ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের ২০২তম জন্মবার্ষিকীতে রাজ্য ওয়েবডেস্কের প্রক্ষে প্রকাশিত নিবন্ধ
সৌভিক ঘোষ
মানুষ আর পশুর মধ্যেকার শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যের আলোচনা জীবনবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়, সামাজিক জীবন নির্মাণ করেছিল যে মানুষ- তাকে আবর্ত করেই এই লেখার প্রসঙ্গ সীমিত।
পশুর সাথে আমাদের যাবতীয় ফারাকের অন্যতম একটি হল এই যে সহজ কথায় ‘ঘর’ বলতে যা বোঝায় সেসব কিছু পশুও বানায়- মানুষ শুধু ঘর বানায় না, ‘মানুষ ঘর বাঁধে’। শব্দার্থের বদলে বুৎপত্তির দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে সমাজবদ্ধ মানুষের সমাজে সেই ‘বাঁধা ঘর’ সকলের কেন, যেমনটা দরকার তা অনেকেরই নেই। বস্তিতে বসতি নির্মাণ করে সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষ যেভাবে বেঁচে থাকেন বা বলা চলে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন তাকে ‘ঘর’ গোছের আদৌ কিছু বলা চলে কিনা এটাই ভাবার বিষয়।
বস্তির ঘিঞ্জি-অপরিচ্ছন্ন গলিঘুঁজিতে মেহনতি মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করেন তা নিয়ে বুর্জোয়াদের নাকি বিশেষ মাথাব্যাথা আছে। আজ বলে নয়, সেই চিন্তায় যে উনবিংশ শতক থেকেই তাদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে চলেছে একথা তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে-
‘…ভালো বাসগৃহ এতই ব্যয়সাধ্য যে অধিকাংশ শ্রমিকের পক্ষে তা ভোগ করা একান্তই অসম্ভব । বৃহৎ পুঁজি… মেহনতী শ্রেণীর জন্য বাসগৃহ নির্মাণে লগ্নি করতে কুণ্ঠিত… ফলে এই শ্রেণীগুলি তাদের বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফাটকাবাজদের শিকারে পরিণত হয়।’
১৮৬৯ সালে জার্মানি থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘ভল্কস্ট্যাট’-র চিঠিপত্র বিভাগে উপরের কথাগুলি লিখেছিলেন ডক্টর এমিল জাক্স।
ডক্টর জাক্স সর্বহারা শ্রমজীবীদের জন্য উপযুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বাসস্থান (মানুষের জন্য যেমনটি হওয়া দরকার) সম্পর্কে বিশেষ উদ্বেগের ভাব দেখান, পরে এহেন বিভীষিকা প্রসঙ্গে সমাধান সুত্র দিতে গিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব করেন। সেইসব ‘ছাইপাঁশ’ মতামত কিভাবে ভল্কস্ট্যাট পত্রিকার সম্পাদকের নজর এড়িয়ে গেল একথা জানিয়ে পত্রিকার দপ্তরে চিঠি লেখেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস।
তখন পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস’কে এই প্রসঙ্গে নিজস্ব মন্তব্য ধারাবাহিক প্রবন্ধের চেহারায় প্রকাশ করার অনুরোধ জানানো হয়।
ডক্টর জাক্স যা লিখেছিলেন তার সারাংশ করতে গেলে দাঁড়ায় সর্বহারা শ্রেণীর জন্য উপযুক্ত বাসগৃহ কেন যে নেই তা আসলে এক রহস্য। আসলে এ হল ইতিহাস ও অর্থনীতির প্রসঙ্গ। বুর্জোয়া সমাজে পণ্ডিতেরা (বুর্জোয়া তাত্ত্বিক অর্থে পণ্ডিত যারা) এহেন বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন, কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে চান, কেনই বা তারা একে সামাজিক সমস্যা মনে করেন এইসব নিয়েই ১৮৭২ সালে ভল্কস্ট্যাট পত্রিকায় কলম ধরলেন এঙ্গেলস।
তার সেই রচনাই এ লেখার মূল ভিত্তি।
