বাবিন ঘোষ
ফ্যাসিবাদী পলিটিকাল ইকোনমি’র খানিক পশ্চাদপসরণ
গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত মামলায় রায় ঘোষণা করেন। এই রায়ে নির্বাচনী বন্ডের পুরো স্কীমটাকেই অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। সিপিআই(এম) ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা এই স্কীমের বিরোধীতা করে পথে নেমে আন্দোলনের পাশাপাশি সর্বোচ্চ আদালতে এই স্কীমের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে। প্রসঙ্গতঃ, সিপিআইএম নির্বাচনী বন্ডের স্কীম ঘোষণার সময়েই এর বিরোধীতা করে জানিয়ে দেয় যে তারা এই বন্ডের মাধ্যমে একটি টাকাও গ্রহণ করবে না। ১৫ই ফেব্রুয়ারির রায়ে সিপিআইএমের অবস্থানকেই মান্যতা দেওয়া হল’। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল’ যে ক’টি যুক্তিতে এই নির্বাচনী বন্ডের বিরোধীতা সেই ২০১৮ সাল থেকে সিপিআইএম করে এসেছে, সেই সকল যুক্তিরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে ১৫ই ফেব্রুয়ারির রায়ে। অর্থাৎ এই স্কীম নিয়ে রাজনীতিতে নির্লজ্জভাবে কর্পোরেট পুঁজির চূড়ান্ত অস্বচ্ছ এক হস্তক্ষেপের যে আশঙ্কা সিপিআইএম করেছিল’ সেই একই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি ঘটল’ সর্বোচ্চ আদালতের রায়েও। এই মামলায় রায়ে আদালতের তরফে রাজনীতি এবং অর্থশক্তির মধ্যে “গভীর সম্পর্ক” ব্যক্ত করে এও বলা হয় যে অর্থনৈতিক অসাম্য রাজনৈতিক অসাম্যের ও জন্ম দেয় কারণ যে যত বেশি অর্থের যোগান দিতে পারে কোনো রাজনৈতিক দলকে, সেই দলের সাথে তার বা তাদের বিভিন্ন স্বার্থপূরণের জন্য লেনদেনের সম্ভাবনাও তত বেশি তৈরি হয়।
কর্পোরেট পুঁজির রাজনৈতিক ব্যবহারঃ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এ দেশের বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার সূচনার অনতিকাল পরেই ১৯৫১ সালে যে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইন এবং ১৯৫৬ সালে যে কোম্পানি আইন প্রণয়ণ করা হয়, তাতে কোনো কোম্পানী অথবা একক ব্যাক্তির তরফে কোনো রাজনৈতিক দলকে অর্থের যোগান দেওয়ার বিষয়ে তেমন কোনো বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি। কেরলে নির্বাচিত বামপন্থী ফ্রন্ট সরকার কে অনৈতিক ভাবে পতন ঘটানোর প্রেক্ষাপটে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে রাজনীতিতে কর্পোরেট পুঁজির বহুল প্রয়োগ নিয়ে বিপুল সমালোচনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালে কোম্পানী আইনে সংশোধন করে ২৯৩(ক) ধারাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার ফলে কোনো কোম্পানীর তরফে অনুদানের ঊর্ধ্বসীমা (৩ বছরের ঘোষিত লভ্যাংশের সর্বোচ্চ ৫%) এবং অনুদানের অঙ্ক এবং যে রাজনৈতিক দলকে সেই অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তার নাম প্রকাশের ও আইনি দায়িত্ব আরোপ করা হয়। এর ঠিক ৯ বছর বাদে ১৯৬৯ সালে উপরোক্ত ২৯৩(ক) ধারাকে আরেকবার সংশোধন করে কোনো কোম্পানীর তরফে কোনো রাজনৈতিক দলকেই অনুদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকে যখন বৃহৎ এবং অতিবৃহৎ শিল্প বা পরিকাঠামোর প্রকল্প সরকারি উদ্যোগে গঠন করা শুরু হয়, তখন থেকেই সরকারি উচ্চতম সকল স্তরেও আর্থিক দুর্নীতির বহু অভিযোগ আসতে শুরু করে। প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে সরকারকে বরিষ্ঠ সংসদ সদস্য কে সান্থানামের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করতে