Money Cover

The Money, The Game: A Report

সুকুমার আচার্য

আমরা ময়লা কাপড় কাচতে হলে লন্ড্রিতে যাই। লন্ড্রি হল ময়লা কাপড় ধোলাই করে পরিষ্কার করার জায়গা। ময়লা টাকাকে সাফ-সুতরো করারও মেশিন আছে। নাটকীয়ভাবে পুঁজিবাদী শাসকরা মাঝে মধ্যে তা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করুক, আসলে তাদের তেমন কিছু করার নেই। কারণ পুঁজিবাদী শাসকদের তার নিজস্ব শ্রেণীর পুঁজিপতিদের জন্য কিছু ব্যবস্থাপনা তো তাকে তার দায়বদ্ধতা থেকেই রাখতে হবে।

আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো দেখলেন একটা শপিং মল আছে, তার কোন খদ্দের নেই। দু’চারটে সাইন বোর্ডের আলো জেলে কোনো একজন লোক হয়তো সেই ভূতপুরী পাহারা দিচ্ছে। বছরের পর বছর এমনই চলছে। কিংবা ধরুন এক একটা বিশাল জায়গা জুড়ে কিছু ভাঙাচোরা ঘর, আর দীর্ঘদিন ব্যবহার না করা একটা সাপ-খোপের জঙ্গল ঘেরা জায়গা পড়ে আছে। তার মাঝখানে একটা সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে। বছরের পর বছর এমনই চলছে। আপনি ভাবছেন- এ কিরে বাবা ! আসলে এর অনেক গুলিই ময়লা টাকা ওয়াশিং করার প্রথম জায়গা। তাহলে কিভাবে ময়লা টাকা ধোলাই হয়, কোন ওয়াশিং মেশিনে ধোলাই হয় সেই চর্চায় আসা যাক।

বিশাল বড় কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে। কোটি কোটি টাকার লাভ হচ্ছে। নানাভাবে এ হাত ও হাত করেও দেখা যাচ্ছে প্রচুর কর দিতে হবে। এখন সরকারকে সেই টাকা তো দিতে চাইছে না ধুরন্ধর বাবুটি। তাই আগে থেকে তার কোম্পানির নামে ঐ ভূতের শপিংমল বা ভাগাড়ের মতো জায়গায় কারখানা দেখিয়ে বসে আছেন। তারপর সেখানে লোকসান দেখাচ্ছেন এবং সেই লোকসান পোষাবার জন্য তিনি যে কোটি কোটি টাকা লাভ করছেন, যেখানে সেখান থেকে খাতায় কলমে বিনিয়োগের নাম করে সরিয়ে দিলেন। কর চোরদের ভাষায় এর নাম হল ‘Placement’, অর্থাৎ টাকাটার স্থানান্তর ঘটাও। এর বৈধতা পুঁজিবাদী সংবিধানের নিয়ম-কানুনই দিচ্ছে, না হলে কি এইভাবে টাকা সরানো যায় ?