ঐ সময় জার্মানিতে হঠাৎ গরীব মানুষের ঘর থাকা না থাকা প্রসঙ্গে এত আলোচনা শুরু হল কেন? এঙ্গেলসের বলছেন- ‘পরোক্ষভাবে হলেও, বড় বুর্জোয়াদেরও এ ব্যাপারে খুব আগ্রহ আছে। আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, শহরগুলি মাঝে মাঝেই যে মহামারীর আক্রমণে জর্জরিত হয়, তার সব কটারই জন্মস্থান হল সেই তথাকথিত ‘দরিদ্র পাড়াগুলি’ যেখানে শ্রমিকেরা গাদাগাদি করে বাস করে। কলেরা, টাইফাস, টাইফয়েড জ্বরে, বসন্ত ইত্যাদি সর্বনেশে রোগগুলি শ্রমিক শ্রেণীর এইসব এলাকার সংক্রামক বাতাসে এবং বিষাক্ত জলেই তাদের রোগবীজানু ছড়ায়। সেখানে এ বীজাণুগুলি প্রায় কখনই সম্পূর্ণ মরে না, সুযোগ পেলেই মহামারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং নিজেদের জন্মস্থান অতিক্রম করে পুঁজিপতিদের অধ্যূষিত শহরের অধিকতর আলো হাওয়াযুক্ত ও স্বাস্থ্যকর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মহামারীর উদ্ভব হওয়ার তৃপ্তিটুকু পুঁজিবাদী শাসনের পক্ষে বিনা শাস্তিতে উপভোগ করা সম্ভব নয়, তার ফলাফল ভোগ করতে হয় পুঁজিপতিদেরও, এবং যেমন মজুরদের মধ্যে তেমনই এদের ভিতরেও যমদূত সমান নির্মমভাবেই অবাধ বিচরণ করে।
এই তথ্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতেই বুর্জোয়া মানবহিতৈষীরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে মহানুভবতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উদ্দীপিত হয়ে পড়েছেন। পৌনঃপুনিক মহামারীর উৎস নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বহুবিধ সমিতি সংগঠিত হয়েছে, পুস্তক লিখিত হয়েছে, রচিত হয়েছে প্রস্তাব, আলোচিত ও গৃহীত হয়েছে আইন। শ্রমিকদের বসবাসের অবস্থা সম্বন্ধে তদন্ত করা হয়েছে এবং চেষ্টা হয়েছে চরমতম দুর্দশার প্রতিবিধান করার। বড় বড় শহরের সংখ্যা ইংলন্ডে সর্বাধিক, সুতরাং বিপদের আশঙ্কাটাও এখানকার বুর্জোয়াদেরই সব থেকে বেশী; তাই এখানেই বিশেষ করে ব্যাপক কার্যকলাপ শত্রু হল। শ্রমিক শ্রেণীর স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে তদন্তের জন্য নিযুক্ত হল একাধিক সরকারী কমিশন। এইসকল কমিশনের রিপোর্ট ইউরোপ- মহাদেশীয় সকল তথ্যসংগ্রহের তুলনায় যথার্থতা, সমগ্রতা এবং নিরপেক্ষতার দিক থেকে অনেক বেশী সম্মানজনক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নতুন নতুন, কমবেশী আমূল সব আইনের ভিত্তি জোগায়। দোষত্রুটি থাকলেও, আজ পর্যন্ত মহাদেশে এই ধরনের যা কিছু করা হয়েছে, তার তুলনায় এসব আইন বহুগুণেই শ্রেষ্ঠ। এ সত্ত্বেও পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থা বারংবার প্রতিবিধেয় অমঙ্গলের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, এবং তা দিচ্ছে এমন অনিবার্য আবশ্যিকতায় যে ব্যাধি প্রতিবিধানের কাজ এমন কি ইংলণ্ডে প্রায় এক ধাপও এগোয়নি।
জার্মানিতে বরাবরের মতো এ ব্যাপারেও সেখানকার বারোমেসে সংক্রমণের উৎসগুলির পক্ষে মারাত্মক স্তরে পৌঁছে সেখানকার তন্দ্রালু, বড় বুর্জোয়াদের ঘুম ভাঙাতে অনেক বেশী সময় লাগল। কিন্তু যে ধীরে চলে, সে নিশ্চিত হয়েই চলে। সুতরাং আমাদের দেশেও শেষ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য ও বাস-সংস্থান সমস্যা সংক্রান্ত একটা বুর্জোয়া সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে, যা হল তার বিদেশী, বিশেষ করে ইংরেজ পূর্বসূরীদের একটা জোলো নির্যাস। অবশ্য তার মধ্যে গুরুগম্ভীর ও উচ্ছাসপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে উচ্চতর মননশীলতার ছাপ দেবার একটা শঠ প্রচেষ্টাও আছে।’
তাহলে বোঝা যাচ্ছে কোনোরকম মানবিক তাড়নায় অভিভূত হয়ে বুর্জোয়ারা গরীব মানুষের ঘর নিয়ে মাথা ঘামায় না। আত্মস্বার্থে বুঁদ থাকার মতো নিজেদের ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে মানানসই কারণটুকু আছে বলেই তারা এই নিয়ে ব্যস্ত হয়। সেই কারণটি আসলে কি? শিল্পাঞ্চলের বেড়ে চলা আসলে শ্রমিক শ্রেণিকে বাধ্য করে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে উপস্থিত হতে। অর্থাৎ ঘর ছেড়ে আসার প্রাথমিক কারণ সেটাই। বুর্জোয়াদের সাথে চুক্তিমাফিক নিজেদের শ্রমশক্তির বিনিময়ে পরিবারের দুবেলার অন্ন যোগাতেই তারা শহরে আসে। ঘড়ির কাঁটা ধরে হিসাব হয় কতক্ষণের শ্রমশক্তি কতটা মজুরি আয় করবে। সুতরাং বাকি সময়টা নেহাত রাস্তায় পড়ে থাকা যায় না বলেই তারা