সৌভিক ঘোষ
আজকের ভারত অথবা যা কিছু…
‘যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।’
কবি লিখেছিলেন। তিনি ঘোরতর কলমবাজ ছিলেন, তা নাহলে এমন দুলাইনে বাইনারি রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে দেওয়া যায় না!
দেশের প্রধানমন্ত্রী একটিও সাংবাদিক সম্মেলন না করে দশ বছর কাটিয়ে দিলেন। মোদী সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরাও ‘ওসব কাজে সময় নষ্ট’ করতে চান না বোঝাই যায়। এসব সত্বেও মোদী সরকারের দশ বছরে সরকারী প্রকল্প ইত্যাদির গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য যত খরচ হয়েছে তার পরিমাণ স্বাধীন দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এমনকি মূল্যবৃদ্ধির হারকে হিসাবের মধ্যে রেখে সেই খরচের প্রকৃত মূল্য (ইন রিয়াল টার্মস) অ্যাডজাস্ট করলেও ব্যয়ের ভার কিছুটা কমে ঠিকই, ধার কমে না। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি আমাদের দেশ নাকি গোটা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের আদিমতম আধার। এও জানা গেছে যে শেষ দশ বছরে সরকারের নামে যা কিছু চলছে সেটাই এযাবৎকাল অবধি স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও দুর্নীতিমুক্ত দেশপরিচালনার অমোঘ নির্ঘোষ। এমনি এমনি তো আর কারোর নিজেই নিজেকে বিশ্বগুরু মনে হয় না!
হায় ডিজিটাল!
২০১৯’র ১২ই এপ্রিল থেকে ২০২৪’র ১৫ই ফেব্রুয়ারি অবধি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অ্যাকাউন্টে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) নিজেরাই জানিয়েছে এই গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে তারা প্রতিটি লেনদেন (ব্যাংকের নিজস্ব পরিভাষায় ট্রানজ্যাকশন)-র বেলায় দাতা ও গ্রহীতার পরিচিতি বিষয়ক জরুরী তথ্যের সাথে মিলিয়েই কাজটি সম্পন্ন করেছে।
এসব জরুরী তথ্য বলতে কি বোঝায়?
সাধারণভাবে যাকে কেওয়াইসি (নো ইওর কাস্টমার) বলে, সেটাই। আজকের ভারতে ব্যাংকিং পরিষেবা পান এমন প্রত্যেক নাগরিককেই বছরে অন্তত একবার নিজের আধার নম্বর, প্যান নম্বর, চলতি মোবাইল নম্বর সহ বিস্তারিত তথ্য নিজের নিজের ব্যংকের শাখায় জমা করতে হয়। ব্যাপারটা সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক দুর্বিষহ ও বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা সন্দেহ নেই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে ব্যাংক ও দেশের সরকারের মনোভাব অনেকটা- ‘সিয়াচেনে সেনা জওয়ান’রা কি অবস্থায় রয়েছেন, আর আপনারা এটুকু করতে পারবেন না!’ অর্থাৎ ব্যাপারটা জরুরী এবং সরকারের নীতি অনুযায়ী বজ্রআঁটুনির নামান্তর।
এহেন কেতাদুরস্ত বন্দোবস্ত নাকি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়বে! অন্তত সম্ভাবনা তেমনই!
কবে?
আজই! অন্তত সম্ভাবনা তাই!
কিভাবে?
গত পাঁচ বছরে স্টেট ব্যাংক অফ ইডিয়ার বিভিন্ন অথোরাইজড শাখা মারফত ইলেক্টরাল বন্ডের যাবতীয় ‘অপারেশন’ চলেছে এবং সেসবের প্রত্যেকটি কেওয়াইসি’র বিধিনিষেধ মেনেই চলেছে। এখন যদি আদালতের সামনে তাদের সেসব তথ্য জমা দিতে বলা হয় তাহলে নাকি ব্যাংকিং পরিষেবার চাপ এতই বেশি যে ‘গোটা ব্যাপারটা’ তারা কিছুতেই সামলে উঠতে পারবে না। অর্থাৎ বজ্রআঁটুনি’র পরিণতি ‘ফস্কা গেরো’তেই শেষ হবে।
বিগত দশ বছরে ডিজিটাল, ডিজিটাল বলে চিৎকার করে লোকজনের কান-মাথা সহ আরও যা আছে সবই ঝালাপালা করে দেওয়া হয়েছে। এখন সেই ডিজিটালের ঠিকাদারেরাই বলছে ওসব তথ্য নাকি দুটি বড় ‘সাইলো’-তে জমা রাখা হয়েছে- তাই সর্বোচ্চ আদালতই হোক আর যেই হোক বললেই তো আর বের করে দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব না!
পাঠক খেয়াল রাখবেন। স্টেট ব্যাংক নিজেরাই নিজেদের তথ্যভান্ডারকে সাইলো বলছে। জেনে রাখা ভালো পশুখাদ্যের ভান্ডার যখন বায়ুনিরোধক কায়দায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকেই সাইলো বলে!