এরপর আসুন টাকা ধোলাই এর দ্বিতীয় ধাপ। এর নাম বাবুরা দিয়েছেন ‘Layering’, বলতে পারেন ‘স্তরীকরণ’। সব দেশের পুঁজিবাদী শাসকরা তাদের শ্রেণীর জন্য কর ছাড়ের বা করশুন্যর স্বর্গরাজ্য খুলে বসে আছে। এটারও পুঁজিবাদী সংবিধানিক বৈধতা আছে। ওদের ভাষায় ‘Tax Heaven’ বা কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য। যে ময়লা টাকাটা মালিকের কাছে আছে, তাকে এখন স্বর্গে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে টাকাগুলো শুদ্ধ হয়ে আসবে। যাবে কি করে সেটা বড় কথা নয়। কারণ তার যাওয়াতে তো সাংবিধানিক বৈধতা আছে। কিন্তু সে গিয়ে থাকবে কোথায় ? সেই জন্য কর চোর বাবুরা আগে থেকে এক-আধটা নয়, বেশ কয়েকটা স্বর্গরাজ্য, যা দেশের নিয়ম-কানুন তাদের জানিয়েছে, পারলে তার সব ক’টিতেই তারা কয়েকটা কোম্পানি আগে থেকে খুলে রাখবেন। এইগুলিতে নিজে থেকে তার মামাতো-মাসতুতো ভাইদের মাথায় বসাবেন। এই কোম্পানিগুলোকে ‘Shell Company’ বলা হয়। আসলে এগুলো ভূঁইফোড় কোম্পানি। কোথাও কোন অস্তিত্ব নেই, শুধু কাগজে নাম। একটা ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরেই হয়তো দশটা কোম্পানির ঠিকানা, ক্যেমেন আইল্যান্ডে একটি মাত্র বাড়িতে প্রায় ১০,৫০০ কোম্পানির ঠিকানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এইসব Shell কোম্পানির মধ্যে কর চোরেরা যে যার সঙ্গে যুক্ত আছে, সেখানে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়। এখন তো ডিজিটাল মাধ্যম, সব চোখের পলকেই হাওয়া। এভাবে বছরে সেখান থেকে প্রায় ২ লক্ষ কোটি ডলার বা প্রায় ১৭০ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। কিছু অংশ আবার ফিরে আসছে পুরনো জায়গায়। দেখানো হচ্ছে কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যে থাকা তার কোম্পানি থেকে আসছে বলে। বিশ্বের কোথায় কোথায় এমন ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য রয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হচ্ছে-

(i) ভারতের ক্ষেত্রে বহু চর্চিত প্রায় সম্পূর্ণ ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য মরিশাস।

(ii) আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (UAE)। দুবাই তার কেন্দ্রবিন্দু। মোনাকো, এন্ডোরা, বাহামাস ইত্যাদি এবং আমেরিকা দেশটার মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজ্য আছে, যেখানে প্রায় কোনো আয়কর দিতে হয় না।

(iii) যেসব দেশে লক্ষ লক্ষ কোটিপতিদের টাকা লুকানোর নানা সুযোগ আছে, তার কয়েকটি হল- সুইজারল্যান্ড, হংকং, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, কে-ম্যান আইল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, লেবানন, জার্মানি, বাহারিন, আমীরশাহী। এখন তো আবার আমেরিকা বিজ্ঞাপন দিয়ে ডাকছে। আপনি কে তা জানার দরকার নেই, শুধু আমেরিকার একটা ব্রোকার ধরে নিন, বাকি শেয়ার বাজারের সব দায়িত্ব ওদের। এই সমস্ত সুযোগ শুধু পুঁজিপতিরা নিচ্ছেনা, সন্ত্রাসবাদীরাও ভালোভাবে নিচ্ছে।

ভাবুন ! সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ টিরও বেশি দেশ আছে যেগুলি ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য আর তার অধিকাংশ স্থানে নাগরিকত্ব পাওয়া অত্যন্ত সহজ ব্যাপার- আর্থিক ক্ষমতা থাকলে নাগরিকত্ব পাওয়া অনেকটাই সহজ। অনেক বড় বড় কর্পোরেট, এমনকি Amazon-ও হাজার হাজার কোটি ডলার লাভ করে, ০% কর্পোরেট কর দেয়। তারা তো বলেন সবই পরিষ্কার অর্থ। কর ছাড়ের দেশে কোম্পানি খুলে মূল কোম্পানিকে করে দেন তারই অধীন। ফলে সব কর ছাড় হয়ে যায়। শুধু মাঝখানে একটা ব্যাংক (সরকারি হলেও ক্ষতি নেই), আর তাকে ব্যবহার করে অর্থের চলাচল। ২০১৬ সালের একটা নথি প্রকাশিত হয়েছে- পানামা পেপার্স। ১ কোটি ১৫ লক্ষ গোপন নথির কথা এসেছে দিনের আলোয়। ২ লক্ষ ১৪ হাজার কোম্পানি এইভাবে তাদের ময়লা অর্থ ধোলাই করছে। সব নাকি একেবারে ফর্সা !

