ট্রেন্ডটা বোঝাই যাচ্ছিল।
দেশের ‘সংবিধানের সর্বোচ্চ অভিভাবক’ বলে একটু একটু করে জনগনের বিশ্বাসযোগ্যতা,আস্থা ও নির্ভরতা গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটির সামনে চ্যালেঞ্জগুলো আসছিল একটার পর একটা। চ্যালেঞ্জ বাইরে থেকে চ্যালেঞ্জ ভেতর থেকে।
কেউ কেউ বলছিলেন “বিচারব্যবস্থার উপর আক্রমণ”, কেউ কেউ বলছিলেন “বিচারব্যবস্থার গৈরিকীকরণ”। সব মিলিয়ে ভারতের সংবিধান অনুসারে যেভাবে চলা উচিৎ তা চলছিল না বেশ কয়েক বছর ধরে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি।সর্বোচ্চ আদালতের চারজন বিচারপতির প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলন।লক্ষ্য সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র।অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালত তার অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য,সমস্যা নিজের অলিন্দের ভিতর সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছিল তার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হল জনগণকে।
তারপর স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তি বাড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন যেমন দেশের প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির সাথে জড়িত কিনা, রাম লালা জন্মেছিলেন এখানেই এই বিশ্বাসে রামমন্দির হবে কি হবে না তা নিয়ে বিতর্ক,এরই মাঝখানে একজন সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির সাংসদ হিসাবে শপথ গ্রহণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটু পেছনে হাঁটা যাক। ৮ ই নভেম্বর ২০১৭ সুপ্রীম কোর্টে ক্যাম্পেন ফর জুডিশিয়াল একাউন্টিবিলিটি এন্ড রিফর্মস বলে একটি এনজিও একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় হলফনামা সহকারে বলা হয় ঊড়িষ্যার একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতির সঙ্গে দেশের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নাম জড়িয়েছে। ভারতের মতো দেশ, যেখানে সুপ্রীম কোর্টের কাজ কর্ম নিয়ে গর্ব করা হত,সেখানে প্রধান বিচারপতির নামে অভিযোগ কোনো মামুলি বিষয় ছিল না।
এরই মধ্যে চলছিল হাইকোর্টগুলি। রাজস্থান হাইকোর্টের জজ সাহেবের রায়ে গোশালা তৈরির ফরমানের নির্দেশাত্মক নীতি। মেঘালয় হাইকোর্টের রায়ে ‘মোদী মমতাকে’ এক ব্র্যাকেটে রেখে অনুপ্রবেশ রোখার বিচারপতির আবেদন ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কিছুই আমাদের সহ্য হয়ে যাচ্ছিল।
তারই মধ্যে লকডাউন, গরীবের পকেট কেটে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রক যখন স্বাস্থ্য থেকে ইন্টারনেট দখল করছিল, মিলিটারি যখন বানাচ্ছিল কাশ্মীরজোড়া কবরখানা, ঠিক তখনই এক স্তব্ধতা চালিত হয়েছিল নতুন দিল্লির ভগবান দাস রোডের এই বিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তিতে,ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে।
সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা সাংবিধানিক কিনা তাই নিয়ে শুনানী আজও শেষ হয়নি।কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে অরুন মিশ্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের আনুকুল্য পেয়েছিলেন কিনা তার উত্তর আজও আসেনি। ঠিক কি কারণে বিচারপতি মুরলীধর বদলি হয়ে গেলেন দিল্লি হাইকোর্ট থেকে খবর জানা যায়নি,ঠিক তেমনি জানা যায়নি ঠিক কেন সেই সুপ্রীম কোর্টের মহিলা কর্মীর, তাঁরই বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিচারের সময় এজলাসে কেন বসেছিলেন বর্তমান সাংসদ ও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। অনেক না জানার মধ্য দিয়েই এ আমলের এলিয়েজা ইম্পে-দের মতামত ধ্বনিত হচ্ছিল সুপ্রীম কোর্টের অলিন্দে অলিন্দে।
এই সময়েই বিশ্ববন্দিত আইন পন্ডিত ফালি এস ন্যারিম্যান লিখেছেন “গড সেভ দি অনারেবল সুপ্রীম কোর্ট’। সেই বই এর শুরুতে ন্যারিম্যান সাহেব বিখ্যাত গায়িকা জোন বায়াজের একটি লেখা ব্যবহার করেছেন সেটি হল,’I have never had a humble opinion. If you’ve got an opinion,why be humble about it’. আমাদের দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা সমস্ত কিছুই জনগনের ব্যক্তি মতামতের,সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। বরং একজন নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার সংবিধানের ১৯ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী সেই নাগরিকের মৌলিক অধিকার। স্বাধীন মতামত গড়ে তোলার পূর্ব শর্ত হল বাক স্বাধীনতা।চরমতম অপ্রিয়,অপছন্দের হয়েও বেঁচে থাকাটাই হল স্বাধীনতার প্রথমতম শর্ত।
একজন নাগরিক সেই অধিকার প্রয়োগ করলে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হলে তা কোথাও কোটি টাকার মানহানির মামলা, কোথাও আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত অবমাননার মামলা দেওয়া হয় যা মানুষের মৌলিক অধিকারকেই খর্ব করে, মানুষকে ভয় দেখায়।
আর গণতন্ত্রে সত্য বলার অধিকারের উপর আক্রমণ মানেই ধরে নিতে হবে গণতন্ত্রের নির্যাসটাই পরাস্ত হয়েছে। প্রশ্ন আসছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আদালতের কাজকর্মের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্ক কতটা? বিশেষত মনে রাখা দরকার বিচার ব্যবস্থার ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা হলে তা কিন্তু আদালত অবমাননার আইনের আওতায় আসেনা। অথচ সেই ই.এম.এস নাম্বুদ্রিপাদ থেকে প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে একটার পর একটা আদালত অবমাননার মামলা করে সন্ত্রস্ত করবার চেষ্টা করা হচ্ছে বিরোধী কন্ঠ। যেমন পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা তাঁর ‘স্যু দি মেসেঞ্জার’ বইতে লিখেছেন কিভাবে একটার পর একটা মানহানির ভয় দেখিয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে কিভাবে কন্ঠ রোধ করা হয়েছে সংবাদপত্রগুলির, চ্যানেলগুলির, কিভাবে অমিত শাহের ছেলের জন্য বিশেষ অনুমতিক্রমে আমেদাবাদ উড়ে যান তুষার মেহেতা,ওয়ার ইনের বিরুদ্ধে করা মামলায়।
সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন ই.এম. এস নাম্বুদ্রিপাদ। তাঁর বিরুদ্ধে কেরালা হাইকোর্টের দেওয়া আদালত অবমাননার জেল ও জরিমানার নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে দেওয়া হলফনামায় তাঁর বিরুদ্ধের অভিযোগকারীকে উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন, “A Citizen is entitled to excercise the right of fair and reasonable criticism in respect of public acts done in the seat of Justice” কেনই বা সেই অধিকার নেই ধরে নেওয়া হবে? বিচারব্যবস্থা সমালোচনার উর্ধ্বে? কখনোই নয়।বরং সুস্থ সমালোচনার মধ্যে দিয়েই বিচারব্যবস্থাকে সাংবিধানিক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সাংবিধানিক লক্ষ্য মানে কিন্তু সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক,ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্য।মনে রাখা দরকার রাজতন্ত্রের মত রাজা ঈশ্বরের দূত নয়,বিচারপতিরা ভগবান নন আর বিচারব্যবস্থা এমনকি সর্বোচ্চ বিচারালয়ও সমালোচনার উর্ধ্বে নয়।
