Internationalism Cover

Religion, Nationalism and Internationalism

সূর্যকান্ত মিশ্র

ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্টকে উপলব্ধি করতে গেলে দুধরণের বৈষম্য ও নিপীড়নকে চিহ্নিত করতে হয়। আমাদের দেশের সমাজজীবনে যেমন শ্রেণীর ভিত্তিতে শোষণ রয়েছে, তেমনই রয়েছে সামাজিক পরিচিতিকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা বঞ্চনা, পীড়ন। এর  পাশাপাশি জাতিভেদ, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা ইত্যাদি বহুমাত্রা বিশিষ্ট পরিচিতি সত্ত্বার নামে বিভেদ সৃষ্টি ও তাকে ব্যবহার করে নির্মিত শ্রেণীগত এবং সামাজিক দুটি প্রধান বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমরা মনে করি ভারতের সমাজে প্রধান বৈষম্য দুটি, শ্রেণী ভিত্তিক ও সামাজিক। এদুয়ের বিরুদ্ধেই নিরন্তর লড়াই চালাতে হবে। সেই লড়াই চলবে শোষণ নিপীড়নের বাস্তবিক পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে, শেষ অবধি।

ভারতে জাতি বলতে যা বোঝায় সে সম্পর্কে অনেক অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা রয়েছে। জাতি পরিচিতির আধুনিক অর্থ প্রসঙ্গে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে বিশদ চর্চা হয়। জাতীয় মুক্তি ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রণকৌশল সম্পর্কে সেই আলোচনায় লেনিনের থিসিস নিয়েও নিস্পত্তির লক্ষ্যেই বিতর্ক চলে। জাতি সম্পর্কে সেই আলোচনাই হল প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তি। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে স্তালিন বলেনঃ ‘একটি জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে গঠিত স্থিতিশীল জনসমাজের ভাষা, বাসস্থানের ভৌগলিক এলাকা (দেশ), অর্থনৈতিক জীবন ও মনস্তাত্বিক গঠনের উপরে নির্ভরশীল এক সাধারণ সংস্কৃতি ইত্যাদির সমষ্টি’। আবার এই বৈশিষ্টগুলির উপরে ভিত্তি করে জাতিগত উন্মাদনা ও বিভাজন সৃষ্টিকারী শক্তিগুলিকে যে শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে সে বিষয়েও তিনি সতর্ক করেছিলেন।  

আরএসএস নিজেদের মতাদর্শগত ধারণা জন্মভূমি, পিতৃভূমি, পুণ্যভূমি ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রচার চালায়। এসমস্ত ধারনাগুলি তারা মুসোলিনি, হিটলারদের থেকেই শিখেছে- এসব এখন প্রমাণিত সত্য। এমনটা যে ঘটতে পারে সেই আলোচনাও স্তালিনের বক্তব্যে উল্লিখিত ছিল, এর মোকাবিলার পথও তিনি দেখিয়ে গেছেন- ‘প্রলেতারিয়েত শ্রেণী বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের প্রতি সমর্থন জানাবে কি না তা তাদের শ্রেণী বিরোধিতা, শ্রেণী চেতনা এবং সাংগঠনিক শক্তির বিকাশের স্তরের উপরে নির্ভর করবে। শ্রেণী সচেতন প্রলেতারিয়েতের নিজস্ব, পরীক্ষিত নিশান রয়েছে। বুর্জোয়াদের নিশানের পিছনে তাদের দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই’।

ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সহ জাতিগত বৈশিষ্টের বিচারে ভারতে প্রকৃত অর্থে অনেকগুলি জাতিসত্বার কার্যকরী উপস্থিতিরই এক সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে, এদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণে একথা সর্বদা মনে রাখতে হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে এঁদের প্রত্যেকের অবদান প্রশ্নাতীত। ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা স্পষ্টতই বিভাজনের রাজনীতি কায়েম করেছিল। স্বাধীনতার সময় ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্যে দিয়ে তাকেই কার্যকর করতে সক্ষম হয় তারা। সে জন্যই আমরা ভারতের স্বাধীনতা’কে আপস ও দেশভাগের স্বাধীনতা বলে চিহ্নিত করেছি। আমাদের বিশ্লেষণ হল স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় বিপ্লবের প্রথম স্তরটি ছিল সংযুক্ত সাধারণ মোর্চার স্তর যাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণী ও মধ্য শ্রেণীর এক বিশাল অংশই সামিল হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার পর এই স্তরের অবসান ঘটেছে এবং আমরা বিপ্লবের দ্বিতীয় অর্থাৎ জনগনতান্ত্রিক স্তরে অবস্থান করছি। বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর সমাধা হলে আমরা তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপবের স্তরে পোঁছাব।

