The Last Lap: Colombia

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিটি জনমত সমীক্ষায় অন্তত একটি পূর্বাভাস ছিল স্পষ্ট।

প্রথম রাউন্ডের ভোটে শীর্ষে থাকবেন বামপন্থী প্রার্থী গুস্তাভো পেত্রো। নির্বাচনের ফল ঘোষণায় মধ্য-বামপন্থী নির্বাচনী জোট প্যাক্টো হিস্টোরিকা (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট)-র প্রার্থী পেত্রো-কে সবচেয়ে বেশি ভোট পেতে দেখে তাই কেউই বিস্মিত হননি। বরং, হতবাক হয়ে গিয়েছেন শাসক নিও লিবারেল ‘উরিবেপন্থী’ প্রার্থী ফেদরিকো গুতেরেইজকে তিন-নম্বরে চলে যেতে দেখে। সবাইকে অবাক করে গুতেরেইজকে ছাপিয়ে দু’-নম্বরে উঠে এসেছেন রিয়েল এস্টেট মুঘল, ১০ কোটি ডলারের সম্পত্তির মালিক রোদোলফো হার্নান্ডেজ, যিনি প্রকাশ্যে নিজেকে ‘হিটলারের অনুগামী’ বলে দাবি করেন।

রোদোলফো হার্নান্ডেজ

পেত্রো পেয়েছেন ৪০.৩২ শতাংশ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থী হার্নান্ডেজের পক্ষে সমর্থনের হার ২৮.১৫ শতাংশ। আর ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইভান দুকের সমর্থন থাকলেও দক্ষিণপন্থী প্রার্থী গুতেরেইজের পক্ষে সমর্থনের হার ২৩.৯১ শতাংশ।

কলম্বিয়ার সংবিধান অনুযায়ী প্রথম রাউন্ডে কোনও প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে প্রথম দু’জনের মধ্য হবে চূড়ান্ত পর্বের ভোট। সেকারণে লড়াই এবার সরাসরি পেত্রো এবং হার্নান্ডেজের মধ্যে। ১৯ জুন চূড়ান্ত পর্বের নির্বাচন। এদিকে প্রথম রাউন্ডে ফল ঘোষণার পরেই এতটুকু দেরি না করে গুতেরেইজ তাঁর সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছেন হার্নান্ডেজকে। এখন গুতেরেইজের সমস্ত ভোট হার্নান্ডেজের পক্ষে গেলে তিনি অনায়াসে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থার জয় নিশ্চিত। যদিও নির্বাচন সবসময় পাটিগণিত মেনে হয় না। দুই আর দুইয়ে চার হয় না। পেত্রোর সমর্থক, যাঁরা ভোট দিতে এলেন না, তাঁদেরকে চূড়ান্ত পর্বে ভোটের লাইনে দাঁড় করানো গেলে ফলাফল অন্য হতে পারে। তাছাড়া, ৭৭-বছরের হার্নান্ডেজ ‘দুর্নীতি-মুক্ত প্রশাসন’ নিয়ে সরব হলেও, নিজে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। কলম্বিয়ার সংবাদমাধ্যম আরসিএন রেডিও-কে তিনি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমি মহান জার্মান চিন্তাবিদ হিটলারের অনুগামী।’ লাতিন আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি ‘কলম্বিয়ার ট্রাম্প’ নামে পরিচিত, যেমন ব্রাজিলের বোলসোলারো।

এই পরিস্থিতি তাই দেশের বামপন্থী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। হিস্টোরিকাল প্যাক্টের কাছে বড় পরীক্ষা। এই জোটে অতি বামপন্থী, কমিউনস (একসময়ের দাপুটে মার্কসবাদী গেরিলা সংগঠন ফার্কের রাজনৈতিক দল), মধ্য-বাম থেকে রয়েছে কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মতো ২০টি রাজনৈতিক দল। দক্ষিণপন্থীরা একজোট হলে, কেন বামপন্থী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি এককাট্টা হতে পারবে না!

তবে কঠিন লড়াই। হিস্টোরিকাল প্যাক্ট-কে শুধু দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে না, লড়তে হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে।

কলম্বিয়া মানে লাতিন আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্ত ঘাঁটি। লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত হলো কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এক কলম্বিয়াতে রয়েছে সাত-সাতটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এর সঙ্গেই পেন্টাগন নিয়মিত অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীকে। প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য নির্ভর করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর। ২০১৯, ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন পদক্ষেপে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয় কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। সামরিক খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র ১২ শতাংশ। রয়েছে ২ লক্ষ ৯৫ হাজারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম। চে’র কথায় ‘ইয়াঙ্কি মন্ত্রিসভা’ অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের (ওএএস) প্রথম বৈঠক হয়েছিল কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায়। ১৯৪৮ সালের ৩০ এপ্রিল। ওএএসের প্রথম মহাসচিবও হন একজন কলম্বিয়ান।

কলম্বিয়ার রপ্তানির অর্ধেকের বেশি আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। শুধু পেট্রোলিয়াম থেকেই আসে ৫৭ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। কলম্বিয়ার প্রায় ৯২ শতাংশ কয়লাই রপ্তানি করা হয়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী দেশ। গত বছরের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টন। রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পান্না, নিকেলের অফুরন্ত ভাণ্ডার। উর্বর কফিখেত। বিপুল এলাকাজুড়ে আমাজনের গহীন জঙ্গল। এই অপার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রয়েছে কানাডা ও মার্কিন সংস্থাগুলির আধিপত্য। ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ওয়াশিংটনের ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ তাই ছিল ছুতো, লক্ষ্য আসলে তেল আর প্রাকৃতিক সম্পদ। তাছাড়া, কলম্বিয়াতে রয়েছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম-সহ একশটির বেশি ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থা। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিরাপদ রাখতে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রকের সঙ্গে ১ কোটি ১০ লক্ষ ডলারের চুক্তি করেছে।

এই নির্বাচন নিয়ে তাই তৎপর ওয়াশিংটন। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তাই কলম্বিয়া সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন বিদেশদপ্তরের রাজনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড। কে এই নুলান্ড? ২০১৪, ইউক্রেনে মার্কিন মদতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করার অন্যতম মস্তিষ্ক। অভ্যুত্থানের ঘটনায় সরাসরি মার্কিন মদত বেআব্রু হয়ে যায় সেসময় মার্কিন সহকারী বিদেশসচিব নুলান্ড এবং ইউক্রেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিওফ্রে পিয়াটের আলোচনার অডিও-রেকর্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর। ইউক্রেনে সরকার পালটে কাদের বসানো হবে তা-ও তিনি ঠিক করেছিলেন। ‘মাইদান’ অভ্যুত্থানে অতি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মার্কিন ঋণ দেবার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় নুলান্ড সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাইরের লোকেরা যাতে (নির্বাচনকে) প্রভাবিত করতে না পারে, তা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে।’ ব্লুরেডিও-কে নুলান্ড বলেছেন, ‘ভেনেজুয়েলা সীমান্তে রুশদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’

এর সঙ্গেই আছে হিংসা আর ভোট কারচুপির আশঙ্কা। যে কোনও মুহূর্তে প্রাণনাশের আশঙ্কায় বামপন্থী প্রার্থী। চব্বিশ ঘণ্টা তাঁকে ঘিরে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। এর মধ্যেই আশার আলো মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। নির্বাচনী প্রচারে পেত্রো বলেছেন, ১৯৪৮ থেকে হিংসায় আক্রান্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কিছু বড় পরিবর্তন জরুরি। তাঁর সরকার কৃষি সংস্কার করবে, শক্তিশালী করবে শ্রম আইনকে, কলম্বিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদি জনগোষ্ঠী মানুষের সমানাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Spread the word

Leave a Reply