প্রভাত পট্টনায়েক
আমরা যখন দেশের স্বনির্ভরতার কথা বলী তখন প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্য সামগ্রী আমাদের দেশেই নির্মিত বা উৎপাদিত হবে এমনটা ধরে নেওয়া হয় না। সমস্ত পণ্য সামগ্রী অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় নির্মিত হবে এমন ভাবনাকে অর্থনীতির পরিভাষায় ‘অটার্কি’ বলা হয়, স্বনির্ভরতার জন্য অটার্কি’র প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক নয়। দরকার হল আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কার্যকরী পুঁজি (ঝুঁকি রয়েছে এমন বিনিয়োগ ব্যতীত) ও বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার (যা রপ্তানি মারফত দেশের আয় হিসাবে গড়ে ওঠে) সম্পর্কিত সরকারের সুস্পষ্ট নীতি, অবস্থান। যদি ঐ দুয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশীয় আমদানির খরচ মিটিয়ে ফেলতে পারি তবে অর্থনীতি পাকাপোক্ত অবস্থায় রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। যদি তেমনটা না করা যায়, অর্থাৎ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে টান পড়ে এবং খরচের ধাক্কা সামলাতে লাগাতার ঝুঁকি রয়েছে এমনসব পথে পুঁজির সঞ্চালনা চলতে থাকে তবে সাময়িকভাবে অত্যাল্প কিছু সুরাহা হলেও আগামী দিনে দেশীয় অর্থনীতি সমস্যায় পড়েই। এই জন্য আমদানির খরচ মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার উপর আমরা যত কম নির্ভর করব আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ততই দৃঢ় হবে। ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া করার সময় অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বৈদেশিক মুদ্রার উপরে নির্ভরতাকে শুন্য ধরে নিয়ে হিসাব করেছিলেন। এমন অবস্থান অবশ্যই চুড়ান্ত প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে নির্ধারিত। অধ্যাপক মহলানবিশের মূল ভাবনাটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার খালি, এমনটা হলে কি করতে হবে? আসলে স্বনির্ভরতার কথা মাথায় রেখেই ঐ পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। আমদানির মাধ্যমে কোনরকম পণ্য সামগ্রীর চাহিদা মেটানো না গেলে যে কোনও দেশকেই নিজের জোরে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাৎক্ষণিক সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে দেশীয় অর্থনীতি এমন পথে এগোতে বাধ্য হয় যার ফলে প্রকৃত অর্থে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা যায়। অর্থনীতির পরিভাষায় একেই ‘বিল্ডিং ক্যাপিটাল গুডস’ বলা হয়। পরবর্তীকালে জাতীয় অর্থনীতিতে মহলানবিশ মডেল ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়, অন্যান্য মডেল অনুসরণ করা শুরু হয়। মহলানবিশের পরিকল্পনামতো বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার’কে শুন্য না ধরে নিয়ে পরবর্তী মডেলগুলি আমদানির পরিমাণকে একটি নির্দিষ্ট পরিমানে বেঁধে সামনে এগোনোর কথা বলে।
জাতীয় অর্থনীতি প্রসঙ্গে আরেকটি কথাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা আমদানি খরচ কমাতে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারের উপরে নির্ভরতা কমাতে চাই এবং তেমনটা করতে গিয়ে ক্রমাগত লগ্নী পুঁজির উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি তখনও আরেক সংকট দেখা দেয়। মনে রাখতে হবে লগ্নী পুঁজি খুবই ক্ষণস্থায়ী চরিত্রের হয়, যে কোনও সময় তা আমাদের দেশের বাজারে যেমন প্রবেশ করতে পারে তেমন চলেও যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলি যদি লগ্নী পুঁজির জোরে নিজেদের বাজারে পণ্য চাহিদার মোকাবিলা করতে যায় তবে তার ফলাফল ভয়ংকর হতে পারে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় এমনই ঘটেছে, পাকিস্তানের অবস্থাও তাই, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা যাবে। আজকের পৃথিবীতে বিশ্ব পুঁজিবাদ এমনিতেই সংকটগ্রস্থ অবস্থায় চলছে। আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ক্রমশ কমছে, এই অবস্থায় লগ্নী পুঁজির ভরসায় জাতীয় বাজেটে আয়-ব্যায়ের ব্যবধান (ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস) যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় বোঝা যাচ্ছে এমনটা দীর্ঘকাল চলতে পারে না। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস বরাবরের মত লগ্নীর জোরে ম্যানেজ করা যায় না। এজন্য আমাদের লগ্নী পুঁজির ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। কোনও একটি দেশের অর্থনীতি যখন তেজি অবস্থায় থাকে তখন প্রয়োজন না হলেও বহুবিধ পথে বিপুল পরিমাণ লগ্নী তার বাজারে প্রবেশ করে অথচ সংকটে পড়লে বিনিয়োগের জন্য যখন লগ্নীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ঠিক তখনই সে ঐ দেশের বাজার ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এভাবে ধোঁকা দেওয়ার বহু উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। লগ্নী পুঁজির ব্যক্তি মালিকানার স্বার্থ বিবেচনা করে পরিচালিত হয় বলেই এমনটা ঘটে। বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজি সবসময় আশংকায় থাকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া কোনও দেশের মুদ্রাস্ফীতি যেকোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং সেই অবস্থায় ঐ দেশের বাজারে লগ্নীর পূর্বনির্ধারিত মুনাফার হারও কমে যাবে। তাই সংকটের আভাষ পাওয়া মাত্রই লগ্নী হওয়া পুঁজি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। এই কারণেই জাতীয় অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতার কথা উঠলে প্রথমেই ফরেন এক্সচেঞ্জের উপরে নির্ভরতা কমানোর ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হয়। তবে উপায় কি? আমদানির খরচের বোঝা যতদূর সম্ভব রপ্তানির আয় মারফত হতে হবে। এর পাশাপাশি সেই ধরণের লগ্নীর উপরেই ভরসা করতে হবে যেসকল ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিপদ অনেকটা কম, বাড়তি খরচের চাপ কম থাকবে অর্থাৎ গৃহীত ঋণে সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম হবে। চীন এক্ষেত্রে বাস্তব উদাহরণ। তারা সবসময় আমদানির তুলনায় (তাদের মুদ্রার হিসাবে) রপ্তানির পরিমাণকে বেশি করে রাখতে পেরেছে। একে এক্সপোর্ট সারপ্লাস বলা হয়। বিপরীতে ভারতের বাজারে সর্বদাই আমদানির চাপ বেশি থেকেছে, অর্থাৎ আমাদের বেলায় ইমপোর্ট সারপ্লাস ঘটছে। আগেকার অবস্থায় আমাদের দেশে সেই সারপ্লাস অর্থাৎ বাড়তি খরচ’কে বৈদেশিক অর্থ সাহায্য (ফরেন এইড), কম সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ইত্যাদি মারফত সামাল দেওয়া হত। বিশ্বায়নের জমানায় পণ্য ও পরিষেবা আমদানির উপরে যাবতীয় আইনি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আগেকার নিয়মে দেশীয় উৎপাদনকে সুরক্ষিত রাখতে যে যে পণ্যের উপরে নিয়ন্ত্রন ছিল এখন আমরা সেইসব পণ্যও আমদানি করছি। এর ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতি বছর বাণিজ্য ঘাটতি (ট্রেড ডেফিসিট) ও আয়-ব্যায়ের হিসাবে ঘাটতি (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট) বেড়েই চলেছে। এধরণের ঘাটতিকে ইদানিং লগ্নী পুঁজির জোরে মেটানো হচ্ছে। আগামিদিনে লগ্নী পুঁজি ভারতের বাজার ছেড়ে চলে গেলে অবস্থাটা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
এবার স্বনির্ভরতার প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ক্ষেত্রের পর্যালোচনা করা যাক। যে কোনও দেশের জন্যই কিছু নির্দিষ্ট পণ্য নির্ধারিত থাকে যাদের মূখ্য পণ্য (কিই কমোডিটি) বলে, দেশের বাজারে এধরণের পণ্যের চাহিদা সর্বদাই বেশি থাকে। সাময়িকভাবে মনে হতে পারে ঐ পণ্যসামগ্রী উৎপাদন না করা গেলেও সমস্যা নেই, আমরা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমদানি মারফত ঐ চাহিদা মেটাতে পারব। কিন্তু সমস্যা হল বিশ্ববাজারে অন্যান্য দেশগুলি আমাদের প্রয়োজনের সময় জরুরী পণ্যসামগ্রী আমাদের চাহিদা অনুযায়ী সওদা নাও করতে পারে। এমনকি পরিমাণের দিক থেকে যদি সেরকম যোগানদার পাওয়াও যায় তা হলেও অন্য আরেকটি সমস্যার সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। সেই সমস্যা বিনিময় মূল্যের। ভারতের মতো এক বিরাট দেশ নিজেদের বিপুল পরিমাণ চাহিদা নিয়ে হাজির হতে চলেছে এই আভাষ পাওয়া