কিন্তু বিপ্লবের বর্তমান স্তরে এসেও পূর্ববর্তী স্তরের কিছু কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। জাতীয় স্তরে সংযুক্ত সাধারণ মোর্চার মধ্যে স্বাধীনতা উত্তর শাসকবৃন্দ (বর্তমান শাসক শ্রেণী) সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সাথে আপস করেছিল যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রাক-পুঁজিবাদী বন্দোবস্ত ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপসরত শক্তিগুলিকে মূলোচ্ছেদের মাধ্যমেই সেই সমস্ত অসমাপ্ত কাজগুলি সম্পন্ন করার দায়িত্ব সমাধা হবে। এর সাথেই আরেকটি প্রশ্নেরও নিস্পত্তি করতে হবে। ভারতের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জাতি ও জাতিসত্তাগুলির সমানাধিকার সুনিশ্চিত করাই হল সেই কর্তব্য। আমাদের সংবিধানের প্রথম বাক্যটি এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে- ‘India that is Bharat shall be a Union of States’- অথচ আমরা দেখছি স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে লাগামহীন আক্রমণ শুরু হয়েছে। জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের আন্দোলনের ঐতিহ্যকে দুর্বল করে দিতেই এমনটা চলছে। রাজ্যের সংবিধান স্বীকৃত অধিকারসমূহ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণার ঘটনা তারই উদাহরণ। রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রীয় হাতিয়ারগুলিকে ব্যবহার করে সংঘ পরিবার হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এই প্রসঙ্গেই সিএএ-এনআরসি’র মতো কয়েকটি দানবীয় আইন প্রণয়নের কৌশলকে আমাদের মনে রাখতে হবে। কোনোরকম বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে অতি দ্রুততার সাথে এসমস্ত আইন সংসদে পেশ করা হয় এবং পাশও করিয়ে নেওয়া হয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-

‘সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্যবিপণীর এক ধারে

                  নিঃশব্দচরণ

আনিল বণিকলক্ষ্মী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে

                  রাজসিংহাসন।

বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি

                  নিল চুপে চুপে —

বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী

                  রাজদণ্ডরূপে।’

অবশ্য এমন অনবদ্য সাহিত্যের ভাষ্যে ঐতিহাসিক উপলব্ধিকে মূলত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যেই বিধৃত করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পরে সি রাজাগোপালাচারি চোল রাজাদের রাজদন্ড ‘সেঙ্গল’টিকে লর্ড মাউন্টব্যাটনের মাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে পাঠিয়ে দিলে তিনি তা মিউজিয়ামে সংরক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রতীক পুনরায় টেনে বের করে এনে দেশের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজকের প্রধানমন্ত্রীর হাতে আসলে যে বণিকের মানদণ্ডটি রয়েছে  তা স্বাধীনতা উত্তর কোনও দেশী-বিদেশী পুঁজির মানদণ্ড না, সরাসরি লুঠেরা পুঁজি- আদানিদের প্রতীক। 

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি শুরু থেকেই ছিল না। জরুরী অবস্থা জারী করার সময় ঐ কথাটি সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে তাকে বাতিল করা হয়নি। যদি একথা মনেও রাখা হয় তবে এই সত্য সম্পর্কেও অবহিত থাকতে হয় ঐ সংবিধানের ছত্রে ছত্রে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সমানাধিকারের উল্লেখ রয়েছে। আজকের ভারতে সেই অধিকারটিই বিলোপ করার চেষ্টা চলছে। সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ছটি মূল ধর্মবিশ্বাস প্রাধান্য বিস্তার করেছে, ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে এর প্রত্যেকটিতে আস্থাশীল মানুষই রয়েছেন। ঐ ছটি ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে চারটিই (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ) নির্মিত হয়েছে আমাদের দেশের মাটিতে। আমাদের সাধারণ ভাষ্য হল- ধর্ম যার যার; রাষ্ট্র, সরকার সবার। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল রাষ্ট্র, সরকার পরিচালনার যাবতীয় উপাদানগুলির থেকে ধর্মের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। কিন্তু সেই ধারণা ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে এমনকি সংবিধান প্রণয়নের পরেও অস্পষ্টতা ছিল। রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই সমস্ত ধর্মকে যথেচ্ছরূপে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই সুযোগকে ব্যবহার করেই সংঘ পরিবার আজ হিন্দুত্বের কর্মসূচি সামনে এনেছে, গোটা দেশকে তারা কেবল একটি ধর্মীয় বস্বাসের নিরিখে সাম্প্রদায়িকতার পীঠস্থানে পরিণত করতে চাইছে। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি অর্থ হল এই যে নাগরিকদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী যার যার ধর্মীয় আচার পালনের অধিকার থাকবে এমনকি কোনও ধর্ম পালন না করার অধিকারও সুরক্ষিত থাকবে। একে সুনিশ্চিত করাই হবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন না করে ধর্মের বিকৃত নির্মাণ হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাকে মদত যুগিয়ে, আজকের ভারতে রাষ্ট্র, বিশেষত সরকার নিজেই সাম্প্রদায়িকতার প্রতিভু হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ইতিহাস বলে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন যোগায়। সেই জন্য সবধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাধারণভাবে লড়াই চালানোর পাশপাশি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বড় বিপদ হিসাব চিহ্নিত করে তার প্রতিরোধে সংগ্রামকে কেন্দ্রীভূত করতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদী শক্তি হল সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তি। ভারতে হিন্দু মৌলবাদ এবং ঐ দুই দেশে ইসলামী মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধেই কমিউনিস্টদের প্রচার, লড়াই-সংগ্রাম চালাতে হয়। এহেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে ভারতের সংবিধানের অভিমুখ স্পষ্ট- তাই আজকের ভারতে সংবিধানও আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।      

সামাজিক বৈষম্যসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু ভারতের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেবলমাত্র শ্রেণী সংগ্রামের উপরে নির্ভরশীল হলেই চলবে না। একটা কথা মনে রাখা দরকার, উগ্র হিন্দুত্ববাদী শ্রেণী ও গণসংগঠনগুলি বিজেপি’র দ্বারা পরিচালিত নয়, তারা সরাসরি সংঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন। সংঘ পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলি সম্পর্কে কোনও বিশদ তথ্য পাওয়া কার্যত অসম্ভব। কিন্তু একথা সর্বজনবিদিত যে এবিভিপি’র ন্যায় ছাত্র সংগঠন কিংবা বিএমএস’র মতো শ্রমিক সংগঠনগুলি এদেরই প্রত্যক্ষ পরিচালনায় এগিয়ে চলে আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ সংগঠনের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আমাদের আজ্যে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে যে ৭২টি আসনে বিজেপি জয়লাভ করেছে তার অর্ধেকেরও বেশি আসন তফশিলি জাতি,উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এই তথ্যকে হালকা মনে করার অর্থ সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা। সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের মধ্যে আরএসএস-সংঘ পরিবার নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে, সেকাজে তাদের সহায় এক বিশেষ কৌশল। একেই মাইক্রো-সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল যে তথ্য সামনে এনেছে তাকে এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতের বিচারে মিলিয়ে দেখতে হবে। এবছর শারদ গণশক্তি পত্রিকায় সত্যজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে উল্লেখ রয়েছে- ‘পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯২টি আসনের ঘোষিত ফলের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৭৭টি আসনে। কিন্তু তার মধ্যে তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত মোট ৮৪টি আসনের মধ্যে ৩৯টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। বাকি ৩৮ আসনে তারা জিতেছিল অসংরক্ষিত আসন থেকে। তাদের জেতা ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩২টি ছিল তফসিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত ও সেই আসনগুলিতে তারা ভোট পেয়েছিল ৪২.৭৯%। পাশাপাশি আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে তারা ৭টি আসনে জিতেছিল ও ভোট পেয়েছিল ৪৪.০৪%। তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে তারা যে ৩৯টি আসনে জিতেছিল তার মধ্যে ৯টি আসনে তারা ৫০% বা তার বেশি ভোট পেয়েছিল। উক্ত ২৯২টি আসনের বিজেপি মোট ভোট পেয়েছিল ৩৭.১৭ ভোট। এই ফল থেকে বোঝা যায়, তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের একটি বড় অংশকে তারা হিন্দুত্ববাদী পরিসরে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই সাফল্য যে শুধু বিজেপি’র সক্রিয়তার সূত্রেই অর্জিত হয়েছে তা নয়। সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সূত্রেই তা অর্জিত হয়েছে। বিজেপি’র ভোট শুধু বিজেপি’র ভোট নয়। তা সংঘ পরিবারের ভোট। তাই ভোটের আগের দিনগুলি বা মাসগুলিতে শুধু বিজেপি’র সক্রিয়তা দিয়ে বিজেপি’র ভোটের পরিমাণ কেন বেশি হলো তা বোঝা যায় না। তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলিতে বিজেপি এত ভোট পাবার কারণ নিশ্চয় নিম্নবর্গকে হিন্দুত্ববাদের পরিসরে আত্তীকৃত করে নেবার ক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য। এই সাফল্য তারা ভবিষ্যতে ধরে রাখতে পারবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু সঙ্ঘ কিভাবে নিম্নবর্গকে তাদের বিভিন্ন ভাঁজে আত্তীকৃত করে ফেলে তা অবশ্যই গভীরভাবে বোঝা দরকার।’

গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনার পরেই আমরা বলেছিলাম পরিচিতি সত্তার রাজনীতির উপর ভিত্তি করে আরএসএস ও সংঘ পরিবার কিভাবে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মাইক্রো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৌশল প্রয়োগ করছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক গোষ্ঠীগুলির উপরে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করছে তারা, এতে একদিকে তাদের একে অন্যের থেকে আলাদা করে রাখাও যাচ্ছে আবার আরেকদিকে সবাইকেই নিজেদের স্বার্থে সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সংঘ পরিবার আদিবাসীদের মধ্যে সংগঠন পরিচালনার সময় তাদের বনবাসী বলে অভিহিত করে। এমনটা করার কারণ কি? কারণ সংঘ পরিবার মনে করে একমাত্র আর্যরাই ভারতের আদিবাসী, প্রাচীন বাসিন্দা। সেই রাজনৈতিক ভাষ্যকে মান্যতা দিতেই এমন ঘুরপথের কৌশল নেওয়া হয়েছে। একই কায়দায় তারা সাঁওতাল, মুন্ডা এধরণের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক ভাষ্যের প্রয়োগ করছে। আদিবাসীদের মধ্যে যারা খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী তাদের ঘর ওয়াপসি বা প্রায়শ্চিত্ত করানো চলছে। সামগ্রিকভাবে তারা অনগ্রসর গোষ্ঠীর সমস্ত অংশকেই একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিচ্ছে। মণিপুরে যা ঘটছে তা হল সেই রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কুকি ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একে অন্যের প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রচার চালানো হয়েছে। মোটের উপরে সবাইকে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনতে চায় এরা। তবে বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের কোনও বক্তব্য নেই- চারটি বর্ণের নির্মাণে কারোর অবস্থান, সামাজিক মর্যাদার ব্যবধানকে এরা ঈশ্বর নির্দেশিত পথ বলেই প্রচার করে, একে স্বাভাবিক নিয়ম হিসাবেই তুলে ধরে। দলিত, আদিবাসী ও পিছিয়ে থাকা অনগ্রসর অংশের সমস্ত মানুষকেই হিন্দুত্বের একমাত্রিক পরিচিতির হাতিয়ারে পরিণত করতে চায়। বিভাজনের রাজনীতিকে ভিত্তি করে নির্মিত এহেন কর্মসূচির ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। আদি শংকরাচার্য অন্যান্য মতাবলম্বীদের বিতর্কে পরাজিত করে অদ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠা করলে এর সূচনা ঘটে। ভারতের ইতিহাসে পাল বংশীয়রাই ছিল শেষ বৌদ্ধ রাজবংশ। তাদের রাজত্ব শেষ হলে সেন রাজাদের যুগ শুরু হয়, এরা ছিলেন হিন্দু বা মূলত ব্রাহ্মন্যবাদী। ব্রাহ্মনদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে পাল রাজত্বের সময় দলিতরা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। পরে সেন বংশের রাজত্ব শুরু হলে তাদের উপরে পুনরায় নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়, সেই কারণেই অনেকে ইসলাম ধর্মে আশ্রয় খুঁজে নিতে বাধ্য হন। আবার কেরালায় ইসলাম ধর্মের প্রসার সুপ্রাচীন,তাই সেখানে অভিজাতদের মধ্যে মুসলমানদের অংশ হিন্দু বা খ্রীষ্টানদের তুলনায় বেশী।বাংলায় শ্রীচৈতন্য দেব একই কারণে বিপুল সংখ্যক অনুগামী পেয়েছিলেন। আজকের ভারতে নিপীড়নের ব্যবস্থাকে পাকা করতে কেবল সরাসরি সার্বিক বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর না করে সংঘ পরিবার মুসলমানদের মধ্যে সবচাইতে অনগ্রসর কিন্তু বিপুল সংখ্যগরিষ্ঠ অংশের(পসামন্দা)  সমর্থন পেতে মাইক্রো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৌশল নিয়েছে।

দলিত, আদিবাসী ও অনগ্রসর বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে নিজেদের অতীত অবস্থানে কিছু বদল করলেও মহিলাদের বিষয়ে সংঘ পরিবার এখনও আগেকার আদর্শগত অবস্থানই বজায় রেখেছে। এ বিষয়ে তারা মনুস্মৃতিকেই প্রামান্য মনে করে। আজও আরএসএস-এ মহিলাদের সদস্য হতে দেওয়া হয় না। ১৯৬৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গড়ে তুলে তারা সেকাজে কিছুটা এগিয়েছিল, তখনও গোলওয়ালকর বেঁচে রয়েছেন। তারা দুর্গাবাহিনী নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। আরএসএস’র মুখে অবশ্য দুর্গার ব্যখ্যা হাস্যকর, ওরা একসময় যাকে দুর্গা বলে চিহ্নিত করেছিলেন সেই মহিলাই আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে রয়েছেন। আজ মহিলা বিল পাশ করানোর নামে তারা যতই প্রচার করুক না কেন, একথা মনে রাখতে হবে ঐ বিল এখনই কার্যকর হবে না। ভেবেচিন্তেই সেরকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতির বর্তমান সংকটের পরিস্থিতিতে লিঙ্গ বৈষম্য (Gender Disparity) ক্রমশই বাড়ছে, এ প্রসঙ্গে সংঘ পরিবারের কোনও বক্তব্যও নেই- কারণ আদর্শগতভাবেই তারা মহিলাদের সমানাধিকারের বিরোধী। আজ নির্বাচনী কৌশল হিসাবে তারা যে পন্থা অবলম্বন করছে সেই মাইক্রো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-য়ের শিকড় রয়েছে পোস্টমর্ডানিজমের মধ্যে। পোস্ট মডার্ন চিন্তাধারা কার্যত বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজির (Global Finance Capital) দর্শন। এতে আলোকোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে (এনলাইটেনমেন্ট) সরাসরি অস্বীকার করে বলা হয় আজকের পৃথিবীতে সার্বিক সামাজিক সত্য বলে কিছুই নেই, একক ব্যক্তি অস্তিত্বে যতটুকু যা ধরা পড়ে, অনুভূত হয় সেটাই সত্য। এহেন বিভাজনের দর্শন আসলে বিশ্বায়িত পুঁজির বিরুদ্ধে জনমানসের ক্ষোভকে একজোট হতে বাধা দেয়, তাদের বিবিধ সামাজিক পরিচিতির ধাঁধায় পথভ্রষ্ট করে তোলে। পরিচিতি সত্তার আন্দোলন আসলে সেই দর্শনকেই আঁকড়ে ধরে গড়ে উঠেছে। শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য বিনষ্ট করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাতে পরিচালিত বিজেপি সরকার সর্বদা লুঠেরা লগ্নী পুঁজির স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত- তাই দেশের গরীব অংশের মানুষকে যেন তেন প্রকারেণ একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাই তাদের রাজনীতি। ধর্ম, জাতি, ভাষা এসবই সেই রাজনীতির একেকটি কৌশল। 