গত কয়েক বছরে সারা দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মত সুপ্রীম কোর্টরও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রহণযোগ্যতাকে অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। এই সচেতন কার্যক্রমে কখনো নিজেদের মতাদর্শের লোকজনকে বিচারব্যবস্থার অভ্যন্তরে জায়গা করে দিয়ে, সামান্যতম অংশই ভিন্ন মতের বিচারপতিদের নানাভাবে ব্যবহার করে নিজেদের রাষ্ট্র ক্ষমতার সম্পূর্ণ দখল নিতে চাইছে বিজেপি।উদ্দেশ্য ভারতের বর্তমান সংবিধান সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো। স্বাধীন ভারতের সংবিধানের জায়গায় মনুবাদের ভিত্তিতে সংবিধান চালু করা।
এই প্রক্রিয়াটির একটি ভয়ানক পরিণতির দিকে আমরা চলেছি।সংবিধানের সামনে এতবড় চ্যালেঞ্জ গত সত্তর বছরে আসেনি।আর সেই সময়টাকে সাংবিধানিক ইতিহাসে লিখে রাখবার ক্ষেত্রে যারা সত্যের আশ্রয় নিচ্ছেন তাদের উপর নেমে আসছে চূড়ান্ত আক্রমণ।কখনো মানহানির মামলায় নাস্তানাবুদ করা, কখনো স্বতঃপ্রণোদিত অবমাননার মামলা করে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্বিত করা। এই কাজ করতে গিয়ে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল হতে গিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করতে শুরু করেছেন কয়েকজন বিচারপতি যে চোখের সামনে বিচারের নিক্তিকে শাসকের শাসন দন্ডের দিকে হেলে থাকতে দেখেও অনেকেই চুপ করে রয়েছেন।
সুপ্রীম কোর্ট প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলার শুনানী করার নির্দেশ দিতে পারেন,অথচ শ্রমিকরা কেন শ্রমের মূল্য পাবেনা তার বিচার করার সময় পাননা। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া সাংবিধানিক ভাবে সঠিক হয়েছিল কিনা তা বিচার করতে পারেন না। এই আজকের ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের ছবি।একাধারে লকডাউন সফল করতে করতে কখন এইসব দূরত্বগুলো বিচ্ছিন্নতায় পরিণত হয়, আমরা যখন বুঝতে পারি! অনলাইন বিচারে বিচারহীন বন্দী থাকে স্বদেশের মানুষ।
সেই ট্র্যডিশন ক্রমাগত চলছে। বাক স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত।কারো কাছেই তা বন্ধক দেওয়া যায়না। কিন্তু বর্তমানে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেশের বিচার ব্যবস্থার সার্বিক ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ে মন্তব্য করলে আজ আদালত অবমাননার স্বতোঃপ্রনোদিত মামলার শুনানি করা যায়, হাজার হাজার লকডাউন সম্পর্কিত, স্বাস্থ্য, কাজ,শিক্ষা সংক্রান্ত মামলাকে শিকেয় তুলে।ভারভারা রাও থেকে আনন্দ তেলতুম্বডের জামিন, প্যারোল ইত্যাদির কথা বিবেচনা না করেই এবং বিজেপির ঘোড়া কেনা বেচার খেলায় রাজস্থানের সাম্প্রতিকতম ঘোড়ার বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেই। বিচার ব্যবস্থার সামনে এতবড় চ্যালেঞ্জ গত সত্তর বছরে আসেনি।
ভারতের বিচারব্যবস্থা অন্ধকারতম সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্ত ভূষনের ক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ,শচীন পাইলটের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার। এ কোন সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়, সরকারের সমালোচনা করলে কারণসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ আর সরকারকে মানে কেন্দ্রের সরকারকে সমর্থন করার সময় বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা! দুটি ক্ষেত্রে বিচারের নিক্তি শাসকের দিকে শাসনের দিকে হেলে আছে।
মাননীয় বিচারক,বিচার সুপ্রিম কোর্টের এক নম্বর ঘরে অশোকস্তম্ভের নীচের লেখাটার মানে যদি ধর্ম যেখানে জয় সেখানে হয় তাহলে বিচারের দেবী চোখ বন্ধ করে রাখলেও চলে, নিক্তির ভারসাম্য রক্ষা পায় টান টান দাঁড়িয়ে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক ঋজুতায়। এটা যেমন একটা পলিটিক্যাল পারপাস ঠিক তেমনি এই প্রাতিষ্ঠানিক ঋজুতাকে ধীরে ধীরে হাস্যস্পদ করে তোলাটাও একটা বড় পলিটিক্যাল পারপাস।আর এইকারণেই পাপেট জুডিশিয়ারির চেয়ে কমিটেড জুডিশিয়ারিও কিছু সময়, কিছু মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখে। মেজরিটি মাইনরিটি হয়।