মাত্রই বিশ্ববাজারে ঐসকল পণ্যের বাজারদর অনেকটাই বেড়ে যাবে। খাদ্য সামগ্রী হল তেমনই এক পণ্য। প্রকতিজাত সম্পদ হিসাবে খাদ্য এবং যাবতীয় কাঁচামাল সহ জীবাশ্ম জ্বালানীর সবটাই যেমন নিজেদের দখলে রাখতে চায় সাম্রাজ্যবাদ, তেমনই দখল করতে চায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের উর্বরা জমিও। এই লক্ষ্যেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সহজলভ্য কৃষিজমির উপরে তার শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ, কারণ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলি এমনসব ফসল উৎপাদনে সক্ষম যা পুঁজিবাদের সদর দপ্তর রয়েছে এমন দেশগুলিতে ফলে না। ঔপনিবেশিক জমানায় মুনাফা লুটে নিতে সেইসব সদর দপ্তরগুলির হাতে একটি অমোঘ অস্ত্র ছিল। আমাদের দেশেই নির্লজ্জের ন্যায় সেই অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয়েছে সর্বাধিক। ঔপনিবেশিক সরকারগুলির অন্যতম প্রয়োজন ছিল কর আদায় করা, সেই আদায় পুষিয়ে নেওয়া হত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ( সেই সময় পেরিয়ে গেলে কৃষক তার জমির উপরে ন্যুনতম অধিকারটুকুও হারাত) কৃষকদের দেয় খাজনার মাধ্যমে। দেয় খাজনা মেটাতে বেনিয়াদের থেকে ঋণ নিতে কৃষকরা বাধ্য হত, সেইসব বেনিয়ারা ঋণের শর্ত হিসাবে উৎপাদিত ফসলের দাম বেঁধে দিত। ফসল উৎপাদনের পরে পূর্ব-নির্ধারিত দামেই ফসল বেচতে হত বেনিয়াদের কাছেই, কোন ফসলের চাষ করা হবে তাও তারাই নির্ধারণ করত। ফসল নির্ধারণে বিবেচিত হত বাজার-দর এবং প্রধান প্রধান লুঠেরা দেশের চাহিদা। ঠিক যেমন আফিম ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আফিম চাষে বাধ্য করেছিল। সাতের দশকে আমাদের দেশের কৃষিব্যবস্থায় পুঁজিবাদের বেড়ে ওঠা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কারোর মনে হতে পারে প্রায় অর্ধ শতাব্দির বেশী সময় ধরে পুঁজিবাদের গড়ে ওঠার পরেও যখন কৃষকেরা বিপন্ন হয় নি তখন কেন এইবার পুঁজিবাদের হাতে কৃষিক্ষেত্রকে দখল করা নিয়ে এতো হইচই করা হচ্ছে। এত বিশাল সময় ধরে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার পরেও দেশের কৃষিজীবীরা নিশ্চিহ্ন হন নি, তাহলে এখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবেন এমন আশংকা করা হচ্ছে কেন? রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃষি বাজারের উপরে কোনোরকম হস্তক্ষেপের সুযোগ না রেখে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পণ্য উৎপাদনকারী ব্যবস্থায় রুপান্তরিত করা হলে তিনটি নির্দিষ্ট বুনিয়াদী পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমে দেশের জমি সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববাজারের অধীনস্থ করতে হবে, যার অর্থ হবে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়া। এমনটা হবে কারন তখন জমি নীতি কিংবা কৃষি জমির ব্যাবহার উন্নত দেশগুলির ক্রয়ক্ষমতার উপরে নির্ভর করবে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলিতে খাদ্যের বাজারে চাহিদা থাকে মূলত সাধারণ খাদ্যশস্যের বদলে গ্রীষ্মকালিন সময়ে উৎপাদিত ফসলের উপরে, ফলে পণ্য উৎপাদন ব্যাবস্থায় দ্বিতীয় যে পরিবর্তন সাধিত হবে তা হল আমাদের দেশের কৃষিজমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদল ঘটানো। এর ফলে দেশের খাদ্যশস্যের ভান্ডারে টান পড়বে এবং আকালের সময়ে বাড়তি খাদ্যের চাহিদা মেটাতে আমরা খাদ্য আমদানি করতে বাধ্য হব। তৃতীয়ত দেশের কৃষকসমাজ কর্পোরেটদের দয়ার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তাদের অর্থনৈতিক পরিচিতির অবনমন ঘটবে। এমন হবার অনেক পদ্ধতি হতে পারে। অনুমানের সুবিধার্থে আমরা একটি পদ্ধতির কথা ভাবতেই পারি – বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের দেশের কৃষকেরা যদি মজুরির বিনিময়ে কর্পোরেটদের জন্য শস্য উৎপাদন করতে শুরু করে তবে আকালের সময়ে তারা চরম দেনাগ্রস্থ হতে বাধ্য হবে অথবা যদি কখনো ফসলের দাম পড়ে যায় (কর্পোরেটদের সাথে ফসল বিনিময়ের চুক্তিমুল্য যাই হোক না কেন বাজারে ফসলের দাম পড়ে যাওয়ার কুপ্রভাবও সরাসরি কৃষকদেরই ভোগ করতে হবে)। একবার যদি