সত্যিই কি ফর্সা ? ময়লা অর্থ বলে যাদের বলা হয়, তার একটা অংশ সেখান থেকে এক রাত যেতে না যেতেই চার-পাঁচটা কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যে থাকা চার পাঁচটা আত্মীয় বাড়ি (Shell কোম্পানি) ঘুরে সোজা সুইস ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। সেখানে গিয়েই জামা বদল (সুইস ফ্রাঁ তে রূপান্তরিত হয়ে) করে পাকাপাকি ভাবে থাকা। এই তৃতীয় ধাপটা হল ‘Integration’ বা আলাদাদের একত্রিত হওয়া। দুনিয়ার বড় বড় জোর ডাকাতদের নানা রকম অর্থ বা অর্থের রং আছে। এখানে এসে তারা সব এক দেহে লীন হয়ে গেল।

এবার আপনাদের সামনে কর চুরির নানা রকম কতগুলি বিষয় নিয়ে আসি-

এতক্ষন যে বিষয় আপনাদের সামনে রাখলাম, তা হল ‘মানি লন্ডারিং’ বা টাকা ধোলাইয়ের বিষয়। যার মাধ্যমে কর চুরি, অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ, দুর্নীতি, গুন্ডামি, খুন ইত্যাদির দ্বারা অর্জিত ময়লা অর্থকে সাফসুতরো করে আবার চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা একে অবশ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ একই কাজ করে পুঁজিবাদী মহল ও কর্পোরেট মহলের মাতব্বররা বিশ্বে মান্য-গন্যের শিরোপা অর্জন করেছেন।

করের ব্যাপারে দু’টি কথা আছে- (i) Tax Avoidance এবং (ii) Tax Evasion; প্রথমে যে বিষয়টা নজরে আনছি সেটা হল ‘Tax Avoidance’ অর্থাৎ কর এড়িয়ে চলা। প্রচুর রোজগার হচ্ছে। এত কর দিতে ইচ্ছে নেই। আচ্ছা, আইন এড়িয়ে চলার জন্য কিছু আইন-ই না হয় দেওয়া হল। আর সে পথে গেলে কোন দোষও পেতে হবে না। কীরকম সেই ব্যবস্থাপনা ?

একটা কোম্পানির প্রচুর লাভ হল। সে লাভ অনুযায়ী কর দিতে চাইছে না। এই যে লাভ, একে বলা হয় বুক ইনকাম (Book Income)। এখান থেকে দশ বছর বিনিয়োগের জন্য বেশ কিছু অর্থ সরিয়ে নেওয়া হল। তারপর অনুন্নত জায়গায় বিনিয়োগ দেখাতে পারলে আরো ছাড়। এটা সব দেশেই আছে। সব বাদ দিয়ে যা থাকল, তার উপর কর। আরও মজার বিষয়, যা বলেছেন ওয়ারেন বাফেট। তিনি বলেছেন- আমি শেয়ার বাজারে অর্থ খাটিয়ে রোজগার করি। আমি ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দিই ১৭.৪% হারে। আর আমার ২০ জন কর্মচারী সবাই তাদের আয়কর দেয় ২১% হারে। তিনি মজা করে বলছেন- আমি দিই কম, আর আমার কর্মচারী দেয় বেশি -এইরকম আমাদের কর ব্যবস্থা। আসলে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তো এইরকমই। যার যত বেশি রোজগার, তার তত কম কর। আর যার যত কম রোজগার, দিন আনি দিন খাই, তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বেশি কর দিতে হয়। আমাদের দেশের কথাই ধরুন। যার বছরে ১০ লক্ষ টাকা আয়, তার কর ১৫%, আর কপর্দকহীন মানুষের জন্য ওষুধের GST- ১৮%, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশী।