হয় সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করার জন্য একটি রিপোর্ট দিতে। ১৯৬৪ সালে সেই রিপোর্টে যে কোনো কোম্পানীর তরফেই কোনো রাজনৈতিক দলকে অনুদান দেওয়া নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয় উচ্চতর মহলে দুর্নীতি আটকানোর জন্য। এর পাশাপাশি এমনটাও মনে করা হয় যে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে যখন ব্যাংক জাতীয়করণের আইন পাশ করা হয় সংসদে, সরকারপক্ষ আশঙ্কিত ছিল’ যে অতি দক্ষিণপন্থী দলগুলো (মূলতঃ স্বতন্ত্র পার্টি) এবং জাতীয় কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী গোষ্ঠী এই সু্যোগে বিক্ষুব্ধ কর্পোরেট সংস্থাগুলি থেকে বিরাট অংকের অনুদানে পুষ্ট হয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস (ইন্দিরা গান্ধীর অনুগামী) সরকারের বিরোধীতায় আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, যে এই সংশোধনী আনার ঠিক ২ বছর আগে, ১৯৬৭’র চতুর্থ লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী দল স্বতন্ত্র পার্টি ৪৪টি আসনে জয়লাভ করে লোকসভায় প্রধান বিরোধী দল হিসাবে স্বীকৃত হয়। স্বতন্ত্র পার্টির জন্মই হয়েছিল’ নেহরুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের অবধী অধিবেশনে গৃহীত “সমাজতান্ত্রিক” লাইনে দেশগঠনের বিরোধীতার মাধ্যমে।
১৯৬৯ সালে দেশের ৪টি বড় রাজ্যের বিধানসভাতেও (গুজরাট, বিহার, উড়িষ্যা এবং রাজস্থান) স্বতন্ত্র পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়ে দাঁড়ায়। ছোট বড় নানা মাপের ব্যবসায়ীদের এবং বৃহৎ ভূস্বামীদের স্বার্থবাহী এই দল জাতীয়করণের কারণে বিক্ষুব্ধ কর্পোরেটের তরফে বিপুল আর্থিক মদত পেতে সমর্থ হবে, এমনটা আন্দাজ করেই ১৯৬৯ সালের উপরোক্ত সংশোধনী এনে রাজনীতিতে কর্পোরেট পুঁজির সরাসরি হস্তক্ষেপের জায়গাটা কে অনেকাংশে শঙ্কুচিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মতই এই সংশোধনীর ক্ষেত্রেও সংসদের ভেতরে এবং বাইরে স্বতন্ত্র পার্টি এবং জনসঙ্ঘের তরফে বিরোধীতা করা হয়। এর প্রায় ১৬ বছর বাদে ১৯৮৫ সালে কোম্পানী আইনের ২৯৩(ক) ধারায় আবারো সংশোধন করা হয় যার মাধ্যমে কর্পোরেট অনুদান সংক্রান্ত আইনি অবস্থান ১৯৬০ এর অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে, বেশ কিছু বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয় এই সংশধনীর মাধ্যমে, যার মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যে সংস্লিষ্ট কোম্পানী রেজিস্ট্রীকৃত হওয়ার অন্ততঃ ৩ বছর বাদে এই ধরণের অনুদান দিতে পারবে এবং অনুদান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কোম্পানীর বোর্ড অফ ডিরেক্টরকে রেজোলিউশনের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে হবে। ১৯৬০ এর আইনের মতই এই সংশোধিত আইনেও অনুদানের পরিমাণ এবং অনুদান গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল বা দলগুলির নাম সেই কোম্পানীকে বার্ষিক প্রফিট এন্ড লস স্টেট্মেন্টে উল্লেখ করার দায়িত্ব রাখা হয়। কর্পোরের্ট অনুদান কে ১৯৬৯ সালের ১৬ বছর পর আবার ফিরিয়ে আনার সময়কাল এ দেশের অর্থনীতির উদারীকরণের যুগ শুরু হওয়ার ঠিক আগের সময়, যখন, সরকারি পরিভাষায় “রিফর্ম বাই স্টেলথ” অর্থাৎ খানিক লুকিয়ে চুরিয়ে, আস্তে আস্তে, আর্থিক সংস্কারের প্রক্রিয়া (রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ) শুরু করা হয়ে গিয়েছে। এরো প্রায় ২৮ বছর বাদে ২০১৩ সালে গোটা কোম্পানী আইনকেই নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। সেই নব্যপ্রণীত কোম্পানী আইনের ১৮২ নং ধারায় পূর্বতন আইনের ২৯৩(ক) ধারার প্রায় পুরোটাই বসিয়ে দেওয়া হয়, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সহ। আগের আইনের আওতায় বিগত তিনটি অর্থবর্ষের লভ্যাংশের ৫% এর ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৭.