ক্ষুধার সাধারণতন্ত্র – শান্তনু দে…

১৯ অক্টোবর ২০২২, (বুধবার)

এক ক্ষুধার সাধারণতন্ত্র! রিপাবলিক অব হাঙ্গার!

আট বছর আগেও বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিল ভারত। এখনও রোয়ান্ডারও নিচে! বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে রোয়ান্ডা ১০২। ভারত ১০৭! ২০১৪-তে ছিল ৯৯। দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র আফগানিস্তান (১০৯) আমাদের নিচে। শ্রীলঙ্কা (৬৪), নেপাল (৮১), বাংলাদেশ (৮৪) এমনকি পাকিস্তান (৯৯) পর্যন্ত ভারতের উপরে!

মোদী ব্যস্ত ‘আজাদীর অমৃত মহোৎসব’ পালনে। মেরা ভারত মহান!

দারিদ্রের গণনা ভারতে শুরু হয় ১৯৭৩-৭৪ সালে। পরে ১৯৯৩-তে দারিদ্র পরিমাপের পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করা হয়। প্রথমে ঠিক করা হয়, ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য মাথাপিছু দিনে কতটা ক্যালরি রোজ দরকার। গ্রামে এই মাত্রাটি ঠিক হয়েছিল ২৪০০। শহরে ২১০০। অর্থাৎ, প্রধান জোরটা দেওয়া হয় খাদ্যের উপর। যদিও জামা-কাপড়ের প্রয়োজনও কিছুটা হিসেবে রাখা হয়। বাস্তবে, গ্রাম-ভারতে ২২০০ ক্যালরিকেই মাত্রা হিসেবে ধরা হয়।

তিনদশক আগে নয়া উদারীকরণের শুরুতে প্রচারের ঝড় তোলা হয় জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়ালেই দারিদ্রের অবসান। ক্ষুধার হাহাকার থেকে মুক্তি। কোথায় অবসান? কোথায় মুক্তি? বরং ফল হয়েছে বিপরীত।

নয়া উদারনীতির পর্বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: যখন অর্থনীতি উচ্চহারের বৃদ্ধি দেখেছে; অন্যটি হলো যখন অর্থনীতি নয়া উদারনীতির সঙ্কটে জড়িয়ে গিয়েছে, এই পর্বটি বিশ্বব্যাপী ঘটনা। এই দুই পর্বের মধ্যে বিভাজিকারেখা হল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন বুদবুদের বিপর্যয় ঘটার পরে ভারতীয় প্রেক্ষিতে ওই সঙ্কটের একটু দেরি করে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। 

নয়া উদারনীতিতে যখন উচ্চ হারের বৃদ্ধি হচ্ছিল, এমনকি তখনও সামগ্রিক দারিদ্রের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম-ভারতে দৈনিক মাথাপিছু ২২০০ ক্যালরি গ্রহণ ( যা দারিদ্রের সংজ্ঞার মূল ‘নিয়ম’) করতে পারছেন না— এমন মানুষের অনুপাত ১৯৯৩-৯৪’র ৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১-১২-তে হয় ৬৮ শতাংশ। শহরে এই ‘মাপকাঠি’ ছিল ২১০০ ক্যালরি। সেখানেও এই না-পাওয়ার অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে হয় যথাক্রমে ৫৭ থেকে ৬৫ শতাংশ। 

নয়া উদারনীতির পথে সঙ্কট ও বদ্ধদশা শুরু হবার পরে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে। ২০১৭-১৮, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফল এত শোচনীয় আসে যে মোদী সরকার তা গোপন করে রাখে। এমনকি এনএসএস-কে তুলে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পিসি মহলানবীশের মতো ব্যক্তি এই গণনা পদ্ধতি চালু করেছিলেন। ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্যে দেখা যায় গ্রাম ভারতে মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয় ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-তে ৯ শতাংশ কমে গিয়েছে। এটিও গড় চিত্র। শ্রমজীবী অংশের ক্ষেত্রে হ্রাস নিশ্চয়ই আরও বেশি। মহামারীর পরে এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির সময়ে পরিস্থিতি হয়েছে আরও খারাপ। 

নয়া উদারবাদের জমানায় ভারত দেখেছে এক অশ্লীল উন্নয়ন। একুশ শতকের ভারতে অসাম্য ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ রাজকে। ব্রিটিশ রাজ থেকে এখন বিলিওনেয়ার রাজ!