বসতির নামে বস্তি গড়ে থাকতে শুরু করে। শুরুর দিকে এমন বন্দোবস্তে বুর্জোয়াদের দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু ছিল না। যখন থেকে একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে শুরু করল, রাস্তার একধারে গজিয়ে ওঠা বস্তির অপরিচ্ছন্নতা প্রাকৃতিক নিয়মেই বস্তিবাসীদের পাশাপাশি বুর্জোয়াদের অন্দরমহলে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে দেয় তখনই আসরে নামেন ডক্টর জাক্সের মতো কিছু কলমবাজ যারা আশ্চর্য সমাধানসুত্রের নামে আসলে প্রতিপন্ন করেন জীবাণু বাহকের ভূমিকায় গরীব মানুষ আসলে কতটা অপরাধী। এই কারনেই গড়ে তোলা হয় জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো (আজকের দুনিয়ায় সেটুকুও বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে)। জনসাধারণের পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন প্রসঙ্গে পৌরসভা ও সংশ্লিষ্ট আইনানুগ বন্দোবস্তের শুরুও হয়েছিল তখন থেকেই। তাই মনে রাখতে হয় জনস্বাস্থ্য কোনও দয়ার দান নয়, কোনও খয়রাতি নয়- বরং একান্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিষেবা।
জনস্বাস্থ্যের মতো পরিষেবাকে দয়ার দান হিসাবে তুলে ধরে বস্তির নোংরা জীবনযাপনের জন্য বাধ্য থাকার আসল দায়টা বুর্জোয়ারা কৌশলে ঠেলে দেয় শ্রমিক শ্রেণির ঘাড়েই। এই লক্ষ্যে তাদের যুক্তি যদিও বহুবিধ। এঙ্গেলস নিজের লেখায় সেইসব যুক্তিকেই তুলোধোনা করেন। সার্বিক আলোচনায় তিনি বাসস্থানের সমস্যাকে তিনটি পর্বে আলোচনা করেছিলেন।
প্রথম পর্বে পিয়ের জোসেফ প্রুধোঁর মতামতকে বিশ্লেষণ করে এঙ্গেলস দেখালেন ঐতিহাসিক দিকে থেকে প্রুধোঁর মতামত ‘দারিদ্র্যের দর্শন’-র থেকে বেশি কিছু এগোয়নি। দর্শনের নামে নিজের বইতে লেখা প্রুধোঁর যাবতীয় মতামতকেই সেইবার কার্ল মার্কস চুরমার করে দিয়েছিলেন। প্রুধোঁর লেখা ‘দারিদ্র্যের দর্শন’-র বিরুদ্ধে মার্কস নিজের লেখার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘দর্শনের দারিদ্র’। তা সত্বেও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রুধোঁর প্রভাব ছিল। এঙ্গেলস বলছেন- ‘ফ্রান্সে প্রুধোঁপন্থীরা শ্রমিকদের মধ্যে সংকীর্ণ একটি গোষ্ঠী ছিল বটে, কিন্তু একমাত্র তাদেরই ছিল সুনির্দিষ্ট সূত্রবদ্ধ কর্মসূচী এবং তারা কমিউনের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব গ্রহণে সক্ষম হয়। বেলজিয়ামে ভালোন শ্রমিকদের মধ্যে প্রুধোঁবাদের ছিল এবছর আধিপতা; আর স্পেন ও ইতালিতে সামান্য দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম ছাড়া শ্রমিক আন্দোলনের সবকিছুই নৈরাজ্যবাদী না হলে নিশ্চিতভাবেই হত প্রুধোঁপন্থী। আর আজ? ফ্রান্সে প্রুধোঁ আজ শ্রমিকমহল থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্যুত। তাঁর সমর্থন বজায় আছে শুধু রাজিকাল বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের মধ্যে, যারা প্রুধোঁবাদী হিসাবে নিজেদের সমাজতন্ত্রী বললেও সমাজতন্ত্রী শ্রমিকেরা যাদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম চালাচ্ছে।
বেলজিয়মে ফ্লেমিশরা আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে ভালোনদের হঠিয়ে দিয়েছে, প্রুধোঁবাদকে স্থানচ্যুত করে আন্দোলনের মানকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলেছে। স্পেন ও ইতালিতে অষ্টম দশকের নৈরাজ্যবাদী জোয়ারে ভাঁটা পড়েছে এবং সেই টানে ঐ মতবাদের অবশিষ্টাংশকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ইতালিতে নতুন পার্টি এখনও বোধ-মছতা অর্জন ও সংগঠনের স্তরে থাকলেও, স্পেনে মাদ্রিদীয় নতেন ফেডারেশন’ নামে যে ক্ষুদ্র কেন্দ্রটি আন্তর্জাতিকের সাধারণ পরিষদের অনুগত ছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে এক শক্তিশালী দলে। তাদের পূর্বগামী হট্টগোলকারী নৈরাজ্যবাদীদের তুলনায় এই দল যে সাফল্যের সঙ্গে শ্রমিকদের উপর বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রীদের প্রভাব ধন করছে তা প্রজাতন্ত্রীদের কাগজপর থেকেই বুঝতে পারা যায়। লাটিন শ্রমিকদের মধ্যে দুধের বিস্মৃত রচনাবলীর স্থান অধিকার করেছে ‘পুঁজি’ আর ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ এবং মার্কসবাদী চিন্তাধারার অন্যান্য গ্রন্থ। একছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায় উন্নীত হয়ে প্রলেতারিয়েত গোটা সমাজের তরফে উৎপাদনের উপায়সমূহ দখল করবে – মার্কসের এই মূল দাবি বর্তমানে লাটিন দেশগুলিতেও সমগ্র বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আজ যখন শেষ পর্যন্ত লাটিন দেশগুলিতেও শ্রমিকদের মধ্য থেকে প্রুধোঁবাদ স্থানচ্যুত, সে মতবাদ যখন তার প্রকৃত ভবিতব্য অনুযায়ী বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া আকাঙ্খার প্রকাশ হিসাবে ফরাসী, স্পেনীয়, ইতালীয় ও বেলজিয়ান বুর্জোয়া ব্র্যাডিকালদের শুধু কাজে লাগছে, তখন আবার নতুন করে এই প্রসঙ্গের অবতারণা কেন? এই প্রবন্ধগুলি পুনর্মুদ্রণ করে গতায়ু বিরোধীর সঙ্গে নতুন সংঘাতের কারণ কী?
প্রথমত, কারণ এই যে, এই প্রবন্ধগুলি শুধুমাত্র প্রুধোঁ ও তাঁর জার্মান প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিতণ্ডাতেই সীমাবদ্ধ নয়। মার্কস ও আমার মধ্যে একটা শ্রমবিভাগ ছিল; মার্কস যাতে তাঁর মহান বুনিয়াদী গ্রন্থটি রচনার সময় পান, সেইজন্য আমার উপর দাবি ছিল বিভিন্ন সাময়িকীতে, বিশেষ করে বিরোধী মতের সঙ্গে সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমাদের মতামত পেশ করা। ফলে আমাকে অধিকাংশ সময়েই প্রধানত নানাধরনের মতের বিরোধিতা করে বিতর্কের মারফত আমাদের নিজস্ব মতবাদ পরিবেশন করতে হত। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রথম ও তৃতীয় ভাগে শুধু যে সমস্যাটি সম্বন্ধে প্রুধোঁবাদী চিন্তাধারার সমালোচনা করা হয়েছে তাই নয়, আমাদের নিজেদের চিন্তাধারাও উপস্থাপিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে প্রুধোঁ এতটা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যে তিনি শুধু নিঃশব্দে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে পারেন না। তত্ত্বগতভাবে খণ্ডিত এবং ব্যবহারিকভাবে পরিত্যক্ত হলেও প্রুধোঁর ঐতিহাসিক আকর্ষণ আজও অক্ষরা। আধুনিক সমাজতন্ত্রের যারা কিছুটা ঘটিয়ে দেখতে চান, এই আন্দোলনে অতিক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় থাকাটাও প্রয়োজন। প্রশ্নে তাঁর সমাজ সংস্কারের কার্যকর প্রস্তাবাবলী পেশ করার কয়েক বছর আগেই মার্কসের দারিদ্র্য প্রকাশিত হয়েছিল। প্রশ্নের বিনিময়-ব্যাংককে ভ্রুণাবস্থায় আবিষ্কার করে তার সমালোচনা ছাড়া মার্কস এই বইটিতে আর বেশী কিছু করতে পারেননি। এইদিক থেকে তাই আমার বইটি দুর্ভাগ্যবশত যথেষ্ট অসম্পূর্ণভাবে মার্কাসের রচনারই পরিপূরক স্বরূপ। মার্কস স্বয়ং এ কাজ করতে পারতেন অনেক ভালো এবং অনেক যুক্তিগ্রাহ্য রূপে। তাছাড়া শেষত, আজ এই মূহুর্তে অবধিও জার্মানিতে বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের সুর প্রতিনিধিত্ব বর্তমান। একদিকে রয়েছে ক্যাথিডার-সমাজতন্ত্র (katheder-socialism: উনিশ শতকের অষ্টম নবম দশকে উদ্ভূত বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের একটি ধারা। এই ধারার প্রবক্তারা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের মঞ্চ থেকে সমাজতন্ত্রের ভেক নিয়ে প্রচার করতেন বুর্জোয়া-উদারনৈতিক সংস্কারবাদ) ও নানা ধরনের মানবহিতৈষী যাদের কাছে শ্রমিকদের বাসগৃহের মালিকে পরিণত করার আকাঙ্খাটা এখনো প্রভাবশালী, তাই এদের বিরুদ্ধে আমার রচনা এখনও সময়োপযোগী।
অন্যদিকে, সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক পার্টির মধ্যেই, এমন কি রাইখস্টাগ গ্রুপের মধ্যেও একধরনের পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব আছে। ব্যাপারটা এই রকম- আধুনিক সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদি মতামত এবং উৎপাদনের সমগ্র উপায়গুলি সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করার দাবিকে ন্যায্য বলে স্বীকার করলেও, এই লক্ষ্য কেবল সুন্দর ভবিষ্যতেই বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব বলে ঘোষণা করা হয় যে ভবিষ্যৎ কার্যত দৃষ্টির অগোচরে। সুতরাং বর্তমানে নিতান্ত সামাজিক জোড়াতালির শরণাপন্নই হতে হবে, এমন কি অবস্থা বিশেষে মেহনতী শ্রেণীর উন্নয়নের জন্যে অতীব প্রতিক্রিয়াশীল প্রচেষ্টার প্রতিও সহানভূতি দেখানো সম্ভব। প্রধানত পেটি চা বুর্জোয়া দেশ জার্মানিতে এই প্রবণতার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অবশ্যম্ভাবী, বিশেষ করে যখন শিল্পের বিকাশের ফলে সবলে ও ব্যাপকভাবে এই পুরাতন ও বদ্ধমূল পেটি বুর্জোয়ার মূলোচ্ছেদ ঘটছে। বিশেষ করে গত আট বছর যাবৎ সমাজতন্ত্র-বিরোধী আইন, পুলিশ ও আদালতের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের শ্রমিকেরা যে আশ্চর্য সহজরি চমৎকার পরিচয় দিয়েছে, তার ফলে এই প্রবণতা অবশ্য আন্দোলনের ক্ষতি করতে পারবে না। তত্ত্বও এই ঝোঁক যে বিদ্যমান তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ঝোঁকটা পরবর্তীকালে যদি আরও দৃঢ় রূপ ও সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করে এবং তা অনিবার্য, এমন কি কাম্যও বটে – তাহলে তাকে কর্মসূচী সূত্রবদ্ধ করার জন্য পূর্বগামীদের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তা করতে গেলে প্রুধোঁকে এড়ানো হবে প্রায় অসম্ভব’।
কার্যত সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা যেমনটা শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে থাকতে হয় তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রুধোঁর সুবিধাবাদী মতবাদের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করে দিলেন এঙ্গেলস। যদিও এই কাজ করতে তিনি প্রুধোঁর ভূমিকার অমর্যাদা করেননি। সমালোচনার নামে খেউড় করার যে সংস্কৃতি সাধারণত পন্ডিতমন্যতার প্রমাণ বলে আমাদের বোঝানো হয়, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস সেই রুচিতে অভ্যস্ত কেউ না। এও মনে রাখার মতোই বিষয়।
দ্বিতীয় পর্বে তিনি অর্থশাস্ত্রের নামে যাবতীয় বুর্জোয়া আদর্শের মুখোশ খুলে দেন। অর্থশাস্ত্রীয় বাস্তবতার অজুহাতে কার্যত নিজেদের সমস্ত দায়-দায়িত্বকেই অস্বীকার করে বুর্জোয়ারা। আসলে বুর্জোয়া সমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে পুঁজি বনাম শ্রমের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের উপরে ভর করে। আর তাই সেই মৌলিক সত্যকে চেপে রাখতে বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা যাবতীয় সামাজিক সমস্যার সমাধানেই পুঁজির মালিকানাকে অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। ঐ কায়দায় তারা দেখাতে চান সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির উপরে ঘটে চলা শোষণ, নিপীড়নের শিকড় আসলে যোগ্যতার প্রশ্নের সাথে, জ্ঞানের পরিমানের সাথে এবং শেষ অবধি পুঁজির মালিকানা দখলে রাখতে না পারার ফলাফলেই নিহিত। অর্থাৎ পুঁজি ও উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণের উপরে বুর্জোয়ারা যেভাবে নিজেদের দখল কায়েম রেখেছে সেটা দোষেগুণে ন্যায্যই, ব্যাপারটা কেউ পেরেছে আর কেউ পারেনি, এটুকুই আসলে কথা। সেই উদ্দেশ্যেই যেকোনো সামাজিক ব্যবধান, বেঁচে থাকতে জরুরী উপকরণে ভোগদখলের বিভিন্নতা ইত্যাদির ব্যখ্যায় তারা পুঁজির বিনিয়োগ হতে ইচ্ছা আছে বা নেই বলে যুক্তি হাজির করে। সামাজিক জীবনে ভোগদখলের যে ফারাক, জীবনযাপনের ইতরাবস্থা মেনে নিতে সর্বহারাদের যে নির্মম বাধ্যবাধকতা সেইসবের মূল কারণটি পিছনেই পড়ে থাকে।