Tax Evasion- বাংলায় ঠিক তর্জমা করা গেল না। কর ফাঁকি বলতে পারেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেসব ছাড় দেবার নানা রকম প্রক্রিয়া আছে, সেগুলো ব্যবহার করার পরে আরও সম্পদ গোপন করে তা আত্মসাৎ করা দরকার হলে, তখন এই প্রক্রিয়ার আশ্রয় বড় বড় কর্পোরেটরা নেন। দুটি আন্তর্জাতিক কর্পোরেটের উদাহরণ দিচ্ছি এবং তারা কীভাবে কর ফাঁকি দিয়ে প্রায় বহাল তবিয়তে রয়ে যাচ্ছে -এমন তথ্য আমেরিকার বিখ্যাত CNBC নিউজ চ্যানেল প্রকাশ করেছে।

(ক) Whirlpool-এর ঘটনা। কোম্পানিটি আসলে আমেরিকার। সেখানেই সব তৈরি হয়। কিন্তু সে দেখাচ্ছে তার যা কিছু পেটেন্ট, তা আছে মেক্সিকোর কারখানায়। তাই কোম্পানিটি মেক্সিকোর কোম্পানির অধীন। কিন্তু মেক্সিকোতে একজন কর্মচারীও নেই। কিন্তু মেক্সিকোর কোম্পানির পুরো শেয়ার হোল্ডিং হচ্ছে লুক্সেমবার্গে থাকা কোম্পানির। সেখানে মাত্র একজন কর্মচারী আছে। তাই আসল কোম্পানি হল লুক্সেমবার্গের কোম্পানি। লুক্সেমবার্গ কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য। ০% কর দিতে হয়। অতএব কোম্পানিটিকে কোথাও কোন কর দিতে হলো না। এইভাবে দীর্ঘ কয়েক দশক চলার পর আমেরিকার কোর্টে মামলা হয়। আমেরিকার কোর্ট জানায় তার এই কাজ বেআইনি।

(খ) আরেকটি সংস্থা Amazon; আমেরিকায় ফেডারেল ট্যাক্স দিতে হয় লাভের ২১%। লাভও আবার গোপন করা যায়। প্রায় সব কোম্পানিই করে। ২০১৮ সালে ১১২০ কোটি ডলার লাভ করেও এই কোম্পানিকে ফেডারেল কর দিতে হয়নি। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল অবধি যদি ধরা যায়, তবে সে কার্যকরী ক্ষেত্রে কত কর দিয়েছে তার হিসেবটা এইরকম-

সালমোট লাভকার্যকরী প্রদত্ত করকার্যকরী প্রদত্ত করের হার %
২০১৮১০৮০ কোটি ডলার(-) ১২.৯ কোটি ডলার(-) ১.২%
২০১৯১৩০০ কোটি ডলার১৬.২ কোটি ডলার(+) ১.২%
২০২০১৯৬০ কোটি ডলার১৮০ কোটি ডলার(+) ৯.৪%
২০২১৩৫১০ কোটি ডলার২১০ কোটি ডলার(+) ৬.১%
৪ বছরে মোট৭৮৬০ কোটি ডলার৪০০ কোটি ডলার(+) ৫.১%

কিন্তু সে এটা কীভাবে করছে ? অবশ্যই ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্যের দেশগুলোকে তার যাত্রাপথ প্রসস্থ করে। এই ব্যবস্থাপনা যত ভদ্রস্থ হোক, আসলে তা জনগণকে ফাঁকি দেওয়া টাকা – ময়লা টাকা। এই ব্যবস্থাপনা ময়লা টাকা তৈরির ব্যবস্থাপনা। এর পরের কাজটা হল সুইস ব্যাংকে গিয়ে একে ধোলাই করা।