ভারতের আয়কর তথ্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেত্তি ও লুকাস চ্যানেলের সমীক্ষায়: এমনকি ১৯৮২-৮৩’র শেষেও, দেশের জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশের আয় ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র ৬.২ শতাংশ। নয়া উদার পুঁজিবাদ বদলে দিয়েছে সবকিছু: ২০১৩-১৪, শীর্ষ ১ শতাংশের ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.৭ শতাংশে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ ভারতে আয়কর আইন চালু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ।

এই ব্যবধান এখন আরও বেড়েছে। আয়ের অসাম্য এখন চরমে। করোনাকালে আরও গভীর হয়েছে এ দেশের ধনসম্পদ বণ্টনের বৈষম্য। ভারতের মুষ্টিমেয় ধনকুবের এবং কোটি কোটি অদক্ষ শ্রমিকের আয়ের ফারাকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অতিমারি পরিস্থিতি।

অক্সফামের অসহায় আর্তনাদ! রিপোর্টের শিরোনাম ‘দ্য ইনইক্যুয়ালিটি ভাইরাস’! বৈষম্যের ভাইরাস!

২০২১, সুইৎজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক মঞ্চ(ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম)-এর বৈঠকের আগে অক্সফামের চাঞ্চল্যকর দাবি: লকডাউনের সময় দেশের ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে গড়ে ৩৫ শতাংশ। বিপরীতে, ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে বিভিন্ন ভাবে। গত বছর এপ্রিলেই প্রতি ঘণ্টায় কাজ হারিয়েছেন ১.৭ লক্ষ মানুষ!

লকডাউন কার্যকর হওয়ার মাস থেকে ভারতের ১০০ ধনকুবেরদের যে পরিমাণ সম্পদ বেড়েছে তাতে তাঁরা দেশের ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ দরিদ্রতম মানুষকে ৯৪ হাজার ৪৫ টাকা করে দান করতে পারতেন!

রিলায়্যান্স কর্ণধার মুকেশ অম্বানির আয় চিকিৎসা-স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্র-রাজ্যের মিলিত বাজেটের চেয়ে বেশি! লকডাউনের সময়ে পর্যন্ত মুকেশের আয় ছিল ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা!

অক্সফামের রিপের্টে বলা হয়েছে, ‘ভারতের বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। অতিমারির সময়ে রিলায়্যান্স কর্ণধার মুকেশ অম্বানির ঘণ্টা পিছু যা আয় তা রোজগার করতে এক জন অদক্ষ শ্রমিকের ১০ হাজার বছর লাগবে’।

বস্তুত, নয়া উদারনীতির মধ্যে দারিদ্র, ক্ষুধার থেকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই। সঙ্কট মোকাবিলার নয়া উদারনীতির রাস্তা হলো পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দেওয়া, এই আশায় যে তারা আরও বিনিয়োগ করবে, তা থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে এবং কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর ফলে সঙ্কট আরও গভীর হয়। সঙ্কটের মধ্যে, যখন বাজারের প্রসার ঘটছে না তখন পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ করে না। সুতরাং যতদিন নয়া উদারনীতি টিকবে, জনগণের অবস্থা খারাপ হতেই থাকবে। যত দ্রুত দেশ এই নীতির পরিধি থেকে বেরোবে, ততো মঙ্গল। 

নয়া উদারবাদের সঙ্কট থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হবে। একমাত্র বামপন্থীরাই জনগণের সামনে হাজির করতে পারে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন এবং অর্থনৈতিক রিলিফের কর্মসূচি। বিকল্পের কর্মসূচী, যা নয়া উদারনীতিকে অতিক্রম করে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে পারে। এই কর্মসূচি জনগণের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে যার ভিত্তিতেই কেবলমাত্র সমস্ত ফ্যাসিস্ত-বিরোধী শক্তির ঐক্য অর্জন করা সম্ভব।

প্রবন্ধতে ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত…।

Spread the word

Leave a Reply