আর তাই এঙ্গেলস অসাম্যের গোড়ায় থাকা সত্যের প্রসঙ্গ দিয়েই আলোচনা শুরু করেন। বাসস্থানের সমস্যাটা আসে কেন? শ্রমিকরা কি ভালোভাবে বাঁচতে চায় না? তারা কি সুযোগের সদ্ব্যবহার (বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের অতি পছন্দের শব্দ) না করে পয়সা উড়িয়ে ফেলে? বেঁচে থাকতে একটা উপযুক্ত ঘর যে লাগে সেটুকু কি তারা জানে না? ঠিক এখান থেকেই দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয়, শেষ হয় ডক্টর এমিল জাক্সের মতো বুদ্ধিজীবীদের ছাইপাঁশ মতামতকে খণ্ড-খণ্ড করে।
এঙ্গেলস লিখছেন- ‘আধুনিক শ্রমিকের পক্ষে বাড়ি এবং জমির মালিকানা যে কী আশীর্বাদ, তার গৌরবোজ্জল চিত্র এখানেই দেখা যাবে। জার্মান গহশিল্পে যে কুখ্যাত নিচু হারে মজুরি দেওয়া হয়, আর কোথায়ও, এমন কি সম্ভবত আইরিশ গৃহশিল্পেও, তা দেখা যায় না। শ্রমিকদের পরিবার নিজস্ব ক্ষুদ্র বাগান বা ক্ষেত থেকে যেটুকু আয় করে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে পুঁজিপতিরা শ্রমশক্তির দাম থেকে সেটুকু কেটে নিতে সক্ষম হয়। যে ফুরন মজুরি দিতে চাওয়া হয়, শ্রমিকেরা তাই গ্রহণ করতে বাধ্য, কেন না অন্যথায় তারা কিছুই পাবে না আর শুধু কৃষির উৎপাদন দিয়ে তারা বাঁচতে পারে না; আবার অন্যদিকে এই কৃষি ও জমির মালিকানাই তাদের এক জায়গায় শৃঙ্খলিত করে রাখে, অন্য কোন কাজের সন্ধানে তাদের ইতস্তত ঘোরাফেরার পথ রাখে বন্ধ করে। এক গাদা ছোটখাট জিনিসে বিশ্ববাজারে জার্মানির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সামর্থ্যের ভিত্তি এখানেই। মুনাফার সবটাই হল স্বাভাবিক মজুরি থেকে কেটে নেওয়া একটি অংশ এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের সবটাই ক্রেতাকে উপঢৌকন দেওয়া যায়। জার্মানির অধিকাংশ রপ্তানির অসাধারণ সুলভ মূল্যের এই হল গূঢ় কারণ।
অন্যান্য শিল্পে নিযুক্ত জার্মান শ্রমিকদেরও মজুরি এবং জীবিকার মান যে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় নিম্নতর, তার জন্য অন্য যে কোন কারণ অপেক্ষা এই পরিস্থিতিই অধিকতর পরিমাণে দায়ী। শ্রমশক্তির মূল্যের অনেক নিচে চিরাচরিত ভাবে দাবিয়ে রাখা শ্রমের এই বাজারদরের জগদ্দল বোঝা শহুরে শ্রমিকদের, এমন কি, মহানগরীর শ্রমিকদেরও মজুরিকে শ্রমশক্তির মূল্যের নিচে নামিয়ে দেয়; এইরকম ঘটবার আরও একটা বড় কারণ হল এই যে, নিম্ন মজুরির গৃহশিল্প শহরাঞ্চলেও প্রাচীন হস্তশিল্পের স্থান দখল করেছে এবং এক্ষেত্রেও মজুরির সাধারণ হারকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।
এইখানেই আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে, কৃষি ও শিল্পের সম্মিলন, বড়, বাগান ও ক্ষেতের মালিকানা এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা, ইতিহাসের পূর্বতন স্তরে যা শ্রমিকদের আপেক্ষিক সচ্ছলতার ভিত্তি ছিল, তাই আজ বৃহদায়তন শিল্পের আধিপত্যের যুগে শ্রমিকটির পক্ষে শুধু জঘন্যতম বাধা মাত্র নয়, গোটা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষেই এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিদারণ অভিশাপ, মজুরিকে তার স্বাভাবিক মানের অনেক নিচে নামিয়ে রাখার ভিত্তি এবং তা শব্দে কোন বিচ্ছিন্ন জেলায় বা শিল্পে নয়, সমগ্র দেশেই। এই রকম অবাভাবিকভাবে মরে কেটে যারা বেঁচে থাকে এবং তা থেকে ধনী হয়, সেই বড় বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়ারা যে গ্রামীণ শিল্প ও শ্রমিকদের নিজস্ব বাড়ির মালিকানা সম্বন্ধে উৎসাহী হবে, তারা নতুন গৃহশিল্প প্রবর্তনকেই পল্লীজীবনের সকল দুর্দশার একমাত্র প্রতিষেধ হিসাবে গণ্য করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!’