এইভাবে দেখা যাচ্ছে আমেরিকার ৫৫ টা বড় বড় কর্পোরেট ২০২০ সালে তাদের প্রভূত লাভ সত্ত্বেও তাদের কোন কর দিতে হয়নি। এর ফলে গড়ে বছরে আমেরিকার ক্ষতি হয় ৪ হাজার কোটি ডলার। CNBC তার সমীক্ষায় এটা দেখেছে যে, এইভাবে চললে আমেরিকার সর্বোচ্চ ধনীদের মাত্র ১% এর জন্য আমেরিকা সরকারের ২০২৯ সাল অবধি ক্ষতির মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লক্ষ কোটি ডলার। এতদিন আমেরিকার সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য সে নিজেই তার দেশে একটার পর একটা খুলে দিচ্ছিল। এখন আমেরিকা সরকারই সবচেয়ে জোর দিয়ে বলছে পৃথিবীতে কোথাও কোন ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য রাখা যাবে না। ন্যূনতম ১৫% কর সব দেশেই চালু করতে হবে। কারণ সে নিজে আজ প্রচন্ড আর্থিক সংকটে পড়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০২০ সালের পর থেকেই বেশ কিছু কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য দেশে ন্যূনতম কর্পোরেট কর চালু করে দিয়েছে। হিসেবে কষে এরা ঠিক বুঝে নিয়েছে যে, বড় বড় বিত্তশালী দেশগুলোতে যে পরিমান কর্পোরেট কর চালু আছে, তার সঙ্গে কতটা কম রাখলে কর্পোরেটরা সুবিধা পাবার জন্য তাদের কাছে আসবে বা আসতে পারে।

যেগুলোকে আমরা কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য বলি, সেগুলো তে কি সত্যি কোনো কর নেই বা ছিল না ? তাহলে দেশগুলো চলছে কী করে ? আসলে আদৌ নেই তা নয়, এইগুলোর অধিকাংশ দেশে কর্পোরেট কর খুবই কম। সেজন্য বড় বড় কর্পোরেটদের দ্বারা তারা আকর্ষিত হয়। আসলে এই প্রক্রিয়া হচ্ছে সেই সব দেশের আয় বৃদ্ধির একটা কৌশল। কর্পোরেট কর ছাড়, কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা কর -ইত্যাদি দিতে হয়। তারপর শ্রমিকরা কাজ করলে তাদের আয়কর দিতে হয়। মালিকের কর্পোরেট কর ছাড় হয়, আর কিছুটা শ্রমিকের কাছ থেকে উসুল হয়। বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছেন- ‘In this world, nothing can be said certain except death and tax.’ (এই দুনিয়ায় মৃত্যু এবং কর ছাড়া কোনোকিছুই নিশ্চিত বলে বলা যায় না -অনুবাদ লেখকের)।

বহু দেশের মধ্যে কয়েকটি দেশের তথ্য এখানে দিচ্ছি। এখান থেকে জানা যাবে এই দেশগুলো কীভাবে তাদের আয় সংগ্রহ করতে গিয়ে কর্পোরেটদের কর ছাড় দিচ্ছে, আর তা সংগ্রহ করছে দেশের জনগণের কাছ থেকে এবং নাগরিকত্ব বিক্রি করার মাধ্যমে সারা বিশ্বের জনগণের কাছ থেকে।

