ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট, সুকন্যা সমৃদ্ধি অ্যাকাউন্ট স্কীম, কিষান বিকাশ পত্র এবং সিনিয়র সিটিজেন্স সেভিংস স্কীম – এই সবগুলিই হল ভারত সরকারের স্মল সেভিংস স্কীমের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রকল্প। দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের পরিশ্রমের রোজগার থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে এই প্রকল্পগুলির সাহায্যে নিজেদের ভবিষ্যৎের লক্ষ্যে তহবিল গড়ে তোলেন। কাজ থেকে বয়সকালীন অথবা দুর্ঘটনাজনিত অবসর কিংবা কোন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এধরনের তহবিলই হল মানুষের আশা ভরসা। খুব স্বাভাবিক, এমন তহবিলগুলিতে প্রাপ্য সুদের হার পরিবর্তন হোক মানুষ চান – কিন্তু সেই পরিবর্তনকে অবশ্যই জনস্বার্থে সময়োপযোগী হতে হয়। মূল্যবৃদ্ধি, আকাশছোঁয়া পেট্রোপন্যের দাম এবং গত বছরে দেশজোড়া লকডাউনে অর্থনীতির ক্রমান্বয়ী অধোগতি এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে মানুষের প্রয়োজন পণ্য কেনার ক্ষমতা ধরে রাখা। সরকারের নিজস্ব প্রতিবেদনেই বারে বারে স্পষ্ট হয়েছে বাজারের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এমনটা হয় উৎপাদনে সংকট দেখা দিলে অথবা বাজারে পণ্য কেনার চাহিদায় ঘাটতি হলে তখন। ভারতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই ঘটেছে।
লকডাউনের সময় আয়কর সীমার বাইরে থাকা মানুষের হাতে প্রতি মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা পৌঁছানোর দাবী সেই কারনেই করা হয়, যদিও সরকার সেই দাবীতে কর্ণপাত করেনি। দাবির বিপরীত রাস্তায় নেমে যারা লকডাউনের অজুহাতে শ্রমিক – কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে সেই কর্পোরেট মালিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বিপুল অংকের করছাড়ের ঘোষণা করেছে। সরকারী সিদ্ধান্তে সারা দেশে বিশাল সংখ্যায় শ্রমজীবী মানুষ রোজগারহীন হলেন – আয় এবং আশ্রয়হীন হয়ে বেঁচে থাকার কারনে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে পণ্য কেনার চাহিদায় ঘাটতি দেখা দিল অথচ বাজারের অবস্থা খারাপ হবার অজুহাত দেখিয়ে যারা পণ্য উৎপাদনের মালিক তাদেরকে আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হল! সারা দেশ যখন আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে তখন কিন্তু কর্পোরেট – মালিকদের মুনাফা অনেকটাই বেড়েছে। উৎপাদন বন্ধ রেখে উৎপাদনের কাজে গড় খরচ (অ্যাভারেজ অপারেটিং কস্ট), মজুরি – বেতনের খরচ (কস্ট অন ওয়েজেস) কোনটাই না হওয়ায় ইতিমধ্যে উৎপাদিত পণ্যের ভান্ডার (ইনভেন্ট্রি) থেকে শুধু বিক্রি করেই তাদের মুনাফা বৃদ্ধি হয়েছে বহুগুণ। এমন অমানবিক এবং অস্বাভাবিক প্রকরণের নামই দেওয়া হয়েছে আধুনিক অর্থশাস্ত্র!
প্রয়োজন ছিল বাজারে পণ্যের চাহিদা ঠিক রাখতে রোজগার হারিয়েছেন যারা তাদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেবার, অন্তত যতদিন না তারা পুনরায় আগের রোজগারের অবস্থায় কিংবা ন্যুনতম ভরসাযোগ্য রোজগারে পুনঃস্থাপিত হতে পারছেন। এমন করা হলে বাজারে মন্দার প্রভাব কমে যেত, লকডাউন প্রত্যাহারের পরে উৎপাদন চালু হলে চাহিদা বাড়ত এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হত। সেই দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সেই জনগণের প্রতি নিজেদের দায় অস্বীকার করলেন যাদের ভোটে স্বয়ং সরকার নির্বাচিত হয়। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি রোধে এই সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, অথচ কৃষকদের আন্দোলনে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের দাবিকে তারা মানতে চাইছেন না যেটা মেনে নিলে খাদ্যশস্যে ফাটকা বাণিজ্য আটকানো যাবে। বেঁচে থাকার ন্যুনতম শর্ত হিসাবে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বাসস্থান একটা ক্ষেত্রেও সরকারের কোনরকম কল্যাণকারী ভুমিকা থাকবে না অথচ কর আদায়ের সময় (এমনকি কর বাড়িয়ে দেওয়ার সময়েও) সরকারের অধিকারের প্রসঙ্গ, রাষ্ট্র পরিচালনার খরচের প্রসঙ্গ একই গুরুত্বের সুচকে রয়ে যাবে এমন একটা উৎকট রাজনৈতিক সংকট আজ আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ঘোষণা করেছে অর্থনীতি প্রসঙ্গে তাদের একটাই সিদ্ধান্ত – রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা এবং যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সম্পদকে বেসরকারি হাতে বিক্রি করে দেওয়া। এতে কাজের বাজারে আরও বেশী অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, বিশাল বেকারবাহিনীর চাপ তৈরি হবে – কম পয়সায় খাটিয়ে নেওয়ার পরিসর আরও বাড়বে ফলে বেলাগাম মুনাফা এবং শোষণের লক্ষ্যে লালায়িত হয়ে এদেশে লগ্নী করার নামে মুনাফা করতে ছুটে আসবে কর্পোরেট পুঁজি – শ্রমিকদের কোন অধিকার থাকবে না শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার (এই প্রসঙ্গে নয়া শ্রম আইনসমূহ মনে রাখতে হবে)। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একটা সরকার কতিপয় ব্যাক্তি মালিকানার সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে। এই হল “লুক ফর ইস্ট” স্লোগানের আড়ালে মোদী সরকারের রাজনৈতিক অর্থনীতি। কম মজুরিতে খাটিয়ে অধিক মুনাফা কামানোর বর্বর লক্ষ্যে পুঁজিবাদ চিরকালই এমন ধান্দার খোঁজে কাজ করেছে, যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের ভূমিকা সেই কারনেই প্রাসঙ্গিক। সরকার আসলে মুনাফা এবং জনস্বার্থের মধ্যে কেটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার এমন একটি সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে যারা আগাগোড়া পূঁজির স্বার্থে এতটাই নিবেদিতপ্রাণ যে আজ অবধি নেহাত ভুল করেও তারা একটি জনস্বার্থবাহী পদক্ষেপ নিতে পারে নি, শুধুই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে গুরু মেনে আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে গেছে।
গত ৩১শে মার্চ সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় – দেখা যায় সমস্ত স্মল সেভিংস স্কীমের ক্ষেত্রেই সরকার দেয় সুদের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন এই আর্থিক পর্বে বিভিন্ন ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে ৪০ বেসিস পয়েন্ট (০.৫ শতাংশ) থেকে ১১০ বেসিস পয়েন্ট ( ১.১ শতাংশ) অবধি কমিয়ে দেবার ঘোষণা ঐ বিজ্ঞপ্তিতে ছিল। দেয় সুদের হার সবচেয়ে বেশী কমানো হয়েছিল এক বছরের জন্য প্রযোজ্য আমানতের ক্ষেত্রে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্বে এক বছরের আমানতে সুদের হার ধার্য ছিল ৫.৫ শতাংশ – তাকে একধাক্কায় ৪.৪ শতাংশ করার কথা বলা হয়। সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস স্কীমে সুদের হার ৭.৪ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশে পরিণত করা হয়। ‘বেটি বচাও – বেটি পড়াও’ স্লোগান দেওয়া সরকার সুকন্যা সমৃদ্ধি অ্যাকাউন্ট স্কীমে দেয় সুদের হার ৭.৬ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনে ৬.৯ শতাংশে। পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের ক্ষেত্রে সুদের হার ঘোষিত হয় ৭.১ শতাংশ, জানুয়ারি – মার্চ’২১-এ এই হার ছিল ৭.৯ শতাংশ।
নিচে সেই সরকারি বিজ্ঞপ্তির ফটো দেওয়া হল –
পরেরদিন ১লা এপ্রিল সকালেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ঐ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার সংক্রান্ত আগেরদিনের বিজ্ঞপ্তিটি খারিজ করা হল। এই কথাও বলা হয় যে ঐ বিজ্ঞপ্তিটি অনবধানতার কারনে জারী হয়েছে (Orders issued by oversight shall be withdrawn) । ২০১৪ সালের পর থেকে মোদী সরকারের কাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এমন অনবধানতা (Oversight) আদৌ অনিচ্ছাকৃত নয়, বরং একশো শতাংশই রাজনৈতিক। সরকার ব্যবসা করবে না বলে ভাষণ দিয়ে তারাই যে বেসরকারি পুঁজি এবং মুনাফার সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা একথা আজ স্পষ্ট।
সরকারী ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সুদ কমলে কি হয়? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় জনসাধারণ সরকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে অধিক সুদের ফাঁদে পড়ে বেসরকারি বিভিন্ন ফান্ডে (চিট ফান্ড যার মধ্যে অন্যতম) আমানত জমা করবেন। সেই সব বেসরকারি হাতে আমানত কতদূর সুরক্ষিত তা সবার জানা। আমাদের রাজ্যেই সারদা কেলেঙ্কারির সাম্প্রতিক উদাহরণ রয়েছে। বাজারে সংকট, বহু কর্পোরেট সংস্থা সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়ে গেছে – এই অবস্থায় জনসাধারনের সঞ্চিত অর্থকে ঘুরপথে বাজারে পূঁজির যোগান হিসাবে পরিণত করতে চাইছে মোদী সরকার। সারা দেশে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলছে – এই অবস্থায় এমন বিজ্ঞপ্তি ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনরোষের জন্ম দেবে এটুকু বুঝতে মোদী সরকার অনবধানের ভুল করতেই পারে না। জনসাধারনের অর্থকে বিভিন্ন পন্থায় কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া যাদের ধারাবাহিক কর্মসূচী সেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত পুনরায় কার্যকরী করতে পারে এই কথা সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে, নির্বাচনের সময় বলেই এমন সন্দেহ আরও বেশী কার্যকর।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