সুতরাং পুঁজি মানে ঠিক কি এই প্রশ্নে কোনোরকম ধোঁয়াশা থাকলে চলে না। পুঁজি হল অবৈতনিক শ্রমের উপরে চেপে বসা কর্তৃত্ব। সোজা কথায় অন্যের গতর যতটা খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাকে সেই তুলনায় কম মজুরি নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ডক্টর এমিল জাক্স আসলে কি করতে চেয়েছিলেন? নিজেদের অপরাধ ঢাকতে সেই ভুল বুর্জোয়াদের আজও হয়, তাদের স্বার্থরক্ষাকারী বুদ্ধিজীবীদের হয়, এমনকি লিবারাল ডেমোক্র্যাটদেরও কখনো এই রোগে ধরে। সেই অসুখের নাম হল শ্রমজীবীদের নীতিজ্ঞান শেখানোর ইচ্ছা। একে তো শ্রমিকেরা কেন ঘরছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে সেই ঐতিহাসিক সত্যকে এরা অস্বীকার করেন, দুই সর্বহারারা আদৌ উপযুক্ত কায়দায় বাঁচতে জানে না বলে ভেবে নিয়ে এনারা হয় উপযুক্ত বিনিয়োগের পরিস্থিতি নেই বলে চলেন আর নয়ত তাদের জমি নেই তাই ঘর নেই এমন শিশুসুলভ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হন। নিজের বইতে বুর্জোয়া অর্থনীতির সামাজিক দায় ব্যখ্যা করতে গিয়ে ডক্টর জাক্স একজায়গায় গুলিয়ে ফেলেন, ফলে দেখা যায় তার লেখায় এমনসব অদ্ভুত কথা রয়ে গেছে- ‘সামাজিক অর্থনীতি বলতে আমরা বোঝাতে চাই সামাজিক প্রশ্ন সম্পর্কে প্রযুক্ত জাতীয় অর্থনীতির তত্ত্ব, অথবা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে প্রচলিত লৌহদৃঢ় নীয়মাবলির ভিত্তিতে, তথাকথিত(!) সম্পতিবিহীন শ্রেণীকে সম্পত্তিসম্পন্ন শ্রেণীর ঘরে উন্নীত করবার জন্য এই বিজ্ঞান নির্দেশিত সমদেয় উপায় পন্থার সমষ্টি’। এর মানে করলে দাঁড়ায় বুর্জোয়া সমাজের মূল ভিত্তি হিসাবে শ্রেণিশোষণের কাঠামোটি যথাযথরূপে বজায় থাকবে, কিন্তু শোষণের সামাজিক দায়টুকু স্বীকার করে নেওয়ায় সেই বন্দোবস্তের অভিশাপেই শ্রমিকশ্রেণির যে চরম দুর্দশা সেটুকু সব ধুয়ে-মুছে যাবে। একটা দেশে বুর্জোয়ারাও কর্তৃত্বে থাকবেন আবার সম্পত্তিবিহীন সর্বহারাদেরও রাতারাতি সম্পত্তিবান করে তোলা হলে যে বুর্জোয়া উৎপাদনপ্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যাবে এটুকু বুঝতে কোনও পণ্ডিত হতে হয় না। কিন্তু এসবই তখন লেখালেখি চলছিল। এমনসব মতামতের বিরুদ্ধেই এঙ্গেলস ভল্কস্ত্যাট পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখেছিলেন।
বাসস্থানের সংকটকে বুর্জোয়ারা চলতি সমাজের মূল সংকটের থেকে আলাদা করে বিচার করেন বলেই হাজার বন্দোবস্তেও বস্তিবাসীদের কপাল আর ফেরে না। বাবুদের মন-মর্জি হলে যদি বা সরকারী ব্যয়বরাদ্দে (কিংবা হাল ফ্যাশনের পিপিপি মডেলে) কখনো দুয়েকটি আবাসন গোছের কিছু গড়েও ওঠে, কিছুদিন বাদেই সেইসব জায়গায় নতুন ভাড়াটিয়ারা এসে বসবাস শুরু করে, শিল্পাঞ্চলের আরেক জায়গায় বস্তি নির্মিত হয়। কারণ উপযুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বাসস্থানের সংকট গরীব মানুষের চেতনার সংকট না, শ্রেণি হিসাবে যাবতীয় সামাজিক শোষণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা সর্বহারাদের যাবতীয় সমস্যার সাথেই তা সম্পৃক্ত। এঙ্গেলস সেই সত্যটুকুই তুলে ধরেছিলেন।