দেশের নামব্যক্তিগত আয়করকর্পোরেট কর ২০২৩নাগরিকত্ব বিক্রয়
সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (UAE)লাভের উপর ৯%১০ বছরের জন্য ৫ লক্ষ ৪৫ হাজার ডলার
বাহামাস৭ লক্ষ ৫০ হাজার ডলারের জমি
বারমুডা০ কিন্তু পে-রোলে (কর্মচারী ও শ্রমিকদের মোট যে অর্থ দেওয়া হয়) ৫.৫%লাভের উপর ১.৭৫%২৫ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ
ক্যেমেন আইল্যান্ড১২ লক্ষ ডলার ২৫ বছরের জন্য, ২৪ লক্ষ ডলার আজীবন
মোনাকো৩৩.৩৩% (কিছু বিশেষ ক্ষেত্র বাদে)ব্যাংকে জমা অন্ততঃ ৫ লক্ষ ইউরো
বাহারিন৪০ হাজার ডলারের ঊর্ধ্বে ১৫%০ কিন্তু তেল, গ্যাস ও ব্যাংকে লাভের ৪৬%২ লক্ষ ৭০ হাজার ডলারের জমি অথবা মাসে ২৬৫০ ডলার আয়
এন্ডোরা১০%ব্যাংকে অন্ততঃ ৫ লক্ষ ইউরো জমা

*২০২৩ সালে দেখা যাচ্ছে UAE, এন্ডোরা -এরা কর্পোরেট কর বসিয়েছে, তার আগে ছিল না। এর থেকেই বোঝা যায় বড় বড় কর্পোরেটদের কেন দেশগুলির প্রতি এত আগ্রহ। (তথ্যসূত্র- Global Residence Index/No Tax Countries : Tax-free Countries in 2023/ Devid Bonellie – 03/11/2023)

এছাড়া লুক্সেমবার্গএর কথায় আসা যাক। এটা এখন কর চোরদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। ছোট্ট একটা দেশ, প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ জনসংখ্যা মাত্র। তার মধ্যে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ লুক্সেমবার্গের নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করেন। আসলে কর্পোরেট মালিকরা খাতায়-কলমে দেখান তারা ১৮৩ দিনের বেশি দেশটাই বসবাস করেন। এই নাগরিকত্ব বিক্রয় দেশটার একটা বড় আয়। কয়েক বছর আগে দেশটায় কোনো কর্পোরেট কর ছিল না। বড় কর্পোরেটদের আকর্ষণ এখানেই। অন্যান্য কর দিতে হয়, তবে তা খুবই কম। যেমন ডিজনি একসময় লাভ করেছিল ১০০ কোটি ডলার। আমেরিকায় তাকে কর দিতে হত ২৯ কোটি ডলার। কিন্তু সে লুক্সেমবার্গকে তার মূল ব্যবসার ক্ষেত্রে দেখিয়ে লুক্সেমবার্গকে কর দিল মাত্র ৩১ লক্ষ ডলার। এইভাবে বেশি বড় বড় অভিজাতিক সংস্থা তাদের মূল ব্যবসার ক্ষেত্র লুক্সেমবার্গকে দেখিয়ে তার কর বাঁচিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে যেটুকু পাচ্ছে লুক্সেমবার্গ, সেটা কম নয়। সারা পৃথিবীর মোট বৈদেশিক ব্যবসার কর (অফ শোর বিজনেস)-এর ১২ শতাংশ সে একাই পেয়েছে ২০১০ সালে। এখনো অব্যাহত আছে। আর পাচ্ছে আর্থিক প্রতিরক্ষা জনিত নিরাপত্তা। যারা যাচ্ছে সেখানে, তারা ব্যাংকে টাকা রাখছে। ফলে লুক্সেমবার্গে জাতীয় আয়ের ৮৫ শতাংশই আসছে ব্যাংক ব্যবসা থেকে। অপরদিকে, চারিদিকে বহু দেশ পরিবেষ্টিত হলেও সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৮০০। কারণ, কে দেশটাকে আক্রমণ করবে ? যে দেশ আক্রমণ করবে, তাকে শুধু সেই দেশের নয় সমস্ত দেশের পুঁজিপতিরা বাধা দেবে তাদের স্বর্গরাজ্যে ঝামেলা করছে বলে। আরো একটা বাড়তি সুবিধা আছে। দেশটা চারিদিকে জার্মানি ফ্রান্স আর বেলজিয়াম দিয়ে ঘেরা। এই দেশগুলো তুলনায় আর্থিকভাবে সচ্ছল। দেশগুলোর সাথে লুক্সেমবার্গের প্রায় কোন বেড়া নেই। ফলে বহু মানুষ ওই তিনটে দেশে যায় আর রোজগার করে লুক্সেমবার্গের আয় বাড়ায়। ফলে সবমিলিয়ে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে লুক্সেমবার্গ হচ্ছে সবথেকে ধনীতম দেশ। তার কাছে আমেরিকাও শিশু। এখন অন্যান্য ধনতান্ত্রিক দেশের সরকার তাদের দেশের পুঁজিপতিদের ব্যাপক হারে কর ছাড় দিচ্ছে। ফলে ২০২৩ সাল থেকে এক লাফে কর্পোরেট কর করে দিয়েছে ১৭ শতাংশ। তুলনায় ইউরোপের হাঙ্গেরির কর্পোরেট কর ৯ শতাংশ। কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যে এইরকম কিছু অবাঞ্চিত বিশৃঙ্খলা কর্পোরেটদের সামনে হাজির হলেও এখনো বহু স্বর্গরাজ্যে যাবার রাস্তা কর্পোরেটদের সামনে খোলা আছে।

এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে। কারা টাকা রাখে সুইস ব্যাংকে ? ১০ লক্ষ ডলার একসঙ্গে যে জমা রাখতে পারবে তার টাকাই ওখানে রাখা হবে। ওখানে এইভাবে অর্থ জমা রাখলে সুদ পাওয়া যায় না, উল্টে অর্থ দিতে হয়। ওরা তো জানে চুরি করা অর্থকে তারা পাহারা দিচ্ছে। তাই পাহারা দেওয়ার জন্য অর্থ তো ওরা চাইবেই। ২০২৩ সালে দেখা গেছে এইসব ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডে জমা টাকার উপর সুদের হার (-) ০.৭৫% (SARON – Swiss Average Rate over Night, investopedia.com)। ১৭ জুন ২০২২ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভারতের কর চোরেরা ওখানে ২০২১ সাল অবধি ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা রেখেছে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় মাত্র ১০০ জনেরই জমার পরিমান ২৫,৪২০ কোটি টাকা (২২ জুন ২০২৩ – PTI)। ২০১৯ সালে ছিল ৬৬২৫ কোটি টাকা, আর ২০২০ সালে সেটা ১৮৩% বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (সূত্র- ১৭ জুন, ২০২২, Scroll.in/National News)। কেমন বাড়-বাড়ন্ত দেখুন- মাত্র আড়াই বছরে সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি। গত ১৪ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। আর সুইস ব্যাংকে চোরেদের মোট জমানোর পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রায় ১১৮ লক্ষ কোটি টাকা (সূত্র- Timesofindia.com, জুন ২০২২)। আমাদের দেশের সমস্ত মানুষ ২০২১ সালে যা উৎপাদন করেছে তার প্রায় অর্ধেকের সমান। বাড় বাড়ন্তের অগ্রগতির হারে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভারত (সূত্র- ইকোনোমিক টাইমস)। দেশে টাকা ফিরিয়ে আনার গল্প বলেছিলেন কে যেন ? তিনি কি এখন টাকা ধোলাইয়ের মেশিনের রক্ষক ?

সুতরাং ময়লা টাকা ধোলাই করার বা কালো টাকা সাদা করার আসল মেশিন তাহলে কোনটা? পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ম কানুন ও ব্যবস্থাপনা। তাই নয় কি? ধনতন্ত্রের বর্তমান অবস্থায় এসে এই ওয়াশিং মেশিনের চাকাটা যেন বেশ দ্রুত বেগে ঘুরছে। কিন্তু কতদিন ঘোরে সেটাই দেখার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদায় হলে মেশিনটাও নিজে থেকে অচল হয়ে যাবে।

Spread the word

Leave a Reply