিনিয়োগের বেলায় ৪০ শতাংশ অবধি বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা হয়েছে।  

শিল্প উৎপাদনী সংস্থা হিসাবে কাজকর্মের গনেশ উল্টে দিয়ে ক্রমশ স্টক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়া ব্যাপারটার শুরু হয় এর পরেই। উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রতিটি শাখার বেলাতেই এমন পরিণতি অবশ্যম্ভাবী। প্রথমেই গেল ইস্পাত। আগে ইস্পাত উৎপাদনের ক্ষেত্রে শেয়ার বেচে বিনিয়োগ টেনে আনার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি, এখন বিরাট আকারের প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার দরকার- তাই এমন সিদ্ধান্ত। এর পরে রাসায়নিক উৎপাদনী সংস্থা, তারপরে একে একে মেশিনারি প্ল্যান্টস। ল্যাংকারশায়ারের গোটাকতক সংস্থাকে (ওল্ডহ্যাম স্পিনিং মিল, বার্নি ওয়েভিং মিল এবং আরও কিছু টেলর কোঅপারেটিভের অধীনে পরিচালিত উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান) বাদ দিলে ইংলন্ডের মতো দেশে শেয়ার বাজারে যাওয়ার তালিকায় বস্ত্রশিল্পের নামই সবার আগে আসে। বাদ পড়া তালিকায় যারা রইলেন তারা আদৌ বেঁচে থাকবেন না, এবারে কোনওমতে টিকে গেলেও পরবর্তী সংকটের ধাক্কা এদের কোমর ভেঙে দেবে, তখন সকলেই শেয়ার বাজারের দিকে ছুটবেন। বস্ত্রশিল্পের পরেই মদ প্রস্তুতকারী কারখানার পালা এলো। এর আগে প্রখ্যাত আমেরিকান মদ উৎপাদনী সংস্থাসমুহ যেমন গিনেস, বাস কিংবা অলসপ’র ব্যবসা ইংরেজ পুঁজির হাতে বিকিয়ে গেছিল, এবার সেইসব ব্রিটিশ মালিকরাই বিক্রি হয়ে গেল। এবার বিরাট বিরাট ট্রাস্ট’দের সেই লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেল। ইউনাইটেড অ্যালক্যালি’র ন্যায় ট্রাষ্টগুলি এতদিন অন্যান্য উৎপাদনী সংস্থাকে ভরসা যোগাত, কমন ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বড় বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করত। এবার তারাই নতুন মালিকের খোঁজে বাজারে গেল। ছোট-খাটো সংস্থাগুলি তখন কি করছিল বলে যারা ভাবছেন তাদের জেনে রাখা ভালো ইন্ডিভিজ্যুয়াল ফার্ম তখনও এতদূর বিকশিত হয়নি যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকৃতি দিতে হত- প্রতিষ্ঠান নয় বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাখতে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হত না।

অন্যান্য বিখ্যাত বাণিজ্য সংস্থাগুলির কি খবর? লিফ্‌স, পার্সন্স, মর্লিজ, মরিসন কিংবা ডিলন’রা সকলেই ‘সেই’ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছিল। পাইকারি বাজারের দোকানগুলি অবধি এই ঢেউ’র আওতার বাইরে ছিল না- সামনের দরজার মাথায় ‘আ লা স্টোর্স’ লিখে রেখে কাউকে আর করে খেতে হয়নি। সকলেই বিকিয়ে ছিল।

অতএব ইংলন্ডের পুরানো বাজারে পড়ে রইল কারা? ব্যাংক ও ঋণ প্রদানকারী অন্যান্য আর্থিক সংস্থাগুলি। নিজেদের হাতে গচ্ছিত সম্পদের অবমূল্যায়নের জরুরী কাজটুকু সম্পন্ন করেই (ডিলিমিটেশন) নিত্যনতুন ব্যাংক গজিয়ে উঠতে শুরু করল। সাতজন প্রাইভেট শেয়ারহোল্ডার’র সাথে নিজের মালিকানা ভাগবাঁটোয়ারা মারফৎ গ্লিন’র মতো কুলীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠানও নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিজেদের পাল্টে ফেলেছিল।

কৃষিক্ষেত্র’ও নতুন অবস্থার বাইরে রইল না। পুরানো ব্যাংক পালটে গিয়ে বিরাট আকারের আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়া মাত্রই বলা যায় মর্টগেজ সম্পত্তির নামে একরকম ঝড় উঠল। জার্মানিতে আমরা কি দেখলাম? এতদিন যারা বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক বলে পরিচিত ছিলেন এবার তারাই নিজেদের সম্পদের রূপান্তর ঘটালেন- জমি মর্টগেজ রেখে সেই টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হতে শুরু হল। যেসব জমি ইতিমধ্যেই ঋণদাতার কব্জায় চলে গেছিল সেসবের বেলায় এমন ঘটার গতিটা ছিল আরও বেশি। দিগন্ত বিস্তৃত কৃষিজমিকে ধু-ধু প্রান্তরের অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল- কৃষিকাজ বিহীন কৃষিবিপ্লব বোধহয় একেই বলে! এমনটা চলতে থাকলে আজ জার্মানিতে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে ইংলন্ড ও ফ্রান্সের প্রায় সমস্ত জমিই স্টক এক্সচেঞ্জে বেচাকেনা চলবে।

এই যে পরিস্থিতি, তাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বলতে একমাত্র শেয়ার কেনাবেচা’কেই বুঝতে হবে। বাকিদের কথা ব্যতিরেকে শুধু যদি ইংলন্ডকেই ধরা হয় তাহলেই আমরা দেখব সেদেশ জুড়ে এখন আসলে কাদের দাপট। আমেরিকান রেলওয়েজ, নর্থ অ্যান্ড সাউথ এবং গোল্ডবার্গার’রাই তো আজকের দিনে মাথা। আমার কথা বিশ্বাস না করতে চাইলে স্টক এক্সচেঞ্জের দিকে নজর দিতে পারেন।

সবশেষে আসে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসঙ্গ। উপনিবেশ থেকে লুটে নেওয়া সম্পদ বিনিয়োগের বন্দোবস্তটাই কার্যত শেয়ারবাজারের অধীনস্থ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। গোটা গোটা দেশ সব স্টক এক্সচেঞ্জে বসে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়া হচ্ছে। কিছু বছর আগে এই কায়দাতেই আফ্রিকা মহাদেশ’কে ইউরোপ নিজেদের মধ্যে বেঁটে নিয়েছে। ফ্রান্স টিউনিস ও টনকিন দখল করেইছে সেই উদ্দেশ্যে। নাইজার, সাউথ আফ্রিকা, জার্মান-সাউথ ওয়েস্ট এবং জার্মান ইস্ট আফ্রিকা বলে-টলে যা কিছু ঘটেছে তা তো আসলে আফ্রিকা’কে লিজে দেওয়ার বন্দোবস্ত। শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে মুনাফা লুট ব্যতীত নাতাল আর ম্যাসোনাল্যান্ডকে দখল করার পিছনে রোডস’দের আর অন্য কোনও উদ্দেশ্যই ছিল না।    

প্রাককথন রাজ্য ওয়েবডেস্কের 

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর- সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply