ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের জাতীয় অর্থনীতি প্রসঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র ১৪ অগাস্ট সংখ্যায় ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি সিন্স ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে প্রভাত পট্টনায়েকের লেখা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ (দুই পর্বে) পার্টির রাজ্য ওয়েসাইটে প্রকাশিত হল।
২য় পর্ব
সহজ কথায় বলা চলে নয়া-উদারনীতি কতিপয় মিথ্যা প্রতিশ্রুতির উপরে ভর করে নির্মিত হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই এই ব্যবস্থায় জিডিপি বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় বেড়েছে, কিন্তু একইসাথে বিবেচনা করতে হয় কর্মসংস্থানের হার প্রায় অর্ধেক নীচে নেমে গেছে। নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তে উৎপাদন কিংবা আর্থিক বৃদ্ধির অপরিহার্য শর্ত হিসাবে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলাই এমনটা হওয়ার আসল কারণ। এই ব্যবস্থায় রপ্তানিতে যুক্ত দেশীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য উৎপাদনের ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলিকেও পণ্য ও পরিষেবা উভয়ক্ষেত্রেই বৈদেশিক বৃহৎ পূঁজির মোকাবিলা করতে হয়। বৃহৎ পূঁজির মোকাবিলা করতে গিয়ে ছোট বড় দেশীয় সংস্থাগুলির উপরে মুনাফা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়, ফল হয় ব্যাপক শোষণ ও যথেচ্ছ কর্মী ছাঁটাই। সেই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র মজুত বেকারবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চেহারাকে বিবেচনা করে বেকারির প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করা চলে না, একইসাথে বিচার করতে হয় নির্দিষ্ট মজুরির কোন একটি কাজ ক্রমাগত কত বেশি বেশি শ্রমিকদের মধ্যে বন্টিত হচ্ছে। বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কর্মক্ষম মজদুরের উপস্থিতির চাপে সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত দরকষাকষির জোর কমতে থাকে, প্রকৃত মজুরির হারও কমতে থাকে।
নয়া-উদারবাদে একদিকে যেমন কৃষক-খেতমজুর ও ছোট উৎপাদকরা ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হয় তেমনই আরেকদিকে অর্জিত অধিকার ধরে রাখতে বাধার সম্মুখীন হয় সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতরা। এই দ্বিবিধ কৌশলে কার্যত সারা দেশেই শ্রমজীবী জনসাধারণের মাথা পিছু প্রকৃত আয়ের গড় ক্রমশ কমতে থাকে। আর তাই, জিডিপি বৃদ্ধির হারে অভূতপূর্ব উন্নতির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সময়তেই সার্বিক দারিদ্র্যও সমানুপাতে বেড়ে চলে। অনেক কষ্ট করে ১৯৮০ সালের শেষ দিকে মাথা পিছু খাদ্যশস্যের পরিমাণ যেখানে নিয়ে যাওয়া গেছিল সেখানেই আটকে থাকে। জাতীয় নমুনা সংগ্রহের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৩-৯৪ সালে গ্রামীণ ভারতে ৫৮ শতাংশই দৈনিক ন্যুনতম ২২০০ ক্যালোরি যুক্ত খাবার পেত না, ২০১১-১২ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ শতাংশে। ঠিক এর পরের জাতীয় পরিস্থিতির পরিসংখ্যান সামনে আসে ২০১৭-১৮ পর্বে (এযাবৎ কালে দেশের সবচাইতে ভয়ানক চিত্রটি ফুটে ওঠে এই পরিসংখ্যানেই), যখন প্রকৃত ব্যয়ের মাথা পিছু হার প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে বলে জানাজানি হয়ে যায়। সেই পরিসংখ্যানের ধাক্কায় মোদী সরকার জাতীয় নমুনা সংগ্রহের কাজের পদ্ধতিটিকেই আমুল পাল্টে দেয়। ঐ পরিসংখ্যানেই উল্লিখিত ছিল ২০১১-১২ সালে শহরাঞ্চলে দৈনিক ন্যুনতম ২১০০ ক্যালোরি যুক্ত খাবার পান না অন্তত ৬৫ শতাংশ মানুষ, ১৯৯৩-৯৪ সালে সেই অবস্থা ছিল ৫৭ শতাংশের।
ট্রিকল ডাউন এফেক্টের মতো জঘন্য প্রতিপাদ্যের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে নয়া-উদারবাদ নিজের সমৃদ্ধিতে শীর্ষে ওঠে ঠিক সেই সময়তেই যখন শ্রমজীবী জনসাধারণের দুর্দশা অভূতপূর্ব অবস্থায় পৌঁছায়। এই অবস্থায় সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনও পথ দেখতে পাওয়া যায় না। সেই বিচারে এমন সংকট অনেকটাই অতর্কিত। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছিলাম নয়া উদারবাদে শ্রমজীবীদের মাথা পিছু প্রকৃত আয়ের গড় কমতে থাকে, যদিও ঐ একই সময়ে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। এর অভিঘাতে দুনিয়ার সর্বত্রই খুব দ্রুত হারে উদ্বৃত্ত আর্থিক সম্পত্তি বাড়তে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে আজকের ভারতেও জনজীবনের অর্থনৈতিক বৈষম্যে যে উৎকট চেহারা দেখা যাচ্ছে তার পিছনের কারণ এটাই। নয়া-উদারবাদই সেই অসাম্যের ভ্রূণ।
একজন ক্রেতার হাতে থাকা একটি টাকা (ভারতীয় মুল্য অনুযায়ী) ক্রমশ নিজের ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। শ্রমজীবীদের হাতে পড়লে সেই মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা আরও নিচে নামতে বাধ্য হচ্ছে। আয়ের হারে এমন অবনমনের ফলে ক্রমশই অধিক উৎপাদন জনিত সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। ইতিমধ্যেই বিশ্ব-অর্থনীতি লাগাতার স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত ফাটকা বাজারের বিরাট বুদবুদ ফেটে পড়ার পর থেকেই সেই স্থবিরতার শুরু। ঐ ফাটকা বাজার এমন একটা ভান করেছিল যেন অনেকেই বিশাল বিশাল সম্পত্তির অধিকারী, সেই দেখিয়ে বাজারে নকল চাহিদা তৈরি করা হয়েছিল। ফাটকা বাজার ধ্বসে পড়লে বোঝা যায় বেশিরভাগ মানুষ কার্যত দেউলিয়া। এরই প্রভাবে ভারতের বাজারেও মন্দার ভাব তৈরি হয়, যার ধাক্কায় একদিকে বেকারি আরকদিকে দুর্দশা দুইই বাড়ে। মোদী সরকার নোটবাতিল এবং জিএসটি লাগু করলে সেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। অবশ্য একথা ভুললে চলবে না যে জিএসটি সংক্রান্ত আইনকানুন প্রণয়নের কাজ পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলেই শুরু হয়েছিল।
নয়া-উদারবাদে এই সংকট মোকাবিলার কোনও উপায় নেই। একমাত্র পথ হল সরকারী ব্য্যবরাদ্দ বাড়িয়ে চলা। সেই পথেও তখনই চলা চম্ভব হবে যদি জরুরী অর্থের সংস্থানে দেশীয় অতি ধনীদের উপরে বাড়তি কর চাপানো হয় অথবা সরকার রাজকোষীয় ঘাটতি স্বীকার করে নেয়- তবেই। এর অন্যথায় যদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শ্রমজীবীদের উপরেই কর ছাপিয়ে দেওয়া হয় তবে যারা ইতিমধ্যেই নিজেদের সমস্ত আয়টুকুই খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন সেই জনসাধারণ নিজেদের চাহিদাকে বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে ঘোরাফেরা করাতে বাধ্য হবেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হলেও এমন পদ্ধতিতে বাজারে সার্বিক চাহিদার চিত্রে খুব একটা বদল আদৌ ঘটবে না। রাজকোষীয় ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি কিংবা অতি-ধনীদের বাড়তি করের আওতায় নিয়ে আসার মতো দুটি কর্মসুচিই নয়া-উদারবাদের ঘোরতর অপছন্দের তালিকাভুক্ত। সরকারী নীতি হিসাবে নয়া-উদারবাদকে বজায় রেখেই যদি এমন কিছু করার চেষ্টা হয় তবে তৎক্ষণাৎ পুঁজি ভারতের বাজার ছেড়ে চলে যাবে- তখন লগ্নীর বাজারে তীব্র সংকট তৈরি হবে।
নয়া-উদারবাদ এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে কি করে? তারা ধনীদের আরও বেশি করে কর ছাড় দেওয়ার বন্দোবস্ত করে, যুক্তি হাজির করা হয় এতে ধনীরা আরও বেশি লগ্নীতে উৎসাহী হবেন। এমন কর ছাড় দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ছাড় বাবদ প্রাপ্ত বিপুল অর্থ নিজেদের পকেটে পুরে পুঁজিবাদীরা একটি পয়সাও লগ্নীতে খরচ করেন না। তাদের এমন ব্যবহারের কারণ বাজারে চাহিদার অভাব, অথচ কেউই উচ্চারণ করেন না ধনীদের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে বলেই সেই অভাব বেড়েছে।
এমন সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসাবে মহামারিকে খাড়া করার কোন কারণ নেই। মহামারী আগে থেকেই এই সংকটের শুরু। মহামারীর অবদান এটুকুই যে তার প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত সামনে এসেছে। এর মোকাবিলা করতে গেলে আমাদের দেশকে নয়া-উদারবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যাতে তেমন কিছু না হয় সেই উদ্দেশ্যেই নয়া উদারবাদ আমাদের দেশে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচির সাথে হাত মিলিয়েছে। এই আঁতাতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই হল জনজীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলি থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিয়ে অতীত কিংবা সাম্প্রতিক কোন অনভিপ্রেত ঘটনার ছুতো তুলে কোলাহল বাধিয়ে চলা। সেই লক্ষ্যেই এরা সংখ্যালঘুদের নিশানা করেছে। জনজীবনের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার প্রশ্নকে গুলিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে একে অন্যকে দোষ দেওয়ার রাজনীতি করা হচ্ছে, সেই কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে স্বাম্প্রদায়িক ঘৃণা। সেই গোলমালের সুযোগে দেশী-বিদেশী বৃহৎ পুঁজি আমাদের জাতীয় সম্পদগুলি একের পর এক দখল করে চলেছে। আমাদের দেশের যাবতীয় খনিজ সম্পদ, বিনিয়োগের বিশাল বাজার, সম্পদশালী পাবলিক সেক্টর থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উৎপাদনক্ষেত্রগুলিকেও কব্জা করছে তারা।
মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে এবং সরাসরি বিপুল আর্থিক সাহায্য মারফত বৃহৎ পূঁজি আমাদের দেশে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। এই সরকারের পিছনে তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দেশের মসনদে বদিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বৃহৎ পুঁজি ভারতে সম্পদ লুঠের আদিম কৌশল অবলম্বনের অনুমতি আদায় করেছে। এর বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করছেন তাদের উপরে ব্যাপক আক্রমন নামিয়ে আনা হচ্ছে, জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেই সেই আক্রমনের কৌশল কার্যকর হচ্ছে।
নয়া-উদারবাদ নিজের সুদিনেই জনগণের উপরে চরমতম দুর্দশা চাপিয়ে দেয়। তাই আজকের ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্যের উৎকট চেহারায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। লুটেরা কর্মসূচীর পথ পরিস্কার রাখতে এই ব্যবস্থা যে কোন দেশের গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তটিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, দেশের বুকে চরম দারিদ্র্য নামিয়ে আনে। যদিও শেষ অবধি নয়া-উদারনীতি কিছুতেই বেকারি সমস্যার সমাধান করতে পারে না, চাহিদার বাজারে স্থায়ীভাবে অভাব চেপে বসে। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে উদ্ভূত জনরোষ মোকাবিলায় আসরে নামে নয়া-ফ্যাসিবাদ। এর মোকাবিলায় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমুহের জোট নির্মাণ জরুরী কাজ হলেও কেবলমাত্র সেই জোট করেই নয়া-ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়া যায় না। নয়া-ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হলে তার পিছনের কারণটিকেও নির্মূল করে দিতে হয়। নয়া-ফ্যাসিবাদের ভিত হল নয়া-উদারবাদ জনিত সংকটের পরিস্থিতি। এই কাজ সহজ নয়, নয়া-ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার লক্ষ্যে সফল হতে দেশের শ্রমজীবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকতম ঐক্য নির্মাণ করতে হবে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া