এই অবসরে এঙ্গেলস বন্ধু কার্ল মার্কসকে কিছুটা বাড়তি সময় যুগিয়েছিলেন। যাতে তিনি নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন এবং ক্যাপিটাল লেখার কাজটি যথাযথরূপে শেষ হয়। ডক্টর এমিল জাক্সদের লেখা সামাজিক ছাইপাঁশের মোকাবিলা করতে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস লিখেছিলেন দ্য হাউজিং কোয়েশ্চেন। মার্কসও তাঁর কমরেডকে কিছুটা সহযোগিতা করেছিলেন। ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ রয়েছে-‘ ক্রমবিকাশের কোন এক বিশেষ স্তরে মেশিন ও ফ্যাক্টরি উৎপাদনের দরুন এ অবস্থার পতনের ক্ষণ ঘনিয়ে আসবে। সেই সময় মনে হয় আগতপ্রায়। কিন্তু জার্মানিতে মেশিন ও ফ্যাক্টরি উৎপাদন দ্বারা গ্রামীণ গৃহ ও হস্তশিল্প- কারখানার ধংসের মানে হবে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ উৎপাদকের জীবিকার ধ্বংস, জার্মান ক্ষুদ্র কৃষককুলের প্রায় অর্ধাংশের উচ্ছেন; শব্দে গৃহশিল্পের ফ্যাক্টরি শিল্পে রূপান্তর নয়, কৃষকের খোদ খামারের রূপান্তর বৃহদায়তন ধনতান্ত্রিক কৃষিতে, ছোট ছোট জোতজমির রূপান্তর বৃহদায়তন মহালে, – অর্থাৎ কৃষকের স্বার্থের মূল্যে পাজি ও ভূমিমালিকানার স্বার্থে শিল্প ও কৃষিবিপ্লব। যদি পুরাতন সমাজ-ব্যবস্থার আওতাতেই এই রূপান্তর জার্মানির ভাগ্যে থেকে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহেই হবে এক মোড় পরিবর্তন। ততদিনে যদি অন্য কোন দেশের শ্রমিক শ্রেণী উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তবে জার্মানিই প্রথম আঘাত হানবে আর ‘গৌরবোজ্জল সৈন্যবাহিনীর’ কৃষকসন্তানগণ সে কাজে সহায়তা করবে বীরত্বের সঙ্গেই।
আর সেই সঙ্গে, প্রত্যেক শ্রমিককে তার নিজস্ব কুটীরটির মালিকানা দান করে। আধা-সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় তাকে তার নির্দিষ্ট পূজিঁপতিটির সঙ্গে শৃঙ্খলিত করে। রাখার বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া এই ইউটোপিয়ার এক ভিন্নতর তাৎপর্য প্রকাশ পাচ্ছে। এর বাস্তব রূপায়নের বদলে ঘটবে ছোট ছোট গ্রামীণ বাসগৃহ মালিকদের গৃহশিল্পের শ্রমিকে রূপান্তর; পুরানো বিচ্ছিন্নতার অবসান এবং সঙ্গে সঙ্গে করে কৃষকের রাজনৈতিক অকিঞ্চিৎকরতার ধ্বংসসাধন, তাদের সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে আকর্ষণ; গ্রামাঞ্চলে শিল্প-বিপ্লবের প্রসারলাভ এবং তার ফলে জনসংখ্যার সর্বাপেক্ষা স্থিতিশীল ও সনাতনপন্থী অংশটার পরিণতি বিপ্লবের লালনাগারে এবং এই সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে গৃহশিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মেশিন দ্বারা উচ্ছেদ, যে উচ্ছেদ তাদের জোর করে ঠেলে দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পথে’।
নগরায়নের কোনও বিকল্প মডেল না, নগরায়ন যে মুনাফা লোটার স্বার্থে বুর্জোয়াদের দ্বারা পরিচালিত উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রভাবে সংগঠিত এক বিরাট সামাজিক পরিকল্পনা- এই ছিল এঙ্গেলসের মূল আলোচনা। অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করলে এঙ্গেলসের লেখাটি খুব একটা নতুন কিছু না ঠিকই। কিন্তু তাঁর এই লেখাটি থেকেই আমরা একটি রাস্তা খুঁজে পাই- ভেকধারি বুদ্ধিজীবী, আধুনিক প্রযুক্তির নামে বড়াই করা বিজ্ঞানীকুল ও সামাজিক সুযোগসুবিধার উপরে সার্বিক দখলদার বুর্জোয়াদের রাতারাতি মানবিক সাজার পিছনে যে বিরাট ভণ্ডামি (যা আজও চলছে) এসবের মুখোশ কিভাবে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে হয়।