তারা কর্পোরেটদের সামনে ঋণের জালে জড়ায় তবে তাদের জমিহারা হয়ে মজদুরে পরিনত হবে। কৃষিক্ষেত্রকে আগাগোড়া পণ্য উৎপাদনের আয়ত্বে নিয়ে যাবার অর্থই হল কৃষকদের চরম দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেওয়া। কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের অধোগতির সমানুপাতেই সারা দেশের মেহনতি মানুষের লড়াই আন্দোলনের অবস্থা নির্ণীত হয় বলে সারা দেশেই মেহনতি মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার বৃদ্ধি ঘটবে। এই ব্যাপারটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে আমরা একটি অবস্থার কথা ভাবতে পারি। ধরা যাক কৃষিজমিতে স্বাভাবিক চাষ-আবাদের বদলে অর্থকরী ফসল ফলানো শুরু হয়েছে কিন্তু প্রতি একর জমিতে কর্মসংস্থানের অবস্থা একই রয়েছে। যদি কর্মসংস্থানের চিত্র একই না থেকে কিছুটাও অধোগতিপ্রাপ্ত হয় তবে সার্বিক দারিদ্রের অবস্থা অবশ্যম্ভাবী। আরও ধরে নেওয়া হল অর্থকরী ফসল ফলানো সত্ত্বেও কৃষক এবং ক্ষেতমজুরদের মাথা পিছু আয়ও এক রয়েছে। এই অবস্থাতেও যদি কেবল একটি বছরে অর্থকরী ফসলের বাজার মুল্য পড়ে যায় তখন গোটা দেশের মেহনতি মানুষের (কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং শ্রমিক) আয় পড়ে যাবে এবং উল্লেখযোগ্য হিসাবে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমবে যার ফলে বাধ্যতামূলক ধার করে বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়বে। এভাবেই একবার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লে তাদের দুর্দশার শেষ থাকবে না এবং ক্রমাগত সেই অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যাবে। এমনটা হবেই কারন আমাদের দেশে কৃষক এবং বাজারের মাঝে কর্পোরেটরা থাকায় পণ্য উৎপাদনে বাজারে দাম পড়তে শুরু করলে তার প্রভাব উৎপাদকের উপরেই এসে পড়বে কিন্তু বাজারে দাম বৃদ্ধির সময় এমন কিছু হবে না। সুতরাং বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লে সেই সুবিধা ভোগ করা কিংবা দাম কমে গেলে সেই ক্ষতিপূরণের সুযোগ দুটোর কোনটারই বাস্তবতা নেই। ফলত ঋণগ্রস্থ কৃষকের গলায় দেনার বোঝা ঝুলতেই থাকবে, তাদের দারিদ্র আরও ভয়াবহ চেহারা নেবে। এর ফলে কৃষিকাজ থেকে সরে এসে মজদুরি করা জনগণ কাজের খোঁজে ঘুরতে থাকবে, তার হবে কাজের বাজারে বেকারদের এক বিশাল মজুত বাহিনী। সবটা মিলিয়ে এই অবস্থা সংগঠিত শ্রমিকদেরকেও সংকটের মধ্যে টেনে আনবে।
এই কারণেই আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদনকে স্বনির্ভরতার দ্বিতীয় ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হতে হবে। স্বনির্ভরতার তৃতীয় প্রসঙ্গে উৎপাদন সংক্রান্ত প্রযুক্তিকে আবর্ত করে আলোচনা এগোতে হয়। উৎপাদনের কাজে আমরা যে প্রযুক্তিই ব্যবহার করি না কেন সেই প্রক্রিয়া-প্রকরণ সুরক্ষিত হতে হবে। যদি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি বিদেশ থেকে কেনা হয় কিংবা সময়োপযোগী না হয় তবে তা কার্যকরী হবে না। এমনটা হলে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সংকটগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যাবে। যে প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হোক না কেন তাতে নিজেদের চাহিদা মাফিক রদ-বদল করা, সময়োপযোগীকরণ করার অধিকার থাকা দরকার। ইদানিং প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তার ভিত্তিই হল এই ধারণা। এক্ষেত্রে দেশে লভ্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ভিত্তিতেই সামনের দিকে এগোনোর পথে চলতে হয়। বৈদেশিক প্রযুক্তি নিয়ে আসার সাথে দেশীয় প্রযুক্তির উন্নতিসাধনের কাজটিও এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। আধুনিক পৃথিবীতে পণ্য এবং বিশেষ করে পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে এমনই একটি উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। সাধারণভাবে বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার, খাদ্য সামগ্রী ও দেশীয় উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি এই তিনটি বিষয়ে স্বনির্ভরতা ব্যতিরেকে জাতীয় স্বনির্ভরতা অর্জিত হতে পারে না।