তবে এই অবমাননার মামলা নতুন নয়।ই.এম.এস নাম্বুদ্রিপাদ, সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভি.আর কৃষ্ণ আইয়ার,প্রাক্তন আইনমন্ত্রী পি শিবশঙ্কর,লেখিকা অরুন্ধতী রায়,বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু,প্রাক্তন সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু – এঁদের সকলের বিরুদ্ধেই আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে।প্রতিটি মামলাই হয়েছে সত্য অথচ অপ্রিয় কথাগুলি প্রকাশ্যে বলার জন্য।
সাংবিধানিক বিচারের মাধ্যমে স্থির হয় সমকালীন ভারতের আইনের রাজনৈতিক দর্শন। তারপর কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার মামলার শুনানী দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রেখে,সি এ এ মামলা ঝুলিয়ে রেখে, লকডাউনের মধ্যে অযোধ্যায় রামলালা মন্দির গড়ার কাজ শুরু করতে করতে…মাননীয় বিচারপতি আপনারাই সাম্প্রতিককালে সন্তান হত্যার কাজ করছেন।সুপ্রীম কোর্ট তো সংবিধানের অভিভাবক,তাহলে সুপ্রীম কোর্টে কিভাবে একই প্রশ্নে, একই বিচারপতি দুটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এটাই কি শ্রেণী বিচার! এটাই কি সর্বোচ্চ আদালতের সদর্প ঘোষণার প্রতি ন্যায় বিচার।নাকি বিচারের রাজনীতি? বিচারব্যবস্থার রাজনীতি! বিষয়টি খুব সহজ ভাবে বলা আছে সি.পি.আই.(এম) এর কর্মসূচীতে-“বিচার বিভাগের পাল্লা শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী জনগনের অন্যান্য অংশের বিপক্ষেই ঝুঁকে আছে।আনুষ্ঠানিকভাবে ধনী – দরিদ্র নীতিগত ভাবে সমান বলে ঘোষিত হলেও বিচার ব্যবস্থা মর্ম বস্তুর দিক থেকে শোষক শ্রেণী গুলির স্বার্থ রক্ষা করে এবং তাদের শ্রেণী শাসনের পক্ষেই দাঁড়ায়।এমনকি বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে পৃথকীকরণের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নীতিও পুরোপুরি অনুসৃত হয়না এবং বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের অধীন।গণতান্ত্রিক নীতি ও সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে উর্দ্ধে তুলে ধরে এমন রায়কে শাসক শ্রেণী বানচাল করে দেয় তার নজির আছে বিচারপতিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় বিচারপতিদের কোনো কোনো অংশের মধ্যে কিছু দুর্নিতি মূলক কার্যকলাপের অভিযোগ উঠছে যার ফলে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।”
বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর। রাষ্ট্রের লক্ষ্য সংবিধানে নির্ধারিত থাকলেও তার বাস্তব রূপায়নের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ছবি আমরা দেখতে পাই। বাস্তবে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বিষয়টি সোনার পাথর বাটি হিসাবেই টিঁকে থাকে। তবু সেই বিচার ব্যবস্থারও তার ন্যূনতম সাংবিধানিক মূল্যবোধের দ্বারা চালিত হয়ে শোষিত,নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস ছিল। জরুরি অবস্থার অন্ধকার দিনগুলিতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে দায়বদ্ধ বিচারব্যবস্থা বা Committed Judiciary বানানোর চেষ্টা হয়েছিল, আজ মানে গত কয়েক বছরে আমাদের বিচারব্যবস্থা ক্রমশই শাসকের কথা বলা পুতুলে পরিণত হচ্ছে।গত মে মাসের ২৭ তারিখ আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে করোনা পরিপ্রেক্ষিতে বিচারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথাই শুধু স্বীকার করেননি বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেন বেশী কার্যকরী তারও ব্যখ্যা দিয়েছেন।
পরিযায়ী শ্রমিক মাইলের পর মাইল হাঁটছে।হাঁটুক।আদালতের কিচ্ছু করার নেই।আদালত কি করবে?
