ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
আগামি ২৭শে সেপ্টেম্বর সারা দেশে ধর্মঘটের আহবান জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এই মোর্চার মধ্যে রয়েছে ৫০০টি কৃষক সংগঠন। ধর্মঘট সম্পর্কে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে, কিছু প্রশ্ন ইচ্ছাকৃত যোগান দেওয়া হয়। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদ নিজের রাজনীতি ছড়ায় – জনমানসে ধর্মঘট বিরোধী যুক্তি প্রচার করে। বিবিধ বাস্তবতা এবং সীমাবদ্ধতার কারনে ধর্মঘট ও তার প্রয়োজন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কিছু প্রশ্ন থাকে – একথা মনে রেখেই রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে “কেন ধর্মঘট?” প্রসঙ্গে দুই পর্বে ধারাবাহিক নিবন্ধ প্রকাশ করা হল। প্রথম পর্বে কৃষক আন্দোলন কেন এবং কোন পথে সেই আলোচনা থাকছে, দ্বিতীয় পর্বে ২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে জনসাধারনের অন্যান্য অংশেরও সক্রিয় সমর্থন সম্পর্কে আলোচনা থাকবে।
প্রথম পর্ব
এদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যাকিছু সংস্কার হয়েছে তার ফলে আজকের ভারতে নানা দিক থেকে নতুন বিনিয়োগ আসছে, কৃষিতে সেভাবেই বেসরকারি বিনিয়োগ এলেই তো বরং কৃষকদের দুর্দশা ঘুচবে। এতে আপত্তির কারন কি?
নয়া-উদারনীতি কিভাবে আজকের ভারতে সংকটের সৃষ্টি করেছে তার বিস্তারিত আলোচনা যদিও এই নিবন্ধের পরিসরে সম্ভব না, তবু একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান এহেন ভ্রান্ত ধারনা কাটাতে সমর্থ হবে। মনে রাখতে হবে ভারতে ১৯৯১ সাল পরবর্তী তিন দশক হল উদারনীতির যুগ। এই পর্বে (১৯৯৫ -২০২০) আমাদের দেশে চার লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এমন মনে করা ভুল হবে যে এতদিন উদারবাদের নজর কৃষির উপরে পড়ে নি, আসলে সরকারী বন্দোবস্তের ফলে কিছুটা হলেও কৃষকদের ন্যুনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। নয়া তিন কৃষি আইনে বিজেপি সরকার সেই অধিকারটুকুও বাতিল করে দিয়েছে।
দেশের সংসদে প্রথামাফিক এই আইনগুলি পাশ হয়েছে। একে চ্যালেঞ্জ করে কি সংবিধান স্বীকৃত গনতন্ত্রের পথকেই রুদ্ধ করা হচ্ছে না। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার আগে সংসদে আলোচনা করা যেত না কি?
হাস্যকর যুক্তি! কৃষকরাই বরং এই প্রশ্ন বারে বারে তুলেছেন! কেন সংসদে এই আইন নিয়ে আলোচনা করা হল না! কেন সারা দেশের কৃষক সংগঠনগুলির মতামত নেওয়া হল না! কোনো নতুন আইনের প্রভাব সমাজের যে নির্দিষ্ট সামাজিক অংশের উপরে পড়ে তাদের সাথে আইন প্রনয়নের পূর্বে আইনানুগ আলোচনার সাংবিধানিক পদ্ধতি আমাদের দেশে ছিলই! কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই সেই প্রথাকে অগ্রাহ্য করেছে। যে কায়দায় এই নয়া তিন কৃষিআইন পাশ করানো হয়েছে তাকে এক কথায় দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে আঘাত হিসাবেই বিচার করতে হবে।
আজ সারা দেশজূড়ে যখন কৃষকরা আন্দোলন করছেন সেইসময় কৃষিতে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রসঙ্গে নীতি আয়োগের কর্তা অমিতাভ কান্ত বিলাপ করে বলছেন “ভারতে বড়ো বেশি গনতন্ত্র রয়েছে”। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদিন করোনা সংক্রমনের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় একলাখের কাছে, তখন সংসদ খোলা রেখে কৃষিবিলগুলিকে আইনে পরিণত করতে সরকারের কোনো সমস্যা হয় নি। অথচ ডিসেম্বর মাসে দিনপ্রতি সংক্রমনের পরিমাণ যখন অনেকটাই কমে তিরিশ হাজারে পৌঁছায়, তখন সংসদের আলোচনা বাতিল করতে সরকারের তরফে সংক্রমনের অজুহাত দেওয়া হল। একে কেমন আচরণ বলা চলে? চালাকি সন্দেহ নেই – কিন্তু আদৌ দেশের সরকার সুলভ কি?
রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাধিক্য নেই, সেখানে বেশিরভাগ সাংসদ বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই নিয়ে সাংসদদের ভোটদানের অধিকার কেড়ে নিয়ে ভোটের আবেদন অবধি সরকার খারিজ করে দেয়। ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) – এর সাংসদেরা সোচ্চার হলে তাদের দুজনকে বরখাস্ত করা হল – এভাবে কৃষি বিল পাশ করিয়ে বিজেপি সরকার কাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে চাইছে?
দিল্লি সীমান্তে যারা আন্দোলন করছেন তারা তো সবাই পাঞ্জাব–হরিয়ানার কৃষক। সারা দেশে এই আন্দোলনের ছাপ কতদূর? এরা লড়াই–এর মনোভাব না নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করছেন না কেন?
লঙ্গরখানা পরিচালনা এবং প্রতিদিন এই আন্দোলনের সারা দেশ থেকে আগত বিবিধ প্রতিনিধিদের সুবিধার্থে যাবতীয় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আচরন সারা দেশে উদাহরণ তৈরি করেছে। সংগ্রামরত কৃষকদের ঐক্য ভাঙতেই তাদের কখনো পাঞ্জাবের কৃষক, কখনো হরিয়ানার কৃষক এভাবে ব্যাখ্যা করছে সরকার। কৃষকদের মধ্যে ধর্মের নামে বিভাজনের জন্য আন্দোলনে খালিস্তানিরা রয়েছে বলে কুৎসার প্রচার চলেছে। যদিও সেই প্রচারে কাজ না দেওয়ায় পরে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এস ওয়াই এল ক্যানালের জল বন্টনকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চলে। এত বাধা পেরিয়েও কৃষকরা লড়ছেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর সারা দেশব্যাপি ধর্মঘট আসলে সেই লড়াকু মনোভাবের প্রতি দেশের জনসাধারণের পক্ষ থেকে সংহতি।
রাজ্য সরকারগুলি এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে না কেন? রাজ্য বিধানসভায় কৃষি বিষয়ক সংশোধনী আইন পাশ করিয়ে নিজেদের রাজ্যে কৃষকদের পাশে থাকতে রাজ্য সরকারগুলির কি অবস্থান?
ঠিকই। সংবিধানের সপ্তম তপশীল অনুযায়ী কৃষি হলো রাজ্য সরকারের তালিকাভুক্ত বিষয়। বর্তমানে কেন্দ্র রাজ্য যৌথ তালিকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে যাতে কৃষির ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলির অধিকার খর্ব করা যায়। রাজ্য সরকারগুলোকে মডেল অ্যাক্ট মেনে চলার নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে কৃষি আইনসমুহ বিনাবাধায় মেনে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে কেন্দ্র এমন দুটি মডেল অ্যাক্ট গঠন করে। ১৭ সালে কৃষিজ উৎপাদন, লাইভস্টক মার্কেটিং আইন এবং ১৮ সালে কৃষিজ উপাদান ও লাইভ স্টক কনট্র্যাক্ট মার্কেটিং সংক্রান্ত আইনে যা যা প্রস্তাব করা হয় সেগুলিই আজকের তিনটি কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার লক্ষ্য করে একমাত্র অরুণাচল প্রদেশ সম্পূর্ণরূপে মডেল আইনটি নিজেদের রাজ্যে লাগু করেছে, অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব এবং ছত্তিশগড় এই মডেল আইনের মধ্যে থেকে নিজেদের ইচ্ছানুসারে কিছু অংশ প্রয়োগ করছে। ২০২০ সালের জুন মাস নাগাদ কেন্দ্রীয় কৃষি দপ্তরের সচিব চিঠি লিখে রাজ্যগুলিকে মডেল অ্যাক্ট সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স গ্রহণের নির্দেশ দেন।