৫% করা হয়। এর মধ্যেই ২০০৩ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি-র জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলকে প্রদত্ত কর্পোরেট অনুদান কে কর ছাড়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন অতি দক্ষিণপন্থী এক সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপি’র রাজনৈতিক চরিত্রে যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। সেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার সাথেই সাযুয্য রেখে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ইস্যু এবং কর্পোরেট পুঁজির দাপট বাড়তেই থাকল’। ২০১৭’র ফিনান্স এক্টে (বাজেটের মাধ্যমে) মোট ৪টি আইন সংশোধন করা হয়, যার মারফৎ এই নির্বাচনী বন্ডের পথ তৈরি করা হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক্টের ৩১ নং ধারা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইনের ২৯(গ) নং ধারা, আয়কর আইনের ১৩(৪) নং ধারা এবং ২০১৩’র কোম্পানি আইনের ১৮২ নং ধারা কে সংশোধিত করা হয় যার ফলে ইলেক্টোরাল বন্ড নামের এক নতুন পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলি’র আর্থিক চাঁদা/ অনুদান গ্রহণের রাস্তা প্রস্তুত হয়। এই বন্ডের মাধ্যমে ২০০০ টাকার বেশি যে কোনো অংকের টাকার অনুদান গ্রহণ সম্ভব হয় যার বিশদ তথ্যসমূহ (কে এই বন্ড মারফত কোন দল কে কত টাকা দিচ্ছে) জনসমক্ষে প্রকাশ করার কোনো আইনি দায় থাকে না কোনো রাজনৈতিক দলের এবং যে সকল কোম্পানী এই টাকা দিচ্ছে, তাদের তরফেও এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব থাকে না। সর্বোপরি, কর্পোরেট অনুদান সংক্রান্ত পূর্বতন সকল আইনেই এই অনুদানের যে ঊর্ধ্বসীমা ছিল’ তা তুলে দিয়ে যথেচ্ছ কর্পোরেট অনুদান গ্রহণের রাস্তা খুলে দেওয়া হয় সে কোম্পানীর কোনো লভ্যাংশ থাকুক বা না থাকুক কিংবা সেই কোম্পানী হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো ভুঁইফোড় কোম্পানী কিনা, সেসবের তোয়াক্কাও না করে।
চোরা না শোনে ধর্মের কথা
জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং রিজার্ভ ব্যাংকের তরফে ২০১৭ সাল থেকেই এই বন্ডের বিরোধীতা করা হয়। ২০১৭ সালের ২রা জানুয়ারি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে চিঠি লিখে স্পষ্টভাবে জানানো হয় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে যে এই স্কীমের মাধ্যমে কালো টাকার লেনদেন বিরাটভাবে বাড়তে পারে কারণ Prevention of Money Laundering Act, 2002 এর বেশ কিছু মৌলিক নীতিকেই এই স্কীমে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে এবং নির্বাচনী খাতে কালো টাকার লেনদেন বন্ধ করাই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা চেক/ ডিমান্ড ড্রাফট, ডিজিটাল লেনদেন বা আরো অন্য অনেক রকম উপায়ে করা সম্ভব। এর জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের ৩০রা জানুয়ারি ২০১৭’র চিঠিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে এই নির্বাচনী বন্ড স্কীমের অন্যতম উদ্দেশ্যই হল’ অর্থদাতা’র পরিচয় গোপন রাখা। এর পরে ২০১৭ সালের ৪ঠা আগস্ট, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে আরেকটি চিঠি লেখা হয় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক কে, যেখানে এও বলা হয় যে সরকার যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিরোধীতা কে মান্যতা না দিয়ে নির্বাচনী বন্ড স্কীম নিয়ে এগোতে চায়, সেক্ষেত্রে যেন অবশ্যই কিছু নির্দেশিকা বা গাইডলাইন মেনে চলা হয় এবং মোট ৬ টি নিয়ম সম্বলিত একটি খসড়া গাইডলাইন ও সরকারের মঞ্জুরির জন্য পাঠায়। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কথা! এর অনতিকাল পরেই কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনী বন্ড স্কীমের একটি খসড়া প্রকাশ করে যেখানে রিজার্ভ ব্যাংকের কোনো সাবধানবাণী’র কোনো প্রভাবই লক্ষ্য করা যায় নি। এই দেখে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আবার ২০১৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরের চিঠির মারফৎ কেন্দ্রীয় সরকারকে জানায় যে এই স্কীমের ফলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গুরুতর সুনামহানি ঘটবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এই চিঠিতে এও জানানো হয়য় যে এই বন্ডের মারফৎ বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা “শেল কোম্পানি” মারফৎ তাদের কালো টাকা সাদা করার এক বিরাট সুযোগ পেয়ে যাবে। প্রায় একই আশঙ্কা আবারো ২৭শে সেপ্তেম্বরের চিঠিতেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায় কেন্দ্রীয় সরকার কে। এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচন কমিশন ও ২০১৭ আলের ২৬শে মে’র চিঠিতে কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রক কে জানায় যে এই স্কীমের ফলে রাজনৈতিক দলগুলির আর্থিক অনুদান গ্রহণের গোটা বিষয়টাই চূড়ান্ত অস্বচ্ছ হয়ে দাঁড়াবে এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইনের যে সংশোধন করা হবে এই স্কীমের প্রয়োজনে তা এক মারাত্মক “রেট্রোগ্রেড স্টেপ” (পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ) হবে কর্পোরেট অনুদানের উপর নজরদারির ক্ষেত্রে। নির্বাচন কমিশন ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাথে একসুরে জানিয়ে দেয় যে কর্পোরেট অনুদানের উপর কোনো ঊর্ধ্বসীমা না রাখার ফলে বিভিন্ন কোম্পানীর তরফে “শেল কোম্পানী” মারফৎ এই বন্ড কিনে কালো টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে পুষ্ট করার বিরাট সভাবনা তৈরি হচ্ছে। কোম্পানী আইনের সংশোধনী নিয়েও নির্বাচন কমিশন আপত্তি করে কারণ সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর তরফে যদি তাদের প্রদত্ত অনুদানের পরিমাণ এবং কোনো রাজনৈতিক দলকে তা দেওয়া হচ্ছে তা যদি বার্ষিক লাভ-ক্ষতির রিপোর্টে না পেশ করা হয়, তা সেই কোম্পানীর কতৃপক্ষকে কোম্পানীর টাকা নিয়ে যা খুশী তাই করার এক অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে দেবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল’ পৃথিবী জুড়ে আজ “কর্পোরেট গভর্নেন্স” সংক্রান্ত যে সকল নীতিকে সবচাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তার অন্যতম একটি অংশ হল’ যে কোনো কর্পোরেট সংস্থার ক্তৃপক্ষের তরফে সেই কোম্পানীর অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। এটি অত্যন্ত জরুরি দুটো কারণে। কোম্পানী আইনের সুপ্রাচীন দর্শন (“জুরিস্প্রুডেন্সে”) অনুযায়ী একটি কোম্পানীতে যেহেতু একাধিক ব্যক্তির লগ্নীকৃত অর্থ থাকে, সেই কোম্পানীর যে সকল শেয়ারহোল্ডাররা থাকবেন, তাদের সকলের এটি জানার পূর্ণ অধিকার রয়েছে যে সেই কোম্পানীর কত টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ উপভোক্তা অধিকার (“কঞ্জিউমার রাইটস”) সংক্রান্ত আইনি দর্শনেও এটি এক দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্টিত তত্ত্ব যে সেই কোম্পানীর উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবা যারা কিনছেন, সেই খরিদ্দার বা উপভোক্তাদের ও অবশ্যই এটি জানার অধিকার রয়েছে যে সেই কোম্পানীর আয়ের টাকা কতখানি কোন খাতে ব্যয় করা হয়। এই তথ্যের উপর তারা তাদের পণ্য/পরিষেবা কেনা বা না কেনার “ইনফর্মড” সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অর্থাৎ কেউ যদি জানেন যে একটি কোম্পানি তাদের আয়ের থেকে সেই ব্যাক্তির অপছন্দের কোনো রাজনৈতিক দলকে নিয়মিত ভাল পরিমাণ অনুদান দিয়ে থাকে, সেই ব্যাক্তি হয়ত’ সেই কোম্পানীর পণ্য বা পরিষেবা না কিনে অন্য কোনো কোম্পাণির থেকে তা কিনতে পারেন। অর্থাৎ উপরোক্ত আইনের সংশোধনের মাধ্যমে একটি কোম্পানীর একদিকে শেয়ারহোল্ডার এবং অপর দিকে উপভোক্তাদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছিল’ এই স্কীমের মধ্য দিয়ে। এটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে খোদ পুঁজিবাদী অর্থনীতির-ই তৈরি করা কর্পোরেট গভর্নেন্স বা উপভোক্তা অধিকার সম্পৃক্ত সকল মৌলিক নীতগুলিকেই বিজেপি সরকার এই নির্বাচনী বন্ড স্কীমে লঙ্ঘন করার যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থা ঠেকায় পড়লে যে পুঁজিবাদেরই সৃষ্ট সকল নিয়ম নীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে, এই স্কীম তার এক অসাধারণ উদাহরণ!
এই স্কীমের আরেকটি বিপজ্জনক দিক হল’ যে ভারতবর্ষে রেজিস্টার্ড যে কোনো কোম্পানী এই স্কিমের আওতায় নির্বাচনী বন্ড কিনে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে পারে। অর্থাৎ সেই কোম্পানীর মালিকানা ভারতীয় নাগরিকদের হাতে আছে কিনা, তা ধর্তব্যের বিষয় রইল’ না। এর ফলে সম্পূর্ণ বিদেশী মালিকানাধীন কোনো কোম্পানীও ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আর্থিক অনুদান করে সেই নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে গঠিত সরকারের নীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। এর সহজ মানে দাঁড়ায়, সেই জাতীয় কোম্পানীর কতৃপক্ষ, যারা কিনা ভারতের নাগরিক ও ন’ন, তাদের ও অবাধ সুযোগ করে দেওয়া হয় ভারতের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপের। কথায় কথায় “জাতীয়তাবাদ”এর ধুয়ো তোলা আরএসএস বা বিজেপি যে আসলে তাদের দেশি বিদেশি “ফিনান্সিয়ার”দের প্রতি কতখানি বশংবদ এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আদতে কতখানি উদাসীন, তা আবারো এই স্কিমের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশনের উপরোক্ত যাবতীয় সতর্কতা কে উড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ইচ্ছামত একটি স্কীম বানিয়ে, ২০১৮ সালের ২রা জানুয়ারি তা ঘোষণা করল’। এরই বিরুদ্ধে ২০১৮ সালেই সিপিআইএম এবং আরো তিনজন মামলাকারীর তরফে সংবিধানের ৩২ নং ধারার আওতায় রিট পিটিশন দাখিল করা হয়য় সুপ্রীম কোর্টে। এই মামলা দাখিল হওয়ার প্রায় ৫ বছর বাদে, ২০২৩ সালের ৩১শে অক্টোবরে, সুপ্রীম কোর্টের ৫ জন বিচারপতি দ্বারা গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চের সামনে শুনানির জন্য পাঠানো হয়।
দুই পর্বে প্রকাশিত