দেশের সংসদে যারা ভারতীয় নাগরিকদের ভবিতব্য নির্ধারণ করেন সেই রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে বিরাট বিরাট অংকের টাকা-পয়সা যুগিয়েছেন কারা সেই কথা যেন মরে গেলেও কেউ না জানতে পারে তাই ইলেক্টোরাল বন্ডের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া হয়ত ভুলে যাচ্ছে অমন বন্দোবস্ত যে আদ্যন্ত অসাংবিধানিক তা গত মাসের ১৫তারিখ সুপ্রিম কোর্ট নিজের রায়ে ঘোষণা করে দিয়েছে। তাই এতদিন যারা নিজেদের ‘ডিজিটাল’ প্রযুক্তির নামে এক ঘটি জল বেশি খেত তারাই আদালতের সওয়ালের সামনে ওসব ডিজিটাল অবস্থায় নেই, কি করে এত কাজ সামলানো যাবে বলে যুক্তি হাজির করেছে!
তারা ঠিক কি বলেছে? আইনজীবী মারফৎ আদালতে তারা যা বলেছে যথাক্রমে তা কিছুটা এমন-
এক, এই কাজ করতে হলে আমাদের গোটা প্রক্রিয়াকে পুনরায় মেলাতে (রিভার্স দ্য প্রসেস) হবে।
দুই, ওসব তথ্য ডিজিটাল অবস্থায় নেই।
তিন, কাজ শেষ করতে তাদের অন্তত জুন মাস অবধি সময় দেওয়া হোক।
অবশ্য চিঁড়ে তাতেও ভেজেনি। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে আজ বিকালের মধ্যেই (আইনি পরিভাষায় ব্যাংকিং বিজনেস আওয়ার্স) এসবিআই’কে সমস্ত তথ্য জানাতে হবে।
আর্থিক তথ্য নিয়ে টালবাহানার অর্থনীতি
ক্ল্যাসিকাল বা ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রীরা একটি মৌলিক ধারণার উপরে ভিত্তি করে যাবতীয় তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। মূল কথাটি ছিল বাজার ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্রীয় অথবা সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া চলতে পারে তবে বেকারির সমস্যা কখনোই তৈরি হবে না। অর্থশাস্ত্রে এহেন উপপাদ্যের ভিত্তি ছিল দুটি। প্রথম- বাজারে কাজ না থাকলে মালিকরা সবাই মিলে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমিয়ে দেবে, এর ফলে শ্রমিকদের নিয়োগ করতে বাজারে নতুন করে উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হলে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে, ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে। দ্বিতীয় পথটিকে সাপ্লাই ড্রিভেন (যোগান নির্ভর) মডেল বলে। এর মূল কথা- চাহিদার সংকটের মোকাবিলায় পণ্যের যোগান বাড়িয়ে দেওয়া। পণ্যের যোগান বাড়াতে গেলে বাড়তি উৎপাদনের জন্য আরও বেশি শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। ইতিমধ্যে যারা কাজ হারিয়েছে তাদের কেনার ক্ষমতা কমেছে ফলে বাজারে চাহিদার সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থার মোকাবিলা করতে নতুন নিযুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীরা বাজারে উপযুক্ত ক্রেতা হিসাবে হাজির হবেন এবং তখনই মন্দার অবস্থা কেটে যাবে ফলে পুনরায় কাজের বাজারে তেজিভাব ফিরে আসবে ফলে সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সবাই আবার কাজ পাবে। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও এমন কিছু ঘটেনি।
স্বাধীন ভারত অর্থনীতির প্রশ্নে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকেই শুরু করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘকাল জোঁকের ন্যায় যাবতীয় সম্পদ লুঠ করেছে। অতএব প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর। সবাই জানে ভারী শিল্প নির্মাণ ব্যতীত একাজ হয় না। জওহরলাল নেহরু প্রথমদিকে পশ্চিমীদের সভ্যতায় ভরসা রেখেছিলেন। রপ্তানির পরেও প্রযুক্তির চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রেখে এবং চড়া হারে সুদ সহ তারা (ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা) সাহায্য করতে চাইলেন। বোঝা গেল সুদের ঢাকেই মনসা বিকিয়ে যাবে। আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। অয়েল রিফাইনারিজ, কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সার সহ বিভিন্ন কেমিক্যালস উৎপাদনী ক্ষেত্র এমনকি ইস্পাত কারখানা অবধি সেই সহযোগিতার ফলাফল। ভিলাই স্টিল প্লান্টের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা তাদেরই প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু বিরাট কারখানাই নির্মাণ করে দেয়নি, সেইসব কলকারখানায় প্রস্তুত সামগ্রীও তারা নিজেদের দেশে আমদানি করে- সোজা কথায় উৎপাদন থেকে বৈদেশিক