মানুষ তার প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেনা।খেতে দেওয়ার দাক্ষিণ্য দেখানো ছাড়া আদালতের কিচ্ছু করার নেই। আদালত কি করবে? আদালত কি করবে? সর্বোচ্চ আদালত? মহামান্য বিচারক, আমরা জানি আদালতের আদতে কিছুই করার নেই।আদালত আদতেই অসহায়। পরিয়ায়ী শ্রমিকের বেলায় অসহায়,বন্ধ কারখানার শ্রমিকের বেলায় অসহায়,আনন্দ তেলতুম্বডে কিংবা কবি ভারভারা রাও এর বেলায় অসহায়।সেখানে আদালত কি করবে? অন্যদিকে লকডাউনে মাইনে কাটা মালিক,ঘৃণা ছড়ানো সাংবাদিক কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় টেস্ট আটকাতে আয়ুষ্মান ভারতের সীমাবদ্ধতা চাওয়া আবেদনকারী সরকারের জন্য আদালত আছে, আদতেই আছে তীব্রভাবে আছে।
৯ ই নভেম্বর ১৯৬৭। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে কেরালার কমিউনিষ্ট নেতা ই.এম.এস নাম্বুদ্রিপাদ দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেন। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন মহামান্য কেরালা হাইকোর্ট। এই রায় চ্যালেঞ্জ করে ই.এম. এস নাম্বুদ্রিপাদের তরফে সুপ্রীম কোর্টের সামনে আপীল করা হয়। ১৯৭০ সালের ৩১ শে জুলাই সুপ্রীম কোর্ট কেরালা হাইকোর্টের রায় বলবত রাখার ঘোষণা করেন এবং বলেন ‘as regards sentence we think that it was hardly necessary to impose heavy sentence. The ends of justice in this case are amply served by exposing the appellant’s ignorance about the true teachings of Marx and Engels (behind whom he shelters) and by sentencing him to a nominal fine’
মহামান্য বিচারক, এ দেশের আদালত মার্কস-এঙ্গেলসের শিক্ষারও বিচার করেছে, এবং সেই শিক্ষা সম্পর্কে ই.এম.এসের অজ্ঞতার কথাও বলেছেন! আদালতের অনেক কিছুই করনীয় থাকে একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।আসলে এই রাষ্ট্রেরও তো একটা ক্লাস জাস্টিসের দায় থাকে নাকি! ঠিক বালকো শ্রমিক কর্মচারীদের করা মামলায় দেওয়া ১৯৯৭ সালের রায়ের মত।দেশের অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্তও দেশের আর্থিক নীতিজনিত, তাই সেক্ষেত্রে আদালতের কিছুই করার নেই।এই সমস্যা আমরা জানি মহামান্য বিচারপতি। কিভাবে পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকে দেশের সুপ্রীম কোর্ট সম্পত্তির অধিকার বাঁচাতে আদা জল খেয়ে লেগেছিলেন তা আমরা বিস্মৃত হইনি। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছিল আর সি কুপার মামলায়।মনে আছে একটার পর একটা জমিদারি বিলোপ আইন বা ভূমি সংস্কারের আইনকে রীতিমত বিচার ব্যবস্থার আক্রমনের সামনে পড়তে হয়েছিল।
দেশের বিচার ব্যবস্থার সমালোচনার প্রশ্নে ই.এম. এস নাম্বুদ্রিপাদের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি,”The Verdict of the Judiciary should be respected and enforced by the executive. As for the legislature it can only change the laws in order to remove the gulf that is found to exist between the will of the People and law as it interpreted by the judiciary. But it does mean that the judiciary is as much suboridinate to the will of the people as the executuve and legislature.”
কিন্তু রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের উপর নির্ভর করে তার বিচারের নিক্তি করাটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা বলে কিছু সম্ভব হয়না। সম্পত্তির অধিকারকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বাস্তবে একজন মানুষের বিচারালয় সম্পর্কে ধারনা গড়ে তোলে। এমনটা না যে সুপ্রীম কোর্ট ভুল করেনা বা করতে পারেনা, কিন্তু সে যখন নিজেকে অব্যর্থ ভাবতে শুরু করে তখন বিচারের বানী নীরবে না, নিভৃতে না সজোড়ে চুরমার হয় রাষ্ট্র দ্বারা শোষণের কষাঘাতে।রাজদ্রোহ বিরোধীতায়, অবমাননায়, মানহানিতে।লাঠি,গুলি,জেলখানার আবর্তে।