আমরা দাবী জানিয়েছি দেশে জনগণনা বা আদমশুমারির কাজ এখনই শুরু করতে হবে। এর সাথেই জাতিভিত্তিক জনগণনার কাজকেও সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের এহেন দাবীর ভিত্তি কি? বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনার সময় আমরাই সাচার কমিশনের মাধ্যমে রাজ্যে সংখ্যালঘুদের প্রকৃত অবস্থার কথা সাচার কমিশনের রিপোর্টে যা পাওয়া যায় সেগুলিকে সমাধান করতে আমরা জাস্টিস রঙ্গনাথ মিশ্রের থেকে পরামর্শ নিয়েই বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করেছিলাম। সামাজিক জীবনে অনগ্রসরদের সামনে তুলে আনতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, অথচ একাজে ধর্ম ভিত্তিক সংরক্ষণের কোনও প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। সামাজিক জীবনযাপনে রীতিমত শ্রমসাধ্য বিশেষ কিছু কাজে মূলত সংখ্যালঘুরাই নিযুক্ত থাকায় ওবিসি’দের জন্য সংরক্ষণে তারাও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তৃণমূল সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে সেই ভাবনা কার্যত বাতিল হয়ে গেছে।

আমাদের দেশে জি-২০’র বৈঠক হল। দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে গিয়ে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বলে এলেন। ঐ শব্দবন্ধে যে সম্পর্কের কথা বলা হয় তা আসলে রাজায় রাজায় সখ্যতার নিদর্শন, কার্যত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উচ্চবর্ণ ও উচ্চ শ্রেণীর সামাজিক রীতিনীতি। একে সার্বিক সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হলেও আসলে ঐ ভাষণের উদ্দেশ্যে উচ্চবর্ণ ও উচ্চ শ্রেণীর সংস্কৃতিকে সবার উপরে চাপিয়ে দেওয়া। সঠিক অর্থে বিশ্বজনীন মানবিক অধিকারের পক্ষে যদি কেউ থাকে তবে সেই ঐতিহ্য কমিউনিস্টদেরই রয়েছে। আমরাই প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিকতাবাদী। মনিপাল হোক বা মণিপুর, ব্রাজিল হোক বা প্যালেস্তাইন দুনিয়ার যেখানেই মানুষের উপরে অত্যাচার, নিপীড়ন নামিয়ে না হয় আমরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই, সক্রিয় প্রতিবাদ জানাই। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে নিপীড়িত মানুষের হাহাকার যাদের বুকে বাজে তারাই কমিউনিস্ট।

আজকের ভারতে যা ঘটছে সে প্রসঙ্গে শেষ কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক এরিক হবসবমের লেখা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা হল। অতীতের ফেলে আসা ঐতিহ্য, ইতিহাসের নামে পুরান ইত্যাদিকে ব্যাপক প্রচার চালানো ও নানা রকমের চিহ্নকে কেন আরএসএস-সংঘ পরিবার নিজেদের প্রচারে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে তা উপলব্ধি করতে এহেন রাজনৈতিক কর্মসূচির শিকড়কে চিনে নিতে হয়। আরএসএস-বিজেপি এদেশে যা করছে তা শুধু আমাদের এদশের বিষয় বলে ভাবলে ভুল হবে। সঠিক অর্থে প্রগতিশীল মেধাবৃত্তিকার ছিলেন বলেই হবসবম ইতিহাসের সারাংশ হিসাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মিথ, ধর্মীয় আস্থা ইত্যাদির চিহ্ন ও তার প্রভাবে উদ্ভূত উন্মাদনার প্রসঙ্গে অসাধারণ ব্যখ্যা দিতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘National myths do not arise spontaneously from people’s actual experiences. They are something which people acquire from someone else, from books, from historians, from films, and now from people who make television. They are not generally part of the historical memory or a living tradition, with the exception of some special cases in which what was eventually to become a national myth was a product of religion. There is the case of the Jews, in whom the idea of expulsion from the land of Israel and the certain return to it is part of the religious practice and literature. Within certain limitations, this is also true of the Serbs, because the loss of the Serbian state in the middle Ages became part of Orthodox religious services and nearly all the Serbian princes became symbols of the Orthodox faith. A special case. But here again, it is not a question of the people constantly remembering: they remember because someone is constantly reminding them’. পরিচিতি সত্বাভিত্তিক জাতপাত নিয়ে বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, লড়াই ও সংগ্রামে এই কথাগুলি স্মরণে রেখেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।

Spread the word

Leave a Reply