বাজারে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির সুযোগ অবধি দিয়েছিল। আজকের প্রজন্মের অনেকেই এসব অজানা। নয়ের দশকে বলা হল, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার প্রায় শেষ। আমাদের রপ্তানি যেমন কম, আমদানি ততাই বেশি। অথচ আমদানির মূল অংশটা ছিল ভোগ্যপণ্যের- বড়োলোকরাই মূলত সেসবের খরিদ্দার। কিছুতেই বলা হল না আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেই তো সরকার বাজারে চাহিদা বাড়াতে পারে, নিজেদের উদ্যোগে কারখানা বানিয়ে কর্মসংস্থান ও যোগান দুইই সামাল দেওয়া যায়। ওসব বললে লগ্নী পুঁজি চটে যাবে, এদেশের পুঁজিপতিরাও কাজের কাজ কিছু করবেন না। অতএব বাজার খুলে দাও। ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে আইএমএফ’র সামনে দাঁড়াতে হল, তারাও শর্ত দিলেন যত খুশি ধার নাও, কিন্তু নিজেদের মুদ্রার দাম কমাও। ভারতীয় মুদ্রার সেই অবনমন আজও চলছে- এই প্রবন্ধ লেখার সময়ও এক ডলার কিনতে ৮২ টাকা ৭৭ পয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নাকি গতি নেই! এরই জোরেই লগ্নী পুঁজি আমাদের দেশে ব্যংকে সুদের হার বাড়তে দিতে চায় না। মানে সাধারণ মানুষ ব্যংকে টাকা না রেখে বিভিন্ন খাতে সরাসরি বাজারে টাকা খাটাতে বাধ্য হোক, এতে পয়সা মেটানোর আইনি বিধিনিষেধ এড়িয়ে যাওয়া যাবে। লগ্নী পুঁজির স্পর্ধা এতদুর বেড়েছে যে তারা দেশীয় রিজার্ভ ব্যাংকের আওতা থেকে নগদ অর্থসম্পর্কিত যাবতীয় ক্ষমতাকে সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছে। কিছুদিন আগেই মোদী সরকার রিজার্ভ ব্যাংকের তহবিলের অর্থ কমিয়ে দিতে বিশেষ ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে- লগ্নী পুঁজির কারবারে কারোর সন্দেহ হতে পারে তাই ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেওয়া গেল।
কি কি ঘটতে পারে?
এক, প্রথম সম্ভাবনাটি ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। দেশজুড়ে আজ সবার নজর থাকবে কখন স্টেট ব্যাংক সব তথ্য জানায় তাই সেদিক থেকে সকলের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে গতকালই সিএএ জারী করার কথা সামনে আনা হয়েছে। সোজা কথা সহজ করে বুঝে নেওয়া, অন্যদের বুঝতে সহায়তা করাই আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। ইলেক্টোরাল বন্ডের আগাগোড়া সবটাই স্পষ্ট করতে হবে, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াকেই করতে হবে। তা নাহলে ঘটনাটা আদালত অবমাননার বিষয়ে পরিণত হবে। আর তাই আমার, আপনার সকলের মাথাটা গোলমাল করে দিতেই নানা আওয়াজ দেওয়া শুরু হয়েছে। দক্ষিণপন্থার চিরায়ত কৌশলই তাই- ছল, চাতুরী, তামাশা ও প্রবঞ্চনা।
জনসাধারণ এসব জানেন, বোঝেনও।
তারা ওদের বাজানো ঢাকের তালে নাচবেন না।
সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট জানিয়েছেন- ‘এসব কৌশলে পার পাওয়া যাবে না’ (Such tactics shall not pass)।
দুই, নয়া-উদারবাদী জমানায় জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে ঠিকই। সেই ক্ষোভকেই আজকের দক্ষিনপন্থা ভুল দিকে পরিচালিত করতে চায়। কেউ দু চারটে নোট হাতে গুঁজে দিয়ে ভোটের লাইনে মারামারি করতে পাঠায়, কেউ পন্ডিত, গবেষক, ইতিহাসবিদদের অপমান করতে পাঠিয়ে দেয়। আগ্রহীরা চাইলে মিলিয়ে নিতে পারেন। এখনও অবধি যা জানা গেছে তাতে স্পষ্ট আমরা যাকে বাইনারি বলছি তার মতোই ইলেক্টরাল বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেটদের থেকে গোপনে পার্টির তহবিলে অর্থ সাহায্য নিতে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস দুইই অন্যদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে, একজন কেন্দ্রে, আরেকজন রাজ্যে।
এই দুপক্ষই নিজেদের মতো করে জনসাধারণকে ভুল বোঝাতে সারাদিন ব্যস্ত থাকবে।
অনেকেই আজকের সময়ে বাস্তব সমস্যাকে বিচার না করেই ‘অতীতে তো এমনসব ছিল না’ বলে বসেন।
জনসাধারণের স্বপ্ন দেখার অভ্যাসকে দোষারোপ না করে, স্বপ্ন পূরণের পথ নির্মাণে বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী বিকল্প যে রয়েছে- একথা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলাই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি। আমরা সেটাই করি, করছি এবং করে চলব।
তথ্যসুত্রঃ
১) গনশক্তি
২) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
৩) সোশ্যাল মিডিয়া