রাজ্য সরকারগুলো যদি চায় তবে তারা নিজেদের সংশ্লিষ্ট বিধানসভায় নির্দিষ্ট আইনের সংশোধন নিয়ে আসতেই পারে। যদিও রাজ্যগুলির উপরে এধরনের সংশোধনীর ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের মাধ্যমে কাজের নিরিখে অর্থ মঞ্জুরীর কথা ঘোষণা করেছে, এতে কেবল তখনই অর্থ মঞ্জুরির সুযোগ পাওয়া যাবে যদি রাজ্যগুলি কনট্র্যাক্ট অর্থাৎ চুক্তি ভিত্তিক চাষ এবং জমি লিজ আইন প্রনয়ন করে। অর্থাৎ রাজ্য সরকারগুলিকে কৃষি আইনে জরুরী কোনরকম সংশোধনী লাগু করতে ঘুরপথে কেন্দ্রীয় সরকার বাধা দিচ্ছে। এর পরে আরো একধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে কর্পোরেটদের সুবিধার্থে এক সাধারণ জাতীয় মডেল আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেই মডেল আইনগুলির তুলনায় এখনকার নয়া কৃষি আইনসমুহ আরও অনেক বেশি কর্পোরেট স্বার্থবাহী।
সরকার তো আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বারে বারে। সেই আলোচনায় কি কোন সমাধানসুত্র পাওয়া সম্ভব না?
অবশ্যই সম্ভব! যদি সমাধানসুত্র খুঁজে পেতে বিজেপি সরকারের আদৌ কোন সদিচ্ছা থাকে। বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ে মিলে প্রচার করছে যে তারা কৃষি আইন বাতিল ব্যতিরেকে যেকোনো দাবিতে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এই আলোচনা সম্পর্কে সরকারের তরফে লিখিত বক্তব্যে আবার তারাই উল্লেখ করেছে সংশ্লিষ্ট আইন বিষয়ক চুক্তি বজায় থাকবেই, আলোচনাক্রমে বলা যেতে পারে কৃষকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেই চুক্তির রং সাদা হবে নাকি কালো! অর্থাৎ সরকার চাইছে আলোচনা এমন হোক যাতে কোনকিছুই পরিবর্তন না করতে হয়। এমন মনোভাবে আলোচনা হতে পারে না।
নয়া কৃষি আইন বলে যা হচ্ছে তার আসল কথা কি? কৃষকদের পক্ষ থেকে সেই আইনগুলির বিরোধিতা করার মূল পয়েন্ট কি কি?
নয়া তিন কৃষি আইন প্রধানত তিনটি বিষয় সম্পর্কিত –
১) কৃষিজাত পণ্য বিপণন বিষয়ক ( Promotion and Facilitation Act)
সোজা কথায় এই আইন কৃষিজাত ফসল বিক্রির বন্দোবস্তে সরকারী ব্যাবস্থা (APMC) সংক্রান্ত। মনে রাখতে হবে বিহারে ২০০৬ সালে এপিএমসি (APMCs)গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার ফলাফল কেমন ছিল? বিহারের কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসল বেসরকারি মালিকের হাতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ধানের বিক্রয়মূল্য হয়ে দাঁড়ায় ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের তিন ভাগের এক ভাগ থেকেও কম। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রদেশে নয়া কৃষি আইনের সুবাদে বহু কৃষক বেসরকারি মালিকানায় ফসল বিক্রি করে প্রতারিত, সর্বসান্ত হয়েছেন (চেক বাউন্স, টাকা আদায়ে ব্যর্থতা, চুক্তি সত্বেও সম্পূর্ণ টাকা উদ্ধার না করতে পারা) – কোনো ক্ষেত্রেই সুরাহা করা যায় নি।
এখনও অবধি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ফসলের বাজার (APMC) রয়েছে প্রায় ২৪৭৭ টি। এগুলি ছাড়াও সারা দেশে নির্দিষ্ট জায়গায় আধা সরকারি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪৮৪৩ টি ছোট বাজার রয়েছে। স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারা দেশে প্রতি ৮০ বর্গ কিলোমিটার ব্যবধানে আরো অনেক বাজারের বন্দোবস্ত করতে হবে, বর্তমানে প্রতি ৫০০ বর্গ কিলোমিটার ব্যবধানে (গড় হিসাবে) এই সুবিধার সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই সুপারিশ অনুযায়ী জরুরী সংস্কার মেনে নেওয়া হলে তাতে সত্যিই কৃষকদের লাভ হত। কিন্তু সরকার নতুন কোনো বাজারের বন্দোবস্ত করতে অস্বীকার করেছে, উল্টে পুরানো অবস্থায় প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার আরো কাটছাঁট করছে।
এতে কৃষকের কোন সমস্যার সমাধান হবে? এতদিন APMC-র কারনে যতটুকু সুবিধা ছিল এই আইনের বলে সেই সুবিধাটুকুও থাকবে না? এরই নাম “সবকা সাথ – সবকা বিকাশ”?
২) চুক্তি ভিত্তিক কৃষিকাজ বিষয়ক ( Agreement on Price Assurance and Farm Services Act)
এই আইনের ফলে চুক্তির জোরে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারির রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে কৃষি বাজারের গোটা ব্যাবস্থাই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বড়ো বড়ো কৃষি বিপণন সংস্থাগুলি কৃষকদের ঘাড়ে চেপে বসবে এবং কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন অস্পষ্টতা ও জটিলতায় ভরা চুক্তির ভিত্তিতে উৎপাদিত ফসল হস্তান্তর করতে বাধ্য করবে। এই আইনে এমন কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই যাতে বলা যায় কৃষকেরা উৎপাদিত ফসল বেচে ন্যায্য দাম এবং চুক্তির ভিত্তিতে কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক পাবেন। প্রয়োজন হলে নির্বাচিত স্থানীয় সংসদ, গ্রামসভা কিংবা কৃষক সংগঠন গুলি কোনরকম জটিল অবস্থাতেই কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে পারবে না। এমনকি চুক্তির জটিলতা দূর করতে কৃষকদের কোর্টের দ্বারস্থ হবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে এই আইনে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জটিল অবস্থার সমাধানে কৃষকদের কোর্টের দ্বারস্থ হবার সুযোগটুকু আইনে অন্তর্ভুক্ত করাই যেত। সেই সুযোগ তো দূর, বেসরকারি বিপণন সংস্থার সাথে কৃষকদের চুক্তির মধ্যে সরকার নিজেকে কৃষকদের পক্ষে নিশ্চয়তা জ্ঞাপক (Guarantor) হিসাবেও রাখতে চায় না। পাঞ্জাবে বহুজাতিক সংস্থার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে আলু চাষের অভিজ্ঞতা ভয়ানক, কৃষকেরা সরাসরি শোষণের শিকার হয়েছিলেন। চুক্তির খেলাপ করা হলে হিমাচল প্রদেশের একজন আপেল চাষীর পক্ষে আদানি ফ্রেশ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোর্টে এক দীর্ঘ আইনি লড়াই করা আদৌ সম্ভব হবে? কৃষি আইনে সংস্কারের নামে আসলে সরকার কৃষকদের সুরক্ষায় নিজের দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়। কৃষকরা তখনই সুরক্ষিত থাকবেন যদি সরকার নিজেকে কৃষকদের পক্ষে নিশ্চয়তা জ্ঞাপক (Guarentor) হিসাবে ঘোষনা করে।
মনে রাখতে হয় একসময় বণিকের ছদ্মবেশে ঢুকে দেশ দখল করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, তাদের তবু কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সকলেই সেই আক্রমণ চুপ করে মেনে নেয় নি। আজ দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে দেশের গোটা কৃষি ব্যাবস্থাটাকেই উপহারের মতো করে তুলে দেবার আইন করছে বিজেপি সরকার। একে আটকানোর লড়াইতে সাথে নেই যারা তাদের স্বার্থ কাদের দিকে?
এবং
৩) খাদ্যপণ্যের মজুত বিষয়ক ( Essential Commodities Act)
এই আইনের বলে কার্যত অবৈধ হোর্ডিং / মজুত কে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। খাদ্য মজুত করার উর্ধ্ব সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাদার সংস্থাগুলি নিজেদের মজুত বাড়িয়ে বাজারে মেকি অভাব তৈরি করবে এবং দাম বাড়িয়ে নেবে – বুঝতে অসুবিধা হয় না। খাদ্যপণ্যের দামে এমন ভয়ানক অস্থিরতার ফলে জনগণের খাদ্য সুরক্ষা গভীর সংকটে পড়বে। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সহযোগিতায় নিজেদের জন্য জমি এবং খুবই সহজ শর্তে পাওয়া ব্যাংক ঋণের সাহায্যে আদানি গোষ্ঠী অতি দ্রুতগতিতে নিজেদের কোল্ড স্টোরেজ এবং সাইলো মেশিন ইত্যাদির সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছে। এমন ঘটনা আকস্মিক নয়, বরং বোঝাই যায় এসবই হচ্ছে সরকারি নীতির ব্যাপারে এক গভীর আলোচনার ভিত্তিতে। কিছুদিন আগেই হরিয়ানায় কৃষিজমি ব্যবহার সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে পানিপত জেলায় আদানি গোষ্ঠী ১৫০ একর কৃষি জমি অতি স্বল্প মূল্যে কৃষকদের থেকে কিনে নিয়ে সেখানে সাইলো স্থাপন করতে পারে। এমনভাবে কৃষিপন্যের উৎপাদনে একচেটিয়া কর্পোরেট রাজ কায়েম হবে। এই আইনের ব্যাপারে কৃষকদের বিরোধিতা এই কারনেই। আবার একই কারনের বিপরীত স্বার্থে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই।
১৯৯১ পরবর্তী আর্থিক সংস্কারের অনুসারী অর্থনৈতিক নীতির প্রভাবে কৃষিতে বেসরকারি কর্পোরেটদের হস্তক্ষেপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। উদারবাদের প্রথম পর্বে বহুজাতিক সংস্থাগুলি কৃষিজ উৎপাদনের চাহিদা যোগানের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বীজ, সার এবং কীটনাশক ইত্যাদিতে নিজেদের বিস্তৃত করেছিল। এখন নয়া কৃষি আইনের জোরে তারা সেই বিস্তৃতির পরিসর আরও বাড়িয়ে গোটা কৃষি বানিজ্য ক্ষেত্রকেই গিলে খেতে চায়। এই আইনে নিয়ন্ত্রিত মান্ডিগুলি দুর্বল হবে, সরকারি শস্যভাণ্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (FCI) এবং সরকারি মান্ডির হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কৃষি ক্ষেত্রের সমস্ত উদ্বৃত্তই জমা হবে বহুজাতিক সংস্থার হাতে। ফলে ধীরে ধীরে কর্পোরেট সংস্থাগুলি খাদ্য সরবরাহের গোটা ব্যবস্থাটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে এবং তারাই নির্ধারক হয়ে বসবে।
সরকারের নয়া কৃষি আইন আগাগোড়া ত্রুটিপূর্ণ একথা স্পষ্ট। এই আইন প্রণয়নের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ত খেয়াল ছিল না যে রাজ্য সরকার কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনে জরুরী হস্তক্ষেপ করতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছিল। কেন্দ্রীয় আইনে একমাত্র কর্পোরেটদের স্বার্থের কথা ভাবা হয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে দেশের কৃষক এবং জনগণের যাবতীয় স্বার্থকে সরকার এড়িয়ে গেছে। সরকারের এমন মনোভাবের কারণেই, কোনরকম সংশোধনীর মাধ্যমে এই আইনগুলিকে কিছুতেই কৃষকদের স্বার্থবাহী কানুনে পরিণত করা সম্ভব নয়।
কৃষক আন্দোলন ও ভারতে শ্রেণীসংগ্রামের সম্পর্ক
অনেকেই নয়া-উদারনীতি এবং কৃষি অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্কের প্রসঙ্গে দুয়ের মধ্যেকার যোগসূত্রটি খুঁজে পান না। মূল সংকট কোথায়? ২০০৮ সাল থেকে লগ্নীপুঁজি সংকটে পড়েছে, এখনও সেই সংকট থেকে তা মুক্তি পেতে পারে নি। এমন অবস্থায় সংকট (অর্থাৎ মুনাফার হার) যত গভীর আকার নিচ্ছে তত বেশী করে লগ্নীপুঁজি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জমি (অর্থাৎ মুনাফার নতুন ক্ষেত্র) খুঁজছে। আমাদের দেশ এক বিরাট বাজার। সেই বাজারে খাদ্যের ব্যবসা (মুনাফার লক্ষ্যে) অবশ্যই লোভনীয় – আর তাই কর্পোরেটদের পছন্দের রাজনৈতিক দল দেশের ক্ষমতায় এসে তাদেরই স্বার্থে কাজ করছে। তিন দশকের উদারনীতি কোনদিনই মানুষের কল্যানের কথা ভেবে পরিচালিত হয় নি, এখন সংকটে পড়ে সেই উদারনীতিই নিজের নখ-দাঁত সমেত আক্রমণ নামিয়ে আনছে মানুষের উপরে। সরকারের নাম করে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে গোটা দেশের কৃষিব্যবস্থাকেই। ন্যায্য দামে ফসল কেনার সরকারী আইন থাকলে সেই পথে বাধা আসে, সরকারী মান্ডি থাকলে কম পয়সায় ফসল বেচতে কৃষককে বাধ্য করা যায় না, কোর্টে মামলা করার অধিকার থাকলে মুনাফা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা ধাক্কা খায় – সুতরাং এই সবকিছু বাতিল করতে হবে। সেই পরিকল্পনারই বহিঃপ্রকাশ হল নয়া তিন কৃষি আইন। লড়াই কৃষকরা একা লড়ছেন বললেই সবটা বলা হয় না – বলতে হবে আজকের দিনে পুঁজি বনাম শ্রমের যে মূল লড়াই জারী রয়েছে তারই একটা ফ্রন্টে ভারতের কৃষকরা লড়াই শুরু করেছেন। জীবন বাজি রেখে কৃষকদের লড়াই-আন্দোলন শুধুই নিজেদের স্বার্থে না, গোটা দেশের জনগণের খাদ্য সুরক্ষার স্বার্থেও। সেই জন্যেই তারা দেশের জনসাধারনকে নিজেদের লড়াইতে পাশে থাকার আহবান জানিয়েছেন – ২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে গোটা দেশের মানুষ সেই লড়াইতে যুক্ত হবেন, জনবিরোধী কৃষি আইন বাতিল করার দাবীতে তাদের লড়াইয়ের সাথে জুড়বে সারা দেশের মানুষের শক্তি। লেখা হবে নতুন ইতিহাস।
যেসকল দাবীতে ধর্মঘট
১) বর্তমানে আয় নেই এমন প্রতিটি পরিবারের জন্য প্রতি মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা দেবার ব্যবস্থা করেতে হবে।
২) প্রতিটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের জন্য প্রত্যেক মাসে মাথাপিছু ১০কেজি রেশন দিতে হবে।
৩) MGNREGA প্রকল্পের পরিসর বৃদ্ধি করে গ্রামীন এলাকায় বছরে ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে, শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪) কৃষক বিরোধী এবং শ্রমিক বিরোধী সকল আইন সমুহ বাতিল করতে হবে।
৫) রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটগুলি (যেমন রেলওয়েস, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, বন্দর ইত্যাদি) কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
৬) সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রগুলিতে কর্মরতদের চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগে তাদের অবসর নিতে বাধ্য করার দানবীয় আইন বাতিল করতে হবে।
৭) সবার জন্য পেনশন স্কীম কার্যকরী করতে হবে। এনপিএস (National Pension Scheme) বাতিল করে পূর্বের পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইপিএস-৯৫ (Employees’ Pension Scheme) কে সংশোধন করতে হবে।
*দ্বিতীয় পর্বে শেষ